আমার মনে হয়, পশ্চিমবঙ্গ থেকে এই প্রথমবার ভোটে দাঁড়ালেন একজন চিকিৎসক-নেতা। হ্যাঁ, আমি ডাক্তার রেজাউল করিমের কথা বলছি।
না, আমি একবারের জন্যেও ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় থেকে শুরু করে ডাঃ সূর্যকান্ত মিশ্র বা ডাঃ রামচন্দ্র ডোম, এমনকি ডাঃ কাকলি ঘোষ দস্তিদার বা ডাঃ মমতাজ সঙ্ঘমিত্রা অথবা ডাঃ নির্মল মাজি, কারো কথাই ভুলে যাচ্ছি না।
আমার বক্তব্য, এঁদের পরিচিতি রাজনীতিক হিসেবে। এঁদের সাফল্য বা ব্যর্থতার দায়ও ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক নেতা হিসেবেই, বা সমষ্টিগতভাবে তাঁদের দল বা দলের রাজনীতির।
কিন্তু, এক এবং একমাত্র চিকিৎসক-আন্দোলন থেকেই উঠে এসে রাজনীতির আঙিনায় পা রাখার নজির, অন্তত এই রাজ্যে, আর নেই।
তিন কি চার দশক আগে, বিশেষ করে বাম দলগুলিতে, এক বিশেষ আন্দোলনের ঘরাণা থেকে নেতা উঠে আসার প্রচলন ছিল। মানে, কৃষক ফ্রন্ট বা শ্রমিক ফ্রন্ট। এই রাজ্যে, সরকারি বাম দলের প্রভাব কমে আসার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত এই দুই উজ্জ্বল স্রোতের ক্ষীয়মানতা। কলকাতা শহরকেন্দ্রিক ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতাদের হাতে যে মুহূর্তে বাম আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীভূত হল, সেই মুহূর্তেই তাঁদের শেষের শুরুটি সূচিত হয়েছিল, এমনটাই মনে করি। পরবর্তীকালেও, অন্যান্য দলেও, বিশেষ একটি আন্দোলনের ফ্রন্ট থেকে নেতা নির্বাচিত হওয়ার নজিরটি বিরল হয়ে উঠেছে।
এই প্রেক্ষিতে, ডাঃ রেজাউল করিমের উঠে আসাকে ব্যতিক্রম ধরা যেতে পারে।
যাঁর প্রত্যক্ষ কোনো দলীয় রাজনীতির অতীত নেই। থাকা সম্ভবও নয়, কেননা তিনি সরকারি চাকরি করতেন। দলমতনির্বিশেষ এক চিকিৎসক আন্দোলনের প্রাণপুরুষ হিসেবেই তাঁর উত্থান। বর্তমান পরিস্থিতিতে, চিকিৎসকদের যদি একটি সুবিধাভোগী শ্রেণীর অন্যতম হিসেবে না ভেবে বিশেষ একটি আক্রান্ত শ্রেণী হিসেবে যুক্তিসঙ্গতভাবে ধরা হয়, বা অন্তত আক্রান্ত শ্রেণীর অন্তর্গত একটি গোষ্ঠী হিসেবে ভাবা হয়, তাহলে সেই চিকিৎসকদের সার্থক প্রতিনিধি হিসেবে ডাঃ করিমের চেয়ে উপযুক্ত কোনো নাম, এই মুহূর্তে, মাথায় আসে না।
এরই সাথে সাথে, তাঁর আন্দোলন শুধুমাত্র চিকিৎসকদের স্বার্থটুকুই যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে, এই ধরনের মায়োপিক নয়। কেননা, তাঁর অন্তর্দৃষ্টি বলে, চিকিৎসকদের স্বার্থ রক্ষা করতে হলে, বা চিকিৎসকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে, সাধারণ মানুষকে পাশে না পেলে চলবে না। আর, রোগী-চিকিৎসকের এই অবিশ্বাসের মূলে রয়েছে সাধারণ মানুষের মনে চিকিৎসা নিয়ে অনিশ্চয়তা ও অসহায়তা, এবং সেই অনিশ্চয়তা-অসহায়তারও মূলে চিকিৎসার বাণিজ্যিকীকরণ।
অতএব, ডাঃ রেজাউল করিমের জনমুখী আন্দোলন মুখ্যত সবার জন্যে স্বাস্থ্যের দাবীতে আন্দোলন, সবার সামর্থ্যের মধ্যে স্বাস্থ্যের দাবীতে আন্দোলন।
স্বাধীনতার পর সাতটি দশক পার হয়ে গেলেও, একটিও সাধারণ নির্বাচন লড়া হয়নি সবার জন্যে স্বাস্থ্যের দাবীকে সামনে রেখে। স্বাস্থ্যচিকিৎসা প্রথম দশটি ইস্যুর অন্যতম, এমন কোনো দলীয় নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোও চোখে পড়েনি কোনোদিন।
দেশের প্রথম সারির সবকটি দলের জনগণের স্বাস্থ্য বিষয়ে এমন প্রকাশ্য অনীহা বা অবজ্ঞার উল্টোপিঠেই থাকে চিকিৎসক ও রোগীকে যুযুধান প্রতিপক্ষ হিসেবে খাড়া করা। এরাজ্যের বাম দলগুলিকে ধন্যবাদ, যে, তাঁরা নির্দল প্রার্থী ডাঃ রেজাউল করিমকে সমর্থন জুগিয়ে এই গড্ডালিকা প্রবাহের বিপরীতে প্রথম পদক্ষেপটি নিলেন।
ডাঃ করিম জিতবেন কি জিতবেন না, সেই প্রশ্ন ভিন্ন। কেননা, নির্বাচনের সমীকরণ ভারি জটিল বিষয়। এবং, এদেশের নির্বাচনে, বিশেষ করে এই বাজারে, শিক্ষিত ভদ্রলোকের জয়ের সম্ভাবনা প্রথম থেকেই কমে যায়, কেননা খেউরের লড়াইয়ে তাঁদের অদক্ষতা লক্ষ্যণীয়। আর, একথা মাথায় রাখতে হবে, পিপল গেট দ্য লিডার দে ডিজার্ভ। কাজেই…..
কিন্তু, তাঁর প্রার্থী হওয়া বা প্রচার-পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে সবার জন্যে স্বাস্থ্যের দাবী কিছুটা সামনের সারিতে আসতে পারবে, কিছুটা মান্যতা পাবে, এই দাবী প্রকৃতঅর্থেই জনসাধারণের মধ্যে থেকে উঠে আসা জনসাধারণের দাবী হয়ে উঠতে পারবে, এইটাও খুব বড় পাওনা।
সেইদিক থেকে বিচার করলে, ভোটের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া বা ফলপ্রকাশের বহু আগেই, ডাঃ রেজাউল করিম ও তাঁর অ্যাজেন্ডাটি জিতে গিয়েছে।
আপনিও গর্ববোধ করুন, কেননা অ্যাজেন্ডাটি আপনারও।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন