রবিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৯

ভিক্টর হারা ~ আর্কাদি গাইদার

বিশ্ববিখ্যাত সংগীতশিল্পী ভিক্টর হারা কে প্রথম চিনেছিলাম আইরিশ শিল্পী ক্রিস্টি মুরের গানে। ভিক্টর ততদিনে মরে ভূত হয়ে গেছেন। চিলেতে মিলিটারি ক্যুয়ের পর কমিউনিষ্ট হিসেবে ওনাকে প্রথমে গ্রেপ্তার করে স্টেডিয়ামে তৈরি হওয়া ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সৈন্যরা পিটিয়ে আগে আধমরা করে ফেলে। যেই আঙুলগুলো দিয়ে গীটার বাজাতেন, সেই আঙুলগুলো এবার এক এক করে ভেঙে ফেলা হয়। তারপর স্বাদবদল করতে, ইলেক্ট্রিক তার দিয়ে কিছুক্ষন শক দেওয়া হয়। এরপর একঘেয়েমি এসে যাওয়াতে, সৈন্যরা ওনাকে গুলি করে স্টেডিয়ামের সামনে ওনার দেহ প্রদর্শনী হিসেবে ঝুলিয়ে রাখে। 

এরও পরে, ভিক্টর হারার ভূত ক্যুতে নিহত চিলের প্রেসিডেন্ট আলেন্দের ভূতের সাথে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছিলো, নতুন সামরিক সরকারের শত্রু বামপন্থী ও কমিউনিষ্টদের এরকম আরও হাজার ভুতের সাথে। উড়তে উড়তে তারা দেখছিলো, সুদুর আমেরিকা থেকে পরিচালিত এই সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় আসা পিনোসে তখন চিলে কে বানাচ্ছে 'নয়া উদারনীতির ল্যাবরেটরি', অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান আর চিকাগো স্কুল প্রেস্ক্রিপশন দিচ্ছে 'অর্থনৈতিক শক থেরাপি'র, সেই শক খেয়ে আধমরা বোবা বাধ্য জনতা অসাড় হয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে দশকের পর দশক। 

কিন্তু মানুষ মরলেও ভূতের তো মৃত্যু নেই। ভূতেরা মহা পাজি হয়, সুযোগ পেলেই বারবার ফিরে ফিরে আসে। চিলেতে আজ হঠাত করে ঝটিকা আক্রমণে ভুতগুলো সব একসাথে ফিরে এসেছে। এসে ভর করেছে জ্যান্ত মানুষগুলোর ঘাঁড়ে। তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে তাদের। ঘরে ঘরে ঢুকে ভূতগুলো মন্ত্র পড়বার মতন করে বলে আসছে - নয়া উদারবাদের এক্সপেরিনেন্ট ডাহা ফেল। সোভিয়েত ইউনিয়ন সিদ্ধান্ত নিয়ে কমইন্টার্ন ভেঙে দেওয়ার ৭০ বছর পরে চিলের প্রেসিডেন্ট পিনেরা আন্তর্জাতিক মহলে সাহায্য প্রার্থনা করছেন 'This is not a harmless protest. This is a coup by the International Communist Movement'. চিলেতে এখন রাস্তায় রাস্তায় ভিক্টর হারা আর আলেন্দের ভূত। স্টেডিয়ামে জড়ো হয়ে কয়েক হাজার ভিক্টর সমস্বরে মুক্তির গান গাইছেন। 

আর চুপিচুপি, খুব সন্তর্পণে, কাউকে জানতে না দিয়ে, পৃথিবীর সম্পূর্ন উলটোদিকে, আস্তে আস্তে নড়েচড়ে উঠছে ডিটেনশন ক্যাম্পের আকাশে চালচুলোহীন ভাবে ভেসে বেড়ানো দুলাল পাল আর ফালু দাসের ভূত। তারা শুনতে পাচ্ছে, অচেনা ভাষায়, কিন্তু চেনা সুরে, গুনগুন করে কারা যেন গান গাইছে।  হয়তো বা ঋণে জর্জরিত হয়ে গাছে ঝুলে পড়া কোন চাষী। বা উঠে যাওয়া ব্যাংকের কাছে নিজের সর্বস্ব হারিয়ে হার্ট এটাকে মরে যাওয়া কোন অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধা। হয়তো বা বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার জমিতে তৈরি বহুতলের ছাদ থেকে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করা কোন শ্রমিক। 

দুলাল দাস শুনছে, কারা যেন ডাকছে - ভিক্টর হারা?
সবাই একসাথে উত্তর দিচ্ছে - উপস্থিত!

দুলাল দাস?
আবার একসাথে -উপস্থিত!

একে একে ভুতেদের নাম ধরে ডাকা হচ্ছে।

চিলের আকাশে তখন সমস্বরে গর্জন শোনা যাচ্ছে - উপস্থিত! উপস্থিত! উপস্থিত!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন