সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

উডেন চেস্ট ~ শৈবাল বিষ্ণু

দাদু বলতেন উডেন চেস্ট, আসলে পাঁচ ফুট উঁচু একটা কারুকাজ করা ব্রিটিশ আমলের আলমারি। সেগুন কাঠের। দাদু বলতেন বার্মা টিক। আলমারির ওপরে একটা কাঠের ফ্রেম, ফ্রেমের মধ্যে আটকানো আয়না। দাদুর মতে বেলজিয়াম গ্লাস। আজকেও বিকেলে দেখলাম, মনে হলো যেন একদম নতুন। এডিনবরা ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট করে দেশে ফেরার পরে চিফ কেমিস্ট হয়ে একটা বড় ওষুধ কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন। ওনার কাজের আর বাকি গোপনীয় বা দরকারী কাগজপত্র রাখতেন এই উডেন চেস্ট এর ভিতরে। আলমারি থাকতো ওনার ল্যাবে। ওনার অফিসের সবার ধারণা ছিল যে এই আলমারি অভিশপ্ত। আলমারির দুটো পাল্লা কাঠের হুড়কো দিয়ে বন্ধ থাকতো, ওপরে আর নিচে। পাল্লা খুলে গেলেই সেদিন কোনো খারাপ ঘটনা ঘটতে চলেছে। সাথে সাথে বন্ধ করলে একটু কম কিছু  হওয়ার সম্ভাবনা। ওটা নাকি আগাম বার্তা দিত কোনো ভয়ংকর বিপদের।


আলমারি কে বানিয়েছিলেন, কে প্রথম মালিক ছিলেন, সেসব জানা নেই, তবে খোদাই করা আছে ১৮৯৩, কানপুর। দাদু বাহান্ন সালে এটি কিনেছিলেন, বেশ সস্তায়, কারণ আগে যারা কিনেছিল তারা ফেরত দিয়ে গিয়েছিল। গুজব ছিল যিনি এটা বানিয়েছিলেন, তাকে নাকি মেরে এই আলমারির ভিতরে রেখে দেওয়া হয়েছিল। দিদার প্রচণ্ড আপত্তি সত্বেও আলমারিটা দাদু বাড়ি এনেছিলেন।


আলমারিটা আসার মাস চারেকের মধ্যেই একদিন দেখা গেছিল আলমারীটা হাঁ করে খোলা, আর আমার মেজো মামা, বয়স আড়াই বছর, সামনে থেবড়ে বসে আছে, আর আলমারিটার সাথে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে, অবশ্যই নিজের ভাষায়। এর কদিনের মধ্যেই মামার খুব জ্বর আসে। টাইফয়েড। কিছুদিন ভুগে মেজো মামা মারা যান। বাড়িতে সবার ভীষণ আপত্তিতে, আর বাড়ীওয়ালার অনড় মনোভাবে শেষ পর্যন্ত দাদু আলমারিটা বাড়ি থেকে সরিয়ে ওনার অফিসের ল্যাবে রাখতে শুরু করেন। যদিও ওনার বৈজ্ঞানিক মন কিছুতেই মানতে চায়নি এই দুটো ঘটনার মধ্যে কোনো যোগাযোগ আছে।


ওষুধ কোম্পানি একটা সময় সেই আলমারী ফেরত দিয়ে দেয় দাদুর মৃত্যুর কয়েক বছর পরে। কিন্তু কেউই নিতে রাজী না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত আমার বাবা ওটাকে নিজের চেম্বারে নিয়ে রেখে দেন। 


ওটা বন্ধই থাকতো। চেম্বারে, এক কোনায়। বাবার এসিস্ট্যান্ট সরকার জেঠু ওটাকে সহ্য করতে পারতেন না, গজগজ করতেন, আর রোজ ধুপ ধুনো দিয়ে পূজো করতেন, যাতে অভিশাপ না লাগে। 


আমি বাবা দাদাদের মত ডাক্তারি পড়িনি, চার্টার একাউন্ট্যান্ট হয়ে ভালই কামাই, সাথে শেয়ার বাজার আমাকে বেশ তাড়াতাড়িই প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে। গাড়ি বাড়ি বিদেশ ভ্রমণ চাকচিক্য এমনকি পাড়ায় সম্মান সবই পর্যাপ্ত পরিমাণে উপভোগ করি। পাড়ার ক্লাবে আমার অনেক উঁচুতে স্থান। ইদানিং ক্লাবও ফুলে ফেঁপে উঠেছে, বিরাট বাজেটের পূজো, দুটো বড় বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, একটা নাটক আরেকটা সিনেমা সপ্তাহ, দুটো মেলা, একটা খেলার মাঠ, দুটো পার্ক, ফোয়ারা, বাগান। অনেক আয়, অনেক ব্যয়। এছাড়াও দুতিনজন কাছের নেতার অবৈধ টাকা ঘোরাবার জন্য কাজে লাগে। ক্লাবের হিসেবপত্র মাসে দুতিনবার দেখে দিয়ে যাই। একতলার কোনের লাইব্রেরি, রিডিং রুম, ক্লাবের অফিস পাশাপাশি। ওই লাইব্রেরীতেই ওটা এখন প্রতিষ্ঠিত, বাবা চেম্বার বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকেই। এখানে এরা কেউই জানেনা ওটার পেছনে আসল গল্পটা। আমি যেদিনই যাই দেখে রাখি আলমারি ঠিকঠাক আছে কিনা। বন্ধ আছে কিনা। কিছু কাগজপত্র দলীল দস্তাবেজ এর কপি আছে ওটাতে। ক্লাবের একদম ওপরতলার চার পাঁচজন ওটা খোলে বন্ধ করে, দরকার লাগলে ব্যবহার করে। বাকিরা জানে ওটা আমার জিনিস, দামী জিনিস, ছোঁয়া বারণ।


চারবার ওটা খোলা পেয়েছি। সরকার জেঠুর এক্সিডেন্টের দিন, বাবার হঠাৎ করে ক্যান্সার ধরা পড়ার দিন। আর বাকি দুবারই ক্লাবের দুজন বরকর্তার মৃত্যুর দিন।


একদম শেষ বেলায় বাবা বোধহয় দুর্বল হয়ে গেছিলেন, আমায় আলাদা করে ডেকে বলেছিলেন ওটাকে বিদায় করে দিতে। কিন্তু আমার মধ্যে ততদিনে একটা অপ্রতিরোধ্য রোখ চেপে গেছিল, আমি পুরো ব্যাপারটাকে খেলা হিসেবে নিচ্ছিলাম। মায়ের মৃত্যু, জামাইবাবুর হার্ট এটাকের সময়, একবারও তো ওটা কিছু করেনি। মনে হয়নি ওটাকে আর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার। 


আমার মনে প্রথম ভয় ধরলো যেদিন ক্লাবে হিসেব পত্র দেখে বেরোবার সময় খুট করে শব্দ পেলাম। ঢোকার সময় দেখেছি আলমারিটার হুড়কো খোলা। বন্ধ করে এসেছিলাম ভালো করে। নিজের হাতে। আবার কিকরে খুললো? সেদিনই রাত্রে ইডির রেড হলো কাছের নেতার বাড়িতে। 


আমারও শরীরটা কদিন বেশ খারাপ যাচ্ছিল, জরুরী ভিত্তিতে স্টেন্ট বসানো দরকার, প্রায় ৯০ পার্সেন্ট ব্লক ধরা পড়েছে এনজিওগ্রাম করে। বুকে মাঝে মাঝেই ব্যথা হয় ভোর রাত্রের দিকে। কিন্তু ডাক্তারের থেকে কিছুদিন সময় চেয়ে নিয়েছিলাম, এই ঝামেলার থেকে নিজেকে না সরাতে পারলে পুরো পরিবার শুদ্ধ রাস্তায় নেমে আসতে হবে। বেশ কয়েকশো কোটি টাকার ব্যাপার। 


আজ একটু তাড়াতাড়ি ক্লাবে পৌঁছেই হিসেবপত্র নিয়ে বসে গেছি। অনিমেষদা সাথে আছেন। উনি কাউন্সিলর, ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। খুব ঘামছেন, এসি চালিয়েও। আমরা মন দিয়ে সব ক্যাচরা পরিষ্কার করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। চারিদিক নিঃশব্দ। হঠাৎ খুট করে শব্দ। ছ্যাঁত করে উঠলো। দেখলাম হুড়কো দুটো খোলা। গিয়ে বন্ধ করে এলাম। অনিমেষদার নামেই সব কাগজপত্র, সই সাবুদ। উনি বুঝতে পারছেন খুব খারাপ ভাবে ফেঁসে গেছেন। বেরোবার উপায় নেই। এরা জাল গুটিয়ে এনেছে, আজকে কালকের মধ্যেই কিছু একটা হবে। তার আগে যতটা গুছিয়ে ফেলা যায় চেষ্টা করতে হবে। আমিও আপ্রাণ চেষ্টায় আছি এই তদন্তে যেন আমাকে কোনোভাবে না জড়িয়ে ফেলে। ঘটি বাটি বিক্রী করেও পার পাবনা। অনেকটাই রাত্রি হয়ে গেছে। অনিমেষদা কে এগিয়ে দিয়ে আসতে বললাম ড্রাইভার কে। গাড়ি ফিরে এলে আমিও বেরোবার জন্যে তৈরী হলাম। দরজা আর লাইট বন্ধ করতে বললাম। বন্ধ করে বেরোবার সময় মনে হলো যেন আবার একটা খুট করে শব্দ শুনলাম।


ফিরে যাবো? বন্ধ করে আসবো, যাতে বিপদ কমে। নাকি পুরোটাই মনের ভুল? আর তাছাড়া লোকে কী ভাববে! আমার মত মানুষের এত কুসংস্কার? কিন্তু লোকে কী ভাববে তা কি আজ ভাবার সময়? গিয়ে বন্ধ করে আসি, অন্তত দেখে আসি। পুরোটাই হয়তো মনের ভুল। নাহ, এত বছরের শিক্ষা দীক্ষার তাহলে কিসের মূল্য যদি এই সামান্য ব্যাপারেই কুসংস্কারগ্রস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু এটা কি সামান্য ব্যাপার নাকি জীবন মরণ সমস্যা? গাড়ি প্রায় বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছিল, বললাম গাড়ি ঘোরাতে, একটা কাজ ভুলে গেছি। বাড়ি থেকে এদিকে উৎকণ্ঠিত ফোন এসে গেছে বেশ অনেকবার, বুঝতে দিইনি যে ভিতরে ভিতরে আমি কতটা কেঁপে গেছি। বলেছি কালকেই তো হাসপাতালে ভর্তি হব, পরশুদিন সার্জারী, এই অল্প কিছু কাজ গুটিয়ে ফেললে আর ওমুখো হতে হবে না অনেক মাস। সবাইকে সব বুঝিয়েই বেরোচ্ছি। ফিরে গেলাম ক্লাবে। 


দরজা খুলে দিলো। লাইট জ্বালিয়ে দিলো। ঠিক যা ভয় পেয়েছিলাম। ওটা খোলা! একদম হাট করে খোলা। বন্ধ করার চেষ্টা করছি কিন্তু হুড়কো গুলো যেন কাজই করছেনা। গায়ে যেন একটুও শক্তি নেই। যেন ওটা আজ আমার সাথে যুদ্ধে নেমেছে। আমাকে ওটাকে হারাতেই হবে। আবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আজ কেন হেরে যাচ্ছি। ওটা জিতে যাচ্ছে। আবার চেষ্টা করি, নাহ ওটা যেন আজ জ্যান্ত হয়ে উঠেছে, অসম্ভব শক্তি ওটার গায়ে। অসম লড়াই লড়ছি মনে হচ্ছে। একা পারবনা। ড্রাইভার চঞ্চল আর ক্লাবের কেয়ারটেকার মণিদাকে ডাকলাম। ডাকছি, কিন্তু আওয়াজ কেন বেরোচ্ছেনা। ওটা কি আজ আমার ওপরে আক্রোশ ফলাচ্ছে? আবার একবার চেষ্টা করে দেখি। নাহ, খুলেই যাচ্ছে। পারছিই না বন্ধ করতে। ওটাকে ছেড়ে বাইরে বেরোতে হবে, সাহায্য দরকার চঞ্চল আর মনিদার। কিন্তু একি, নড়তে পারছিনা কেন? পাল্লা গুলোর সাথে আটকে যাচ্ছি কেন, জড়িয়ে যাচ্ছি কীকরে ওটার সাথে? আটকে যাচ্ছি কেন? বেরোবার দরজাটাকে আর দেখতে পাচ্ছিনা কেন? আলো কে নিভিয়ে দিল? ওটা কি আমার ওপরে চেপে বসলো? বুকে এত চাপ কিসের? ওটা আমার বুকের ওপরে বসে আমাকে মেরে ফেলতে চাইছে, ওটা আমাকে শেষ করে দিতে চাইছে। আর লড়াই করতে পারছিনা। ঘুম পাচ্ছে। ওটা জিতে গেল…


সাদা রঙের আলো। হালকা। চারিপাশ ঠান্ডা। অল্প ব্যথা। মাথা ভার ভার। ঘুম পাচ্ছে। চারিপাশে অনেক কিসব অপরিচিত আলো। খুব ঘুম পাচ্ছে।


ঘুম ভাঙ্গার পরে জানলাম সেদিন রাত্রে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল, সকালেই সার্জারী হয়ে ৯টা স্টেন্ট বসেছে। সেদিন রাত্রে অনিমেষদাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। ইডি বা পুলিশ আমার খোঁজ করেনি। 


কদিন পরে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই লম্বা ছুটি নিয়ে নিয়েছি। ঘরেই থাকছি।  ডাক্তার বলেছেন আমার অবস্থা অত্যন্ত জটিল তাই আরো একটা সার্জারী লাগবে খুব শিগগিরই। যে নয়টা স্টেন্ট বসেছে সেগুলো ৯০% এর বেশী ব্লক ছিল। আরোও ছয়টা ব্লক আছে যেগুলো ৮৫ শতাংশের বেশী। এক্ষুনি স্টেন্ট বসাতে হবে। আমি রাজি হলেই আরেকটা সার্জারী করে দেবেন। আর বুকে ব্যাথা হলেই যেন জানাই, সাথে সাথে সার্জারির ব্যবস্থা করবে।


ঘরে ফিরে ছুটি নিয়ে রেস্ট নিচ্ছি। ক্লাবের কাঁচা কাজ থেকে নিজে কীকরে উদ্ধার পাই তার জন্যে যাকে যেখানে যা দেওয়ার সেসব ব্যবস্থা করছি। আরো মাস দুতিন লাগবে সম্পূর্ণ থিতোতে, ততদিন সময় চাই আমার। তারপর সার্জারী করা যাবে। প্রায় রোজই বুকে ব্যাথা হচ্ছে, ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। ওষুধ পত্র খেয়ে কমছে। বউ এখন মেয়ের ওখানে গেছে, মেয়ে প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছে। কয়েক কোটির ওপর খরচ কিন্তু হোস্টেলের খাবার ভালো নয়। তাই বউ গেছে মেয়েকে নিয়ে পাশেই একটা বাড়ি ভাড়া করে থেকে মেয়েকে সুস্থ স্বাভাবিক করে তুলতে যাতে কলেজ যেতে পারে।


শুধু লোক লাগিয়েছি ওটাকে সরিয়ে দিতে, কারপেন্টার রাজেনবাবু কে দিয়ে কাটিয়ে দিয়ে ওটাকে নষ্ট করে দিতে। কুসংস্কার নয়। আসলে বউ খুব ঝামেলা করছে। বলছে আমাকে নাকি ওই ওটার সামনেই পাওয়া গেছিল। দরজা খোলা ছিল। ওটাই অপয়া। কীকরে বোঝাই যে আমি তো ভেবেছিলাম মরেই গেছি। যাইহোক সংসারে শান্তি বজায় রাখতে কার্পেন্টার এর কাছে ওটা চলে গেছে। নামমাত্র টাকায়, দরাদরি করিনি। বলেছি ক্লাব এর সাথে আর সম্পর্ক থাকবেনা, তাই সরিয়ে দিতে হচ্ছে, আর বাড়িতে এ জিনিস রাখার জায়গা নেই।


উনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক করে ওটার ইতিহাস জানতে চাইলেন, বারবার। একটু এদিক ওদিক করে সযত্নে আসল কথাটা এড়িয়ে ইতিহাস বলেছি। চোখ মুখ দেখে মনে হলনা রাজেনবাবু বিশ্বাস করলেন। উনি বলে গেলেন আগে চেষ্টা করবেন খদ্দের পেতে, তেমন খদ্দের পেলে দিয়ে দেবেন, অর্ধেক আমার অর্ধেক ওনার। না পেলে কেটে দেবেন। কেন আমি অত সুন্দর একটা ওয়ার্ক অফ আর্ট কে কাটাতে চাই ভেবে পাচ্ছেন না। সন্দেহ নিয়েই যেন ফিরে গেলেন। 


৩:৫৪ বাজে। সকাল হয়নি। আলো ফোটেনি। পাখি ডাকেনি। আজ আমার আবার ব্যথা করছে। ওষুধ খেয়েছি। ব্যথা কমছেনা। আবার ওষুধ খেলাম, আরেকটা ডোজ নিলাম। তাও ব্যথা বেড়েই চলেছে। ফোন কোথায়? ফোন। কাউকে ডাকতে পারছিনা। আবার সেদিনের মত লাগছে। আবার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। গলা শুকিয়ে আসছে। আমি চিৎকার করছি। ছটফট করছি। কই ব্যথা কমছে না কেন। কখন কমবে। 


মনে হচ্ছে এবারে যেন কমছে? হালকা লাগছে কি? অবশ লাগছে। ঘুম পাচ্ছে। ঘুম। ঘুম। ঘুম।


ঠিক সেই সময়ে, রাজেন বাবুর দোকানের পেছনে গুদামে ওটা থেকে কি খুট করে একটা শব্দ এল?


না, আসেনি। আসবেও না আর কোনোদিন। ওটা তো আর রাজেনবাবুর কাছে নেই। ওটা চলে গেছে, ওটা নতুন জীবন পেয়েছে কোনো বড়লোকের সংগ্রহে, বা হোটেলে, বা মিউজিয়ামে। কিন্তু ওটা আর আমাদের পরিবারে নেই। 


আমাদের পরিবারে, বংশানুক্রমে চিরকালই শোক, তাপ, দুঃখ, মৃত্যু, অসুখ, লোভ, লালসা, অপরাধ, সব ছিল, ভবিষ্যতে থাকবেও। শুধু সামনে থাকবেনা একটি নিরীহ কাঠের আলমারি, এই সবকিছুর জন্যে দোষ চাপানোর, অপয়া বলে দায়ী করার জন্যে!


(ছবি ইন্টারনেট থেকে)



শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৫

ভারতমাতা ও তার জন্ম ~ অরিজিত মুখার্জী

শিক্ষিত উঁচু জাতের বাঙালি ভদ্রলোকের হাতে ভারতমাতার জন্মের এই গল্পটা অনেকদিন ধরেই লেখার ইচ্ছে ছিল। অনেক টালবাহানার পর লিখেই ফেললাম, কারণ আজকের দিনে এই ন্যারেটিভটা জানা জরুরী। অবশ্যই মৌলিক কিছু নয়, মূলতঃ তনিকা সরকার, সুমিত সরকার, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, আশিস নন্দী, মৃণালিনী সিনহা — এরকম বেশ কিছু স্কলারের লেখা পড়ার পর একটা সাধারণ ভাষায় সিন্থেসিস। আমি ইতিহাসের ছাত্র নই, মানে এই বিষয়ে ফর্মাল কোনো ট্রেনিং নেই। নিজের ইচ্ছেতে কিছু বই পড়ি। পরিচিত লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করে বোঝার চেষ্টা করি। এই লেখাটা সেইরকমই — ঠিক বুঝলাম কিনা সেইটা যাচাই করার জন্যে। ভুল থাকাই বরং স্বাভাবিক। তাই, যাঁরা ইতিহাসের ছাত্র, তাঁরা শুধরে দিলে উপকৃতই হব।
গল্পটা ঊনবিংশ শতকের আলোকপ্রাপ্ত বাঙালি ভদ্রলোক সমাজকে নিয়ে — যাঁরা সাধারণভাবে শিক্ষিত আর অবশ্যই উঁচু জাতের। গল্পের ক্লাইম্যাক্স ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে, যে সময়ে নানান কারণে তাঁরা খানিকটা অস্বস্তিকর জমির ওপরে দাঁড়িয়ে। কলোনিয়াল ইতিহাসের গবেষকরা মনে করেন এই জমি থেকেই জন্ম নিয়েছিল হিন্দু পুনরুত্থান বা রিভাইভালিজমের ধারণা, যার চূড়ান্ত ফলাফল হয়ে দাঁড়ায় একটা ভৌগোলিক অঞ্চলকে দেবীর রূপে দেখতে শুরু করা। ঐতিহাসিকভাবে যে কথাটা মনে রাখা দরকার, সেটা হল এই মাতৃমূর্তির জন্ম পুরাণকথা থেকে হয়নি, কারণ ভারত অ্যাজ আ স্টেট/রাষ্ট্র কনসেপ্টটা ব্রিটিশ আমলের। আজকের নেশন-স্টেটের ধারণার মতনই এই দেবীপ্রতিমার ধারণাও আদপেই "টাইমলেস" নয়, বরং এর জন্ম হয়েছিল ঊনবিংশ শতকের বাংলার কঠিন বাস্তবের মধ্যে। একের পর এক সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ধাক্কায় ক্ষতবিক্ষত বাঙালি ভদ্রলোক বাঙালি তখন পরিচয়ের সংকটে ভুগছে। সেই অবস্থার মধ্যে জাতীয়তাবাদী ইন্টেলেকচুয়ালরা একটা আধ্যাত্মিক ক্ষেত্র তৈরী করে নিয়েছিলেন — খানিকটা স্যাংচুয়ারি বলা যায় — ঘরবাড়ি সংসার, বাড়ির মেয়েরা, আর পরিবার — যে স্যাংচুয়ারিতে কলোনিয়াল শাসকের কর্তৃত্ব থাকবে না, সেই অধিকার থাকবে শুধু পরিবারের কর্তা বাঙালি ভদ্রলোকের হাতেই। এই আবহেই জন্ম হয় "দেশমাতৃকা'-র, বলা যায় বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেই, এবং অচিরেই এই মাতৃমূর্তি ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আইকন "ভারতমাতা" হয়ে ওঠে।
একটা ক্রনোলজিকাল অর্ডারে এই ঘটনাগুলো পর পর সাজাতে পারলে আমরা সেই সময়ের ছবিটা খুঁজে পাব।
এই সময়টাকে জানতে হলে আমাদের শুরু করতে হবে ১৭৯৩ সালের পার্মানেন্ট সেটলমেন্ট অ্যাক্ট, অর্থাৎ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আইন থেকে। অভিজাত হিন্দু বাঙালি ভদ্রলোক জমিদার শ্রেণী, বা ল্যান্ডহোল্ডিং ক্লাস — আমাদের গল্পের এক চরিত্র — এর জন্মও এই আইনের পরেই। এই আইন অনুযায়ী ভদ্রলোক জমিদারেরা কোম্পানি বাহাদুরকে দেওয়া পূর্বনির্ধারিত খাজনার বিনিময়ে পাকাপাকিভাবে তাদের এস্টেটের মালিক পরিচিতি পেয়ে যায়, পেয়ে যায় রায়তদের ওপর যেমন খুশী খাজনা চাপানোর স্বাধীনতা। বেসিক্যালি পরজীবী বা প্যারাসাইট বলতেই পারেন এই ক্লাসকে — কারণ এদের বেঁচে থাকা ছিল অন্যের পরিশ্রমের ফসলের ওপর নির্ভরশীল, আর একই সঙ্গে তাদের স্ট্যাটাসও পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল কলোনিয়াল শক্তির ওপর। উল্টোদিকে, এই ভদ্রলোক শ্রেণী আবার নিজেদের অধিকার আর আধিপত্যের ব্যাপারে ছিল মারাত্মক রক্ষণশীল। এই শ্রেণীরই একটা অংশের উচ্চাশা ছিল জমিদারির বাইরেও কলোনিয়াল শাসকের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার। ১৮০০ শতকের শুরুর দিকে নানান ধরণের ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে, যেমন জাহাজ বা ব্যাঙ্কিং ইত্যাদিতে বাঙালি ভদ্রলোক ভালোই পরিচিতি পেয়েছিল — দ্বারকানাথ, রামদুলাল দে (মানে ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাবা) ইত্যাদি নাম ইতিহাসে পড়ে থাকবেন। তবে ওপর ওপর আশাব্যঞ্জক হলেও খানিক অনিশ্চয়তাও ছিল সেই যুগের এই অন্ত্রপ্রনরশিপে।
অভিজাত ভদ্রলোক বাঙালির ব্যবসায়িক আশাভঙ্গ হয় ১৮৪০ নাগাদ, যখন একাধিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা এসে একের পর এক ধাক্কা মারতে শুরু করে। একাধিক ইউরোপীয় ব্যাঙ্কিং সংস্থা, যেমন ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে যায়। এই ব্যাঙ্কগুলোর আমানতে থাকা বাঙালি পুঁজি পুরোপুরি মুছে যায় বাজার থেকে। কোম্পানি সরকার এই সংকটের সময়ে জাতিবিদ্বেষের ধ্রুপদী সংজ্ঞা মেনে সাদা চামড়ার ইউরোপীয় পুঁজির স্বার্থ দেখায় মন দেয়। বাঙালি তথা ভারতীয় আমানতকারীদের কাছে একটা স্পষ্ট বার্তা পৌঁছয় — যে আধুনিক পুঁজিবাদী ভবিষ্যতের দরজা দেশীয় পুঁজিপতিদের জন্যে বন্ধ। ওসব সাহেবদের খেলার মাঠ, নেটিভ বাঙালির সেখানে জায়গা নেই। বাঙালি উচ্চবিত্ত ভদ্রলোক আচমকা ধাক্কা খেয়ে পিছু হটে আসে, আর তার নিরাপদ এলাকা, অর্থাৎ জমিজমা সম্পত্তির মধ্যে গুটিয়ে যায়। সম্ভাব্য অন্ত্রপ্রনর থেকে বাঙালি উচ্চবিত্ত ভদ্রলোক হয়ে যায় পুরোদস্তুর ভূস্বামী। তাদের পুঁজি সীমাবদ্ধ থেকে যায় খাজনা বা রেন্টের মধ্যেই। ইউরোপীয়দের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার স্বপ্ন দেখা বাঙালি ভদ্রলোক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে অন্তর্মুখী।
অর্থনৈতিক পরিসর ছোট হয়ে আসার পাশাপাশি ঊনবিংশ শতকের প্রথম ভাগে আরও দুটো বড় ধাক্কা খায় এই রক্ষণশীল হিন্দু বাঙালি ভদ্রলোক। এবং এই দুটোকেই সে দ্যাখে তার নিজের সনাতনী সাংস্কৃতিক এবং গার্হস্থ্য জীবনের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হিসেবে। প্রথম ঘটনা ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা রদের আইন এবং দ্বিতীয় ঘটনা ১৮৫৬ সালের বিধবাবিবাহ আইন। রেনেসাঁর সময় থেকে মুক্তচিন্তায় শিক্ষিত এক শ্রেণীর বাঙালি এই দুই আইনকে প্রয়োজনীয় সামাজিক সংস্কার হিসেবে দেখলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ সনাতনী হিন্দু বাঙালির কাছে এই দুটো আইন ছিল পবিত্র ধর্মীয় আচারের মূলে অযাচিত কলোনিয়াল/বিদেশী আক্রমণ। তার কারণটাও সহজবোধ্য। হিন্দু পুরুষের চিরকালীন কনসেপ্ট ছিল স্ত্রীসুলভ ভক্তি, বংশগৌরব আর বিয়ের অলঙ্ঘনীয় পবিত্রতা। সতীদাহ রদ আর বিধবাবিবাহ — দুটোই সেই চিরকালীন সনাতনী হিন্দু পৌরুষের ধারণার ওপর আক্রমণ। হিন্দু বাঙালি ভদ্রলোকের অন্দরমহলে পুরুষই ছিল সর্বময় কর্তা, তার হাতেই যেখানে নিয়ন্ত্রিত হত লিঙ্গ, জাতি আর ধর্মের সমস্ত আচার, পুরুষই ছিল পারিবারিক পবিত্রতার রক্ষক। সেই অন্দরমহলের ভিতরে কলোনিয়াল আইনের ঢুকে পড়ার ধাক্কা সমস্ত সনাতনী ধ্যানধারণাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল সেই সময়ে। রামমোহন এবং বিদ্যাসাগর সেই যুগের ভদ্রলোক বাঙালির কাছে হয়ে ওঠেন খলনায়ক।
[এবং আজও এর অন্যথা হয় না। উত্তর ভারতীয় সনাতনী হিন্দুর ডেফিনেশনে আজও স্ত্রীকে মুখ বুজে স্বামীর হুকুম মানতে হয়। আজও রক্তের শুদ্ধতা সনাতনী হিন্দুর কাছে জরুরী। এবং আজও অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে করা মানে অলঙ্ঘনীয় জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক। বেশ কয়েক দশক আমরা কিছুটা স্বাধীনভাবে ভাবতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু উত্তর ভারতীয় সনাতনী হিন্দুত্বের ছোঁয়ায় নতুন করে সনাতনী হয়ে ওঠা সেদিনের সনাতনী হিন্দু বাঙালির বংশধর আধুনিক বাঙালির মধ্যে যদি আপনি রামমোহন বা বিদ্যাসাগর সম্পর্কে একই ঘৃণার আভাস পান, তাহলে বুঝব এই লেখার উদ্দেশ্য সফল।]
১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর কোম্পানির হাত থেকে ক্ষমতা চলে যায় ব্রিটিশ সরকারের হাতে। ইংরিজী শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক তখন বিভিন্ন সরকারি অফিসে চাকরি করে। তার পরিচিতি "বাবু" হিসেবে। সে সাহেবের অনুগত কর্মচারী (যে আনুগত্য খানিকটা ১৮৫৭ সালের ব্যর্থ বিদ্রোহের ফসল), তাকে ছাড়া সাহেবের একটা দিনও চলে না। মোটামুটি এই শতকের মাঝামাঝি সময়ে সরকারি দপ্তর আর সওদাগরি অফিসে চালু হয় ঘড়ির ব্যবহার — ইউরোপীয় স্টাইলে ক্লক টাইম। বাবুর চাকরি বাঁধা পড়ে ঘড়ির নিয়মানুবর্তিতায় — দশটা পাঁচটার অফিসের বাঁধনে — বাঙালি বাবুর কাছে যেটা ছিল পুরোপুরি অচেনা একটা ব্যবস্থা। দুই দশকের মধ্যেই সাহেবের অনুগত কর্মচারীর কাছে রোজকার এই সাবর্ডিনেশন আর ঘন্টা মিনিটের চাপ ক্রমশ: দাসত্বের মত মনে হতে থাকে। অফিসের বাইরে বাড়িই তার নিরাপদ স্যাংচুয়ারি হয়ে ওঠে, যেখানে সে তার একান্ত ব্যক্তিগত কোলাহলহীন জগতের অভ্যন্তরে নীরবে ধার্মিক চিন্তাভাবনার সময় পায় — মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে যা তার বাইরের জীবনের ফাঁপা দাসত্বের একদম উলটো পিঠ। দাসত্বের চাপ মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের কাছে বোঝা হয়ে উঠতে শুরু করে।
এই সময়েই আসে ভূমিকম্প (অবশ্যই প্রতীকী অর্থে)। যে জমি ছিল অভিজাত জমিদার শ্রেণীর মূলধন বা আশ্রয়, সেই জমিই ভয়ানকভাবে কেঁপে ওঠে তাদের পায়ের নীচে — ১৮৭৩ সালে পাবনার রায়তি দাঙ্গার সময়ে। প্রধাণতঃ মুসলমান এবং নীচু জাতের হিন্দু রায়তরা বাড়তে থাকা খাজনা আর জমিদারি অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগঠিতভাবে রুখে দাঁড়ায়। জমিদার আর প্রজাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কটা পিতা ও সন্তানের মত — বহু বছর ধরে সযত্নে লালিত এই কল্পকথা রাতারাতি মুখ থুবড়ে পড়ে এই রায়তি বিদ্রোহে। তবে এই বিদ্রোহের ধাক্কার চেয়েও ভদ্রলোক জমিদারদের কাছে বড় ধাক্কা ছিল কলোনিয়াল শাসকের প্রতিক্রিয়া — অনুগত জমিদারদের প্রতি নয়, বরং রায়তদের প্রতি সরকারি সহানুভূতি, খাজনার অবস্থা যাচাই করার উদ্দেশ্যে রেন্ট কমিশন তৈরী আর প্রজার অধিকার সংক্রান্ত আলোচনার শুরু। হিন্দু বাঙালি ভদ্রলোক নিজেদের দুই দিক থেকে আক্রান্ত মনে করতে শুরু করে — একদিকে তাদের এতদিনের প্রজাদের ঔদ্ধত্য বা ইনসাবর্ডিনেশন, অন্যদিকে সরকার তরফ থেকে তাদের আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে পাওয়া বিশ্বাসঘাতকতা। সেই সময়ের বাংলা কাগজে জমিদারি সম্পত্তির ক্ষতির পাশাপাশি ফলাও করে "নীচুজাতের অপমান”-এর কথাও ছাপা হতে থাকে। লেখা হয় "নারীর অবমাননা" বা "সতীত্ব লঙ্ঘন”-এর কথাও। জমিদারি অত্যাচারের বিরুদ্ধে অপবিত্র ছোটজাত আর মুসলমানদের রুখে দাঁড়ানোর এই ঘটনা অভিজাত মধ্যবিত্ত নির্বিশেষে বাঙালি ভদ্রলোক সমাজে হয়ে দাঁড়ায় কালচারাল এবং সেক্সুয়াল পলিউশন — হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তঃপুরের ক্ষেত্রে যেটা চরমতম অপমান।
শেষ ধাক্কাটা আসে ১৮৮৩ সালে — ইলবার্ট বিলের সময়ে। ব্রিটিশ সরকার একটা আইন আনার চেষ্টা করে যাতে বলা হয় ভারতীয় (অর্থাৎ কালো চামড়ার নেটিভ) ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে ইউরোপীয়দের বিচার হতে পারবে। খুবই সাধারণ একটা মানবিক আইন — বিচারব্যবস্থায় একটা সমতা আনার উদ্দেশ্যে। কিন্তু এই প্রস্তাবিত আইনের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া ব্রিটিশ রাজের চরম জাতিবিদ্বেষকে একদম উলঙ্গ করে দেয় সকলের চোখের সামনে। সরকার এই জাতিবিদ্বেষের সামনে আত্মসমর্পণ করে এবং প্রমাণ করে দেয় যে পশ্চিমী শিক্ষা বা আনুগত্য কোন কিছুর বিনিময়েই কালো চামড়ার ভদ্রলোক "বাবু" ব্রিটিশদের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারবে না; সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে এই শিক্ষিত হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণী চিরকালই সাদা চামড়ার সাহেবের পায়ের নীচেই থাকবে, অফিস কাছারিতে দশটা পাঁচটার দাসত্ব করবে — ব্লাডি নেটিভ হিসেবে।
১৭৯৩ থেকে ১৮৯০ — এই একশো বছরের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক, কৃষি এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একের পর এক ধাক্কা খাওয়ার পর একমাত্র একটাই জায়গা হিন্দু ভদ্রলোক বাঙালির কর্তৃত্বের আওতায় থেকে গিয়েছিল — আর সেটা হল অন্দরমহলের নারীশরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ। শিশু বয়সে বিয়ে, এবং দশ বছর বয়সে রজঃস্বলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গর্ভাধানের জন্যে জোর করে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার আচারের ফলে একাধিক ১০-১২-১৪ বছরের বাচ্চা মেয়ে জবরদস্তি শারীরিক সঙ্গমের ফলে মারা যায়। আদালতে বেশ কিছু মামলা ওঠার পরে ব্রিটিশ সরকারের টনক নড়ে, এবং ১৮৯১ সালে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কারণ দেখিয়ে তারা এজ অফ কনসেন্ট বিলের প্রস্তাব আনে বিয়ের বয়স দশ থেকে বাড়িয়ে বারো করার জন্যে। প্রস্তাব আসার সঙ্গে সঙ্গেই সর্বগ্রাসী প্রতিরোধ শুরু হয় সমাজের চতুর্দিক থেকে। হিন্দু বাঙালি মনে করে মেয়েদের বিয়ের বয়স দুই বছর বাড়ানোর এই প্রস্তাব মোটেও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কারণে নয়, বরং হিন্দু আচারব্যবস্থার ওপর চরম আঘাত যার ফলে মেয়েদের গর্ভ কলুষিত হবে, বংশধারা দূষিত হবে, এবং সবচেয়ে বড় কথা, এর ফলে পতন হবে বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের শেষ দুর্গ, অর্থাৎ নারীশরীরকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতার। নারীশরীরকে নিয়ন্ত্রণের এই অধিকার রক্ষাই হয়ে ওঠে চারপাশ থেকে আক্রান্ত হিন্দুধর্মকে রক্ষা করার সমান। একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল — এই এজ অফ কনসেন্ট বিলের সময়ে, না ব্রিটিশ সরকার, না বিলের সমর্থক বা বিরোধী বাঙালি জনগণ — কেউই এই বিল আসলে যাদের জন্যে আনা, সেই মেয়েদের সম্মতি নেওয়ার কথা ভাবেনি।
[হিন্দু খতরে মে হ্যায় – এনিওয়ান?]
রেনেসাঁর আলোকপ্রাপ্ত বাঙালির প্রগতিশীল রিফর্মার থেকে হিন্দু রিভাইভালিস্ট হয়ে ওঠার গতিপথের ধারণা সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝা যায় যদি আমরা বঙ্কিমের লেখা খুঁটিয়ে দেখি। বঙ্কিমের পরিবর্তনও ঊনবিংশ শতকের এই ক্রাইসিসগুলোর মধ্যে দিয়েই এসেছিল। লেখকজীবনের একদম শুরুর দিকে বঙ্কিম ছিলেন ক্ষুরধার সমালোচক — বিশেষ করে নানান পিতৃতান্ত্রিক এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী ট্র্যাডিশনের। যেমন ধরুন "সাম্য" (যদিও পরের দিকে বঙ্কিম নিজে এই রচনাকে প্র্যাক্টিকালি অস্বীকার করেন) রচনায় বঙ্কিম এই ব্রাহ্মণ্যবাদী এবং পিতৃতান্ত্রিক আচারব্যবস্থাকে কলোনিয়াল শাসনের চেয়েও খারাপ বলে অভিহিত করেছিলেন। কপালকুণ্ডলায় নায়িকার মুখে শোনা যায় — “যদি জানিতাম যে, স্ত্রীলোকের বিবাহ দাসীত্ব, তবে কদাপি বিবাহ করিতাম না"। বা "বিষবৃক্ষ" উপন্যাসে পুরুষের বহুগামিতা এবং কামনা, ব্রাহ্মণ্যবাদের নানান আচারের মধ্যে মেয়েদের দমবন্ধ করা অবস্থার সরাসরি সমালোচনা পাওয়া যায়। এই পিরিয়ডে বঙ্কিম পশ্চিমী ধ্যানধারণার আদলেই সামাজিক গোঁড়ামোকে আঘাত করেছিলেন। ব্যঙ্গ করেছিলেন ইংরিজী চালচলনের নকলকারী বাবুদেরও। আবার, বঙ্কিমের ধারণা যে খানিক ফ্র্যাকচার্ড ছিল, তারও প্রমাণ পাওয়া যায় ১৮৭৫ সালে লেখা কমলাকান্তে যেখানে তিনি স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যাওয়া নারীর মধ্যে স্ত্রীলোকের আসল রূপ কল্পনা করেন —
"যখন আমি উৎকৃষ্টা, যোষিদ্বর্গের বিষয়ে চিন্তা করিতে যাই, তখনই আমার মানস—পটে, সহমরণপ্রবৃত্তা সতীর মূর্ত্তি জাগিয়া উঠে। আমি দেখিতে পাই যে, চিতা জ্বলিতেছে, পতির পদ সাদরে বক্ষে ধারণ করিয়া প্রজ্বলিত হুতাশন মধ্যে সাধ্বী বসিয়া আছেন। আস্তে আস্তে বহ্নি বিস্ত‌ৃত হইতেছে, এক অঙ্গ দগ্ধ করিয়া অপর অঙ্গে প্রবেশ করিতেছে। অগ্নিদগ্ধা স্বামিচরণ ধ্যান করিতেছেন, মধ্যে মধ্যে হরিবোল বলিতে বলিতেছেন বা সঙ্কেত করিতেছেন। দৈহিক ক্লেশ-পরিচায়ক লক্ষণ নাই। আনন প্রফুল্ল। ক্রমে পাবকশিখা বাড়িল, জীবন ছাড়িল, কায়া ভস্মীভূত হইল। ধন্য সহিষ্ণুতা! ধন্য প্রীতি! ধন্য ভক্তি!" [স্ত্রীলোকের রূপ, কমলাকান্ত]
কিন্তু ওই পাবনা রায়ট, ইলবার্ট বিল এবং এজ অফ কনসেন্ট বিল নিয়ে কূটকচালির সময় থেকেই বঙ্কিমের বদলের ট্র্যাজেক্টরিটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বিশেষ করে রেভারেন্ড হেস্টির সঙ্গে ১৮৮২ সালের একটা বিতর্কের পর থেকেই। রেভারেন্ড হেস্টি (স্কটিশ থিওলজিয়ান এবং স্কটিশ চার্চ কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল) সনাতনী হিন্দু ধ্যানধারণাকে আক্রমণ করেছিলেন ব্যাকওয়ার্ড বলে (কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ক্রিশ্চানিটি অ্যান্ড কমন সেন্স অফ ম্যানকাইন্ড বলে একটা পাবলিক লেকচার সিরিজে) — মূলতঃ মূর্তিপূজা, এথিকস (যেখানে কৃষ্ণের লীলাপ্রসঙ্গ উঠে আসে) এবং র্যাশনালিটি নিয়ে। বঙ্কিম সম্পর্কে অভিযোগ করেন যে তিনি পাশ্চাত্য চিন্তাভাবনা থেকে সিলেক্টিভলি কিছু কিছু জিনিস বেছে নিয়েছেন, এবং হিপোক্রিটের মত হিন্দুধর্মকে ডিফেন্ড করেছেন। ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে বাংলার শিক্ষিত ভদ্রলোক সমাজের সার্বিক অসহায়তার অনুভূতি থেকেই বঙ্কিমের মধ্যেও বদল আসতে শুরু করে। হেস্টির আক্রমণের জবাবে বঙ্কিম বঙ্গদর্শনে একাধিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, এবং এই বিতর্কের পর থেকেই হিন্দু রিভাইভালিজমের ছাপ দেখতে পাওয়া যায় বঙ্কিমের পরবর্তী রচনাগুলোতে — যেমন কৃষ্ণচরিত্র, ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি।
বঙ্কিম তাঁর আগের প্রগতিশীল রচনাগুলোকে অস্বীকার করতে শুরু করেন (সাম্য ফর এগজাম্পল), পাশাপাশি গড়তে শুরু করেন জাতীয়তাবাদের একটা নতুন ছবি, যেখানে দেশপ্রেম একই সঙ্গে মিলিট্যান্ট এবং ভক্তিমূলক।
জন্ম হয় দেশমাতৃকার আইডিয়ার — ১৮৮২ সালে আনন্দমঠের মধ্যে দিয়ে। কলমের আঁচড়ে বঙ্কিম সংঘাতের কেন্দ্রে থাকা এই পবিত্র, বিপন্ন, আদর্শ হিন্দু নারীসত্ত্বাকে রূপান্তরিত করলেন এক দেবী চরিত্রে। আঁকলেন পূর্বের গৌরবের ছবি (মা যাহা ছিলেন — সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা), ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষের আবহে আঁকলেন কালরূপিণী এক নারীকে (মা যাহা হইয়াছেন — অত্যাচারী শাসকের হাতে দেশ যখন শোষিত, দরিদ্র, এবং মৃতপ্রায়), এবং কোন এক ভবিষ্যতে বিদেশী শাসনের অবসানের পর বাংলাপ্রদেশের আইকন — দেবী দুর্গা (মা যাহা হইবেন — দশপ্রহরণধারিণী)। এই মাতৃরূপিণীর দেহ হয়ে উঠল গোটা জাতির মানচিত্র — পবিত্র এবং অলঙ্ঘনীয়, যে কোন কলোনিয়াল আইন বা জমির খাজনার আন্দোলন থেকে বহু দূরের এক সত্ত্বা।
এই মাতৃমূর্তি বা ডিভাইন মাদার, বাঙালি ভদ্রলোকের এতদিনের অপমানের জবাব দেওয়ার এক রাস্তা খুলে দিল। এইখানে একটা জিনিস ক্ল্যারিফাই করে দেওয়া দরকার — এই বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণীকে একটা মনোলিথিক ব্লক হিসেবে দেখলে ভুল করা হবে। এই ভদ্রলোক শ্রেণীর মধ্যে স্তরবিন্যাস ছিল। একদম ওপরে ছিল অভিজাত ল্যান্ডেড ক্লাস, যাদের মূল উৎকন্ঠা ছিল পাবনা রায়তি বিদ্রোহ আর রেন্ট অ্যাক্টকে ঘিরে — মুসলমান এবং নীচু জাতের বিদ্রোহ ছিল তাদের অথরিটির প্রতি চ্যালেঞ্জ, এবং কলোনিয়াল সরকারের প্রতি ক্ষোভ তৈরী হয় এইখান থেকেই। এই অভিজাত শ্রেণীর নীচের স্তরে ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত — প্রধাণত: চাকরিজীবী — যারা সেই মুহূর্তে ক্রমাগত বর্ণবিদ্বেষ, পৌরুষত্ব নিয়ে উপহাস আর ঘন্টা-মিনিটের জাঁতাকলে আটকে পড়েছিল। দেশমাতৃকার মূর্তি ওপর থেকে নীচ অবধি পুরো ভদ্রলোক শ্রেণীর কাছেই অ্যাপীল করে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, আদালতে, বা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুরুষত্বহীন ভদ্রলোক নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করল এই দেশমাতৃকার একনিষ্ঠ সন্তান এবং রক্ষক হিসেবে। তার রাজনৈতিক অক্ষমতা বদলে গেল পবিত্র সামরিক কর্তব্যে। তার আহত পৌরুষের নিরাময় হল বীরের আত্মত্যাগের প্রতিশ্রুতিতে। নানান জটিল সামাজিক সংস্কার আর বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের কাছে পিটিশন দিয়ে আপোস করার বদলে জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠল আবেগ আর ভক্তির মিশেলের পবিত্র ধর্মযুদ্ধ।
এই ছিল দেশমাতৃকার জন্মের ঐতিহাসিক পটভূমি — অনেকদিন ধরে চলে আসা ক্রাইসিসের মধ্যে থেকে তৈরী হওয়া বিপন্ন মাতৃমূর্তি, যাকে যে কোন মূল্যে রক্ষা করা মায়ের যে কোন সন্তানের কর্তব্য।
এই অবধি কোন গোল নেই, সাধারণভাবে গোটা ব্যাকগ্রাউন্ডটা খানিক জটিল হলেও। শুধু প্রশ্ন থেকে যায় বঙ্কিমের এই দেশমাতৃকা কবে এবং কীভাবে ভারতমাতা হয়ে উঠলেন?
বঙ্কিমের মূল উপন্যাসের দিকে যদি তাকাই, দেখব আনন্দমঠে সন্তানদের মূলশত্রু মুসলমান নবাব এবং অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকের দুর্নীতিগ্রস্ত ক্ষয়িষ্ণু মুঘল প্রশাসন। আনন্দমঠের শেষাংশে ব্রিটিশ শত্রু তো নয়ই, বরং শান্তি, শৃঙ্খলা ও ন্যায়ের শাসনের প্রবর্তক — সত্যানন্দ ও চিকিৎসক/মহাপুরুষের মধ্যে বাক্যালাপ মনে করুন...তাহলে, স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে এই ব্রিটিশপন্থী, মুসলিমবিরোধী আখ্যান কীভাবে উপনিবেশ—বিরোধী জাতীয়তাবাদের বাইবেল হয়ে উঠল?
আনন্দমঠ, দেশমাতৃকা আর বন্দেমাতরমের এই ট্রান্সফর্মেশন ঘটেছিল জাতীয়তাবাদের স্ট্র্যাটেজিক কারণে। বঙ্কিম নিজে ১৮৮০-র দশকে বসে ১৭৭০ সালের সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পটভূমিতে আনন্দমঠ লিখেছিলেন। তাঁর প্রজন্মের কাছে ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে একটা কমপ্লিকেটেড ও খানিক মোহভঙ্গের দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও আশাবাদ পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। সেই প্রজন্ম ব্রিটিশ শাসনকে হিন্দু অনৈক্য এবং দুর্বলতার সাজা হিসেবে দেখেছিল, আর ব্রিটিশ শাসককে দেখেছিল আধুনিকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবাদের শিক্ষা দেওয়া স্কুলমাস্টার হিসেবে — যাদের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ভারতীয় হিন্দুরা একদিন স্বশাসনের যোগ্য হয়ে উঠতে পারে।
“সনাতনধর্মের পুনরুদ্ধার করিতে গেলে, আগে বহির্বিষয়ক জ্ঞানের প্রচার করা আবশ্যক। এখন এদেশে বহির্বিষয়ক জ্ঞান নাই — শিখায় এমন লোক নাই; আমরা লোকশিক্ষায় পটু নহি। অতএব ভিন্ন দেশ হইতে বহির্বিষয়ক জ্ঞান আনিতে হইবে। ইংরেজ বহির্বিষয়ক জ্ঞানে অতি সুপণ্ডিত, লোকশিক্ষায় বড় সুপটু। সুতরাং ইংরেজকে রাজা করিব। ইংরেজী শিক্ষায় এদেশীয় লোক বহিস্তত্ত্বে সুশিক্ষিত হইয়া অন্তস্তত্ত্ব বুঝিতে সক্ষম হইবে। তখন সনাতনধর্ম প্রচারের আর বিঘ্ন থাকিবে না। তখন প্রকৃত ধর্ম আপনা আপনি পুনরুদ্দীপ্ত হইবে। যত দিন না তা হয়, যত দিন না হিন্দু আবার জ্ঞানবান গুণবান আর বলবান হয়, তত দিন ইংরেজরাজ্য অক্ষয় থাকিবে। ইংরেজরাজ্যে প্রজা সুখী হইবে — নিষ্কণ্টকে ধর্মাচরণ করিবে। অতএব হে বুদ্ধিমান — ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধে নিরস্ত হইয়া আমার অনুসরণ কর।" [আনন্দমঠ]
বঙ্কিমের এক প্রজন্ম পরে, ১৯০৫ সালে স্বদেশী আন্দোলনের সময়, রাজনৈতিক আবহাওয়া ক্রমশঃ আরও উগ্র হয়ে ওঠে। দুর্ভিক্ষ, জাতিবিদ্বেষ, আর বঙ্গভঙ্গের পরে সাধারণ মানুষের ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে হতাশ হতে শুরু করে। অরবিন্দ ঘোষের মত বিপ্লবীরা মনে করতে শুরু করেন যে তাঁদের গণআন্দোলনের জন্যে প্রয়োজন একটা শক্তিশালী প্রতীকের। এবং শুধুমাত্র স্ট্র্যাটেজিক কারণেই তাঁরা আনন্দমঠের একটা সিলেক্টিভ ন্যারেটিভ বেছে নেন, যেখানে উপন্যাসের শেষে ব্রিটিশপন্থী অংশটুকু বাদ দেওয়া হয়। গল্প শেষ হয় যুদ্ধের ধ্বনি দিয়ে, ব্রিটিশ শাসনকে বৈধতা দেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে নয়। একটা কথা মাথায় রাখবেন — আনন্দমঠ লেখা হয়েছিল তৎকালীন বাংলা প্রদেশের (মানে সুবাহ্‌ বাংলা — বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা মিলিয়ে যে প্রদেশ) পটভূমিতে। "সপ্তকোটিকন্ঠ কলকলনিনাদকরালে, দ্বিসপ্তকোটি ভূজৈঃধৃত খরকরবালে" — এখানে সপ্তকোটি অর্থাৎ সাত কোটি সেই সময়ের সেন্সাস অনুযায়ী বাংলা প্রদেশের জনসংখ্যা। এবং ইন্টারেস্টিংলি, সেই জনতার মধ্যে হিন্দু এবং মুসলমান, সকলেই ছিল। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রয়োজনে বাংলায় অরবিন্দ, মহারাষ্ট্রে তিলক, আর তামিল প্রদেশে সুব্রমনিয়া ভারতীর হাত ধরে বঙ্কিমের দেশমাতৃকা হয়ে উঠলেন ভারতমাতা, ভারতীয় উপমহাদেশের ম্যাপ হয়ে উঠল ভারতমাতার দেহ, বাংলার সাত কোটি সন্তানের বদলে যার অ্যাপীল ছড়িয় পড়ল সমস্ত দেশবাসীর কাছে, শত্রু আর কোন বিশেষ ধর্মালম্বী রইল না, বরং হয়ে উঠল যে কোন বিদেশী শাসক। মূল উপন্যাস থেকে বন্দেমাতরমকে বের করে আনা হল জাতীয়তাবাদী স্লোগান হিসেবে।
কিন্তু কিছু সমস্যা থেকেই গেল। বন্দেমাতরমের দেবী হিন্দু দেবী, তার ভাষা সংস্কৃত ও বাংলার মিশেল। কিন্তু বাস্তবে অনেক মুসলমান ধর্মাবলম্বীর কাছে এই প্রকট হিন্দু ইমেজকে সরাসরি গ্রহণ করা একটু সমস্যার হয়ে পড়েছিল ধর্মীয় কারণে, এবং সেটা অযৌক্তিকও নয়। মাথা ঠাণ্ডা করে ভেবে দেখলে এটা আপনারও মনে হবে — যদি আপনাকে এলিয়েন কোন ধর্মীয় স্লোগান দিয়ে কোন জাতীয় অনুষ্ঠানে যেতে হয়। নাস্তিকদের তো যে কোন ধর্মীয় চিহ্নেই অস্বস্তি হবে। তিরিশের দশকে এই বিষয়টা বড়সড় চর্চায় আসে। সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথের পরামর্শে বন্দেমাতরমের প্রথম দুটো স্তবককে আলাদা করে আনার পরেও কিছু ক্ষেত্রে অস্বস্তি থেকেই গিয়েছিল। যেমন, মুসলিম লীগ এই গানের দিকে আঙুল তুলে বলত কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষতা আসলে হিপোক্রেসি, ভুয়ো। উল্টোদিকে হিন্দু দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদের কাছে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ হয়ে দাঁড়ায় ভারতমাতার পবিত্র শরীর থেকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আলাদা করে দেওয়ার সামিল। হিন্দু মহাসভার পোস্টারে বা প্যামফ্লেটে রক্তাক্ত ছিন্ন অঙ্গের ভারতমাতার ছবি ছাপা হত সেই সময়ে...
আমাদের দুর্ভাগ্য, যে এইখান থেকেই শুরু হয়েছিল ভারতমাতার আইডিয়ার ওয়েপনাইজেশন। ঔপনিবেশিক অপমানের জবাব দেওয়ার প্রতীক হিন্দু জাতীয়তাবাদের হাতে হয়ে দাঁড়িয়েছিল সংখ্যাগুরুর অস্ত্র। আজও তার ব্যতিক্রম হয় না, উলটে এই ধারণা আরো পোক্ত হয়েছে বিভিন্ন কারণে। সঙ্ঘ পরিবারের ভারতমাতার প্রতি শ্রদ্ধা বা বন্দেমাতরমের প্রতি আজকের পীরিত আসলে তাদের নিজেদের প্রতিচ্ছবি হিসেবে ভারতকে দেখার উদাহরণ — যেখানে ভারত দেশটাকে ভালোবাসা মানে ভারতমাতার মূর্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো; দেশের মানুষ, নদী, বনজঙ্গল, পাহাড়, পশু পাখি সেখানে গৌণ; এখানে দ্বিধা মানে অবাধ্যতা, দেশদ্রোহ। নিজস্ব পলিটিকাল এজেন্ডার রূপায়ণের উদ্দেশ্যেই সঙ্ঘ পরিবার রামজন্মভূমি আন্দোলনকে রামের পবিত্র ভূখণ্ডকে মুক্ত করার ধর্মযুদ্ধ হিসেবে দেখিয়েছিল। বন্দেমাতরম এদের কাছে দেশপ্রেমের নামে প্রশ্নহীন ভক্তিমূলক আনুগত্যের প্রতীক...
=========================================
ভারতমাতার জন্মের গল্প এইটুকুই। প্রাচীন পুরাণকথা থেকে তাঁর জন্ম হয়নি। বরং, বাস্তবে শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোকের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের আগুনে তাঁকে তৈরী করা হয়েছিল। তাঁর সশস্ত্র মূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে ব্যাঙ্ক ফেলিওর, রেন্ট স্ট্রাইক, জাতিবিদ্বেষ, নারীর অধিকার-বাল্যবিবাহ-বৈধব্য ইত্যাদি নিয়ে আদালত এবং সেই সময়ের সমাজমাধ্যমে তির্যক বিতর্কের ইতিহাসের ওপর। তিনি ঊনবিংশ শতকের কঠিন বাস্তবের মাটিতে হেরে যাওয়া হিন্দু ভদ্রলোকের শেষ আশ্রয় — এক কল্পিত অলঙ্ঘনীয় দেবীমন্দিরের প্রতিমা, উঠতি অ্যান্টিকলোনিয়াল "ইম্যাজিনড কমিউনিটির" ভিত্তি, যাঁকে ঘিরে এক বিচিত্র ভূখণ্ডের নানান ধরণের বৈচিত্রসম্পন্ন অসংখ্য মানুষ এক হয়ে দাঁড়িয়েছিল কলোনিয়াল শাসকের বিরুদ্ধে। আবার একই সঙ্গে তাঁর হিন্দু রূপের জন্যেই অহিন্দুদের সামনে অলঙ্ঘনীয় সীমানা তৈরী হয়েছিল একটা সময়ে। যাদের বিশ্বাস বা ওয়ার্ল্ডভিউ কোন দেবদেবীর প্রতি শ্রদ্ধাপ্রদর্শনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি, তাদের শুরু থেকেই "অপর" করে রাখা হয়েছে।
ভারতমাতার লিগ্যাসি কাজেই অস্পষ্ট। যে প্রতীক কলোনিয়াল শাসকের বিরুদ্ধে ছিল শক্তিশালী অস্ত্র — একটা, সাহস আর আইডেন্টিটির উৎস — সেই একই প্রতীকের ডিএনএর মধ্যেই লুকিয়ে থেকেছে সংখ্যাগুরুর গা-জোয়ারি। স্বাধীনতার পর থেকেই এই লুকিয়ে থাকা শক্তিকে খুঁচিয়ে জাগিয়ে তুলেছে সঙ্ঘপরিবার। "মা যা হইবেন" — দশপ্রহরণধারিণীর পরিবর্তে "মা যা হইয়াছেন" — দেশপ্রেমের এক লিটমাস টেস্ট — যার মাধ্যমে বহিরাগত "অপর"-কে চিহ্নিত করা যায়। ভারতমাতার গল্প তাই যতটা না পবিত্র দেশপ্রেমের কাহিনী, তার চেয়ে অনেক বেশি জাতীয়তাবাদের ধারালো দ্বিমুখী তরোয়াল সম্পর্কে শিক্ষা — যে প্রতীক স্বাধীনতার লড়াইয়ে লক্ষ মানুষের স্লোগান হতে পারে, লক্ষ মানুষকে এক করতে পারে, সেই একই প্রতীক নতুন ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে এক দেশ — এক ধর্ম — এক ভাষা — এক পোশাক — এক খাদ্যাভ্যাসের নামে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ইউনিফর্মিটির হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে, উলটে সামাজিক বিভেদকে তীব্র করার অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে।
আধুনিক নেশন-স্টেট নিজেদের লেজিটিমাইজ করার জন্যে যে ধরণের কাহিনী ব্যবহার করে, ভারতমাতা সেই সমস্ত কাহিনীর মধ্যে একইসাথে লুকিয়ে থাকা ঐক্য এবং বিভাজনের ক্ষমতার টেস্টামেন্ট।
রেফারেন্স (ইন নো পার্টিকুলার অর্ডার):
(১) Hindu Wife, Hindu Nation: Community, Religion, and Cultural Nationalism, Tanika Sarkar, Permanent Black
(২) Rebels, Wives, Saints: Designing Selves and Nations in Colonial Times, Tanika Sarkar, Permanent Black
(৩) The Truths and Lies of Nationalism as Narrated by Charvak, Partha Chatterjee, State University of New York
(৪) The Unhappy Consciousness: Bankimchandra Chattopadhyay and the Formation of Nationalist Discourse in India, Sudipta Kaviraj, OUP India
(৫) The Swadeshi Movement in Bengal, Sumit Sarkar, People’s Publishing House
(৬) ‘Kaliyuga’, ‘Chakri’ and ‘Bhakti’: Ramakrishna and His Times, Sumit Sarkar, Economic and Political Weekly, Vol 27, No 29, Jul 18 1992
(৭) Colonial masculinity: The 'manly Englishman' and the 'effeminate Bengali' in the late nineteenth century, Mrinalini Sinha, Manchester University Press
(৮) Imagined Communities: Reflections on the Origin and Spread of Nationalism, Benedict Anderson, Verso

বৃহস্পতিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২৫

তাজ মহল ও একটি কিশোর ~ শৈবাল বিষ্ণু

যমুনার কালো জলে হালকা হাওয়ার পরশ, সামান্য ঢেউ, পাখিরা তাদের বাড়ি ফিরে গেছে, সন্ধ্যার প্রদীপ জ্বলে উঠেছে ঘরে ঘরে। বারো বছরের এক কিশোর তখনও বিভোর হয়ে আছে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শিল্পকর্ম সহ এক আশ্চর্য্য সৃষ্টির সামনে। বিকেলে প্রথম দর্শনে তেমন আপ্লুত না হলেও, চারিপাশ ফাঁকা হয়ে আসার পরে, পুরো পরিবেশটা যেন গ্রাস করে নিল, আচ্ছন্ন করলো অস্তিত্ব। কিশোর কোনোভাবে একা হয়ে গেছিল। তার সাথের মানুষজন একটু অন্য দিকে সবাই। 

বেটা আপ কাহাঁসে আয়ে হো? সম্বিত ফিরল পাশে বসা সাদা দাড়িওয়ালা অতি বৃদ্ধ মানুষটির কথায়। বললেন, উনি এখানেই থাকেন, উনি কোনোভাবে মুঘলদেরই বংশধর। ফুল ধুপ ধুনো দেন, ওনাদের রীতি নীতি অনুযায়ী ধর্মীয় কাজগুলো করেন, সরকার থেকে ভাতা পান। 

বললেন আমি কি আসল সমাধি দেখতে ইচ্ছুক? অবশ্যই! আমি চললাম ওনার সাথে। জানতামও না যে যে সমাধি দেখলাম সেই দুটো আসল নয়, আসল গুলো আরো নিচে। সবাই যে সমাধি দেখে, সেই দুটো সমাধিই নয়।

তালা খুলে খুব সরু একটা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নিয়ে গেলেন। উনি দেখালেন। আলো দিলেন। চোখ বন্ধ করে কিছু একটা বিড়বিড় করে বললেন। মমতাজ আর শাহ জাহান শুয়ে আছেন সামনে।

বললেন এবারে ফিরে চল বেটা। আর ভুলেও একবারও পিছনে তাকাবেনা। সোজা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে বাইরের চত্বরে ফাঁকা আকাশের নিচে চলে যাও। ফিরে তাকিও না। তাজ মহলের সব দরজা বন্ধ হবে এবারে, এরপর এক মুহুর্ত থাকলেও আটকে যাবে।

আমিও কিছু না ভেবে উঠে এলাম। বাবা মা কাকু কাকিমারা আমাকে খুঁজছিল। আমাকে দেখে নিশ্চিন্ত হলো। সেই মুহূর্তে ফিরে তাকালাম একবার। 

পুরো চত্বর ফাঁকা। আমরা গুটি কয়েক ট্যুরিস্ট, পনেরো ষোলজন খুউব বেশী হলে। অতি বৃদ্ধ নেই।

চার পাঁচজন সিকিউরিটি এসে সব দরজা শিকল তুলে দিয়ে আমাদের বেরোতে বললো, কারণ প্রায় আটটা বাজে। তাজ মহল বন্ধ হবে।

আবার ফিরে তাকালাম। নাহ্! কেউ কোত্থাও নেই।

ওই সিকিউরিটির লোকজন কে জিগালাম, আচ্ছা এক বয়স্ক সাদা দাড়িওয়ালা মানুষ, ওনারা দেখেছেন? জানেন? 

না, ওনারা জানেন না। দেখেননি কোনোদিন। আর কেউই দেখেনি। কোনোদিন।

অনেক বছর পরে সেই কিশোর খুঁজে দেখবে, সেই দিনটা ছিল ১৭ই জুন। মমতাজের মৃত্যুদিন!


রবিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৫

চুনো মাছ ও বাল্যকাল ~ অনিমেষ বৈশ্য

মাছের বাজারে গিয়ে দেখলাম, একটা বড় হাঁড়িতে হরেক কিসিমের চুনো মাছ খলবল করছে। কী নেই তাতে? খোলসে, পুঁটি, মৌরলা, চাঁদা, বেলে মাছ...। আরও কত কী! বহুদিন খোলসে (বাঙালরা বলে, খোইলসা) খাইনি। এমনকী চোখেও দেখিনি। কত মাছ যে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, তার হিসেব নেই। কিংবা হয়তো আছে। আমি জানি না। 
বিদেশি দ্রব্যে বাজার ছেয়ে গেছে। কিন্তু মাছের ভুবনায়ন কি হয়েছে? মানে, ত্রিনিদাদের মাছ তেঘরিয়ায় বিক্কিরি হচ্ছে, এমন তো শোনা যায়নি। তা হলে এই চুনো মাছগুলো গেল কোথায়? কোন আঘাটায়?  জলা বুজিয়ে যে অসংখ্য ফ্ল্যাট মাথা তুলেছে, তার ধারেকাছে গেলে হয়তো  চুনোমাছের আত্মার ফিসফিসানি শোনা যাবে।
তা সেই বড় চুনো মাছের হাঁড়ির সামনে ভনভন করছে লোকজন। হেমন্তের ভোর। মাছের বাজারের জলে পায়ের পাতা ভিজে যাচ্ছে। সবাই ওই মাছ কিনতে চায়। ভিড় ঠেলে আমিও নিলাম সেরটাক। নানা জাতের মাছ আমার ঝোলায়। আজ মাছের বিয়ে। ওরা বরযাত্রী যাচ্ছে। গায়ক-অভিনেতা অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় মঞ্চে উঠে একদা মাছের বিয়ে গানটি খুব গাইতেন। এখনও গান কি না, জানি না। তবে গানটি আমার কানে লেগে আছে। গানটা শুরু হচ্ছে এই ভাবে----চ্যাং মাছে বলে মাঝিভাই/ আমাকে না মারিও মাঝিভাই/ আমাকে না মারিও...। কেন চ্যাং মাছের নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার এই কাতর আবেদন? শোনা যাক গায়ক কী গাইছেন----আরে কাইল  দারিকার হইব বিয়ারে/ আমি বইরযাত্রী যামু/ আরে ও আমারই ক্যাকুইমাসি, মেনকাদিদি, বৌভুলানি, মাথাঠেঙানি, পেছাদুলকি, ঠ্যাংদিগিলা, জটাবোগিলা...আলুকশালুক শালুক ননদি...মা হইব মৌরলা, কাইল দারিকার হইব বিয়া, আজও চান্দা না আইল রে...।
এমন অদ্ভুত দুলে দুলে গাইতেন অরিন্দম যে, দর্শকরাও দুলে উঠত। বিয়েতে মা সাজবে মৌরলা, কিন্তু বাউন্ডুলে চান্দা মাছ গেল কোথায়? সে তো এখনও এল না। সাইকেলে ঝোলাটা আটকে আমিও মন খুলে গাইতে শুরু করলাম---আরে ও আমারই ক্যাকুইমাসি, মেনকাদিদি, বৌভুলানি, মাথাঠেঙানি, পেছাদুলকি, জটাবগিলা...(ভুল লিখলে ক্ষমা প্রার্থনীয়)। দুরন্ত ছন্দের গানটি গেয়ে শিরা-ধমনি এমন চলকে উঠল, মনে হল, বাল্যকাল ফিরে পেয়েছি। আমার এই এক দুরারোগ্য রোগ। যেখানে ছিটেফোঁটা বাল্যকালের সন্ধান পাই, সেখানেই থানা গেড়ে বসে পড়ি। হেমন্তের শিরশিরে হাওয়াও কোন সুদূর থেকে বাল্যকাল ডেকে আনে। কার্তিকের জ্যোৎস্না, হিমমাখা ভোর আমাকে আছড়ে ফেলে ফসলের খেতে। 
তা যাই হোক, আমরা রোজ খাল, বিল, পুকুর বুজিয়ে ফেলছি। আসলে ঠিক খাল-বিল বুজিয়ে ফেলছি না। আত্মাকে গলা টিপে খুন করছি। আমার বাড়ির অদূরে একটি ইটখোলা ছিল। তাতে ছিল খানতিনেক গভীর পুকুর। সেই পুকুরে মাছ ধরার টিকিট বিক্কিরি হতো। টিকিট কেটে লোকজন মাছ ধরত। মাছের চারের যে কত সম্মোহনী গন্ধ থাকতে পারে, তা পুকুর ধারে না-গেলে বোঝা যেত না। কেউ কেউ উৎকৃষ্ট মানের সুরা মাছের টোপে মাখিয়ে দিতেন। মাছও যে মদ্যপ হয়, সেটা ওই পুকুর ধারে বসে জেনেছি। কয়েক হাত অন্তর ছিপ ফেলে ফাতনার দিকে তাকিয়ে আছে মৎস্যশিকারিরা। উপরে সুনীল আকাশ। অদ্ভুত এক নীরব মেলা। এত মানুষ বসে আছে। কিন্তু কেউ কোনও কথা বলছে না। পাছে মাছ পালিয়ে যায়। মাছ যে গোলযোগ সইতে পারে না। তা সেই পুকুরগুলো আর নেই। সেখানে ফ্ল্যাট উঠেছে। একটি পুকুরকে সুইমিং পুল বানানো হয়েছে। কিন্তু পুকুর আর সুইমিং পুল এক জিনিস নয়। পুকুরে শালুক ফোটে, পুকুরের গভীরে ডুব দিয়ে ছেলেরা মাটি তুলে আনে, পুকুরে ঝিনুক থাকে, পুকুরের জলে সর পড়ে, পুকুরে কার্তিকের চাঁদ জ্যোৎস্না ঢেলে নিজের বাসা খোঁজে। এই পুকুরেই ছিল খোলসে, চাঁদা, পুঁটি মাছের বসত। আমরাই ওদের বাসা কেড়ে নিয়েছি। এখন কেঁদে কী হবে? মাছের বিয়ের গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরে মাছের ঝোলাটা রাখলাম নীচে। দু-একটা মুক্তিকামী মাছের মুখ উঁকি মারছে আমার দিকে। ওগুলো কি সত্যিই মাছের মুখ? নাহ। ওরা বাংলার মুখ। হেমন্তের ভোরে মাছের ঝোলায় খলবল করছে আমার বাংলা।
পৃথিবীর রূপ খোঁজার আর দরকার কী?

শনিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৫

শ্রম কোড কেন বিপদজনক ~ কুশল দেবনাথ

চারটি শ্রম কোড কেন বাতিল করতে হবে

বিজেপি-পরিচালিত এনডিএ সরকার ২৯টি শ্রম আইনকে চারটি লেবার কোডে পরিণত করে সংসদে পাশ করেছে। এই আইন কার্যকর করা যাচ্ছিল না, তার কারণ বিধি (rules) তৈরি হয়নি। বিধি তৈরি না হলে কোনো আইন লাগু করা যায় না। পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের তিনটি রাজ্য বাদ দিয়ে সব রাজ্যই ইতিমধ্যে বিধি তৈরি করেছে। এ বছরের গোড়ায় কেন্দ্রীয় শ্রম দপ্তর ঘোষণা করেছিল, পয়লা এপ্রিল ২০২৫ থেকে সারা দেশে শ্রম কোড লাগু করা হবে। শেষ অবধি তা হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন হল, সারা ভারতে যখন শ্রম কোড চালু হবে, তখন পশ্চিমবঙ্গেও কি আইন লাগু হবে? হ্যাঁ হবে, কারণ শ্রম যে হেতু যুগ্ম তালিকাভুক্ত, তাই কেন্দ্রীয় সরকার নোটিফিকেশন জারি করতে পারে যে, যে রাজ্যগুলি বিধি তৈরি করেনি, সেগুলিতেও কেন্দ্রীয় বিধি লাগু হবে।
২০২০ সালে তিনটি কৃষি আইন ও চারটি শ্রম কোড লোক সভায় বিল আকারে পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্বার কৃষক আন্দোলনের জেরে কেন্দ্রীয় সরকার তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। শ্রম কোডের বিরুদ্ধে গোটা দেশে বিভিন্ন ধরনের ট্রেড ইউনিয়ন যে প্রতিবাদ করেনি, এমনটা নয়। কিন্তু সেই প্রতিবাদের ধার অনেক কম ছিল। শ্রমিক আন্দোলনের দুর্বলতার জন্যই আজ গোটা দেশে শ্রম কোড লাগু হতে চলেছে।
প্রশ্ন আসে, বিভিন্ন সময় আমাদের দেশে যে শ্রম আইন এসেছিল, তার সাথে এই চারটি শ্রম কোডের পার্থক্যটা কী? এ যাবৎ কালে যে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে শ্রম আইন এসেছিল, তার প্রত্যেকটিরই আলাদা আলাদা উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু এই চারটি শ্রম কোড ভিন্ন ভিন্ন আইনকে একটা সূত্রে গেঁথে দিয়েছে। তাই প্রতিটা আইনের যে আলাদা আলাদা উদ্দেশ্যগুলি ছিল, সেগুলি তুলে নেওয়া হয়েছে। একটু উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক। ১৯৭০ সালে যখন 'কন্ট্র্যাক্ট লেবার (রেগুলেশন ও অ্যাবোলিশন)' আইন আসে, তার উদ্দেশ্য ছিল ঠিকা শ্রমিকদের কাজের নিয়মাবলী নির্দিষ্ট করা, ও ঠিকা প্রথার অবসান ঘটানো। যদিও ঐ আইনে ঠিকা শ্রম নির্মূল করা বা 'অ্যাবোলিশন'-এর কোনো কথা লেখা হয়নি, তবু এই উদ্দেশ্যে আইনটি তৈরি হয়েছিল। এ বারে 'অক্যুপেশনাল সেফটি, হেল্থ এবং ওয়ার্কিং কনডিশন' ২০২০ নামক শ্রম কোডটিতে ঠিকা শ্রমিকের বিষয়টা অন্তর্ভুক্ত করা হোলো। ফলে ঠিকা শ্রমিকদের জন্য ১৯৭০ সালে প্রণীত মূল আইনটির তাৎপর্যই হারিয়ে গেল। আমরা দেখি, এই কোডের বিষয়টির 'উদ্দেশ্য' হিসেবে লেখা রয়েছে, পেশাগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও কাজের অবস্থা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ঠিকা শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার যে মূল উদ্দেশ্য ছিল, যার জন্য আইনে ঠিকাদারদের লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল, প্রধান নিয়োগকারীকে সময়মতো মজুরি মেটাতে, এবং অন্যান্য সুবিধা ঠিকা শ্রমিকদের দিতে বাধ্য করা হয়েছিল — সে সব কিছুই আর নতুন আইনে নেই।
আমরা যদি চারটি শ্রম কোড খুঁটিয়ে পড়ি, তা হলে দেখব যে এই কোডগুলির উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণিকে টুকরো টুকরো মানুষে পরিবর্তিত করা। পুঁজিবাদের শুরুর পর্যায়ে শ্রমিক ছিল 'ক্লাস ইন ইটসেল্ফ' — 'শ্রমিক' একটি শ্রেণি-পরিচয়। কিন্তু ধারাবাহিক লড়াইয়ের মাধ্যমে শ্রমিকরা 'ক্লাস ফর ইট সেল্ফ' (নিজেদের জন্য নির্মিত শ্রেণি, স্বরচিত পরিচয়) অবস্থানে পৌঁছয়। লেবার কোডে এমন অনেক বিষয় যুক্ত করা হয়েছে যেখানে শ্রমিকরা সেই 'শ্রেণি' সত্বা হারিয়ে ফেলবে, কেবল 'ব্যক্তি' সত্বায় পরিণত হবে। অর্থাৎ পুঁজির হামলার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভাবে শ্রমিক শ্রেণির প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না। 
দ্বিতীয়ত, শ্রম কোড এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে বেশির ভাগ শ্রমিকই শ্রম আইনের আওতার বাইরে চলে যাবে। উদাহরণ দিয়ে বলা যাক- ১৯৭০ সালে কন্ট্রাক্ট লেবার (রেগুলেশন ও অ্যাবোলিশন) অ্যাক্টে ২০জন শ্রমিক ঠিকাদারের অধীনে কাজ করলে আইনি অধিকার পেতো। শ্রম কোডে সংখ্যাটা ৫০ করে দেওয়া হয়েছে।ফলে একজন কন্ট্রাকটর ৪৯জন শ্রমিককে নিয়ে কাজ করলে আইন তাকে ছুঁতেও পারবে না। আর বিভিন্ন কোম্পানিতে ঠিকা শ্রমিকরা একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত হয় এবং কাজ করে, সেই সংখ্যাটা মাত্রাতিরিক্ত হয় না। উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে নানান ধরনের ঠিকাদারকে নানা কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একজনই ঠিকাদার সব ধরনের কাজ করেন, এমন নয়। কাজ এমন টুকরো টুকরো করে দেওয়ার ফলে, একজন ঠিকাদার ৫০জনের বেশি ঠিকা শ্রমিককে নিয়োগ করবেন, সে সম্ভাবনা কতটুকু? সুতরাং নতুন লেবার কোডে বেশির ভাগ ঠিকা কর্মীকে শ্রম আইনের বাইরেও নিয়ে আসা হলো। ফলত কন্ট্রাকটর কিংবা মূল কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের ওপর যথেষ্ট আক্রমণের চেষ্টা করবে।
এই শ্রম কোডগুলিতে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার, অর্থাৎ ধর্মঘট করার অধিকার সুকৌশলে কেড়ে নেবার চেষ্টা হয়েছে। কেড়ে নেওয়া হয়েছে ছাঁটাই শ্রমিকদের পুনর্বহালের বিষয়টিও। কারখানায় স্থায়ী ভাবে নিযুক্ত হওয়ার যে অধিকার শ্রমিকের ছিল, তা তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। শুধু ঠিকা শ্রমিক নয়, অন্য একটা বিরাট অংশের শ্রমিককেও লেবার আইনের আওতার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, এই শ্রমকোডে 'ফ্যাক্টরি'-র সংজ্ঞাও পাল্টে দেওয়া হয়েছে। এত দিন আইনি সংজ্ঞা ছিল, 'যে প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ-সংযোগ থাকলে অন্তত ১০জন শ্রমিক কাজ করে, অথবা বিদ্যুৎহীন প্রতিষ্ঠানে অন্তত ২০জন শ্রমিক কাজ করে, তা 'ফ্যাক্টরি' বা কারখানার মর্যাদা পাবে। এবং এই আইনের সুবিধা পাবে। কিন্তু শ্রম কোডে শ্রমিক সংখ্যা পূর্বের আইনের দ্বিগুণ করা হয়েছে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ-সংযোগ আছে, এমন প্রতিষ্ঠানে অন্তত ২০জন শ্রমিক কাজ করলে তারা শ্রমিকের মর্যাদা পাবে। আর বিদ্যুৎহীন প্রতিষ্ঠানে অন্তত ৪০জন শ্রমিক কাজ করতে হবে। যে হেতু ভারতে অধিকাংশ কারখানা খুব কম শ্রমিক নিয়ে কাজ করে, তাই আইনে পরিবর্তনের ফলে বিপুল সংখ্যক শ্রমিকদের কোনো আইনি সুবিধা থাকবে না। তাদের শ্রম আইনের সুরক্ষার বাইরে নিয়ে যাবে শ্রম কোড। এই কোড শ্রমিকদের একটি ঐক্যবদ্ধ শ্রেণির পরিবর্তে অগুনতি টুকরো টুকরো মানুষে পরিণত করবে। এ হল সংগ্রাম ও সংগঠন করার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা। এই কোড বাতিলের লড়াই ছাড়া, অন্য কোনো রাস্তা খোলা নেই এ দেশের শ্রমিক শ্রেণির কাছে।
যে চারটি শ্রমিক কোড আইনে রূপান্তরিত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল 'দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস কোড, ২০২০' — শিল্পে শ্রমিক নিযুক্তি, ট্রেড ইউনিয়ন, নিয়োগকারী ও শ্রমিকের মধ্যে বিবাদ সম্পর্কিত আইন। এ বিষয়ে তিনটি পূর্বতন আইন ছিল 'দ্য ট্রেড ইউনিয়ন অ্যাক্ট, ১৯২৬', 'দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল এমপ্লয়মেন্ট (স্ট্যান্ডিং অর্ডার্স' অ্যাক্ট, ১৯৪৬', এবং 'দ্য ইন্ডায়স্ট্রিয়াল ডিসপিউটস, ১৯৪৭।' এই কোডে একটি শব্দ সংযোজিত হয়েছে, 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট।' এতে লেখা হয়েছে, একজন শ্রমিক তার মালিকের সাথে লিখিত চুক্তি করবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। নির্দিষ্ট সময়ের পরে (সেটা কয়েক মাস বা কয়েক বছর হতে পারে) তাকে আবার চুক্তি করতে হবে। অর্থাৎ ধারাবাহিক ভাবে কাজের সুযোগকে খর্ব করা হল, চুক্তিভিত্তিক, স্বল্পমেয়াদী নিয়োগকে আইনত বৈধ করা হল।
নরেন্দ্র মোদি সরকার ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর মরসুমি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি ঢোকায়, সরকারি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। ২০১৮ সালে বস্ত্রশিল্পের জন্য এর 'গেজেট নোটিফিকেশন' জারি হয়। লেবার কোডে শিল্পের সমস্ত বিভাগে 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট' বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে। এটা করতে এই সরকার এতটাই বদ্ধপরিকর যে গ্র্যাচুয়িটি আইনেরও পরিবর্তন করেছে। ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্টের চুক্তি করলে এক বছরে গ্র্যাচুইটি পাবেন শ্রমিক। সরকারি ভাবে গ্র্যাচুইটি পাবার নিয়ম হল, অন্তত পাঁচ বছর কাজ করলে গ্র্যাচুইটি পাওয়া যায়। কিন্তু সময়সীমা কমিয়ে এক বছর করা হল। আমাদের দীর্ঘ দিনের দাবি ছিল গ্র্যাচুইটি আইনের সংশোধন করে পাঁচ বছরের জায়গায় এক বছর কাজ করলেই গ্র্যাচুইটি দেওয়া হোক। সরকার মানেনি। এখন শ্রম কোডে এই সুবিধা দেওয়া হল কেন? এটা শ্রমিককে প্রলোভিত করার জন্য, যাতে 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট'-এর নিয়মে শ্রমিক মালিকের সঙ্গে লিখিত চুক্তি করে৷ কিন্তু স্বল্পমেয়াদী এই চুক্তি যদি মালিক পুনরায় নবীকরণ না করে, তা হলে তো গ্র্যাচুইটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সব পাওনার শেষ হবে। 
অর্থাৎ 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট' চুক্তিতে একবার ঢুকলে স্থায়ী চাকরির সম্ভাবনা, শ্রমিকের বিভিন্ন অধিকার, সব বাতিল হয়ে যাবে। এমনকি শ্রমিকের সংগঠিত হয়ে ইউনিয়ন করার বিষয়টি আর থাকবে না। ফিক্সড টার্মে যে শ্রমিক কাজ করছে তার মধ্যে অহোরহ এই ভয় থাকবে যে যদি সে মালিক বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যায় তাহলে তা লিখিত চুক্তির বিরুদ্ধে হবে৷ সুপরিকল্পিত ভাবে ফিক্সড টার্ম ব্যাপারটা আনা হয়েছে যার ফলে স্থায়ী শ্রমিক থাকবে না, শ্রমিকের কোনো সুরক্ষা পাবে না, শ্রমিকরা ইউনিয়নভুক্ত হবে না বা সংগঠিত প্রতিবাদ করবে না। কারণ, ফিক্সড টার্ম চুক্তিতে যে শ্রমিক কাজ করছে তার মধ্যে অহরহ এই ভয় থাকবে যে যদি সে মালিক বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যায়, তা হলে তা লিখিত চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করবে। সুপরিকল্পিত ভাবে নিয়োগের ক্ষেত্রে 'ফিক্সড টার্ম' চুক্তির ব্যাপারটা আনা হয়েছে যার ফলে স্থায়ী শ্রমিক থাকবে না, শ্রমিকের কোনো সুরক্ষা পাবে না, শ্রমিকরা ইউনিয়নভুক্ত হবে না বা সংগঠিত প্রতিবাদ করবে না। আর এখানে সরকার বা লেবার দপ্তরের কোনো দায়ও থাকবে না। কারণ মালিকের সাথে লিখিত চুক্তি করেই ব্যক্তি শ্রমিক কাজ পেয়েছে৷ সরকার বা শ্রম দপ্তরের এখানে কিছু করার নেই৷ এমনকি শ্রমিক কোনো আইনি সুরক্ষাও পাবে না। কারণ আদালতে যুক্তি আসবে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ লিখিত চুক্তি করে স্বল্পমেয়াদী নিয়োগের শর্তাবলী মেনে নিয়েছে। অর্থাৎ সব দিক থেকেই 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট' একটি আদ্যোপান্ত দানবীয় আইন।
একটা প্রশ্ন আসতে পারে— এ দেশে বিভিন্ন শিল্পে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকই বেশি। 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট'-এর সঙ্গে তা হলে তফাতটা কী হল? মূলগত ভাবে তফাত না থাকলেও একটি তফাত আছে৷ তা হল, চুক্তিভিত্তিক বা কনট্র্যাকচুয়াল শ্রমিকের ক্ষেত্রে সব সময় নিয়োগের নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে না, বা লিখিত চুক্তি করতে হয় না। কিন্তু 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট' ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করে লিখিত চুক্তি থাকতে হবে। আরও বড় সমস্যা হল, শ্রম কোডে এটা অন্তর্ভুক্ত হবার ফলে একে আইনত বৈধ করা হল। আরও যে সমস্যা পরবর্তী কালে আসবে তা হল, শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বা আদালতের যে একটা ভূমিকা থাকে, তা কার্যত নাকচ হয়ে যাবে।
এরপর এই কোডের আরও দুটি বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করব — ধর্মঘট এবং ট্রেড ইউনিয়ন আইন বিষয়ে।
ধর্মঘট বিষয়ে আগে বলা ছিল, এক দল শ্রমিকের কাজ বন্ধ করা বা সংঘবদ্ধ ভাবে কাজ করতে না চাওয়াকে 'স্ট্রাইক' বা ধর্মঘট বলা হবে। এ বার তার সঙ্গে আরও একটি বিষয় যুক্ত করা হয়েছে৷ পঞ্চাশ ভাগের একজন বেশি শ্রমিক যদি ছুটি নেয়, তা হলে সেটাও ধর্মঘট হিসাবে গণ্য হবে। শ্রমিক কাজ করতে চায় না, বা কাজ বন্ধ করে তার অধিকার আদায়ের জন্য। কিন্তু ছুটি তো একটা অধিকার৷ ৫০ ভাগের একজন বেশি শ্রমিক ছুটি নিলে সেটা কেন ধর্মঘট হিসাবে গণ্য হবে? এতে ছুটি বা Leave-কে ধর্মঘটের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে। এটা একটা অধিকার জোর করে কেড়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছু নয়। দ্বিতীয়ত, আগে জনপরিষেবার কোনও ক্ষেত্রে শ্রমিকরা ধর্মঘট করতে চাইলে নোটিস দিতে হত। বাকি শিল্প, যা 'পাবলিক ইউটিলিটি সার্ভিস'-এর মধ্যে পড়ে না সেখানে ধর্মঘটের জন্য আগাম নোটিস দিতে হত না। শ্রম কোডের নিয়ম অনুসারে ধর্মঘট করার বিষয়টি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিলম্বিত হয়ে যাবে — ইউনিয়ন ধর্মঘটের নোটিস দিল, মালিক মানল না, সেটা শ্রম দপ্তরে দু'তরফের বিবাদ বা 'ডিসপ্যুট' হিসেবে গেল। তারপর শুরু হল আলোচনা। আলোচনা চলাকালীন কোনো পক্ষ এক তরফা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, বলছে কোড। অর্থাৎ কার্যত ধর্মঘটের বিষয়টা এক অন্তহীন প্রক্রিয়ার মধ্যে চলে গেল। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কোনো কারখানায় মালিক বা কর্তৃপক্ষ একতরফা কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শ্রমিক কাজ বন্ধ করে দেয়। অথবা, দুর্ঘটনায় কোনো শ্রমিক মারা গেলে, বা গুরুতর আহত হলে শ্রমিকরা তক্ষুণি কাজ বন্ধ করে দেয়। শ্রমিকদের এই সমবেত প্রত্যাঘাতে মালিকপক্ষ অনেক ক্ষেত্রেই পিছু হটেছে। এ যাবৎ এটা বে-আইনি কাজ হিসেবে গণ্য হত না। কিন্তু বর্তমানে কোনও পরিস্থিতিতেই তাৎক্ষণিক কাজ বন্ধ করা যাবে না। শ্রমিকদের নোটিস দিতে হবে, তারপর ধর্মঘট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে। অর্থাৎ আইনের প্যাঁচে এই ধরনের সমস্ত লড়াই চলে যাবে বিশ বাঁও জলে। এই ভাবে ধর্মঘটের অধিকার কার্যত কেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে শ্রম কোডে। 
নতুন শ্রমকোডে ট্রেড ইউনিয়ন সংক্রান্ত প্রশ্নে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়েছে। যে কোনো কারখানায় একের অধিক ইউনিয়ন থাকলে, কোনও শ্রমিক সংগঠনকে আইনত স্বীকৃত বা 'রেকগনাইজড' ইউনিয়ন হতে গেলে মোট শ্রমিকদের ৫১% বা তার বেশি নাম মাস্টার রোলে থাকতে হবে। যদি ৫০%-এর বেশি শ্রমিকের সমর্থন কোনো ইউনিয়ন না পায়, তা হলে আনুপাতিক হারে কাউন্সিল তৈরি করতে হবে। সেই কাউন্সিলই মালিকপক্ষের সঙ্গে দর কষাকষি করবে। আপাত ভাবে মনে হয় ৫১% বেশি শ্রমিকের নাম মাস্টার রোলে থাকলে ব্যাপারটা তো মন্দ নয়। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায় — ৫১% শ্রমিকের নাম মাস্টাররোলে রাখার বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়নি। ফলে ইউনিয়ন তৈরির ক্ষেত্রে রাজ্যের শাসক দলের, বা কারাখানা মালিকের একটা বড় ভূমিকা থাকবে। তাদের পছন্দের ইউনিয়নের শ্রমিকদের ৫১ শতাংশ বা তার বেশি সদস্যের নাম মাস্টাররোলে ওঠানোর চেষ্টা জারি থাকবে। আর ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা যাই হোক,.... প্রধান এজেন্ট হিসেবে নির্বাচনের কোনো কথা এই আইনে নেই। স্বাভাবিক ভাবেই ইউনিয়নের উপর শাসকদলের বা মালিকের নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি থাকবে।
এর আগে আমরা দেখেছি, 'ফ্যাক্টরি'-র সংজ্ঞা বদলে বহু কারখানা শ্রমিককে আইনের সুরক্ষার বাইরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আরও একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় 'স্ট্যান্ডিং অর্ডার'— যার উল্লেখ 'দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস কোড, ২০২০'-তে লেখা আছে। তিনশো বা তার বেশি শ্রমিক যে ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন সেখানে স্ট্যান্ডিং অর্ডার থাকবে। এখন প্রশ্ন হল, স্ট্যান্ডিং অর্ডারের গুরুত্ব কোথায় ছিল? স্ট্যান্ডিং অর্ডারে কী থাকে? শ্রমিকদের বিভাগ নির্ণয় (ক্লাসিফিকেশন) অর্থাৎ শ্রমিকটি স্থায়ী না ক্যাজুয়াল, নাকি বদলি শ্রমিক, ইত্যাদি। এ ছাড়া কাজের সময় থেকে শুরু করে শিফট কী ভাবে চলবে, টিফিনের সময়, বেতন কখন, কবে দেওয়া হবে, ছাঁটাইয়ের শর্ত, খারাপ ব্যবহারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা— অর্থাৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কর ব্যাপারটি নীতিভুক্ত হয়। দু'ভাবে স্ট্যান্ডিং অর্ডার হয়। একটা থাকে মডেল স্ট্যান্ডিং অর্ডার, আরেকটা মালিক-শ্রমিক চুক্তি হয় লেবার দপ্তরের উপস্থিতিতে। এখন কিন্তু ৩০০-র চেয়ে কম শ্রমিক কাজ করলে সেখানে কোনো স্ট্যান্ডিং অর্ডার থাকবে না। অর্থাৎ ফ্যাক্টরি চলার অভ্যন্তরীণ রীতি তুলে দেওয়া হল।
অতএব আমরা দেখতে পাচ্ছি, নতুন আইনে নানা সংজ্ঞা এবং বিধি বদল করে লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে আইনের বাইরে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ সংগঠিত শিল্প-শ্রমিকদের মৌলিক আইনি অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে৷ কাড়া হয়েছে সংগঠন ও সংগ্রামের অধিকার।
অপর দিকে যে সব শ্রমিকেরা আজ শ্রম আইনের আওতায় নেই, সেই লক্ষ লক্ষ শ্রমিকদের বিষয়ে চারটি শ্রম কোড কী অবস্থান নিয়েছে? বেশি ব্যাখ্যা করার দরকার নেই, কিছু উদাহরণই যথেষ্ট। লাখ লাখ গৃহপরিচারিকাদের সম্পর্কে কোডে কোনো কথা বলা নেই। আর আজকের শ্রম-বাজারে যে শ্রমিকদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়, সেই গিগ শ্রমিকদের ব্যাপারে লেখা আছে, 'gig workers means a person who performs work or participates in a work arrangement and earn from such activities outside of traditional employer-employee relationship.' মানে প্রথাগত মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের বাইরে থাকবে গিগ শ্রমিকরা। তাদের কোনো আইনি অধিকার থাকবে না। শুধু কিছু প্রকল্পের সুযোগ পাবে। এ সব থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে চারটি শ্রম কোড সমস্ত ধরনের শ্রমিকের মৌলিক আইনি অধিকার কেড়ে নেওয়ার একটি হাতিয়ার। এই চারটি শ্রম কোডকেই বাতিল করার দাবিতে সমস্ত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
প্রশ্ন হল, আজ ভারতে কেন এই শ্রম কোড আনা হল? বিজেপি সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটা কি? এর পিছনের রাজনীতিটা আমরা বুঝব কী ভাবে? রাজনীতি বুঝতে না পারলে সঠিক প্রতিরোধও গড়া যাবে না।
কয়েকটা প্রশ্নে ভাগ করে এর উত্তর খুঁজব।
১) শ্রমকোড বা শ্রম আইন আনার প্রেক্ষিতটা কী?
বিশ্বে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আসার পর শ্রমিক শ্রেণি পুঁজির আক্রমণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অধিকারের দাবিতে সংগঠিত হওয়া শুরু করে। 'মেশিন-ভাঙা' আন্দোলন থেকে বিভিন্ন বিভাগে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, পরবর্তীতে বিভিন্ন কারখানায় কিংবা শিল্প-ভিত্তিক সংগঠনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। মে দিবসের লড়াই ছিল পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের শ্রেণিগত ভাবে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের একটি চমৎকার উদাহরণ। ইতিমধ্যে ১৮৭১ সালে প্যারি-কমিউন ঘটে। ১৯১৭ সালে শ্রমিকরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে রাশিয়ার। রাশিয়ার বিপ্লব গোটা পৃথিবীতে শ্রমিক আন্দোলনে নতুন জোয়ার আনে। ঐ সময় বিভিন্ন দেশে শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হয়ে আইনি অধিকার পাবার লড়াই জোরদার করে। অপর দিকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লড়াইয়েও অংশগ্রহণ করে। অন্য দিকে বুর্জোয়ারাও ক্ষমতা হারানোর ভয়ে শ্রমিকদের কিছু আইনি অধিকার দিতে বাধ্য হয়। এবং নানান ধরনের শ্রম আইন তৈরি হয় নানান দেশে। মানে রাষ্ট্র একটা নিয়ম প্রবর্তন করে যা শ্রমিক, মালিক, রাষ্ট্র সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। এই সব আইনের মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণি কিছু আইনি অধিকার পায়। শ্রমিক বিপ্লব যাতে না হয়, তার জন্য বুর্জোয়ারা এই অধিকার দিতে কিছুটা বাধ্যও হয়। কিন্তু এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, উত্তাল শ্রমিক আন্দোলন না থাকলে শ্রমিকদের এই আইনি অধিকার অর্জন হতো না। শ্রমিকরা যা কিছু আদায় করেছে, সংগঠনের জোরে, ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের জোরেই করেছে।
আমাদের দেশের সংগঠিত শিল্পও তার ব্যতিক্রম নয়। এ দেশের শ্রমিকরা আন্দোলনের জোরে বেশ কিছু আইনী অধিকার অর্জন করেছে। ভারত রাষ্ট্রে দেশী-বিদেশী একচেটিয়া পুঁজিপতিদের শাসন থাকা সত্ত্বেও অনেক লড়াই করে শ্রমিকরা এই অধিকার অর্জন করেছিল। শ্রমিক আন্দোলন যত দুর্বল হতে থাকে, পুঁজিপতি শ্রেণি ততই শ্রমিকের আইনি অধিকারকে খর্ব করতে তীব্র আক্রমণ নামিয়ে আনে। এর বিরুদ্ধে শ্রমিকরা প্রতিরোধ গড়তে পারেনি। ফলে বহু ক্ষেত্রে পুঁজিপতিরা তাদের ইচ্ছেমতো নিয়ম প্রবর্তন করতে শুরু করে। কাজের ঘন্টা বাড়ানো, স্থায়ী শ্রমিক প্রথা রদ, বেতন সংকোচন, চুক্তি শ্রমিক ও ঠিকা শ্রমিকের সংখ্যায় বৃদ্ধি, ইচ্ছেমতো ছাঁটাই, যখন-তখন কাজ বন্ধ করা, ইত্যাদি চলতে থাকে। এক কথায় শ্রমিকদের ওপর ব্যাপক আক্রমণ নামিয়ে আনে।
২) আর এস এস পরিচালিত বিজেপি সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কি?
এই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে আমাদের দু'টো বিষয় নিয়ে একটু কথা বলে নিতে হবে :
(ক) গত শতাব্দীর ন'য়ের দশক থেকে এই দেশে নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির আগমন ঘটে, কংগ্রেসের নরসীমা রাও ও মনমোহন সিংহের আমলে যার প্রবর্তন হয়। এটি গোটা দেশের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিপুল বদল আনে।  
(খ) এই পর্যায়েই এ দেশের ফ্যাসিস্ট দল বিজেপির বিপুল শক্তিবৃদ্ধি ঘটে। স্বাভাবিক ভাবেই পরবর্তী কালে ভারতের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সবচেয়ে আগ্রাসী, আক্রমণাত্মক, হিংস্র পুঁজিপতি গোষ্ঠী বিজেপি-কে নিঃশর্ত সমর্থন দেয়। ফ্যাসিবাদ সব সময় প্রধান প্রতিপক্ষ করে শ্রমিকশ্রেণিকে। শ্রমিক শ্রেণি যাতে শ্রেণিবদ্ধ ভাবে সংঘবদ্ধ না হতে পারে, শ্রমিকদের শ্রেণিগত ঐক্য ভেঙে যাতে শ্রমিকরা পরস্পর-বিচ্ছিন্ন হয়, মতাদর্শের দিক দিয়েই ফ্যাসিস্টরা তা নিশ্চিত করতে চায়। ফ্যাসিবাদী শাসন ও স্বৈরাচারী শাসনের মধ্যে তফাৎ হলো, ফ্যাসিবাদী শাসনে স্বৈরাচার থাকবে, কিন্তু স্বৈরাচারী শাসনে ফ্যাসিবাদ থাকবেই— এমনটা নয়। একটু আলোচনা করা যাক। ১৯৭০-১৯৭৬ যখন ইন্দিরা গান্ধীর চরম স্বৈরাচারী শাসন চলছে, সেই সময়েই তিনটি শ্রম আইন তৈরি হয় : ১৯৭০ সালে কন্ট্রাক্ট প্রথা (রেগুলেশন ও এ্যবুলেশন) আইন, ১৯৭২ সালে গ্র্যাচুইটি আইন, ১৯৭৬ সালে সমকাজে সমবেতনের আইন। দেশে স্বৈরশাসন চলাকালীনই এই আইনগুলি পাশ হয়েছিলো, যেগুলি শ্রমিক-স্বার্থ কিছুটা হলেও রক্ষা করেছিলো। কিন্তু ২০১৪-২০২৫, এই এগারো বছরে নরেন্দ্র মোদী সরকার শ্রমিক স্বার্থে একটাও আইন তৈরি করেনি। উপরন্তু ২৯টি শ্রম আইনকে চারটে শ্রম কোডে পরিবর্তিত করে শ্রমিকদের আইনি অধিকার কার্যত কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। যে চারটি শ্রম কোডের মাধ্যমে কার্যত এই সরকার বেশির ভাগ শ্রমিককে শ্রম-আইনের বাইরে নিয়ে এসে গেছে। অপর দিকে যেটুকু আইন থাকবে, সেটা প্রত্যক্ষ ভাবে মালিকদের স্বার্থরক্ষা করবে। যেমন ধর্মঘট, ট্রেড ইউনিয়ন করা, মজুরির প্রশ্ন, গিগ-প্ল্যাটফর্ম শ্রমিক-সহ অজস্র শ্রমিকদের বিরুদ্ধে আইনকে দাঁড় করানো, ইত্যাদি। এক কথায় একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থে ফ্যাসিস্ট শক্তি তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা নিয়ে দাঁড়াবে। কোনো মতেই যেন শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হতে না পারে। এটা আরো ভালো ভাবে লক্ষ করা যাবে গুজরাটে। এই পর্যায়ে দুটি রাজ্যে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন তুলনামূলক ভাবে সক্রিয়, গুজরাট ও তামিলনাডু। এ দেশে চারটি শ্রম কোড আইনে রূপ পাওয়ার পরও দেশব্যাপী শ্রমিকদের নানান প্রতিবাদের জন্য আজো শ্রমবিধি তৈরি হয়নি। ফলে চারটি শ্রম কোডকে প্রায়োগিক স্তরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই অন্তত একটি ক্ষেত্রে আট ঘন্টার জায়গায় ১২ ঘন্টা কাজের জন্য অর্ডিন্যান্স গুজরাট সরকার লাগু করেছে। অথচ সপ্তাহে ৪৮ ঘন্টায় কাজের কথাও লেখা আছে। তার মানে এক দিকে দৈনিক ১২ ঘন্টা কাজকে আইনত বৈধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে, অপর দিকে সপ্তাহে চার দিন কাজ করতে হবে। এখন, একটা শিল্প তো তিন দিন বন্ধ রাখা যাবে না! ফলে এই অর্ডিন্যান্সের ফলে বাকি দু'দিন বেআইনি প্রক্রিয়াকে আইনি প্রক্রিয়া করে দেওয়া হলো। ফ্যাসিস্ট শক্তির আঁতুড়ঘর গুজরাট। তাই গুজরাটে অর্ডিন্যান্স করে তারা দেখে নিতে চায় ১২ ঘন্টার কাজকে আইনত বৈধ করলে সমাজ জুড়ে তার কি প্রতিক্রিয়া হয়। আর সেই জন্যই এই অর্ডিন্যান্স। এক কথায়, শ্রম কোড আনার পিছনে এটাই বিজেপি-র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। এক দিকে যেমন বেশির ভাগ শ্রমিককে আইনের আওতার বাইরে নিয়ে যাওয়া, অপর দিকে যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে তা দিয়ে আরো জোরের সাথে একচেটিয়া বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষা করা।
এখন প্রশ্ন হলো, এর বিরুদ্ধে লড়াইটা কিভাবে গড়ে উঠবে? প্রতিরোধ কিভাবে করবে শ্রমিক শ্রেণি? এই আলোচনায় যাবার আগে আমাদের দেশের শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা ও শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে একটু কথা বলে নিতে হবে।
দীর্ঘ দিন ধরে শ্রমিক আন্দোলন একটা ভাটার পর্বের মধ্য দিয়ে চলছে। এক দিকে পুঁজিপতি শ্রেণির নিত্যনতুন, একচেটিয়া হামলা চলছে, সেই সঙ্গে উৎপাদনের পদ্ধতির পরিবর্তন হচ্ছে, অপর দিকে দীর্ঘ লড়াই করে শ্রমিকশ্রেণি যে অধিকার অর্জন করেছিল সেগুলি আস্তে আস্তে হাতছাড়া হচ্ছে। আজকের শ্রম কোডে যে সব অধিকার ধরে রাখার জন্য লড়াই করা হচ্ছে, বাস্তবে সেগুলো হারানোর প্রক্রিয়া অনেক দিন ধরেই সমাজ জুড়ে চলছে। যেমন স্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ প্রথা রদ, চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ ও ঠিকা শ্রমিক বৃদ্ধি, কাজের ঘণ্টা বৃদ্ধি, কাজের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অবাধ ছাঁটাই-সাসপেন্ড, মজুরি কমানো, ধর্মঘট-সহ যে কোনও শ্রমিকদের লড়াইয়ের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, ইত্যাদি। তথ্যপ্রযুক্তি থেকে শুরু করে যে কোন ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প, পরিষেবা শিল্প সর্বত্র অস্থায়ী শ্রমিক ও কাজের ঘণ্টা বৃদ্ধি করা হয়েছে। নতুন ধরনের শ্রমিক, যেমন গিগ শ্রমিক, প্ল্যাটফর্ম শ্রমিকদের আইনি অধিকার দেওয়া হয়নি। গৃহশ্রমিক থেকে মিড ডে মিল কর্মচারী, এদের জন্য কোনো আইন নেই। এক কথায়, কোটি কোটি মানুষ শ্রম দিচ্ছেন, সম্পদ তৈরি করছেন অথচ তাঁদের সুরক্ষার জন্য কোনো আইন নেই। শ্রমিক আন্দোলনের এই ভাঁটার সময়ে এক দিকে দীর্ঘ দিন আগে অর্জিত অধিকারগুলি হারাচ্ছেন, অপর দিকে অজস্র যে নতুন 'শ্রমিক' যোগ দিচ্ছেন নানা ধরনের কর্মক্ষেত্রে, নানা ধরনের শর্তে, তাঁদের জন্য কোনো আইনি ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এই হচ্ছে আজকের শ্রমিক আন্দোলনের অবস্থা। কোথাও যে লড়াই বা প্রতিরোধ হচ্ছে না তা নয়, কিন্তু তা সামগ্রিক পরিস্থিতিকে স্পর্শ করতে পারছে না। এই হচ্ছে আজকের শ্রমিক আন্দোলনের পরিস্থিতি। একটা প্রশ্ন আসবেই— এই তো কিছু দিন আগে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট হয়ে গেল। সেখানেও তো প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কিছু ছবি পাওয়া গেছে। তা হলে? হ্যাঁ, এটা সত্য যে বিজেপি বাদে প্রায় সমস্ত সংসদীয় রাজনৈতিক দল ও তাদের পরিচালিত ইউনিয়ন, অজস্র ছোট ছোট ট্রেড ইউনিয়ন, নকশালপন্থীদের বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, নানা ধরনের স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন এই ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাতে একটা রাজনৈতি

শনিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২৫

গ্যাপ ~ সুনৃতা মাইতি

অপর্ণার মন খুব খুব  খারাপ। শরীরও জুতের নেই। দুগ্গা পুজো হয়ে দীপাবলি, এত পরিশ্রম গেছে যে বলার নয়। উৎসবের দিনকাল মানেই বাড়ির মানুষদের বাড়িতে সকাল থেকে রাত্তির পর্যন্ত পায়ে পা তুলে জেঁকে বসে থাকা তো শুধু নয়, আত্মীয়স্বজনদের যাওয়া আসাও  লেগে থাকে। আনতাবড়ি খাটতে খাটতে  অবস্হা কেরোসিন! শরীর এসব সয়ে নেয়, তার অভ্যেস আছে। বাকি রইল মন। সেও অনেক কিছু সইতে সইতে আজকাল শক্তপোক্ত হয়ে গেছে। নারকোলের মত। ভেতরের সারজলটুকুর সন্ধান পেতে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়। কিন্তু মনের ওই নরম জায়গাটাতে যদি আঘাত লাগে তবে কি আর সহ্য হয়! সে কি সত্যি খারাপ! খারাপ মা? তার মেয়ে তার পিঠপিছে সেটাই বলেছে! মানে ঠিক বলেনি, লিখেছে। সেইটা আবার অপর্ণার গোচরে এসেছে।

লে দে কে অপর্ণার একটিই তো সাফল্য। তার একমাত্র সবেধন নীলমণি মেয়ে শ্রীতমা। বিটস পিলানিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে, পড়াশোনায় যেমন ভাল, তেমনই দুর্দান্ত ফ্যাশানিস্তা। রাস্তায় বেরোলে লোকে হা করে তাকিয়ে থাকে। দীপাবলির ছুটিতে বাড়ি এসেছে। এসেই এমন সব ধুন্ধুমার ড্রেস পড়েছে যে বাড়িতে তার বাবার  সাথে চুলোচুলি হতে বাকি ছিল। অপর্ণা অতি কষ্টে ওই রক্ষনশীল ভদ্রলোক ও মেয়েকে যুগপৎ সামলেছে। মেয়ে পোশাকের ব্যাপারে মঝঝিম পন্থা নিতে বাধ্য হয়েছে মায়ের মধ্যস্থতায়। কিন্তু তাও তার বাপ ব্যাটামানুষের কি রাগ! গজগজ করতে করতে শাশুড়ি মায়ের কাছে কাঁধ মানে পাতি বাংলায় কন্ধা খুঁজতে গিয়েছিল। এদিকে অপর্ণার শাশুড়ি মাও বয়স বাড়ার সাথে সাথে আজকাল হেভি সেয়ানা হয়ে গেছেন। কোন দিকে যাবেন বুঝতে না পারলে বুড়ি আজকাল কানে কম  শোনার একটিং শুরু করেন। সেটাতে কাজ না হলে বলতে থাকেন," হরি বোল! হরি বোল! " যখন ইয়ে বয়স ছিল,সাংঘাতিক সব গা জ্বালানি কমেন্ট করতেন, যাকে বাঙাল ভাষায় বলে, চিমটাইন্যা কথা। আর খুব আস্তে বলতেন ,এত আস্তে যে খুব কাছাকাছি থাকা মানুষরাই শুনতে পেত। অপর্ণার বড় জা মৃদুলা সেই মন্তব্য শুনলেই হাউ হাউ করে দাপাদাপি করে উঠত।  পাড়াশুদ্ধ মানুষ বলত ," আহা! শাশুড়ি মানুষটি কি শান্তিপ্রিয়! গলা পর্যন্ত শোনা যায়না! বড়  বৌ কি দজ্জাল দেখো! "

তারপর তো বড় ভাসুর ও জা আলাদা হয়ে যায় তাদের যৌথ সংসার থেকে। অপর্ণা বরাবরই শান্ত ও ধৈর্যশীল মেয়ে। সবাইকে খুশি করেই চলার চেষ্টা করেছে বরাবর। তাতে অবশ্য ভালই হয়েছে। সকলেরই বিষদাঁত সময়ের সাথে সাথে নড়বড়ে হয়েছে। সব ক্ষত ভুলে সেও একদিন নিজের মত করে জীবনটাকে দেখতে পেরেছে, সাজতে গুজতে পেরেছে, নিজের মত শান্তিনীড় তৈরি করার চেষ্টা করতে পেরেছে। 

কিন্তু মেয়ের ব্যাপারটা ভাবলেই তার চোখ জলে ভিজে উঠছে।রাতে ঘুমোতে গিয়ে সে বার বার তার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করছে, 

"হ্যাঁ গো, এটা কি সত্যি ? মেয়ে তার হোয়া স্ট্যাটাসে তাই লিখেছে! সারা দুনিয়াকে জানিয়েছে,তার মা খারাপ! হ্যাঁ গো,আমি এত খারাপ!"

তার স্বামী চোখ ছোট ছোট করে কূটনী ভঙ্গিমায় বলেছে,

" তবে আর বলছি কি! নিজের চোখে দেখেও তোমার বিশ্বাস হলনা! যাগ্গে, বাদ্দাও। কবে বিয়ে হবে, কবে জামাই হবে! ওই নিয়ে ভেবে কাজ নেই।"

আসলে কিনা তার  কলিজার টুকরো মেয়ে  হোয়া স্ট্যাটাসে তার সামাজিক বায়োডাটা দিয়েছে, তাতে নিজের প্রোস আর কোন্স দিয়েছে। মজা করেই দিয়েছে হবে। মানে তাকে যে বিয়ে করবে, কী কী ভাল - মন্দের সম্মুখীন হবে আর কি। ওই আগাম ঘোষণার মত। আজকালকার নতুন জেনারেশনের ছেলেমেয়েরা মানে যাদের জেন জি বলা হয় তারা এইরকম খুল্লামখুল্লা। মেয়ের ভালর মধ্যে লিখেছে, বয়ফ্রেন্ড একটি ফ্যাশন সচেতন মেয়ে পাবে, ভাল মনের মেয়ে পাবে, আবার খারাপের মধ্যে সে খুব এক্সপেনসিভ, মাথা গরম পদী ইত্যাদি। ফেলু গোয়েন্দা বাপ ডজন খানেক ফেক একাউন্ট খুলে সারাক্ষণ মেয়েকে সোস্যাল মিডিয়ায় স্টক করে বেড়ায়। মেয়ে বিপথে যাচ্ছে কিনা তাই নিয়ে বেজায় ভয় লোকটার। ফেসবুক, ইনস্টা, লিংকডিন তো বটেই, হোয়াতেও নজরদারি বাদ নেই। তাই ওই বাপের চোখেই এই স্ট্যাটাস পড়েছে। ওই বায়োডাটার মধ্যে একটা পয়েন্ট ছিল, জামাই একজন খারাপ শাশুড়ি পাবে। ভালয় না মন্দয়? প্রোসে না কোনে? ঠিক মনে নেই! দেখতে দেখতেই চোখটা ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল কিনা!এইসব ভাবতে ভাবতেই অপর্ণা পরিষ্কার বুঝতে পারে, তার উপচে পড়া দুই চোখ আর জল ধরে রাখতে পারছে না। চোখ মুছতে মুছতে সে মেয়ের ঘরের দিকে রওনা হয়। না না, রাত বারোটা হোক কিংবা একটা এখনই তার ক্লিয়ার পিকচার চাই। যাকে গোদা বাংলায় ক্ল্যারিটি বলে। কীসে ভুল হল তার! মেয়ের কাছে  খারাপ কেন হল সে! তার এতদিনকার সব শ্রম কি বৃথা!

কিছুক্ষণ পর একজন মেয়ের সামনে গিয়ে একজন মাকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে শোনা যায়,

"হ্যাঁ রে, আমি এত খারাপ! এত ব্যাড? তোর বর যে হবে, সে ব্যাড শাশুড়ি পাবে?  ছিঃ!"

"যাব্বাবা! আমি আবার তোমাকে ব্যাড কোথায় বললাম?"মেয়ে ঘুম চোখে আকাশ থেকে পড়ে।

"বলিসনি! ওই যে স্ট্যাটাসে লিখেছিস ,মনে নেই! ইউ ক্যান গেট আ ব্যাডি মাদার ইন ল!বাবা ভাগ্যিস দেখাল,তাই জানলাম!"

মেয়ে বিছানা থেকে অতি কষ্টে বডি তুলে বিরক্ত গলায় বলে, "ফাইন!এতই যখন দেখেছ, ব্যাডের পাশে ডি আর ওয়াই টা  আন্দেখা করছ কেন! ওটা ব্যাডি ছিল।"

"দেখেছি। ব্যাডি। তোর ঠাকুমা হলে বলত, ব্যাডের স্ত্রী লিঙ্গ হবে। আমি যদ্দুর জানি, ওর মানে ক্রিমিনাল গোছের কিছু। " মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে।

"বেশ! অনেক বুঝেছ। তাহলে দয়া করো। আমাকে ঘুমোতে দাও। আর পারলে গুগল করে দেখে নিও মানেটা। "বলেই মেয়ে পাচন গেলা মুখে কী সব বিড়বিড় করতে করতে বালিশে মাথা রাখে।

অপর্না নাক টানে, ভাল ভাবে চোখ মোছে আর তড়িঘড়ি ঘরে এসে মোবাইল নিয়ে ভালভাবে গুগল করে বিস্ফারিত নেত্রে দেখে ব্যাডি আদতে স্ল্যাং এবং এর দুটো অর্থ। এর একটি, জেন জি এর ভাষায় ,কনফিডেন্ট, স্টাইলিশ আর অ্যাটরাকটিভ! কি কেলো! উপরে চোখ তুলে সে ভাবে,এ যে ইয়েদের ভাষায়, হ্যারি হে ডিনোবন্ডু কেস! সে কী বুঝতে কী বুঝেছে!

তার মেয়ে মা সম্পর্কে এই ভাবে! বুকে একরাশ প্রজাপতি ওড়াওড়ি করে তার। এই ডানা ঝাপটানো হৃদয় নিয়ে সে মোবাইলে আবার চোখ রাখতেই দেখে পিরিং করে মেসেঞ্জারে গভীর রাতের মেসেজ ঢুকেছে, "বি টি ডাবলু, ইউ লুক গুড ইন শাড়ি।"

হাসি হাসি মুখে সে ভাবে,তাই না তাই! কিন্তু বি টি ডাবলু আবার কী কেস রে বাবা!

পুলিশের ডাক ~ অনিমেষ বৈশ্য

আমাদের পাড়ায় একটি পুলিশ ফাঁড়ি ছিল। ফাঁড়ির উঠোনে একটি কাঁঠালগাছ। পাশে একটি ছোট শিবমন্দির। আমরা সেই মন্দিরের চাতালে বসে দিনরাত তাস পিটতাম। মাঝে-মাঝে দু-একজন পুলিশ উনুনে ভাত চাপিয়ে আমাদের সঙ্গে দু-হাত তাস খেলে নিতেন। এক বিশাল চেহারার পুলিশ থেবড়ে বসে কুটনো কুটতেন। আর একজন পুলিশের নাম মনে নেই। তাঁর বয়স ছিল কম। তিনি হেমন্তের সকালে রোদে পিঠ দিয়ে নিশ্চিন্তে উল বুনতেন। কার জন্য বুনতেন জানি না। তখনও রেডিমেড সোয়েটারের যুগ আসেনি। মা-মাসি-পিসি-দিদিমণি সবার হাতে থাকত উলের কাঁটা। কিন্তু একজন তাগড়াই চেহারার পুলিশ তাঁর কর্মস্থলে উল বুনছেন, এ দৃশ্য আমি কখনও দেখিনি। শীর্ষেন্দু মুখুজ্জে জানতে পারলে ওঁকে নিয়ে একটা দারুণ গল্প লিখে ফেলতেন। আমি লিখতে পারি না বলে পাঠকরা বঞ্চিত হলেন। 
এই পুলিশ ফাঁড়ির পত্তন হয়েছিল সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে। জরুরি অবস্থার আশপাশে। আমরা তখন ইস্কুলে পড়ি। নেহাতই কচিকাঁচা।

তখন থেকেই ফাঁড়ির পুলিশের সঙ্গে পাড়ার ছেলেদের নিদারুণ সদ্ভাব। এক পুলিশের নাম ছিল রাখাল। বিশাল চেহারা। তাঁর ছেলে রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনে পড়ত। রাখালপুলিশকে আমার এক জেঠামশাই ছোট একটু জায়গা দিয়েছিলেন। তিনি সেখানে পর্ণকুটির তৈরি করে সপুত্র বসবাস করতেন। রাখালপুলিশকে উর্দি পরা অবস্থায় কমই দেখেছি। তিনি কাছে থাকলে চোরেরা স্বস্তি পেত। চোরের মনে হতো, ইনি পুলিশ হবেন কোন দুঃখে? যেন বাড়ির লোক লক-আপে ট্যাংরা মাছ রেঁধে এনেছেন। রাখালপুলিশকে আমরা কাকু বলে ডাকতাম। তাঁর শরীর ও মনে পুলিশের অংশ ছিল সামান্যই। তিনি ছিলেন যাত্রার অভিনেতা। শিবরাত্তিরে ফাঁড়ির সামনের মাঠে হ্যাজাক জ্বেলে যাত্রা হতো। কোনও একটা পালায় দীর্ঘদেহী রাখালকাকুকে শিশুর মতো কাঁদতে দেখেছি। বোধহয় সাবিত্রী-সত্যবান পালায়। তিনি কার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, মনে নেই। সাবিত্রী হওয়াও বিচিত্র নয়। বসন্তকালে বিরহের পালা দেখে আমাদের তনুমন শিরশির করত। চৌদিকে বাতাসের হু হু আর কোকিলের কুহু। পুলিশ যে বসন্তের দূত হতে পারে, এ কথা পাঁচকান হলে পুলিশেরই চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে। কিন্তু গাঁ-গেরামের খবর পুলিশের বড় কর্তারা রাখতেন না। ফলে নিরবচ্ছিন্ন শান্তিতে পুলিশকর্মীরা কালাতিপাত করতেন। শিবরাত্রির বহু আগে যাত্রার মহড়ার হু হু হা হা শুনে তস্করেরও বুঝি বুক কেঁপে উঠত। ফাঁড়ির পিছনে ছিল আকন্দের ঝোপ। বনতুলসী, আসশেওড়া, নিসিন্দার ঝোপঝাড়ও ছিল ইতিউতি। সেই সব গহিন ঝোপঝাড়ে একটা লম্বা কালো পাখি রক্তকরবী-র রাজার মতো গম্ভীর গলায় ডেকে যেত। তাকে দেখা যেত কম। আমাদের জীবনে তখন নন্দিনী আসবে-আসবে করছে। একটু উতল হাওয়া দিলেই ঝিমধরা ভালোলাগা চৌদিকে। ফিসফিসিয়ে হাওয়াকে বলতে ইচ্ছে করত, ধীরে বও, ওগো ধীরে বও।

ফাঁড়িতে খান কতক রাইফেলও ছিল। শেষ কবে ওই রাইফেলের গুলির শব্দ শোনা গেছে, তার কোনও হিসেবনিকেশ নেই। আমরা মাঝে-মাঝে সেই রাইফেলের হিমশীতল শরীর স্পর্শ করে নিজের জীবনযৌবন সার্থক করেছি। কিছুদিন পরে দেখলাম একটা রাইফেলও নেই। কালী পুলিশ বলে একজন রাগী পুলিশ ছিলেন। একদিন দিনমানে ফাঁড়ির ভিতর থেকেই তাঁর সাইকেল চুরি যায়। এই চুরির খবর বোধহয় বড় কর্তাদের কানে পৌঁছেছিল। তার পর থেকেই ফাঁড়িতে রাইফেল রাখার আর কোনও দরকার মনে করেননি কর্তারা। রাইফেলের বদলে বাঁশি আর বেহালা হলে পালা বোধহয় আরও জমে উঠত। 

একদিন রাখালকাকুর বাড়ির সামনের মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বাঁশঝাড়ের দিক থেকে হাওয়া বইছে। শীতকাল। ধানের শীষে সোনালি রং লেগেছে। ফড়িং উড়ছে। সদ্য লাঙল দেওয়া মাটি থেকে গন্ধ আসছে ভুরভুর। কোন একটা গানের দু-লাইন গেয়ে উঠেছিলাম, মনে নেই। হঠাৎ দেখি রাখালকাকু একটা নিমের দাঁতন মুখে নিয়ে বললেন, 'কী রে কচি, পালায় গান গাইবি?' আমি তো চমকে উঠলাম। বলে কী? পালায় গান গাইব? বললাম, 'আমি তো গান গাইতে পারি না।' রাখালকাকু বললেন, 'এই যে গাইলি।' গান গাওয়া আর গান গাইতে পারা কি এককথা ? কিন্তু রাখালকাকুকে কে বোঝাবে সে-কথা। আমি দৌড় লাগালাম। রাখালকাকু বলে চলেছেন, 'আরে শোন, পালাচ্ছিস কেন? নিমাই সন্ন্যাস পালা হবে। ওই দেখো।'

আমি ছুটছি। পুলিশকাকুও ডেকে চলেছেন, 'আরে শোন। এই কচি।' আমি ছুটছি। এই প্রথম পুলিশ দেখে ভয় লাগছে। পায়ের নীচে শুকনো বাঁশপাতা। ধানগাছের হাওয়া লাগছে গায়ে। ওই তো সোনাডাঙ্গা মাঠ, ওই যে পদ্মফুলে ভরা মধুখালি বিল, ওই যে বীরু রায়ের বটতলা...।

মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি। চলে...চলে...এগিয়েই চলে। দূরে পুলিশের বীণ শোনা যায়।

বুধবার, ৫ নভেম্বর, ২০২৫

রবীন্দ্রনাথ বুর্জোয়া কবি - বামপন্থীদের গালাগালি একটি ফ্যাক্ট চেক ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

-"রবীন্দ্রনাথ বুর্জোয়া কবি - বামপন্থীদের গালাগালি একটি ফ্যাক্ট চেক"-

বামপন্থীরা (বা কমিউনিস্টরা) রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া বলে গালাগালি করেছিল - দক্ষিণপন্থীদের দ্বারা এই বহুল প্রচারিত কুৎসা নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। আসলে এটি একটি অর্ধ সত্য (যা কিনা মিথ্যার চেয়েও ভয়ানক।  হ্যাঁ, বলা হয়েছিল। কে বলেছিলেন, কোথায় বলেছিলেন দেখে নেওয়া যাক। 

'মার্কসবাদী' নামক পত্রিকায় "বাংলা প্রগতি সাহিত্যের আত্মসমালোচনা" শীর্ষক প্রবন্ধে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম নেতা (তখনও সিপিআইএম এর জন্ম হয় নি), বুদ্ধিজীবী প্রাবন্ধিক প্রয়াত ভবানী সেন (রবীন্দ্র গুপ্ত ছদ্মনামে ) রবীন্দ্রনাথের যে মূল্যায়ন করেছিলেন তাতে বুর্জোয়া, ভাববাদী ইত্যাদি শব্দ আসে [সূত্র: ধনঞ্জয় দাশ সম্পাদিত 'মার্ক্সবাদী সাহিত্য: বিতর্ক'; প্রথম খন্ড, নতুন পরিবেশ প্রকাশনী]। 

প্রথম কথা ভবানী সেন কবিকে বুর্জোয়া বলার ঢের আগে কবি'র সর্ম্পকে এই মূল্যায়ন চালু ছিল। রবীন্দ্রনাথ নিজে নিজেকে শ্রেনী অবস্থানের দিক থেকে কি ভাবতেন, সেটাও একটু দেখে নেওয়া যাক। ১৭.০৩.১৯৩৯ এর চিঠিতে অমিয় চক্রবর্তীকে তিনি লিখছেন - "যখন ময়মনসিংহগীতিকা হাতে পড়ল, খুব আনন্দ পেয়েছিলুম। শ্রেনীওয়ালাদের মতে এসব কবিতা হয়তো বা প্রোলিটেরিয়েট, কিন্তু আমি তো জাত - বুর্জোয়া, আমার ভালো লাগতে একটুও বাধে নি।" [রবীন্দ্রনাথ, চিঠিপত্র]। 

দ্বিতীয় কথা এই যে কবি সম্পর্কে ভবানী সেনের এই মূল্যায়ন ছিল লেখক হিসেবে সেনের একান্ত একক সিদ্ধান্ত, উনি কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র ছিলেন না বা ওই মূল্যায়ন পার্টির সামগ্রিক সিদ্ধান্তও ছিল না। এর প্রমাণ আমরা পাই অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির আরেক নেতা, পরবর্তীকালে সাংসদ হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এর লেখা থেকে। 

২২সে জুন ১৯৪১ সালে হিটলার দ্বারা সোভিয়েত ভূমি আক্রান্ত হওয়ার পর পরই তাঁর এবং স্নেহাংশু আচার্য, জ্যোতি বসু, গোপাল হালদার চিন্মহণ সেহানবীশ প্রমুখ কমিউনিস্টদের উদ্যোগে গড়ে ওঠে ফ্রেন্ডস অফ সোভিয়েত ইউনিয়ন বা সোভিয়েত সুহৃৎ সমিতি। ড: ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রখ্যাত বামপন্থী নেতা এর সভাপতি হন। 

সদ্য স্থাপিত সমিতির পক্ষ থেকে সুরেন গোস্বামী গেলেন শান্তিনিকেতনে - রবীন্দ্রনাথের স্বাস্থ্য তখন ভেঙ্গে পড়েছে, কিন্তু তাঁর আশীর্বাদের বড় প্রয়োজন ছিল সমিতির। কবি রাজি হলেন সমিতির পৃষ্ঠপোষক হ'তে, তবে সাবধান করে দিয়ে বললেন যে, ইংরেজ নিজের স্বার্থে সোভিয়েতকে সাহায্য করবে বলছে বটে, কিন্তু "বিশ্বাস কোরো না ওদের; তোমরা কমিউনিস্টরা ওদের বিরুদ্ধে লড়াইতে গা-ঢিলা দিয়ো না।" কমিউনিস্ট পার্টির ও চিন্তা তখন ঐরূপই ছিল - তাই সুরেন বাবু দেখালেন রবীন্দ্রনাথকে পার্টির সদ্য গৃহীত প্রস্তাব, কবি পুলকিত হলেন। [সূত্র: হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় , তরী হতে তীর, মনীষা গ্রন্থালয়]।

তৃতীয় কথা এই যে, পরবর্তীকালে স্বয়ং ভবানী সেন তাঁর অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে আসেন সেটা তার লিখিত "একজন মনস্বী ও একটি শতাব্দী" শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করলেই জানা যায়। একটু ছোট্ট অংশ উদ্ধৃত করা যাক। "স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে - ভাববাদ যদি জীবন্ত সত্যের বিরোধী ই হবে তাহলে রবীন্দ্রনাথ কেমন করে ভাববাদের আশ্রয় থেকে জীবনের মহাসত্যকেই রূপ দিতে পারলেন, কেমন করে তাঁর পক্ষে সম্ভব হ'লো ভাববাদের ঊর্ধ্বে উঠে, যে সত্য বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের একান্ত নিজস্ব, তাকে উজ্জীবিত করা? এ প্রশ্নের একমাত্র উত্তর এই যে তিনি ছিলেন মহান শিল্পী, এবং মহান শিল্পীর সৃষ্টি প্রতিভার বৈশিষ্ট্যই এই যে সত্য তাঁর মধ্যে প্রতিফলিত হয়। তাই তাঁর মনের মধ্যে ছিল এমন একটি সত্যানুসন্ধানী আবেগ যা তাঁকে তাঁর দার্শনিক বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে তুলে ধরছে, অতিক্রম করে নিয়ে গেছে তাঁকে সেই ভাববাদী দর্শনের সীমা থেকে।" [সূত্র: নীলরতন সেন সম্পাদিত রবীন্দ্র বীক্ষা, এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি]

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ভবানী সেন আগের অবস্থান থেকে এতটাই সরে এসেছিলেন যে প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক নারায়ন চৌধুরী সেন মশাইকে বিদ্রূপ করে লিখেছিলেন, "হাওয়ামোরগের মত বায়ুর গতি বুঝে কেবলই যদি দিক বদলাতে হয় তাহলে তার মূল্যায়ন নামক অনুশীলনীর কোন সার্থকতা থাকে না" [সূত্র: সংস্কৃতি'  ৭১]

এই লেখা আর দীর্ঘায়িত না করে এবার শেষ করা যেতে পারে কবি'র জীবনের শেষ দিনগুলিতে গিয়ে। বঙ্গের কমিউনিস্টদের স্নেহের চোখে  দেখলেও কমিউনিজম এর স্বরূপ নিয়ে, সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে, সমাজবাদ  নিয়ে কবি'র মনে সংশয় ছিল।  শেষ জীবনে তার অবসান  ঘটে। সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রান্ত হওয়ার পর ছয় সাত সপ্তাহের বেশি তিনি বাঁচেন নি। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে কেবল জানতে চাইতেন যুদ্ধের খবর আর যে দেশে তিনি "লক্ষ্মীর কল্যাণী মূর্তি" দেখেছিলেন সেই সোভিয়েত দেশ এর জেতার সামান্য কোনো খবর পেলেও শিশুর মতো খুশি হতেন, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিস এর মতো অন্তরঙ্গ সহচরকে বলে গিয়েছিলেন যে, "সোভিয়েত কখনো হার মানবে না।" এক বিষন্ন শ্রাবণ দিনে কবি চলে গেলেন, ব্যাথাতুর দেশবাসীর মহাগুরু পতনের আঘাত সইল, উপায়ন্তর ছিল না, মৃত্যু তো অবধারিত ঘটনা । তবে কবির ঋষিবাক্য ব্যর্থ হয় নি, যে দেশে তিনি 'লক্ষীর কল্যানী মূর্তি' দেখেছিলেন সেই সোভিয়েত দেশ পরম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রমাণ করলো যে সমাজবাদ অপরাজেয় [সূত্র: চিন্মহণ সেহানবীশ, রবীন্দ্রনাথ ও বিপ্লবী সমাজ, বিশ্বভারতী প্রকাশ]।

 ফ্যাক্ট চেকটি শেষ হল।

রবিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৫

অঙ্ক আর বিপ্লবের ডুয়েল ~ শুভময় মৈত্র


[যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেই নিয়ে বিভিন্ন ঘটনা এবং লেখা বারবার ফিরে আসে ভাবনায়। যখনই সেখানে কোন অকাজে যাই, সেসব কেজোকথার শেষে বেরোতে বেরোতে সন্ধে। চারপাশে ঝকঝকে পড়ুয়াদের কলতান, পাখির কিচিরমিচির, একটু দূর থেকে ভেসে আসা বাসের হর্নের মধ্যে হঠাৎ করে সময়যানে ফিরতে হয় সাড়ে তিন দশক। অনেক কিছুর মতই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এরকম এক পুরনো লেখা, যা হয়তো দু-এক জায়গায় ছাপা হয়েছে আগে, তবে সেভাবে পেশাদারী কোন কাগজে নয়। তাই আর কারও কোন অনুমতি না নিয়েই আপনাদের সামনে আর একবার টুকেই দিলাম পুরনো সেই তথ্য আর কল্পনার মিশেল, দু এক জায়গায় অল্প এদিক ওদিক করে। গবেষণার ক্ষেত্রে হলে নিশ্চিত চাকরি যেত, ওই যাকে বলে কিনা সেল্ফ প্লেজিয়ারিজম। সেকথা থাক। আগে পড়েছেন সে সম্ভাবনা খুবই কম। আর পড়ে থাকলে তো এই অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পেয়েই গেলেন। লেখাটি আমাদের এক অতিপ্রিয় অঙ্কের মাস্টারমশাই অধ্যাপক তরুণ কুমার মুখার্জীর স্মৃতিতে, সংক্ষেপে যিনি পরিচিত ছিলেন টিকেএম নামে। বহু বছর আগে যখন এই লেখাটা প্রথম লিখি, তখন তিনি সকলের মধ্যেই ছিলেন। আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল এ বছরের জুলাই মাসে যখন নতুন করে এই লেখাটি খুঁজে পেতে রিভাইজ করছি, ঠিক তার কদিন আগেই ফ্রান্সের নির্বাচনে তৃতীয় থেকে একলাফে প্রথম স্থানে চলে এসেছে বামপন্থীরা। এই লেখার প্রেক্ষিত সেই ফ্রান্সকে নিয়েই, তবে দু-আড়াই শতক আগে।]  

ছিপছিপে লম্বা চেহারার তরুণ-বাবু হেঁটে যাচ্ছেন লাল চেয়ারের পাশ দিয়ে। শিরদাঁড়া সোজা, কাঁধে ঝোলান একটা সপ্তর্ষিমন্ডল আকারের আঁকড়া দেওয়া কাঠের ছাতা। এইট-বি বাস-স্ট্যান্ড এর দিক থেকে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে একটু বাঁ দিকে গেলে ছাত্র সংসদের অফিস। রাজ্যে বহু রাজনৈতিক পরিবর্তন সত্ত্বেও অতি বামদের দাপট এই কচি সংসদে কখনও কমে নি। সেখান থেকে সোজা হাঁটলে ডান দিকে খেলার মাঠ আর বাঁদিকে ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া লাল চেয়ার। থুড়ি জায়গাটা আছে, কিন্তু সিমেন্টে বাঁধানো সেই প্লাস্টিকের চেয়ার গুলো আর নেই। সময়টা আশির দশকের শেষ ভাগ, সেপ্টেম্বর মাস প্রায় ফুরিয়ে এসেছে - কলকাতায় পুজোর গন্ধ। স্যার অঙ্কের ক্লাস শেষ করে ফিরছেন। তাঁর হাঁটার গতির সঙ্গে তাল সামলাতে ছাত্রদের রীতিমত ছুটতে হচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে তাঁকে ধরে ফেলল প্রণব। সঙ্গে আমরা আরও অনেকে। যাদবপুরের ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্ররা। কি দুর্ভাগ্য যে প্রযুক্তি বা বিজ্ঞান যাই পড়ো না কেন, অঙ্কের হাত থেকে নিস্তার নেই। ক্লাসে পরীক্ষার খাতা দিয়েছেন তরুণবাবু। আমাদের মত পরীক্ষায় নিয়মিত গাড্ডু খাওয়া ছেলেদের ধান্দা কি করে দু-এক নম্বর বাড়ানো যায়। "স্যার, এখানটা কেন কেটেছেন? আর একটু নম্বর কি এখানে বাড়ত না? আর এক নম্বর বাড়লেই আমার চল্লিশ হয়ে যেত", ইত্যাদি ইত্যাদি। তরুণবাবু রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কারো নম্বর বাড়িয়ে দিচ্ছেন, কাউকে বা একটা ছোট্ট ধমক। উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম হওয়া প্রণবের বক্তব্য অবশ্য অন্য। সে পুরো নম্বর পেয়েছে। কিন্তু তার একটা অঙ্কে সামান্য ভুল আছে, সেখানে স্যার নম্বর কাটেন নি। সে তাই নম্বর কমাতে ছুটেছে। প্রণবের দাবী শুনে চোখ কুঁচকে তাকালেন তরুণবাবু। "বুঝলে হে ছোকরা, অঙ্কের কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল সেটা বোঝার মত বয়স তোমার এখনো হয় নি। যোগ বিয়োগে ভুল হলেই নম্বর কাটা যায় না। ঠিকঠাক বুঝেছ কিনা সেটা দেখতে হয়। তুমি ভেবো না যে আমি মন দিয়ে খাতা দেখি নি। তোমার ভুলটা কোন ভুল-ই নয়। এ বয়েসে মানুষ তো কতরকমের ভুল-ই করে। কিন্তু কোন এক মে মাসের শেষ দিনে তোমাদের বয়সী একটা ছেলে যা ভুল করেছিল সে কথা ভাবলে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।"





আমাদের চোখ চকচক করে উঠল। তার মানে গল্প আছে। আমাদের বয়সী, অর্থাৎ ঊনিশ-কুড়ি। স্যারের গৌরচন্দ্রিকা মানে তো অঙ্কের কোন এক মস্তান লোকের জীবন নিয়ে জমজমাট আলোচনার সূত্রপাত। কিন্তু এত অল্প বয়েসের কে সেই লোক যার ভুল কিনা স্যারের মন খিঁচড়ে দেয়? সে আবার কি গোলমাল পাকাল? স্যারের গল্প কত বছর আগের কে জানে! ঘটনা সুদূর অতীতে যাই হোক না কেন, ঘটমান বর্তমানে আলগা ঘামে ভেজা বিকেলটা যে অসাধারণ কাটতে চলেছে সেটার একটা ক্ষীণ আভাস পাওয়া গেল। ততক্ষণে আমরা লাইব্রেরির কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। ডানদিকে ঘুরেই বউদির ক্যান্টিন। স্যারের পয়সায় হাতে গরম ফিসফ্রাই, বিকেলের শেষ রোদ্দুর আর তার সঙ্গে হাত ধরাধরি করে হেঁটে বেড়াবে অঙ্ক আর ইতিহাস। ফাটা প্লাস্টিকের টেবিলের পাশে গোল করে রাখা চার পাঁচটা চেয়ার। স্যারকে ঘিরে আমরা বসে পড়লাম। প্রণব, সুমিত, অরিন্দম, দেবজ্যোতি আর আমি। অঙ্কের নম্বরের নিরিখে বেশি থেকে কম, একশো থেকে আঠেরো।

"সে ছোকরা জন্মেছিল ১৮১১ সালের ২৫শে অক্টোবর। প্যারিসের দক্ষিণ শহরতলীতে বর‍্যো-লা-রেইন নামের একটা ছোট্ট জায়গায়। ১৭৯২ সালে ফরাসী বিপ্লবের সময় এই জায়গার নাম বদলে রাখা হয়েছিল বর‍্যো-লা-এগালিতে, অর্থাৎ সমতার কথা ঢুকে গেছিল নামের মধ্যে। বিপ্লব দীর্ঘজীবি হল, তবে সে ইতিহাস গত হলে পুরনো নামটা আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছিল ১৮১২ তে। নাহ, অনেকক্ষণ তোদের ঝুলিয়ে রেখেছি। সে সময়ের গোটা প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে। এবার বলেই ফেলা যাক, লোকটার নাম এভারিস্তে গ্যালোয়া। শুনেছিস কেউ?" তুমি থেকে ততক্ষণে আমরা তুই হয়ে গেছি। ফলে বোঝা গেল যে স্যারের মেজাজ দারুণ ফুরফুরে। তার মানে গল্প জমবে এবং কিছুক্ষণ পরে আর একবার চা সিঙ্গারার সম্ভাবনা প্রবল। বাংলা বানানে 'ণ'/'ন' না জানলে আমরা যেমনভাবে মাঝামাঝি লিখি সেরকম একটা মুখের ভাব করছিলাম। কিন্তু প্রণব এখানেও একশো। "হ্যাঁ স্যার জানি। অঙ্কের যাদুকর, মৃত্যু ডুয়েল লড়তে গিয়ে। ৩১শে মে, ১৮৩২, মাত্র ২০ বছর বয়েসে। ইতিহাসে কিছু বিতর্ক আছে, কিন্তু এরকম শোনা যায় যে মৃত্যুর আগের রাতে সে শেষ করে যায় এক অসাধারণ গবেষণা, যেটা গণিতজ্ঞদের মধ্যে গ্যালোয়া ফিল্ড নামে প্রসিদ্ধ।"

— "তাহলে তোরা সবই জানিস। কালকে ক্লাসে ওটাই পড়াব।" স্যার প্রায় উঠে পড়লেন। "না না স্যার, কিচ্ছু জানি না, সত্যি বলছি।"  হৈ হৈ করে আমরা লাফিয়ে উঠলাম। আমাদের দৃষ্টির আগুনে দুর্দান্ত ফরসা প্রণব ততক্ষণে ম্লানমুখ লুকোনোর জায়গা খুঁজছে। বারো ক্লাসে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে এক নম্বরে থেকে শান্তি হয় নি, সঙ্গে কোথাকার কোন ফরাসী গণিতজ্ঞ, সে ব্যাটাকেও গুলে খেয়েছে। আর তার জন্যে কিনা জমজমাট একটা ধারাবিবরণীর সঙ্গে চা সিঙ্গারা ফসকে যেতে বসেছে। যাদবপুরের বিশাল খেলার মাঠের দিক থেকে পথ খুঁজে নেওয়া টুকরো হাওয়া, ঝিল পেরিয়ে পাঁচিলের ওপারে রেল লাইন থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসা ট্রেনের ঘটঘট, সঙ্গে প্যারিসের রাস্তায় মনে মনে হেঁটে বেড়ানো, এতো কিছু একসঙ্গে দফারফা হয়ে যাওয়ার যোগাড়। স্যার উঠে দাঁড়িয়েছেন, পাশে প্রণব-ও। প্রণবের কাঁধে হাত রাখলেন স্যার। "তোর হবে। যা চা বলে আয়।" সমান লম্বা দুজন মানুষ। একই রকম ছিপছিপে চেহারা। একজন প্রায় ষাট, অন্যজন তার তিন ভাগের এক ভাগ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমরা। আমার অঙ্কে আঠেরো পাওয়া ভাঙ্গা মন ততক্ষণে দুঃখ ভুলে প্যারিসের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া শ্যেন-এর ঘোলা জলে ছলাত-ছল। (এবার অলিম্পিকে যার ওপর শোভাযাত্রা সহকারে উদ্বোধন, অর্থাৎ যখন এই লেখা রিভাইজ করছি সেই সময়।) অঙ্কে গোল পেলে কি হবে, ভূগোলে আমাকে হারায় কে? আমি তো ইতিমধ্যে হাঁটা লাগিয়েছি প্যারিসের পোড়া ইঁট সাজানো সরু গলিপথে।

— "গ্যালোয়ার বাবা উদারপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অষ্টাদশ লুই যখন ১৮১৪ সালে ক্ষমতায় ফিরে এলেন তখন তিনি গ্রামের মোড়লও হয়েছিলেন। গ্যালোয়ার মা ছিলেন জজের মেয়ে। ছোটবেলায় ছেলের পড়াশোনা তাঁকেই দেখতে হতো, স্বামী মোড়ল হলে যা হয় আর কি। ঠিক বারো বছরে ইশকুলে ঢোকে গ্যালোয়া। বছর-দুই ল্যাটিন আর পুরনো সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা ভালই চলছিল, কিন্তু এর মধ্যেই অঙ্কের নেশা তাকে পেয়ে বসে। হাতের কাছে পেয়ে যায় আর এক ফরাসী গণিতজ্ঞ অ্যাড্রিয়েন-মেরী লেজেন্ডার-এর (১৮ সেপ্টেম্বর ১৭৫২ — ১০ জানুয়ারী ১৮৩৩) লেখা জ্যামিতির বই। তোরা যেমন করে ফেলুদা পড়িস, সেই গতিতে জ্যামিতির ঐ কঠিন বই এক নিঃশ্বাসে নামিয়ে দিয়েছিল বাচ্ছা ছেলেটা। বছর পনেরো পেরতে না পেরতেই আর এক ফরাসী দিকপাল জোসেফ-লুই ল্যাগ্রাঞ্জের (২৫ জানুয়ারী ১৭৩৬ — ১০ এপ্রিল ১৮১৩) গবেষণার কাজকর্মও হজম করে ফেলেছিল সে।" চায়ে বেশ জোরে একটা চুমুক দিলেন তরুণ-বাবু। স্যারের কথার ফাঁকে অঙ্কের এইসব প্লাতিনি জিদান-দের চেনা নাম শুনে প্রণব মাঝে মাঝেই লাফিয়ে উঠে কিছু বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু পাশেই সদা সতর্ক সুমিত। কখনো কাঁধ চেপে ধরে, কখনো চিমটি কেটে রুখে যাচ্ছে তাকে। নব্বুই-এর দশকের গোড়ায় ইন্টারনেট ছিল না। ফলে আমাদের কাছে আজকালকার পড়ুয়াদের তুলনায় খবর থাকত অনেক কম। তার ওপর লেজেন্ডার সিম্বল কিম্বা ল্যাগ্রাঞ্জের ইন্টারপোলেশন আমাদের মত ফাঁকিবাজদের সঙ্গে যোগাযোগ করত শুধু পরীক্ষার আগের রাতে। তাই এই নামগুলো স্যারের বর্ণণা থেকে আমার কাছে ভেসে আসছিল আবছা আবিল্যির মত।

— "তোরা যেমন বাবার পয়সায় কোচিং এ পড়ে বারো ক্লাসের পর একবারে যাদবপুরে ঢুকে গেছিস, গ্যালোয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কিন্তু অত সহজ হয় নি। সেই সময় ফ্রান্সে অঙ্ক শেখার সবচেয়ে ভাল জায়গা ছিল ইকোলে পলিটেকনিক। ইন্টারভিউ-এ ভাল না করায় সে বেচারি সেখানে সুযোগ পেল না। তার বদলে পড়তে হল ইকোলে প্রিপারেটরিতে, যেটা কিনা সেই সময় অনেক কমা একটা জায়গা। তবে এটা মাথায় রাখিস যে সেই জায়গার নাম এখন ইকোলে নরমালে, আজকের দিনে বেশ নামজাদা। এখানকার মাস্টারদের সঙ্গে গ্যালোয়ার দহরম মহরম বেশ ভালই ছিল। ১৮২৮-এ এখানে ভর্তি হওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই ভগ্নাংশের ওপর একটা বেশ ভালো কাজও করেছিল গ্যালোয়া। তার জীবনের সবচেয়ে বড় অবদান অবশ্য পলিনোমিয়াল ইকুয়েশন, আর সে সমস্ত অঙ্কও এর মধ্যে শুরু করে দিয়েছিল সে। তার বয়েসটা ভাব একবার। তখন মাত্র আঠারো। হ্যাঁ, হ্যাঁ, অঙ্কের খাতায় তুই আজকে যে নম্বর পেয়েছিস সেটাই।" আমার দিকে কটমট করে তাকালেন স্যার। "পরের পরীক্ষায় সামলে নেব ঠিক।" মিনমিন করে বললাম আমি। এর বেশি আর কি-ই বা বলতে পারি? চোখের সামনে তখন সিনেমার মত চলে বেড়াচ্ছে বিশাল বিশাল গম্বুজ দিয়ে বানানো প্যারিসের এক ইউনিভার্সিটি। ছাইরঙা ইটের রাস্তা শেষ হয়ে শ্বেতপাথরের সিঁড়ি, দুপাশে ফোয়ারা আর সাজানো ফুলগাছের সারি। সেখানে ঢুকে অনেকটা গাড়িবারান্দার মত বিশাল জায়গা আর তার দুপাশে উঁচু উঁচু ক্লাসঘর, জানলার কাঁচগুলো রামধনুর রঙে রাঙানো। আমাদের তরুণবাবুর মতই পড়াচ্ছেন এক ফরাসী অধ্যাপক। গায়ে বকলস লাগান সাদা জামা, পরনে কালো প্যান্ট। আমার চারপাশে বিভিন্ন ডেস্কে বসে ঝলমলে চেহারার সব রাজপুত্তুর রাজকন্যেরা। সামনে বড় বড় তিনটে বোর্ডে একটানা লিখে যাচ্ছেন অধ্যাপক, মাঝে মাঝে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। পেন্ডুলামের মত দুলে উঠছে লালচে চুলে মুক্তোর হার ঢেকে যাওয়া ফরাসী রাজকন্যেদের ঘাড়। রাজপুত্রেরা প্রায় স্থির। তাদের চোখ কখনো বোর্ডের দিকে, কখনো বা নিজেদের বাঁধানো খাতায়।

— "এর মধ্যে গ্রামের পুরোহিতের সঙ্গে বিভিন্ন গোলমালে জড়িয়ে পড়ে ১৮২৯ সালে আত্মহত্যা করে বসেন গ্যালোয়ার বাবা। সেই সব ঝামেলার মধ্যে তার কদিন পরেই আবার ইকোলে পলিটেকনিকে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করে গ্যালোয়া। কিন্তু ভাগ্যদেবী এবারেও সহায়তা করলেন না। গ্যালোয়া তার নিজের গবেষণার কাজ যেভাবে বোঝানোর চেষ্টা করল সেটা মানতে পারলেন না পরীক্ষকেরা। সেই বছরের একদম শেষের দিকে ইকোলে প্রিপারেটরিতে থেকেই ডিগ্রি পেল সে। যদিও সে পরীক্ষাতেও নাকি গ্যালোয়ার সমস্ত ব্যাখ্যা বুঝতে পারেন নি পরীক্ষকেরা। এর মধ্যে গবেষণা অবশ্য থেমে থাকে নি। দুর্ভাগ্য যে বার বার তার গবেষণাপত্র ফিরিয়ে দিয়েছেন সেই সময়কার বিশেষজ্ঞরা। শেষপর্যন্ত ১৮৩০-এ গ্যালোয়ার তিনখানা গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় যার মধ্যে একটা খুব গুরুত্বপুর্ণ অংশ গ্যালোয়া থিওরী নামে সারা পৃথিবীতে আজ বিখ্যাত।" স্যার বোধহয় আর একটু হলেই সে সব থিওরী বোঝানোর একটা সৎ প্রয়াসে সামিল হতেন। কিন্তু অরিন্দমের ছোট্ট হাই আর দেবজ্যোতির আরামোড়া ভাঙ্গা দেখে বিরত হলেন।

— "একঘেয়ে লাগছে বুঝি? কিন্তু গল্পের আসল জায়গাটাই তো বাকি। তবে তোদের যদি ভাল না লাগে তাহলে আজকে এই পর্যন্তই থাক। পরে না হয় বাকিটা শুনে নিবি। বাড়ি ফেরার সময় তো তো প্রায় হয়েই এলো।" স্যার আবার উঠে দাঁড়ানোর ভঙ্গী করলেন। এবার কিন্তু প্রণবই বাঁচালো। "পাঁচটা কুড়ির ট্রেন চলে গাছে স্যার। এর পরেরটা ছটা পঁয়তাল্লিশ।" আড়চোখে নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সবে পাঁচটা বেজেছে। স্যার হাতে ঘড়ি পরেন না, আর আশির দশকে কলকাতায় মোবাইলের আবির্ভাব হয় নি। "ঠিক আছে, তাহলে শেষ করে ফেলাই যাক।" স্যার আবার শুরু করলেন। "প্যারিসে তখন চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা। ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ সময় ১৮৩০-এর জুলাই মাস। রাজা দশম চার্লসকে উল্টে দেওয়া হয় এইসময়ে। ২৬শে জুলাই এই বিদ্রোহ সামাল দেওয়ার জন্যে একগাদা জোরালো দমননীতি জারি করার চেষ্টা করেন রাজা। তার মধ্যে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও খর্ব করা হয়। কিন্তু এসব করে কি আর বিদ্রোহ রোখা যায়? প্যারিসে সেদিন বেশ গরম ছিল, বুঝলি। সঙ্গে জনগণের মাথাও। ২৭ তারিখ সকাল থেকেই লোকজন পথে নামতে শুরু করে। আর ২৯ তারিখের মধ্যেই রাজার রাজত্বের পতন এবং মূর্ছা। এইসব রাজনৈতিক কর্মকান্ডে গ্যালোয়াও জড়িয়ে পড়েছিল। সারা প্যারিসের মানুষ যখন রাস্তায় নেমেছে, তখন ছাত্ররাও পিছিয়ে ছিল না। ইকোলে পলিটেকনিকের পড়ুয়ারা বিদ্রোহে যোগ দিলেও, ইকোলে প্রিপারেটরিতের অধিকর্তা সেখানকার ছাত্রদের আটকে রেখেছিলেন। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে খবরের কাগজে চিঠি লেখে গ্যালোয়া এবং এই কারণে পরবর্তীকালে সে বহিষ্কৃত হয় ইউনিভার্সিটি থেকে। যদিও তার আগে সে নিজে থেকেই সেখানকার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল।"

— "জুলাই মাসের গোলমালের পরে ক্ষমতা দখল করেন লুই-ফিলিপ। এই সময় রিপাবলিকানদের সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দেয় গ্যালোয়া। সে দলের নাম ছিল ন্যাশনাল গার্ড। বিভিন্ন রাজনৈতিক বিবাদে ঐ সময় এই দলকে বেআইনি ঘোষণা করা হয় আর এদের কিছু লোককে ভরা হয় জেলে। তারা অবশ্য কয়েকমাসের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যায়। সেই উপলক্ষে ১৮৩১-এর ৯-ই মে এক বিপুল পানভোজনের আয়োজন হয়েছিল। সেখানে রাজা লুই-ফিলিপ থেকে আলেক্সান্ডার দ্যুমার মত বিখ্যাত লেখক-ও উপস্থিত ছিলেন। কথিত আছে যে রাজার সামনে মদের গেলাস তুলে উচ্ছ্বাস দেখানোর সময় গ্যালোয়া নাকি একটা ছুরি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। রাজা অনুমান করেন যে তাঁকে ভয় দেখাচ্ছে গ্যালোয়া এবং সেই অপরাধে তাকে পরের দিনই জেলে ঢোকানো হয়। অবশ্য মাসখানেক বাদেই জেল থেকে মুক্তি পায় সে।" একটানা বলে একটু দম নেওয়ার জন্যে থামলেন তরুণবাবু। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন, "বাস্তিল দূর্গের পতন কবে হয়েছিল?" অঙ্কে টঙ্ক না হলেও, ইতিহাসে আমি মোটেই পাতিহাঁস নই। ফলে গড়গড় করে বলতে শুরু করলাম। "ওটা ফ্রান্সের স্বাধীনতা দিবস স্যার। ১৪-ই জুলাই, ১৭৮৯। বিপ্লবের ধাক্কায় বাস্তিল দূর্গের পতন। দিনটাকে ওরা স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করে।"

— "ঠিকই বলেছিস। আমার গল্পের জন্যে এটুকুই যথেষ্ট।" আমাকে চট করে থামিয়ে দিয়ে আবার শুরু করলেন স্যার। "১৮৩১ সালে ওই দিনটা উদযাপনের আনন্দে গ্যালোয়া এক সশস্ত্র মিছিলের নেতৃত্ব দিতে বেরিয়ে পরে। গায়ে পোশাক ছিল ন্যাশনাল গার্ড-দের, যেটা তখন সম্পুর্ণ বেআইনি। এই অপরাধে আবার ৬ মাসের জন্যে জেলে পোরা হয় তাকে। এবার জেলে থাকার সময় গ্যালোয়া ফের গবেষণাতে মন দেয়। ২৯-শে এপ্রিল, ১৮৩২-এ জেল থেকে ছাড়া পায় সে। কিন্তু আবার শুরু হয়ে যায় জোরদার বৈপ্লবিক কর্মকান্ড। যদিও জটিল বীজগণিত নিয়ে কাজ চলতে থাকে একইসঙ্গে। ভাবাই যায় না যে ছেলেটা কি করে একহাতে ঐরকম ঝুঁকির রাজনীতি আর অন্যহাতে গভীর অঙ্ক সমান্তরালভাবে চালিয়ে যাচ্ছিল। তোদের এক একটা ইউনিয়নের নেতা তো অঙ্কের খাতা ফাঁকা রাখাই বেশি পছন্দ করে।" মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকালেন স্যার। বোধহয় আমার মনের কথাটা বুঝতে পারছিলেন। আমি তখন ভাবছি যে পরের পরীক্ষাতে মাথায় শিরস্ত্রাণ চাপিয়ে আর হাতে ছুরি নিয়ে যোদ্ধার বেশে মোকাবিলা করব অঙ্ক প্রশ্নের। তাতে যদি কয়েকমাস জেলে যেতে হয় তাও ভাল, কিছুদিন তো অঙ্ক থেকে মুক্তি!

— "গ্যালোয়ার জীবনটা যদি শুধু অঙ্ক আর বিপ্লব এই দুই বিন্দুকে যোগ করা সরলরেখার মধ্যে দিয়ে চলত তাহলে হয়ত গল্পটা এভাবে শেষ হত না। কিন্তু বাধ সাধল এক তৃতীয় বিন্দু। যে মহিলার নাম স্তেফানিয়ে-ফেলিসি পোতেরিন দ্যু মোতেল। সে সময় গ্যালোয়া যে হোস্টেলে থাকত সেখানকার ডাক্তারের মেয়ে ছিল এই দ্যু মোতেল। ত্রিকোণ প্রেমের গল্প নাকি রাজনৈতিক শত্রুতা সে কথা আজও সঠিক জানা যায় নি, কিন্তু এটা জানা যায় যে এই মহিলা সম্পর্কিত কোন এক ঘটনায় ডুয়েল-এর চ্যালেঞ্জ নিয়ে বসে গ্যালোয়া। আলেক্সান্ডার দ্যুমার ভাষ্য অনুযায়ী প্রতিদ্বন্দ্বী যুবকের নাম পেসচেউক্স দ্য'হারবিনভিলে। যাদের মুক্তি উপলক্ষে বিরাট পান ভোজনের আয়োজন হয়েছিল, সে নাকি তাদেরই একজন। অন্য একটা মত বলে সম্ভবত সেই ছেলের নাম আরনেস্ট ডুচাটেলেট, যে গ্যালোয়ার সঙ্গে একইসময়ে জেলে গেছিল সশস্ত্র মিছিলে অংশগ্রহণ করে। ডুয়েল হয়েছিল ৩০-শে মে। লড়তে গিয়ে তলপেটে গুলি লাগে গ্যালোয়ার। পরদিন সকালে সে মারা যায়। মৃত্যুর আগে সে নাকি তার ভাইকে বলে গেছিল - কাঁদিস না আলফ্রেড, কুড়িতে মরার জন্যে আমাকে সমস্ত সাহস একসঙ্গে জড়ো করতে হয়েছে।" আমরা সবাই চুপ। স্যার উঠে দাঁড়িয়েছেন। নজরে আসে নি কখন শরতের সন্ধেটা ঝুপ করে আমাদের কাঁধে চেপে বসেছে।

------
~Saibal