সরকারি জুমলার একটা গল্প বলি শুনুন।
১৯৩৮ সালের কথা। তার বছর কয়েক আগে, সঠিকভাবে বলতে গেলে ১৯৩৩ সালের জানুয়ারি মাসে অ্যাডলফ হিটলার প্রথমবার জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে ডাক পান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট, ফিল্ড মার্শাল হিন্ডেনবার্গের কাছ থেকে। প্রথমে ছিলো কোয়ালিশন, কিন্তু অচিরেই একে একে সবাইকে সরিয়ে, অন্য দলগুলোকে বেআইনি ঘোষণা করে, লেবার ইউনিয়ন বাতিল করে সেখানে ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট বা নাৎসি পার্টির একমাত্র সংগঠন বসিয়ে হিটলার জার্মানির একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে ওঠেন। রাইখস্ট্যাগ তখন ছিলো নাম কা ওয়াস্তে, রাবারস্ট্যাম্প মাত্র। গোয়েবলস তখন প্রোপাগান্ডা মিনিস্ট্রির সর্বেসর্বা, তাঁর ইশারায় দেশের সমস্ত সংবাদমাধ্যম পরিচালিত হত - তিনিই বলে দিতেন কবে কোন খবর কীভাবে লিখতে হবে। সাংস্কৃতিক সংগঠন থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটি অবধি - সর্বত্রই ন্যাশনাল সোশ্যালিজমই একমাত্র এবং আবশ্যিক বিষয়। ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো হত জার্মান সায়েন্স, জার্মান হিস্টরি, জার্মান জাতিগত তত্ত্ব ইত্যাদি - নামীদামী যে অধ্যাপক বা সংস্কৃতি কর্মীরা এ পথে হাঁটতে চাননি, তাঁদের তখনই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো শুরু হয়ে গেছে, কখনো খুন করাও। এর মধ্যে বার্লিন এবং অন্যান্য শহরে লাইব্রেরির সমস্ত বই জ্বালিয়ে দেওয়ার মত ঘটনাও ঘটে গেছে।
তো যেটা বলছিলাম - সাধারণ জার্মানরা কিন্তু কঠিন অবস্থা সত্ত্বেও বেশ মানিয়ে নিয়েছিলো, কারণ জাতীয়তাবাদের হিস্টিরিয়া হিটলার সফলভাবে চালাতে পেরেছিলেন, বিশেষ করে ভার্সাই চুক্তির ফলে জার্মানীর দুরবস্থা আর তা কাটানোর জন্যে লীগ অফ নেশনস থেকে বেরিয়ে আসা, এমনকি অসামরিক ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত রাইনল্যান্ডে জার্মান সৈন্য পাঠানো - বিভিন্ন প্লেবিসাইটে জার্মানরা ঢেলে হিটলারের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। হ্যাঁ, গেস্টাপোর ভয়ে অনেকেই হয়তো না-কে হ্যাঁ লিখেছেন, কিন্তু তাতেও এই বিপুল সমর্থনকে অস্বীকার করা যায় না।
এই সময়ে, হিটলার, সাধারণ জার্মান কর্মীদের মধ্যে আরও জনপ্রিয়তার লক্ষ্যে একটি "জনসাধারণের গাড়ি" তত্ত্ব বাজারে আনেন। গোদা বাংলায়, সমস্ত জার্মান কর্মীদের জন্যে সহজলভ্য গাড়ি তৈরী হবে, তার দাম থাকবে ৯৯০ মার্ক, অর্থাৎ তখনকার হিসেবে ৩৯৬ ডলার। তৈরী হয় ভোকসওয়াগন - যার আক্ষরিক অর্থ - "পিপলস কার"। বলা হয় (হিটলারের নিজস্ব দাবীও তাই) যে অস্ট্রিয়ান ইঞ্জিনিয়ার ডঃ ফার্ডিন্যান্ড পোর্শের করা বীটলসের ডিজাইনে হিটলার অবদান ছিল। এবারে বেসরকারি কোনো সংস্থার পক্ষে ওই দামে গাড়ি বানানো সম্ভব নয় – তাই হিটলারের নির্দেশে তৈরী হল সেই সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গাড়ি তৈরীর কারখানা, একটি সরকারী সংস্থা, যার মাথায় হিটলার বসালেন নাৎসি পার্টির লেবার ফ্রন্টকে। বলা হল এই কারখানা থেকে প্রতি বছর পনেরো লক্ষ গাড়ি বাজারে আসবে। গোয়েবলসের দল প্রচারে নেমে পড়লো এই নিয়ে, বছরে পনেরো লক্ষ গাড়ি, কোথায় লাগে ফোর্ড কোম্পানি? লেবার ফ্রন্টের তরফ থেকে কারাখানা শুরুর জন্যে পাঁচ কোটি মার্ক দেওয়া হল। কোথা থেকে এলো এই টাকা? সেই যে হিটলার ট্রেড ইউনিয়নের বদলে নাৎসি সংগঠন বাধ্যতামূলক করলেন - তাদের তো সাপ্তাহিক চাঁদা দিতে সমস্ত কর্মীকে - তাই দিয়েই তৈরী হয়েছিল লেবার ফ্রন্টের "ফান্ড"।
এবার আসরে নামলেন ডঃ রবার্ট লে, যিনি জার্মানিব্যাপী লেবার ফ্রন্টের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি কর্মীদের জন্যে আনলেন একটা নয়া স্কিম - অনেকটা গাড়ির দামের দরুণ সপ্তাহে একটা ইনস্টলমেন্ট - সমস্ত কর্মীকে এই টাকা দিতে হবে প্রতি সপ্তাহে - যতটা সে পারবে - দশ বা পনেরো মার্ক করে। এই টাকা জমে যখন ৭৫০ মার্ক হবে, তখন সেই কর্মী একটা রসিদ পাবে অর্ডার নম্বর সহ, তাতে লেখা থাকবে যে কারখানা থেকে গাড়ি বেরোলেই সেই কর্মী একটি গাড়ি পাবে। এভাবে জার্মানির সমস্ত কর্মীর কাছ থেকে কয়েক বছর ধরে তোলা হল লক্ষ লক্ষ মার্ক।
বলাই বাহুল্য, ভোকসওয়াগনের কারখানা থেকে নাৎসি শাসন চলাকালীন একটিও গাড়ি রাস্তায় বেরোয়নি। ১৯৩৯ সালের পয়লা সেপ্টেম্বের জার্মান ট্যাঙ্কবাহিনী পোল্যান্ডের বর্ডার বেরোয়। ততদিনে ভোকসওয়াগনের কারখানা গাড়ির কারখানা থেকে বদলে হয়ে গেছে যুদ্ধাস্ত্র তৈরীর কারখানা। "জনসাধারণের গাড়ির" তত্ত্ব দেখিয়ে জার্মান কর্মীদের কাছ থেকে সংগৃহীত লক্ষ লক্ষ মার্ক গাড়ির বদলে কাজে লাগলো যুদ্ধাস্ত্র তৈরীতে, আর তার পরের কথা আর কাউকে বলে দেওয়ার দরকার নেই। আমরা সবাই জানি সেই গল্পটা।
শেখার বিষয় এইটাই যে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর "গ্র্যান্ড স্কিম" গুলোও এরকমই জুমলা।
যেমন ধরুন "প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনা"। চাষীদের কাছ থেকে ফসল বীমার জন্যে টাকা নেওয়া হয় যাতে খরা, বন্যা, অতিবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের জন্যে চাষীদের ক্ষতি আটকানো যায়। ২০১৬ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এই স্কিম চালু করেন। আরটিআই সুত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যাচ্ছে ২০১৪-১৫ বা ২০১৬-১৬ সালে (অর্থাৎ, নতুন চালু করা স্কিমের আগের বছরে), যখন পুরনো ফসল বীমা চালু ছিলো, তখনকার তুলনায় ইনসিওরেন্স প্রিমিয়াম বেড়েছে ৩৪৮% (১০,৫৬০ কোটি থেকে বেড়ে ৪৭,৪০৮ কোটি)। এবং হাতে গোণা কয়েকটি বেসরকারি বীমা সংস্থা, রিলায়েন্স যাদের মধ্যে অন্যতম, ২০১৬-১৭ সালে মুনাফা করেছে ৭০০০ কোটি টাকার, যেখানে গড়ে ক্ষতিগ্রস্ত চাষী খরিফ মরসুমের জন্য পেয়েছে মাত্র ১০,০০০ টাকা। নাম আসবে আরো অনেক স্কিমের - যেমন এগ্রিকালচারাল ক্রেডিট, প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি, স্বচ্ছ ভারত, স্মার্ট সিটি ইত্যাদি - সবই দেখা যাচ্ছে জুমলা। ভোকসওয়াগন কারখানার মত এখানেও স্কিমগুলো তৈরী যাদের উদ্দেশ্যে, তারা কিন্তু যে তিমিরে ছিলো সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। ১৯৩৮ সালে কর্মীদের দেওয়া টাকায় তৈরী হয়েছিলো যুদ্ধাস্ত্র। আজ ভারতে চাষী বা কারখানার শ্রমিকদের টাকায় কর্পোরেটপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী তুষ্ট করছেন কখনো আম্বানিকে, কখনো আদানিকে।
এটা আমরা যত তাড়াতাড়ি বুঝবো, ততই মঙ্গল।
[Source: The Rise and the Fall of the Third Reich, William Shirer]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন