পুরো দেশটা যখন দিওয়ালি পালন করছে সেদিন বাঙালীর আজ কালীপূজা। পুরো দেশ যখন পূজার বেদীতে ফর্সা টুকটুকে লক্ষীমেয়ে সাজাচ্ছে, তখন বাংলার প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে সাজছেন কাজলের মতন কালো মুক্তকেশী নগ্ন কালী। তাঁর গলায় মুণ্ডমালার হার, কোমরে নরহস্তের কটিবাস। তিনি আবার শিবের বুকে দাঁড়িয়ে। তাঁর পূজায় লাগে মাংস ও মদ।
মদ শুধু এই উগ্রবাদী কালো মেয়েটাই খায়না। খান দুর্গাও। শ্রীশ্রীচণ্ডী বলছে সে কথা। যুদ্ধে মহিষাসুর অহঙ্কারে মত্ত হয়ে প্রবল গর্জন করলে দুর্গা বলেছিলেন, "গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ় মধু যাবৎ পিবাম্যহম/ময়া ত্বয়ি হতেঽত্রৈব গর্জিষ্যন্ত্যাশু দেবতাঃ।" অর্থাৎ, "রে মূঢ়, যতক্ষণ আমি মধুপান করি, ততক্ষণ তুই গর্জন করে নে। আমি তোকে বধ করলেই দেবতারা এখানে শীঘ্রই গর্জন করবেন!" মধু কিন্তু এখানে মোটেও নিরীহ পানীয় নয়। সংস্কৃতে মদের একটি প্রতিশব্দ মধু।
আবার, বেশ কিছু পুরনো পটচিত্রে দেখা যায়, দেবী সিদ্ধলক্ষ্মীও সুরাপান করছে। চণ্ড-মুণ্ড বধের সময় দেবী কৌষিকীর কপাল থেকে উৎপন্না হয়েছিলেন যে কালিকা, তিনি আবার পান করেন কেবল রক্তই!
কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের বৃহৎ তন্ত্রসার অনুসারে শ্মশানকালী শ্মশানে বাস করেন। তাঁর চোখদুটি রক্তপিঙ্গল। দেহ শুকনো, বাঁ-হাতে মদ ও মাংসে ভরা পানপাত্র, ডান হাতে সদ্য কাটা মানুষের মাথা। দেবী হাসিমুখে নরমাংস খাচ্ছেন। তাঁর গায়ে নানারকম অলংকার থাকলেও তিনি উলঙ্গ এবং মদ্যপান করে উন্মত্ত হয়ে উঠেছেন।
রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকরের মতে, কালীর আরেক রূপ চামুণ্ডা, বিন্ধ্য অঞ্চলের উপজাতিদের দেবী। চামুণ্ডার উদ্দেশে পশু ও নরবলি ও মদ উৎসর্গের প্রথা ছিল। আবার শোনা যায় যে মাংস ও মদ-সহকারে যে তন্ত্রসিদ্ধ পূজাপদ্ধতি বাংলায় তা এনেছিলেন ঋষি বশিষ্ঠ। জনশ্রুতি বলে, পঞ্চ ম কার অর্থাৎ মদ্য-মাংস-মৎস্য-মুদ্রা-মৈথুন সহকারে তন্ত্রমতে দেবী আরাধনা বশিষ্ঠ নিয়ে আসেন বঙ্গে। পণ্ডিতদের বক্তব্য, বৈষ্ণবদের পঞ্চগব্য অর্থাৎ দধি-দুগ্ধ-ঘৃত-গোমূত্র-গোময়ের ঠিক বিপরীতে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই মদ্য-মাংস-মৎস্য-মুদ্রা-মৈথুন। অথচ সবই কিন্তু একটা হিন্দুধর্মের গন্ডির ভিতরেই। তাই লক্ষ্মী আর কালী - দুই মেরুর দুই ভিন্নস্বাদের মেয়েকে আমরা হিন্দুরা পূজা করি।
বাঙালীদের অন্য কোনো ভাষাভাষীদের প্রতি বিদ্বেষ নেই। তবুও তারা একটু অন্যরকম। না, শুধুমাত্র নোবেল প্রাইজে এগিয়ে নেই তারা। তারা হয়তো ধর্মীয় ক্ষেত্রেও অন্য রকম। তাই তারা কালো মেয়ে পুজো করে, তারা মাংস খায়, তারা পুরুষের বুকে স্ত্রীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পারে। আবার তারা লক্ষ্মীর পা আঁকে বাড়ির আনাচে কানাচে, খিচুরী ভোগ রান্না করে। আজকের দিনে হয়তো অনেক সামাজিক নিয়ম কানুন লেনদেনের মধ্যে বাঙালীও বিয়ের আগের দিন মেহেন্দি সংগীত করছে, আবার হয়তো কেউ কেউ চাঁদ উঠলে চালনী দিয়ে বরকে দেখে জলও খাচ্ছে। কিন্তু কোথাও যেন বাঙালী ব্যতিক্রম।
তাই যারা হিন্দুত্ববাদী বলতে কেবল নিরামিষাশী কপালে তিলক কাটা পুরুষ, ঘোমটানশীন পতিঅনুসরণকারী স্ত্রী, আর মদ্যপান বর্জন বোঝেন তারা একটু ভেবে দেখবেন, বাঙালীর মতন একাধিকত্ব ও বহুত্ববাদের হিন্দুত্বের সামনে তাদের এই ক্ষুদ্র সংকীর্ণ হিন্দুবাদ দাঁড়াতে পারে কিনা।
ছবিতে: সপ্তদশ শতকের বাশোলি চিত্রে সুরাকুম্ভ হাতে কালী এবং সুরাপানরতা সিদ্ধলক্ষ্মী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন