বৃহস্পতিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৮

কুত্তার বাচ্চা ~ ঋষেণ ভট্টাচার্য্য

গত শনিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ শেয়ালদায় 9C প্লাটফর্ম ধরে হাঁটছিলাম গঙ্গাসাগর এক্সপ্রেস ধরবো বলে। শনিবার সাধারণত ওটাই ধরি। ট্রেন প্লাটফর্মে দিয়ে দিয়েছে বলে বেশ তাড়াতাড়ি হাঁটছি। প্লাটফর্ম ফাঁকা। আমি ট্রেনের মাঝামাঝি, আর একদম সামনের দিকে জেনারলে উঠতে হবে। কম্পার্টমেন্টে উঠে প্লাটফর্মের দিকেই একটা জানলার ধার পেয়ে গেলাম। ট্রেন ছাড়তে এখনো মিনিট দশেক দেরি। কম্পার্টমেন্টের ভেতর ভ্যাপসা গরম, দুর্গন্ধ, মেঝেতে জল পড়ে লোকের পায়ের ধুলোয় কাদা কাদা ছাপ, মাথার ওপর আলু লঙ্কার বস্তার ঝাঁঝ, এখনো আলো পাখা জ্বালানো হয়নি - সব মিলিয়ে নরক। ফ্রান্স জার্মান ডেনমার্কে আমার মত সাধারণ মানুষ কেমন ভাবে ট্রেন জার্নি করে আর কার কোন পাপে আমি এদেশে জন্মে কি ভাবে ট্রেন জার্নি করি ভাবতে ভাবতে, গন্ধ থেকে বাঁচতে জানলায় মুখ লাগিয়ে প্লাটফর্মের দিকে তাকিয়ে বসলাম।

হঠাৎ দেখি একটা সাদা কালো ছোপ ছোপ নেড়ি কুকুরের বাচ্চা তার খয়রি রঙের মায়ের সাথে খেলছে। মা শুয়ে শুয়ে ল্যাজ নাড়াচ্ছে আর বাচ্চাটা নানাদিক থেকে ছুটে ছুটে এসে মায়ের গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। মাও শুয়ে শুয়ে বাচ্চাটাকে হাত পা দিয়ে ধরার চেষ্টা করছে, উল্টে যাচ্ছে, বাচ্চাটাও মায়ের নাগাল ছাড়িয়ে একটু দূরে ছুটে গিয়ে প্রবল বিক্রমে ফিরে এসে আবার মায়ের গায়েই ঝাঁপিয়ে পড়ছে। মা বাচ্ছাটাকে খেলাচ্ছে আবার মাঝে মাঝে দেখে নিচ্ছে লোকজনের যাতায়াতের পথে কেউ যেন মাড়িয়ে না দেয়। বাচ্ছাটাও হুঁশিয়ার, মাঝে সাঝেই দেখে নিচ্ছে সে যেন মায়ের থেকে যেন বেশি দূরে চলে না যায়। কাছাকাছি কোনো বসার জায়গা বা থামের আড়ালে একটু লুকিয়েই আবার মায়ের গায়ে লাফিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়া। আর মায়েরও সেই ল্যাজ নেড়ে নেড়ে বাচ্ছাকে খেলানো। বেশ লাগছে দেখতে।

কতক্ষণ সময় কাটলো জানিনা, দুজন আর.পি.এফ বা জি.আর.পি. স্টাফ একটা কুচকুচে কালো ল্যাব্রাডর নিয়ে ধিরে সুস্থে আমার কম্পার্টমেন্টে এসে উঠলো। ট্রেন্ড ল্যাব্রাডর নিঁখুতভাবে সমস্ত কম্পার্টমেন্ট শোঁকাশুঁকি করে পুলিশদের সাথেই কম্পার্টমেন্ট থেকে নেমে পড়লো। পুলিশ দুটো আমার কম্পার্টমেন্টের সামনেই বসার জায়গায় ল্যাব্রাডরের স্ট্র‍্যাপটা হাত থেকে ছেড়ে, একটু বসলো, হয়তো অনেকগুলো কম্পার্টমেন্ট সার্চ করে ক্লান্ত কিম্বা হয়তো ইন্সট্রাক্সন থাকে ট্রেন না ছাড়া অবধি প্লাটফর্মেই ডিউটি দিতে হবে। ল্যাব্রাডরটাও শক্ত কাঁধে মাথা উঁচু করে সাবধানী ভঙ্গিতে পাশে দাঁড়িয়ে।

এদিকে সেই মা আর বাচ্চার খেলা একটুর জন্য থেমেছে। মা ভীষণ উৎকণ্ঠার সাথে ভারী চেহারার বিজাতীয় কুকুরকে দেখছে। বাচ্ছাটার কিন্তু ভ্রক্ষেপও নেই। মা খেলা বন্ধ করতেই বাচ্ছাটা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো ল্যাব্রাডরটার দিকে। বাচ্ছাটা একটু ভয়ে ভয়ে বিরাট বড়সড় চেহারার ফরেনারকে দেখছে, মাথাটা যতটা সম্ভব উঁচু করা যায় করতে গিয়ে উল্টে পড়লো তার পায়ের কাছে। মাও ওদিকে গা ঝাড়া দিয়ে বসে পড়েছে, আমার হাসি পেলেও তার মা কিন্তু ভীষণ উত্তেজিত - যদি অতো বড় চেহারার কুকুরটা কামড়ে দেয় তার বাচ্ছাকে। পুলিশ অফিসারটিও সাংঘাতিক বিভ্রান্ত। অন ডিউটিতে কি খেলা করা উচিত? নাকি দুধের শিশু দেখলে অন ডিউটিতেও একটু চুমু খাওয়া যায়? অফিসার খুব তাড়াতাড়ি আলগোছে বাচ্ছাটার মাথায় একটা চুমু দিলো। ব্যাস, বাচ্ছাটা পেয়ে গেলো নতুন বন্ধু। এক পাক গড়িয়েই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বাচ্ছাটা ছুট মারলো মায়ের কাছে। মায়ের পিঠে একটা গুঁতো মেরেই আবার ছুট অফিসারের দিকে। ওদিকে জাঁদরেল অফিসারও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ল্যাজ নাড়ছেন, আর মাঝে মাঝে একবার তাঁর হায়ার অথরিটি বা বসেদের দিকে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছেন, তাঁরা কিছু মনে করছেন কিনা। পুলিশ দুটির কোনো ভ্রুক্ষেপও নেই সে দিকে। তারা নিজেদের মধ্যেই গল্পে মশগুল। আমি হাসছি। ভাগ্যিস জাপান ইংল্যাণ্ড অস্ট্রেলিয়ার বদলে ভারতবর্ষে জন্মেছি। তাইতো প্লাটফর্মে স্ট্রে-ডগের বাচ্ছার সাথে পুলিশ কুকুরের খেলা দেখতে পাচ্ছি। মা শুয়ে শুয়ে ল্যাজ নাড়ছে, বাচ্ছাটা ছুটে ছুটে এসে মায়ের ল্যাজ ছুঁয়ে দিচ্ছে, মা ধরতে গেলেই পালাচ্ছে পুলিশ কুকুরটার কাছে। সেও কান নামিয়ে ল্যাজ নেড়েই চলেছে, তার ল্যাজ ছুঁতে এলেই সে বাচ্ছাটার মাথা চাটছে। বাচ্ছাটা আবার ছুটে মায়ের কাছে।

নাইন-সি প্লাটফর্মে সামনের দিকে রেলিং নেই। এই ছোটাছুটি করতে করতেই বাচ্ছাটা হঠাৎ পড়লো লাইনে। মাও এক নিমেষে ঝাঁপ মারলো লাইনে। আমিও ট্রেন থেকে নেমে প্লাটফর্মের ধারে গেলাম দেখার জন্য। বাচ্ছাটা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। মা বার দুয়েক বাচ্ছার পেছনে আর পেটে ধাক্কা দিলো মুখ দিয়ে। বাচ্ছাটা কাঠের স্লিপার থেকে লাইনের ওপর দাঁড়ালো, ব্যালেন্স নেই। উল্টে পড়লো। মা চারপায়ে ব্যালেন্স করে লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে। বাচ্ছাটাও উঠলো লাইনের ওপর। মা আবার ধাক্কা দিলো পেছেন দিকে। বাচ্ছাটা উল্টে পড়লো স্লিপারে। আমার বিরক্ত লাগছে মায়ের ওপর, কেন যে ওইটুকু বাচ্ছা কে ঠেলে লাইন থেকে প্লাটফর্মেই তুলতে হবে কে জানে! ওইটুকু বাচ্ছা কি অতটা লাফাতে পারে? ওকে একটু ঘুরিয়ে সামনের স্লোপ দিয়ে প্লাটফর্মে তুলে নিলেইতো হয়! শেয়ালদা স্টেশন, ব্যস্ত লাইন। কখন ট্রেন চলে আসবে আট নম্বরে। আবার ধাক্কাধাক্কি চললো কিছুক্ষণ। লাইন থেকে প্ল্যাটফর্ম, একটা প্রমাণ সাইজ মানুষের বুক সমান উঁচু লাফানো সম্ভব নয় বাচ্ছাটার। এবার মা চেষ্টা করছে মুখে করে তুলে নিতে। মা ভাবলো, বাচ্ছার ঘাড়ের কাছে কামড়ে ধরে লাফিয়ে উঠবে। আমিও নিশ্চিন্ত। কিন্তু হলো না। মা বাচ্ছাটাকে মুখে নিয়ে মুখ উঁচু করে লাফাতে পারছে না। মুখে নিয়ে লাফাতে গেলেই বাচ্ছাটা পড়ে যাচ্ছে মুখ থেকে।

মা লাফিয়ে উঠলো প্লাটফর্মে। পুলিশ কুকুরটার দিকে স্পষ্টভাবে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত গলায় ঠিক দু'বার ডাকলো। সাধারণ চিৎকার নয়, কেমন যেন একটু চাপা গলার আওয়াজ।

শুনেছি ল্যাব্রাডর রেস্কিউ ডগ, গান ডগ। অনায়াসেই বিশাল ওয়েট ক্যারি করতে পারে। চোয়াল অ্যাতোই শক্তপোক্ত যে ভুজের ভূমিকম্পের সময় মাটির ১২ ফুট নিচ থেকে জামার কলার ধরে টেনে তুলতো মৃতদেহ। কিন্তু সে সব নয়, আমি দেখলাম এক অদ্ভুত জিনিস।

মা কুকুরটা একবার সাহায্য চাইতেই তড়াক করে লাইনে নেমে পড়লো ল্যাব্রাডরটা। আর.পি.এফ. বা জি.আর.পি. স্টাফদুটোও অবাক। ট্রেন্ড ডগ কখনো ওভাবে চলে যায় নাকি? ওরা দাঁড়িয়ে পড়েছে অবাক হয়ে। মা কুকুরটা আবার লাফ মারলো লাইনে। ল্যাব্রাডরটার লাফানোতে ভয় কিনা জানিনা, বাচ্ছাটা মারতে গেল এক ছুট, কিন্তু মা টা ঠিক তার আগেই ধরে ফেলেছে বাচ্ছাটাকে। আমি দেখেছি যে কোনো শ্বাপদ দাঁত দিয়ে বাচ্ছার ঘাড়ের কাছটা ধরে তোলে। ঠিক যেভাবে মা এখন বাচ্ছাটাকে ধরে আছে। আর আশ্চর্য, ল্যাব্রাডরটা বিশাল হাঁ করে বাচ্ছাটার পেটের কাছে ধরলো। মা ছেড়ে দিয়েছে বাচ্ছাটাকে। ল্যাব্রাডরটা অবলীলাক্রমে বাচ্ছাটাকে মুখে নিয়ে নিজের দেহটা একদম নিচু করে এক লাফ মারলো প্লাটফর্মে। অবাক কাণ্ড, উঠেও মুখ থেকে নামাচ্ছে না বাচ্ছাটাকে। প্লাটফর্মের ধারে দাঁড়িয়ে আছে লাইনের দিকে তাকিয়ে। এবার মা উঠলো লাফ মেরে। বাচ্ছাটা ছটফট করছে মুখের ভেতর। তাও ছাড়েনা।  দুজন পুলিশের একজন ডাকলো, "জয়!" ল্যাব্রাডরটা তাকালো পুলিশটার দিকে, মুখে বাচ্ছা। নামাবার নামও নেই। মা প্লাটফর্মে উঠে মাঝামাঝি চলে এসেছে। এবার জয় বাচ্ছাটাকে ছাড়লো, একেবারে মার কাছে গিয়ে।

এখন জয় বসেছে  পুলিশ দুটোর পাশে। আবার সেই শক্ত কাঁধে মাথা উচু করে কম্পার্টমেন্টের দিকে তাকিয়ে থাকা, হাজার হাজার লোকের মধ্যে সন্দেহভাজনকে খুঁজে বের করে চিনিয়ে দেওয়া, গাদা গাদা মালপত্রের মাঝে আসল মালকে শুঁকে আলাদা করা।

আমার ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। কি জানি, ওই শেয়ালদার উদ্বাস্তু মা বোধ হয় বাচ্ছাটাকে ওখানেই মানুষ করবে। ট্রেন ছাড়ার পর অফিসার আবার নীল বকলসটা পরে নিয়ে অন্য ট্রেনে ডিউটি করতে উঠবে বা অন্য প্লাটফর্মে টহল দেবে। কিন্তু এই অফিসারের কাছে যখন এক একা অসহায় নারী তার শিশুর জন্য সাহায্য চায়, সেই নারীকে সে রেপ করতে যায় না। বলে না ওটা আমার জুরিসডিক্সান নয়। কিম্বা অসহায়ের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিশেষ রকম কিছু প্রত্যাশাও করে না। অত্যন্ত দায়িত্বসহকারে তার কর্তব্য পালন করে। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার ভাষা। অ্যাতো অনুন্নত মনুষ্যেতর জীব হয়েও দুটি বিজাতীয় নারী পুরুষ কেমন সুন্দর একে অপরকে সমস্যা বোঝালো আর সমাধান করলো।

আমি জানতাম, পুলিশ ডগ স্পেশালি ট্রেন্ড। তারা কখনই বিশেষ কিছু গন্ধ ছাড়া অন্য কিছুকে পাত্তা দেয়না। অন্য জীবজন্তুর ধারে কাছেও যায় না। তারা অত্যন্ত পরিচ্ছন্নভাবে থাকে। অনান্য জীবজন্তু থেকে আগত ভাইরাস ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণের ব্যাপারেও তারা সচেতন, এমনিই তাদের প্রশিক্ষণ। প্রভুর আদেশ ছাড়া নাকি তারা জৈবিক তাড়নাতেও সাড়া দিতে দ্বিধা বোধ করে। কিন্তু না, তারা চোখ বন্ধ করে আইনের কথা ভাবে না, তারা মানবিক, তাদের বিচারবুদ্ধি সুস্থ। আমাদের মত শুকনো নয়।

আমি কিন্তু অফিস যাওয়া আসার পথে রাস্তার ফুটপাতে বসে থাকা ভিখিরিগুলোকে ঘেন্না করি। দামি সাবান আর পার্ফিউম্ মেখে অফিসে যাই তো - পাগল নাকি! কোনো উদ্ববাস্তুর বাচ্ছা ড্রেনে পড়ে গেলে কোলে করে তুলে আনবো? সময় থাকলে বড় জোর মোবাইলে একটা ছবি তোলা যেতে পারে।

ওটাতো একটা কুকুর, আমিতো আর কুকুর নই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন