শুক্রবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৮

আসিফা বানু ~ উদয়ন পন্ডিত

আপনারা কেউ এশার বাতুলের নাম শুনেছেন? নাতাশা রাথার? সমরিন মুস্তাক? ইফরা বাট বা মুনাজা রশিদ? না শুনে থাকলে জেনে নিন, অবিলম্বে কিনে ফেলুন Do You Remember Kunan Poshpora, আর পড়ে ফেলুন কিভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর রাজপুতানা রাইফেলসের চার নম্বর ব্যাটেলিয়ন এক প্রাক্ বসন্তের রাতে কুপওয়ারার কুনান আর পাশপোরা নামে দুটো পাশাপাশি গ্রামের দেড়শোজনেরও বেশি মহিলাকে গণধর্ষণ করেছিল।জেনে নিন চাহানপোরার ঘটনা,'৯০-এর ৭ই মার্চ ছানবিন করার নামে কিভাবে কুড়িজন সি আর পি এফ জওয়ান চব্বিশ বছরের নূরকে রান্নাঘর থেকে টেনে এনে গণধর্ষণ করেছিল, তারপর তার ননদ জাইনা আর আরো দু'জন কিশোরীকে। জেনে নিন পাজিপোরা-বালি্রাপোর ঘটনা, কুনান-পাশপোরার মাঝারি সংস্করণ চক সৈয়দপোরা, বিজবেহরা,হায়হামা। জেনে নিন গুরিহাখরায় তার ধর্ষিতা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিভাবে অবলীলায় মা বলেছিলেন তাঁর মেয়ে নয়, তিনি ধর্ষিতা হয়েছেন। খাতায় লিখে রাখুন '৯৭-এর ১৩ই এপ্রিল, আগামীকালের তারিখ, যেদিন শ্রীনগরের উপকণ্ঠে ভারতীয় সেনা বারোজন কাশ্মীরী তরুণীকে ধর্ষণ করেছিল। গেঁথে নিন মগজে, গেঁথে নিন মনের মধ্যে- ওয়াভুসা, সোপোর, গুজ্জরদারা-মঞ্জগাঁও- যাতে আপনি চোখ বুজলেই সবুজ ঘাসে চাপ চাপ রক্তের দাগ, নীল আঙ্গিয়া, ওই তো শুয়ে আছে আশিয়া, তার একটু দূরেই নিলোফার জান, তাদের আপেলরঙা গাল, শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট, অনাবৃত তলপেট। 

আপনি ভাবুন সেই নার্সের কথা, সেই মেয়েটি, যে জন্মসূত্রে কাশ্মীরী পণ্ডিত ছিল বলে তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছিল JKLF, তারপর পিটিয়ে খুন করেছিল। মনে করুন ত্রেহগাঁওয়ের সরকারি গার্লস স্কুলের সেই ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টের কথা, যে মেয়েটিকে দিনের পর দিন গণধর্ষণ করার পর কুচিকুচি করে কাটা হয়েছিল করাতকলে। মনে করুন ফারুখ আহমেদ দার নামের সেই সারমেয় সন্তানের কথা, যে একটি কিশোরীকে গণধর্ষণের পর গুলি করে খুন করেছিল, মনে করুন সেই শিক্ষিকার কথা, যাকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল তার পরিবারের সামনেই, মনে করুন সেইসব মেয়েদের কথা, যাদের মাথায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে মুতাহ্-এর (সাময়িক বিবাহ) জন্য বাধ্য করেছে সন্ত্রাসীরা, তারপর ধর্ষণ করে গেছে দিনের পর দিন।

এবং আপনি মনে করুন জম্মু-কাশ্মীরে এখন পিডিপি-বিজেপির মিলিজুলি সরকার- তারা এই ধর্ষিতাদের জন্য কি করেছে?

এবার আপনি আপনার ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিন। নিভিয়ে দিন সবক'টা আলো। আপনার সমস্ত জামাকাপড় খুলে ফেলে মেঝেতে শুয়ে পড়ুন। আপনার পিঠে ঠাণ্ডা লাগছে। এবার আপনি মনে করুন সাতদিন ধরে আটবছরের বাচ্চা মেয়েটি একটা মন্দিরের গর্ভগৃহের স্যাঁৎসেঁতে মেঝেতে এর চেয়েও খারাপ অবস্থায় পড়ে ছিল। সে তার ছেঁড়াখোঁড়া যোনিপথে উষ্ণ রক্তের স্রোত অনুভব করছিল; সে তার জরায়ুতে গরম বীর্য অনুভব করছিল; তার ছোট্ট ছোট্ট আঙুলগুলো কাঁপছিল; সে বুঝতে পারছিল তার মধ্যে ঢুকছে আর বেরিয়ে আসছে একের পর এক মানুষ। সে আছাড়ি পিছাড়ি করছিল, সে হাত পা ছুঁড়ছিল, সে কাঁদছিল। তারপর আস্তে আস্তে সব থেমে গেল।

এরপরেও রাস্তাজুড়ে যেসব শুয়োরের বাচ্চারা রামের নামে মিছিল করে, তাদের আমি বাঞ্চোৎ বলি। মূত্রপাত না, তাদের ঘিলুতে আমি পেচ্ছাপ করি। আমি রাস্তাজুড়ে কাঁদি, আমি দেওয়ালজুড়ে লিখি আসিফা বানু, স্বপ্না কুমারী ঝা-র ঠিক পাশে, সুমিতা মণ্ডলের ঠিক পাশে। আমি ছিঁড়েখুঁড়ে দিই গেরুয়া রং, গ্রাফিতিতে লিখি বিলকিস ইয়াকুব রসুল। আমাদের শহরজুড়ে উড়তে থাকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টের পাতা, তুমি ছোট ছোট হাতে লেখ সৃজনদার গান, 'রাষ্ট্র, সে তো এখনো শোষণযন্ত্র', তুমি ছুঁয়ে দাও সেই অগুন্তি উড়তে থাকা পাতা, যাতে লেখা- কাশ্মীরে প্রতি তিনজন পুরুষের একজন ধর্ষিত, ১৯৯২ সালে ভারতীয় সেনা ৮৮২ জন মহিলাকে গণধর্ষণ করেছিল, শুভ মাথুর আর সীমা কাজীর জ্বলন্ত আখর- 'Rape is an essential element of the Indian military strategy in Kashmir' আর 'Rape is a cultural weapon of war'. তুমি ছুঁয়ে দাও আসিফা, আর এই পাতাগুলো টিউলিপ হয়ে ফুটুক হজরতবালের বাগিচা জুড়ে, গজালা আপনমনে শিকারায় বসে গাইতে থাকুক, 'হর চেহরা য়াহা চান্দ তো জরা সিতারা/ ইয়ে ওয়াদি-এ-কাশ্মীর হ্যায় জন্নত কা নজারা', আর তাতেই থেমে যাক উপত্যকা জুড়ে অস্ত্রের ঝনঝনানি, পেলেট গান, পাথরের গায়ে সন্ত্রাসীর ছবি মুছে যাক, ইনশা তার দৃষ্টি ফিরে পাক, পাথরের ফাঁকে ফুটুক বুনো ফুল, সোপিয়ান ছেয়ে যাক টিউলিপে, কোনো এক সন্ধ্যায় পশমিনা জড়িয়ে লিদারের পাশে বসে তুমি আমাকে 'জেহ্‌লুমাস' শুনিও গজালা, 'কদ্‌লে তার দি না কাহ্‌ জেহ্‌লমস/ নায়ভি হুন্দ পেয়ালে চুহ্‌ আয়ভু জেহ্‌লমস/ খোৎসান চস্‌ নাউভি মন্‌জ জেহ্‌লমস'।

অপেক্ষায় রইলাম।



​ছবিঃ অরিজিত সেন ​




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন