
সেদিন গদগদ আনন্দবাজার সিক্সটি পয়েন্ট হেডিং-এ লিখেছিল, 'বাম বিদায়'। লিখেছিল, 'উন্নয়ন আর সুশাসনই মন্ত্র মমতার।¹' শুধু লেখেনি, সেই 'উন্নয়ন'ই একদিন লাঠি হাতে দাড়িয়ে থাকবে আপনার পাড়ার রাস্তার মোড়ে। সেই 'উন্নয়ন'ই একদিন বাইকে চেপে, মুখ ঢেকে, বোমাবাজি করবে আপনার নিরুপদ্রব গ্রামে। শুধু লেখেনি, সেই 'সুশাসনেই' একদিন ভিন রাজ্যের মার্কা মারা মস্তানরা বিরোধী'দের পেটাতে তাবু খাটিয়ে ঘাঁটি গাড়বে মদ-মাংসর আড্ডায়। সেই সুশাসনেই একদিন পুলিশ লক আপে সাংবাদিকার তল্লাশি হবে নগ্ন অবস্থায়। ঝাঁ চকচকে নবান্নের চোদ্দতলা থেকে ম্যাডাম অবশ্য টুইট করে জানিয়ে দিয়েছেন; 'পশ্চিমবাংলায় গণতন্ত্র অটুট'।
ম্যাডামের থেকে 'গণতন্ত্র' কেই বা আর ভালো জানবেন বলুন? টানা তিনবার জয়ের পর সেদিন যাদবপুরে সোমনাথ চ্যাটার্জির বিজয়রথ ১৯,৬৬০ ভোটের ব্যবধানে থমকে দিয়ে, তাক লাগিয়ে, পার্লামেন্টে সর্বকনিষ্ঠা সাংসদ হিসেবে অভিষিক্তা হয়েছিলেন রাজনীতির আঙ্গিনায় নিতান্তই আনকোরা ঐ কিশোরী; মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়²। রাজনৈতিক জীবনে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ১৯৮৪-২০০৯, ৯বার লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জিতেছেন ৮ বারই³। বিরোধী রাজনীতির গুল্ম থেকে পরিণত হয়েছেন মহীরুহে। বামফ্রন্ট সরকার আমলেই, মানুষের ভোটেই, নির্বিঘ্নে আর অবাধেই।
অবশ্য সোমনাথ চ্যাটার্জির নির্বাচনী হার ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। ১৯৭৭'র বিধানসভা নির্বাচনে কাশীপুর বিধানসভা কেন্দ্রে নিকটতম কংগ্রেস প্রতিদ্বন্দ্বী প্রফুল্ল কান্তি ঘোষের বিরুদ্ধে ৫,৯৭৬ ভোটে বিজিত সি.পি.আই(এম) প্রার্থী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাঁধে ন্যস্ত হয়েছিল প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রকের গুরু দায়িত্ব⁴। ১৯৮২'র বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের প্রাপ্ত আসন ১৯৭৭'র ২৩১'র তুলনায় বেড়ে দাঁড়ালো ২৩৮। প্রাপ্ত ভোটও ৪৫.৮৪% তুলনায় বেড়ে দাঁড়ালো ৫২.৭% ⁵। অথচ, ঐ কাশীপুর কেন্দ্রেই, ঐ কংগ্রেসের, ঐ প্রফুল্ল কান্তি ঘোষের কাছেই ৭২৮ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হলেন বামফ্রন্ট সরকারের 'হেভিওয়েট' মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ⁶।
পড়ন্ত বিকেলে রাইটার্সের সিঁড়ি তে সেদিন জ্যোতি বসু'র নাগালে পেতেই সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেছিলেন
- বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নির্বাচনী হার নিয়ে আপনি কি বলবেন?
স্বভাবসিদ্ধ শান্ত শীতল আর প্রত্যয়ী গলায় জ্যোতি বাবু জবাব দিয়েছিলেন
- আমি কি বলব ? বলবেন তো আপনারা। রাজ্যে গণতন্ত্র কত শক্তিশালী সেটা বলুন। অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোটের এর থেকে উৎকৃষ্ট উদাহরণ কি আর হতে পারে?

আচ্ছা, কি ভেবেছিলেন বলুন তো দাদা? ৭০'র অন্ধকারে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের ভাবশিষ্যা হয়ে যার রাজনীতিতে আগমন, জাল সার্টিফিকেটে লগ্নে যার সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু, বিধানসভা ভাঙচুরে যার রাজনৈতিক উত্থান, তিনি গুণ্ডা না পুষে চণ্ডীপাঠ করবেন? কি ভেবেছিলেন, গণতন্ত্রের পাঁচ পা দেখবেন? অবাধ ভোটাধিকার পাবেন? 'বদলা নয় বদল হবে'? কার্টুন আঁকবেন? সুদীপ্ত-সইফুদ্দিনরা বিরোধী ছাত্র রাজনীতি করবে? বরুণ বিশ্বাসেরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করে প্রাণে বেঁচে থাকবেন? রেলের জমিতে ভেলর-চেন্নাই'র মত স্বাস্থ্য পরিষেবা গড়ে উঠবে? পাহাড়ে, গুরুং অ্যান্ড গিরি কোম্পানি এক চিলতে গোর্খাল্যান্ড নিয়ে বিজয় মিছিল করবে? জঙ্গলমহলে যৌথ বাহিনী প্রত্যাহার করে চৈত্র মাসে বিশেষ সেল দেওয়া হবে? রাঢ় বাঙলা গ্রেটার ঝাড়খণ্ডে মিশে যাবে? দু-কিস্তির মহার্ঘ্য ভাতা মিটিয়ে সরকারী কর্মচারী'দের বেতন কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী'দের সাথে মিলে মিশে চমচম হয়ে বইবে? ব্যাগ নিয়ে বাজারে বেরোলে টপাস করে একটা চাকরি এসে পড়বে? ঘরের জানলা দিয়ে আলটপকা আপনার বেডরুমেও বিদেশি বিনিয়োগ এসে হামাগুড়ি দেবে ?
এসব কিছুই হওয়ার ছিল না। হয়ও নি। তাই আজ না হয় একবার হিসেব কষেই দেখুন। আয়নায় সামনে দাড়িয়ে একবার চাওয়া-পাওয়ার অঙ্ক মিলিয়েই দেখুন। যে বাংলায় বিনিয়োগ নেই, শিল্প নেই, বেকার'দের চাকরি নেই এস.এস.সি-টেটের নিয়োগে স্বচ্ছতা নেই, ঘুষ ছাড়া ইন্দিরা আবাসের ঘর নেই, কমিশন ছাড়া পঞ্চায়েতর কাজের টেন্ডার নেই, তৃণমূল না করলে সরকারী প্রকল্পের লিস্টে নাম নেই, পাড়ার মস্তান নেতা'দের অনুমতি ছাড়া গাছের পাতা নড়ার উপায় নেই, এমনকি আজ আপনার অবাধ শান্তিপূর্ণ ভোট দেবার নুন্যতম অধিকার পর্যন্ত নেই; সেই বাংলায় লড়াইটা কি আর শুধুই একটা পঞ্চায়েত নির্বাচনের আছে? সেই বাংলায় লড়াইটা কি শুধুই সি.পি.আই(এম) আর তৃণমূলের আছে? সেই বাংলায় লড়াইটা কি শুধুই নিছক রাজনীতির অঙ্কের আছে?
আসলে লড়াইটা এখন নিজের ভোটাধিকার রক্ষার। লড়াইটা এখন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের। লড়াইটা এই দমবন্ধ পরিবেশটা বদলে দেবার। লড়াইটা নতুন বাংলা গড়ার। লড়াইটা আমার। লড়াইটা আপনার। লড়াইটা এই লুম্পেন'দের বিরুদ্ধে বাকী সবার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন