বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৯

বিদ্রোহ আজ ~ অর্ক রাজপন্ডিত

হাতে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। আমার থেকে ঠিক চল্লিশ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে সেবাস্তিয়ান পিনেরার সৈন্য। আমি তখন স্লোগান দিচ্ছি দু হাত মুঠো করে। বন্দুক তাক করার আগে আমার দিকে সৈন্য একবার দেখলো তার পর ফায়ার!

আমি গুলিবিদ্ধ। আমার মত হাতে মাথায় কাঁধে পায়ে গুলি নিয়ে আহতরা উপচে পড়ছে স্যান্টিয়াগোর পোস্টা সেন্ট্রাল হাসপাতালে। কারোর দরকার অপারেশন, ডাক্তারবাবুরা বলছেন হাতজোড় করে অপারেশনরই খরচই কয়েক হাজার পেসো। হাসপাতাল আমাদের চিকিৎসা দিতেও অক্ষম।

তবু আমরা মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে ফিরে আসছি স্যান্টিয়াগোর রাস্তায়। তবু আমরা আবার পোস্টার সাঁটছি স্যান্টিয়াগোর মেট্রো স্টেশনের দেওয়ালে দেওয়ালে। 'ইটস নট অ্যাবাউট থার্টি পেসো'স, ইটস অ্যাবাউট থার্টি ইয়ার্স'!

আমরা যারা চিলির ছেলে মেয়ে, আমরা শুধু মেট্রো রেলের ভাড়া নিয়ে আন্দোলনে নামিনি। আমরা কুড়ি লাখ রাস্তার দখল নিইনি শুধু মেট্রোর ভাড়া কমানোর জন্য। পিনোচেত জমানা শেষে কেটে গেছে চিলিতে তিনটি দশক। আমাদের মজুরি ছাঁটাই হয়েছে, আমাদের বাপ চাচাদের পেনশন উঠে গেছে, আমাদের স্কুলে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ বেড়েছে অহরহ। আমরা রাস্তায় আমরা এর শেষ দেখেই ছাড়বো।

চিলির আগুন জ্বলে উঠেছে হাইতিতে। পোর্ট আউ প্রিন্সের দখল নিয়েছে হাইতির জনগণ। বিমানবন্দরের রানওয়ে, টারম্যাক জনতার দখলে।

'এই এয়ারপোর্টর রানওয়েতে একটাই উড়োজাহাজ নামবে, যে জোভেনেলকে নিয়ে চলে যাবে আমাদের দেশ থেকে, আমরা আর ওকে রাষ্ট্রপতি দেখতে চাই না', হাইতির রাষ্ট্রপতি জোভেনেলের সংস্কারের বিরুদ্ধে এভাবেই ঝড়ে পড়েছে অসন্তোষের তুফান। হাইতিতে এখন ন্যুনতম মজুরি মাত্র ২.৫০ ডলার! হাইতিতে এখন মুরগির মাংস থেকে ডিম খায় না হাইতির যৌবন।

চিলি, হাইতি হয়ে বিদ্রোহ ইকুয়েডরে। রাষ্ট্রপতি লেনিন মনেরো চেয়েছিলেন আইএমএফ'র দাওয়াই মেনে আর্থিক সংস্কার। প্রবল ব্যায়সঙ্কোচ। কুইটোর রাস্তা দখল নিয়ে বসে থেকেছে ইকুয়েডরের আদি জনগোষ্ঠী। পিছিয়ে আসতে হয়েছে লেনিন মনেরোকে। আইএমএফ'র ডিক্রি ৮৮৩ জ্বালিয়ে দিয়েছে জনতা।

উত্তর গোলার্ধ থেকে দক্ষিণ গোলার্ধ। বিদ্রোহ চারিদিকে বিদ্রোহ আজ।

লাতিন আমেরিকা থেকে উত্তর ইউরোপ। উত্তর ইউরোপ থেকে উত্তাল মধ্যপ্রাচ্য।

১৬৬০ লেবানিজ পাউন্ড খরচ করলে তবে ১ডলার মেলে। এমনই তীব্র সঙ্কট লেবাননে। দেশের ডলার সঞ্চয় খরচ হয় শুধু বিদেশ থেকে নেওয়া ধার শোধ করতে। অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে এক সপ্তাহের বেশি বন্ধ লেবাননের সব ব্যাঙ্ক। রাস্তায় নেমে এসেছে লেবাননের যৌবন। লেবাননের বিদেশমন্ত্রী বলেই ফেলেছেন ভাঁড়ে মা ভবানী, এক বছরের মধ্যে লেবাননের কোন ডলার সঞ্চয়ই থাকবে না। বেইরুটের রাস্তার দখল গিয়েছে জনতার হাতে। লেবানন জুড়ে দ্রোহ কাল।

লেবাননের আগুন জ্বলেছে ইরাকে। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে একের পর রাজনীতিক নেতারা শুধু ঝুটা প্রতিশ্রুতিই দিয়ে গেছে। ইয়াঙ্কি যুদ্ধবাজরা শেষ করেছে বাগদাদ। একই পথে হেঁটেছে ইরাকি রাজনীতিকরা। বাগদাদের যৌবনের চাকরি নেই। বাগদাদের রাস্তার পাশাপাশি অচল হয়েছে মেসান, ভিকোয়ার, মুথান্নার মত শহরতলি।

'আমরা কিছুই পাইনি, আমাদের কেউ কিছুই দেয়নি শুধু মৃত্যু আর বুলেট জখম ছাড়া', বাগদাদের রাস্তায় বিদ্রোহে গুলি খেয়ে মরেছে ২১জন, তবু রাস্তা ছাড়েনি বাগদাদের যৌবন।

ইরাকের আগুণ জ্বলে উঠেছে মিশরে। রাষ্ট্রপতি আব্দেল ফাতা আল সিসি'র জমানায় মিশরে দারিদ্র্যসীমার নিচে এখন ১০০জনের মধ্যে ৩৪জন। সরকার খরচ করে শুধু প্রাসাদে আর রাজকীয় হোটেলে। মুখে মুখোশ নিয়ে কায়রোর রাস্তায় জনতা।

স্বাধীন কাতালান রাষ্ট্র চাই, বার্সোলোনা এয়ারপোর্ট অবরুদ্ধ হয়েছে। বিমানবন্দর ঘিরে থেকেছে জনতা, মুক্তি দিতে হবে স্বাধীন কাতালান আন্দোলনের নেতাদের। কাতালানের পাশে হংকং। টানা দুমাসের বেশি সময় হংকং'র রাস্তায় আগুণ। মেইনল্যান্ড চায়নায় প্রত্যার্পণ নীতি থেকে সরে আসার পরেও অশান্ত হংকং।

ক্ষোভের আগুন লন্ডনে। ঝাঁ চকচকে সেতু আর স্কোয়ার দখল করেছেন পরিবেশ আন্দোলনকারিরা। 'এক্সটিন্কশন রেবেলিয়ন'। ২০২৫ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমণ নামিয়ে আনতে হবে শূন্যতে। বরিস জনসন ব্রেক্সিত বিতর্ককে ছাপিয়েছে জল হাওয়া আর রোদ্দুর বাঁচাতে চেয়ে রাস্তায় নামা আন্দোলনকারিরা।

প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। প্রশ্ন ওঠা সঙ্গত।

দুনিয়া জোড়ে বিক্ষোভ অসন্তোষের শ্রেণিগত অবস্থান কি এক? উত্তর না এবং না। স্বাধীন কাতালান চেয়ে যাঁরা বার্সেলোনা এয়ারপোর্ট দখল করছেন তাঁদের শ্রেণিগত অবস্থানের সঙ্গে ফারাক রয়েছে ইকুয়েডরের আদি জনগোষ্ঠীর।

স্যান্টিয়াগো, বেইরুট, কুইটো, লেবানন আর লন্ডনের মধ্যে মিল এক জায়গাতেই।

যারা রাস্তায়, যারা স্লোগানে তারা সবাই সঙ্কটের ছেলেমেয়ে। পুঁজিবাদের জঠরেই তাদের জন্ম। ভিন্ন কারনে ভিন্ন দেশে রাস্তায় তারা সবাই নামলেও তাদের মূল লড়াই উদারনীতির বুলডোজারের বিরুদ্ধে।

লাতিন আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্য উত্তর ইউরোপের দামাল ছেলেমেয়েরা দেখেছে ব্যায়সংকোচের নামে মজুরি ছাঁটাই। দেখেছে পেনশনে কোপ। দেখেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের চড়া ফি'জ, দেখেছে চাকরির দরজায় তালা।

স্যান্টিয়াগো আর লেবানন, বার্সেলোনা আর লন্ডন তাই একই সময়ে টিয়ার গ্যাসের শেল পাল্টা ছুঁড়ে দেয়। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়েও ফিরে আসে প্রতিরোধে। বন্ধুর মৃতদেহ আটকে রেখে শিরায় শিরায় স্লোগান তোলে।

নয়াদিল্লির রাস্তায় নেমে আসুক লেবানন। চিলি। ইকুয়েডর। হাইতির প্রবল পরাক্রম। লাখে লাখ যৌবন অবরুদ্ধ করে রাখুক পার্লামেন্ট।

যত দিন না তোমরা উন্নয়নের নামে আদিবাসীদের উপর দলিতদের উপর টার্গেট প্র্যাকটিস বন্ধ না করছো, আমরা রাস্তা ছাড়বো না।

যত দিন না তোমরা কাশ্মীরে নিরন্তর অবরোধ না তুলছো আমরা রাস্তা ছাড়বো না।

যত দিন না তোমরা আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা থেকে হাত না গোটাচ্ছ আমরা রাস্তা ছাড়বো না।

যত দিন না তোমরা গোমাতা আর ভারতমাতার নামে আমার মা কাকিমা চাচি খাল্লামার তেল নুন চিনি ডাল ভিটামিন ক্যালসিয়াম কেড়ে নেওয়া না বন্ধ করছো আমরা রাস্তা ছাড়বো না।

ভিক্টর হারার সঙ্গে লেবানন কুইটো স্যান্টিয়াগোর সঙ্গে নয়াদিল্লির রাস্তায় গান গেয়ে উঠবেন মাথা ঝাঁকিয়ে বব মার্লে।

'ডু ইউ হিয়ার মি, আই অ্যাম এ রেবেল, রেবেল ইন দ্য মর্নিং রেবেল অ্যাট মিড ডে টাইম..'।

যাঁদের কান আছে তারা শুনতে পাচ্ছেন বিদ্রোহের গান, বিরুদ্ধতার কবিতা। ব্যবস্থা পাল্টানোর স্লোগান।

সকালে। মধ্য দুপুরের গনগনে আঁচে। রাতের জ্যোৎস্নামাখা চাঁদের আলোয়। বিদ্রোহ আর বিদ্রোহ।

আর বিদ্রোহ মানেই ন্যায়সঙ্গত। টু রেবেল ইজ জাস্টিফায়েড।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন