শনিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৯

শরৎ ঋতু ~ অর্ক রাজপন্ডিত

পঞ্চমীর রাত থেকেই হঠাৎ সব শুনশান। রাতে ভালো বোঝা যায় না। গাড়ি কমে গেছে রাস্তায়। বিলকুল ফাঁকা সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার, তেলেঙ্গাবাগান, মুদিয়ালি। 

হোয়াটসঅ্যাপ কাজ করছে না। ফেসবুক খুলছে না। আপনি আধো ঘুমে উঠে বসলেন। ফোন করতে থাকলেন বন্ধুদের, প্রিয়জনদের। ফোনের কানেকশন বন্ধ। 

আপনি টিভি খুললেন। এবিপি আনন্দ বন্ধ। চব্বিশ ঘন্টা বন্ধ। রিপাবলিক টিভি বন্ধ। কোন চ্যানেলই আপনি দেখতে পারছেন না। 

হঠাৎ উৎসবের আলো ঝলমলে রাতে হল কি শহরটার? আস্ত জ্যান্ত শহর কি হঠাৎ মরে গেল? 
সকাল হল। আপনার রেডিওতে আর বেজে উঠলো না প্রভাতী অনুষ্ঠান। ভেসে এলো না কোন আগমনী গানের সুর। আপনার বাড়িতে পৌঁছয়নি কোন খবরের কাগজ। 

আপনি ক্রমশ অবাক হচ্ছেন এবং ভয় পেতে শুরু করেছেন। আপনি দরজা খুলে বাইরে এলেন, আপনার পাড়ার পুজো প্যান্ডেলের সামনে দাঁড়িয়ে মিলিটারি ট্যাঙ্ক। আপনি বেজায় ভয় পেতে শুরু করলেন, আপনার দিকে ধেয়ে এলো জলপাই পোষাকের হিংস্র শ্বাপদের দল। আপনি এক ছুট্টে সেঁধিয়ে গেলেন বাড়িতে। 

আপনার বাড়ির সামনের মুদির দোকান বন্ধ। সিঙ্গারা জিলিপি বন্ধ। চায়ের দোকান বন্ধ। পুজো প্যান্ডেল থেকে ভেসে আসছেন না অখিলবন্ধু ঘোষ বা তালাত মাহমুদ।  

আপনার পাড়ায় চক্কর কাটছে সাঁজোয়া গাড়ি, আর আপনি শুনছেন, শুনেই চলেছেন, 'ইউ আর আন্ডার সিজ। ইয়োর স্টেট ইজ আন্ডার সিজ'। 

আপনি পাড়ার মোড়ের ব্যানার থেকে টুকে নেওয়া 'দিদিকে বলো'র নম্বর দেখে ফোন ঘোরাতে চাইলেন, কাজ করে না ফোন। দিদি নেই, দিদি পালিয়েছেন দিল্লি। আপনি ছুটবার চেষ্টা করলেন আলিমুদ্দিনে। সব্বাই গ্রেপ্তার। সূর্য মিশ্র, বিমান বসু, মহম্মদ সেলিম সব্বাই। 

আপনি আলিমুদ্দিন থেকে পা বাড়ালেন বিধান ভবনের দিকে। সোমেন মিত্র থেকে অধীর চৌধুরী সব্বাই গ্রেপ্তার। আপনার পাড়ার কাউন্সিলার পাড়া ছাড়া। আপনার পৌরসভার দোর্দন্ডপ্রতাপ চেয়ারম্যানকে আপনি খুঁজে পাচ্ছেন না। 

আপনার ছোট শিশুকন্যা তখন বায়না জুড়েছে, আজ রাতে যেতেই হবে 'সাউথ', চষে ফেলতেই হবে বাবুবাগান, যোধপুর পার্ক। আপনি বোঝাতে পারছেন না ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদা ছোট্ট শিশুকন্যাও এখন 'আন্ডার সিজ'। 

চমকে উঠবেন না। আপনার স্নায়ুকে শিথিল করুন। আপনার স্নায়ুকে সহনশীল হতে বলুন। আপনি বাড়িতে আর আপনার স্ত্রীর বাপের বাড়ি বসিরহাট হওয়ার কারনে জলপাই পোষাকের শ্বাপদেরা তাঁকে নিয়ে যাচ্ছে ডিটেনশন ক্যাম্পে। আপনার খুড়শ্বশুড়, মেজ শালী সব্বাই পৌঁছে গেছেন ডিটেনশন ক্যাম্পে। 

মৃত এই শহরে, মৃত এই রাজ্যে আপনি একা। ভীষণ একা। 

আপনার একাকিত্ব দেখে মুচকি হাসছে শ্রীনগর। আপনার একা বোকা ন্যাকামিকে পেল্লাই জোরে সিটি মারছে কুলগাম পহেলগাঁও। আপনার বিহ্বলতাকে যার পর নাই আওয়াজ দিচ্ছে নওগাঁও, বরপেটা। 

৬০ দিন ৮ ঘন্টা এভাবেই আটকে আছে কাশ্মীর। আপনি ক্রুদ্ধ হননি। আপনি জানতে চাননি। আপনি যোগাযোগ করতে চাননি ফি শীতে আখরোট বিলি করে যাওয়া শালওয়ালার খবর। 
আসামে রাষ্ট্রহীন হয়েছেন ১৯লক্ষ মানুষ, তাঁদের মধ্যে ৮৫শতাংশ মানসিক ব্যাধিতে ভুগছেন, এই সব অশ্লীল দৃশ্যাবলী আপনাকে রাগিয়ে তোলেনি। 
আপনার ভ্যাবাচাকা মুখ দেখে বেজায় হাসছেন জলপাইগুড়ির অন্নদা রায়। আপনার শিশুকন্যার চোখের জল দেখে কান্না পাচ্ছে না দক্ষিণ দিনাজপুরের মন্টু সরকারের মেয়ের। 

কারণ তখন আপনি চুপ ছিলেন। আপনি একটি কথাও বলেননি। 
খুব অসহায় লাগছে? ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে বুকের আঙিনা? বুঝতেই পারছেন না হঠাৎ এদিন কেন আপনাকে দেখতে হল? 

অবাক হবেন না। আপনার মত অবাক আশ্চর্য হচ্ছেন আপনার সহনাগরিকেরাও। 
পরশু যা হয়েছে কাশ্মীরে, কাল যা হয়েছে আসামে, আগামী কাল তাই হতে পারে আমার আপনার বাংলায়। 

এখন অবাক হওয়ার সময় নয়। বিহ্বলতার সময় নয়। এখনও আছে সময় রুখে দাঁড়ানোর। 

এই শারদে একটা কাজ আপনি নিশ্চিত করতেই পারেন। মুদিয়ালিতে গিয়ে বলুন কুলগামের গল্প। সুরুচি সংঘের লাইনে দাঁড়িয়ে আলোচনা করুন ডাল লেকে নৌকা বাওয়া মহিলার কাজ না থাকার কথা। কলেক স্কোয়ার আর বাগবাজার সার্বজনীনে আপনি সংহতিতে গলা ফাটাতে না পারলেও ফিসফিস করে বোঝান রাষ্ট্রহীন হওয়া বরপেটা, গুয়াহাটির কথা। 

আমাদের কাছে উৎসব মানে একান্তই আমাদের। আমাদের শারদ মানে রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গান। আমাদের শারদ মানে নতুন কাকাবাবু আর মিতিন মাসি। আমাদের শারদ মানে নমবীর ধুনুচি নাচ আর দশমীর ভাসান। আমাদের শারদ মানে বিশু আর আসলানের কোলাকুলি। 

সংঘ পরিবার আমার আপনার সংস্কৃতির হদিশ জানে না। আমার আপনার সম্প্রীতির ঠাসবুনোট গল্প জানা নেই মমতার। 

বি জে পি-র সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধ হানুক আমাদের আজন্মের সংস্কৃতি। যা ছড়িয়ে আছে কর্ণফুলির শেতলা থানে। ইছেমতীর মাজারে। গড়িয়াহাটের দাবার বোর্ডে। নন্দনের টিকিটের লাইনে। উত্তর কলকাতার গলির ভেতর জেগে থাকা খবরের কাগজে আলতা দিয়ে লেখা পোস্টার সাঁটা পার্টি অফিসে। বেলেঘাটার খালপাড়ের রক্তদান শিবিরে। যাদবপুর এইট বি আর চৌরঙ্গীর বুক স্টলে। 

আপনার ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদা ছোট্ট শিশুকন্যার জন্য বাড়িতে অন্তত একটা জুঁই বা গন্ধরাজ ফুলের গাছ লাগান। 

ফুল ফুটতে শুরু করলে তার হাতে অন্তত একটা কঞ্চি ধরিয়ে বলুন, পাহারা দিতে শেখ। পাহারা দিতে অভ্যাস কর। পাহারা দেওয়া জরুরি। 
উৎসবের ঋতুও হোক
 আদর্শের ঋতু। প্রতিরোধের ঋতু।

(লিখেছেন অর্ক রাজপন্ডিত, সাংবাদিক)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন