আপনি তো জানেন, প্রাইভেট সেক্টর মানেই বেশ একটা স্যুট-টাই গোছের ব্যাপার। কেতাদুরস্ত অফিস। বায়োমেট্রিক অ্যাটেণ্ডেন্স। অফিস ঢুকলেই কলিগরা বগলের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে 'গুড মর্নিং' বলবে। লাঞ্চে সালমা হায়েকের ইনস্ট্রাগ্রাম নিয়ে গসিপ বসবে। রিক্রিয়েশন রুমে 'দিস সিস্টেম ইস ব্লাডি ক্র্যাপ!' ডায়লগ সহযোগে ক্লাসিক মাইল্ডসের ধোঁয়া উড়বে। এয়ার-কন্ডিশন রুমে ম্যানেজার প্রফিটের অঙ্ক কষবে। সিইও ব্যালেন্স শিটে টার্গেটের আঁকিবুঁকি কাটবে। আপনি তো জানেনই প্রাইভেট সেক্টর মানেই বেটার ডিসিপ্লিন, বেটার সার্ভিস। এবং অবশ্যই বেটার ইকনমি।
আপনি তো অভিমন্যু। মায়ের পেটের ভেতর থেকেই আপনি শুনেছেন পাবলিক সেক্টর মানেই বেশ একটা ক্যাবলাকান্ত গোছের ব্যাপার। ভুঁড়িওয়ালা লোকজনদের আড্ডা। ঐ ঠিক যেমন সিনেমায় দেখায়; অন্ধকার বারান্দা পেরিয়ে একটা লজঝড়ে অফিস, ঘরের কোণে টিমটিম করা বাল্ব, মাথার উপর ঘড়ঘড় করা ফ্যান, টেবিলের উপর ক্যালক্যাল করা ফাইল আর চেয়ারে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা কেরানি। আপনি তো জানেনই পাবলিক সেক্টর মানেই লোকসান, ইকনমির সর্বনাশ। অতএব BSNL তুলে দাও। BPCL গুঁড়িয়ে দাও। সিম্পল।
এমনিতে হোয়াটস-অ্যাপ ইউনিভার্সিটির কৃতি ছাত্র হিসেবে আপনি টেলিকম দুনিয়ার নাড়ি-নক্ষত্র সবই জানেন। তবুও বলুন তো, টেলিকম ম্যানুফ্যাকচারিং-এ আজকাল রাজত্ব করছে কারা? মোটোরলা, নকিয়া, এরিকসন, সিমেন্সের মত প্রাইভেট কোম্পানি? আজ্ঞে না! বরং গত ১০বছরে এই আমেরিকান, ইউরোপিয়ান মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানি গুলিকে টেকনোলজি এবং তুলনামূলক মূল্যে টেক্কা দিয়ে টেলিকম ম্যানুফ্যাকচারিং-র গ্লোবাল মার্কেটের অবিসংবাদিত নায়ক এখন চিনের Huawei এবং ZTE। গোটা বিশ্বে 5G-র পায়োনিয়ারও Huawei এবং ZTE। সারপ্রাইস, সারপ্রাইস! Huawei এবং ZTE কিন্তু তথাকথিত প্রাইভেট কোম্পানি নয়। বরং Huawei–র মালিকানা কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন কর্পোরেশনের। আর ZTE-র মালিকানা মূলত চিনে সরকারের। আসলে কি জানেন, নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা বলে কেঁদে ভাসিয়ে লাভ নেই। বরং নাচটা শিখতে হয় ¹।
এই পর্যন্ত পড়ে যারা আমাকে 'চিনের দালাল' হিসেবে দাগিয়ে দিয়েছেন, কিম্বা আমার প্রোফাইলে 'চিনের চেয়ারম্যান/আমাদের চেয়ারম্যান' শ্লোগান খুঁজতে গোয়েন্দাগিরি করছেন তাঁরা সিট ব্যাক অ্যান্ড রিল্যাক্স! পিকচার আভি বাকি হ্যা মেরে দোস্ত! শুনুন, ৮০-র দশকে ভারত সরকার যখন প্রান্তিক মানুষের কাছে সুলভে টেলিফোনের সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার কথা ভেবেছিল, তখন এই দেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ আবহাওয়ায় এয়ার-কন্ডিশন ছাড়া এক্সচেঞ্জ রুমে কার্যকরী এবং টেকসই সুইচ বানাতে প্যান্টুল হলুদ হয়ে গিয়েছিল Bell সহ পাশ্চাত্যের বহু প্রাইভেট টেলিকম কোম্পানির। শ্যাম পিত্রোদার নেতৃত্বে, MAX সুইচ ডিজাইন করে সেদিন সবাই কে চমকে দিয়েছিল টেলিকম দুনিয়ার দুধের শিশু C-DoT। আজও ভারত ছাড়াও ৭০টি দেশে MAX সুইচই ব্যবহার করা হয়। আজও ভারতের 'টেলিকম রিভোলিউশেন' বলতে MAX সুইচ ডিজাইনের স্বর্ণময় অধ্যায়কেই বোঝানো হয়। সারপ্রাইস, সারপ্রাইস! এই C-DoT কিন্তু তথাকথিত প্রাইভেট কোম্পানি নয়। বরং ভারত সরকারের অধীনস্থ পাবলিক সেক্টর²।
এমনিতে হোয়াটস-অ্যাপ ইউনিভার্সিটির সিলেবাসে আপনি তো পড়েছেন প্রাইভেট সেক্টর মানেই প্রফিট। তা ইদানীং কত প্রফিট করেছে ভোডাফোন, এয়ারটেল কিম্বা জিও? চলতি আর্থিক বছরের জুন কোয়ার্টরে ভোডাফোনের লোকসান ৪,৭৭৪ কোটি³, এয়ারটেলের ২,৮৬৬ কোটি⁴। এমনকি ব্রিটিশ টেলিকম রিসার্চ সংস্থা বার্নস্টাইন জানাচ্ছে ২০১৮-১৯ আর্থিক বছরের ডিসেম্বর কোয়ার্টারে জিও খাতায় কলমে ৮৩১ কোটি প্রফিটের গল্প শোনালেও আসলে লোকসানের পরিমাণ ছিল ৩,৮০০ কোটি⁵। কিন্তু আপনি তো অভিমন্যু। মায়ের পেটের ভেতর থেকেই আপনি শুনেছেন লোকসান কেবল BSNL–র হয়। আসলে মুশকিলটা হল অভিমন্যু সবটা শোনার আগেই ঘুমিয়ে পড়ে।
তাই অভিমন্যু জানেনা, BSNL-র পরিকাঠামো ব্যবহার করেই এতদিন মুনাফা লুটেছে প্রাইভেট সেক্টর। অভিমন্যু জানেনা, BSNL–কে মোবাইল সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে সুযোগ দেওয়া হয় হাচ, এয়ারটেল ব্যবসা শুরু করার ৭বছর পর। অভিমন্যু জানেনা, মোবাইল সার্ভিসের দুনিয়াতে পা রেখেই ২০০৪-০৫ আর্থিক বছরে ১০,০০০ কোটি প্রফিট করেছিল BSNL। অভিমন্যু জানেনা, তারপরেও 3G-4G স্পেকট্রামের নিলামে অংশগ্রহণ করার সুযোগই পায়নি BSNL। অভিমন্যু জানেনা, অস্থিরতা সত্ত্বেও এই সেপ্টেম্বরেও ১৩.৫লক্ষ নতুন গ্রাহক বাড়িয়েছে BSNL। অভিমন্যু জানেনা, আজও টেলিকম সেক্টরের সম্মিলিত মোট ৮লক্ষ কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণের ২লক্ষ কোটিই জিও-র। ২লক্ষ কোটি ভোডাফোন এবং এয়ারটেলের। আর মাত্র ২০,০০০ কোটি BSNL-র¹।
তাই বুড়ো বয়সে ছেলেমানুষি করার ইচ্ছে হলে দুধের গ্লাসে ব্রনভিটা গুলে খেতে পারেন, খড়িমাটি দিয়ে রাস্তায় দাগ কেটে কিথ কিথ খেলতে পারেন, কিন্তু 'লোকসানর জন্য পাবলিক সেক্টর বেচে দিতে হচ্ছে' এসব গল্প দেবেন না। লাভ-লোকসান মাপকাঠি হলে গত ৫বছরে ৩৫,১৮২কোটি লাভ করা⁶, ২০১৭-তে মহারত্নের⁷ অন্তর্ভুক্ত হওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা BPCL বেচে দেওয়ার ধান্দা করে কোন আহাম্মক সরকার?
আসলে ডিমনিটাইজেশনের গিমিকে গরীব মানুষ কে ATM-র লাইনে দাঁড় করিয়েছে এই সরকার। 'চৌকিদারের' মুখোশ পরে মালিয়া-মোদীদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে এই সরকার। গত ৫বছরে ৫.৭৬লক্ষ কোটি কর্পোরেট ট্যাক্স মকুব করেছে এই সরকার⁸। আর আজ যখন দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার ৫% এসে ঠেকেছে, শিল্পপণ্যোত্পাদী বৃদ্ধি -১.১%-এ নেমে গেছে⁹, ৪৫ বছরের সর্বোচ্চ বেকারত্ব মাথাচাড়া দিচ্ছে¹⁰, জিএসটির মত জটিল কর ব্যবস্থার চাপে লক্ষ মাত্রা থেকে ৯৮,২০২ কোটি টাকা কম রেভেনিউ আদায় হচ্ছে¹¹; তখন দেশের মানুষের করের টাকায়, অসংখ্য মানুষের রক্ত জল করা পরিশ্রমে তিল তিল করে গড়ে ওঠা, পাবলিক সেক্টর গুলি কে ধারাবাহিক ভাবে দুর্বল করে বেচে দিয়ে নিজেদের মুখ বাঁচাতে চাইছে এই সরকার।
সম্প্রতি ফরবেসে ১০০জন ধনীতম ভারতীয়দের যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, তাতে ৮ধাপ উঠে দ্বিতীয় স্থানে আছেন গৌতম আদানি। আর এই নিয়ে টানা ১২বছর প্রথম স্থানে মুকেশ আম্বানি¹²। ২০১৪-২০১৯, মোদীর রাজত্বে মুকেশ আম্বানির সম্পত্তি ১.৬৮লক্ষ কোটি থেকে বেড়ে ৩.৬৫লক্ষ কোটি হয়েছে। বৃদ্ধির হার ১১৮%। আর গৌতম আদানির সম্পত্তি ৫০.৪ হাজার কোটি থেকে বেড়ে ১.১লক্ষ কোটি হয়েছে। বৃদ্ধির হার ১২১%¹³। তা প্রাইভেট সেক্টরের প্রফিট বাড়লেই যদি দেশের অর্থনীতির উন্নতি হয়, তাহলে বড্ড জানতে ইচ্ছে করে; আম্বানি-আদানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হোয়াটস-অ্যাপ ইউনিভার্সিটির কৃতি ছাত্রদের, পাবলিক সেক্টরের বাপ-বাপান্ত করা আজকের অভিমন্যুদের, ট্রিকল-ডাউন অর্থনীতির স্বপ্ন ফেরি করা দালালদের, নাগপুরের হাফপ্যান্ট ওয়ালা দাদুর নাতিদের, কিম্বা ভারতের ৯৯% সাধারণ মানুষের সম্পত্তি এই ৫ বছরে কত শতাংশ বেড়েছে? ১২১% ? না ১১৮% ?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন