সোমবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

ভাষা হোক উন্মুক্ত! ~ সেখ সাহেবুল হক

-'তোর তৈরী সফটওয়্যারের দাম কত রাখবি?'

-'দাম রাখবো কেন? কোনো টাকা পয়সা দিতে হবে না। ভাষার জন্য টাকা নেবো কেন?'

এক সিনিয়রকে এভাবেই বলেছিলেন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের এক তরুণ। কালক্রমে তাঁর তৈরী সফটওয়্যার ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলা লেখার পন্থাকে খুব সহজ এবং সরল করেছে। 'ami ekjon bangali' টাইপ করলে খুব সহজেই বাংলায় 'আমি একজন বাঙালি' লেখা হয়ে যায়। এর অবদান বাঙালি সন্তান মেহদী হাসানের। 


একসময় কম্পিউটারে বাংলা লেখা ছিল বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। টাইপ শেখার মতো বাংলা টাইপ শিখতে হতো। আস্তে আস্তে সড়গড় হয়ে তারপর বাংলা লেখা যেতো। মেহেদী হাসানের  সফটওয়ারের দৌলতে বাংলা লেখা খুব সহজ হলো। কম্পিউটার ছাড়াও স্মার্টফোনে বাংলা লেখার কৌশল আজ আমাদের হাতের মুঠোয়। ফেসবুক স্ট্যাটাস-কমেন্ট ছাড়াও হোয়াটসঅ্যাপ বা অন্য যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলা লিখে ভাব বিনিময় সহজ হয়েছে। সর্বোপরি, বাঙালি সাধের খিস্তিখেউড় বাংলায় করতে পারে। বাংলা হরফে গালাগালির স্বাদই আলাদা। যিনি খান, তিনি যেমন ঠিকঠাক স্বাদ পান, আবার যিনি দেন, তিনিও যথাযথ সুখ পান।   

 
বইমেলা উপলক্ষে ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের বাংলা অ্যাকাডেমি চত্বর সেজে উঠেছিল বইয়ের স্টলে। সেবার বইমেলায় 'বাংলা ইনভেনশ থ্রু ওপেন সোর্স', সংক্ষেপে 'বায়োস' নামে একটি সংগঠন অংশগ্রহণ করে। এই সংগঠনের সদস্যরা মেলায় সম্পূর্ণ বাংলায় 'লোকালাইজ করা' একটি লিনাক্স ডিস্ট্রোর প্রদর্শনী করেছিলেন। যার পোশাকি নাম ছিল 'বাংলা লিনাক্স'।

'বাংলা লিনাক্স' -র সাহায্যে বাংলা লেখার পাশাপাশি উইন্ডোর টাইটেল, মেনু বা ফাইলের নামকরণ সবই বাংলায় করা যায়। দুর্দান্ত সিস্টেমটি সবার নজর কেড়েছিল। কারণ বাংলা লেখার জন্য প্রচলিত কীবোর্ড গুলিতে সহজে বাংলা লেখা যেত না। অপারেটিং সিস্টেমটিও সম্পূর্ণ বাংলায় ছিল না।

 
'বায়োস' এর প্রদর্শনীতে একটি ছেলে দাঁড়িয়েছিল, প্রোগ্রামিংয়ে যার ভীষণ আগ্রহ ছিল। সে বাড়ি ফিরেছিল প্রদর্শনীর ব্যাপারে ভাবতে ভাবতে। এরপরই কীভাবে এমন একটা কিছু বানানো যায়, যা দিয়ে অতি সহজে সকলে বাংলা লিখতে পারা যাবে, এই স্বপ্ন তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে। বইমেলার সেই ছেলেটিই ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র মেহদী হাসান খান। অভ্র সফটওয়্যার আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে যিনি বাংলা লেখায় নিঃশব্দ বিপ্লব এনেছিলেন। 

 

প্রথমে মেহদী 'বায়োস' এর লিনাক্স নিয়ে চর্চা শুরু করেন। কিন্তু তাঁর কম্পিউটারে উইন্ডোজ থাকায়, বাংলা লিনাক্স দিয়ে কাজ করতে পারছিলেন না। প্রোগ্রামিংয়ে নিবেদিতপ্রাণ ছেলেটির মনে এই ব্যাপারটি নিয়ে তীব্র কৌতুহল ছিলো। সেজন্য বাংলা লিনাক্সের ওই ফন্টটি ইনস্টল করেন। এসময় তার নজরে এলো একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। মাইক্রোসফট ওয়ার্ড কীবোর্ডের ইনসার্ট ক্যারেক্টার ব্যবহার করে ওই ফন্টের ক্যরেক্টারগুলো আনা সম্ভব এবং তা বেশ ভালো কাজ করে। তবে এটি বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, বিরক্তির উদ্রেক করে। মেহদী চাইছিলেন বাংলা লেখার এমন একটি সিস্টেম, যার সাহায্যে যে কেউ সহজেই বাংলা লিখতে পারবেন। 

 
ক্রমশ মেহদী উপলব্ধি করলেন, তাঁর একটি কীবোর্ডের প্রয়োজন, যার সাহায্যে ইউনিকোড দিয়ে খুব সহজেই বাংলা লেখা যাবে। কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলেন না তিনি। তিনি বুঝতে পারলেন, এমন কীবোর্ড পেতে হলে তাঁকেই তৈরি করতে হবে।

 
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়াশোনার মাঝে তাঁকে সৃষ্টির নেশা গ্রাস করলো। নাওয়া-খাওয়া ভুলে হোস্টেল রুমের দরজা জানালা বন্ধ করে সারাক্ষণ বসে বসে কী যেন করতে লাগলেন! শিক্ষকরা এবং সহপাঠীরা ভাবলেন, ছেলেটা মায়ের ভোগে গেল!
একদিকে পড়াশোনা অন্যদিকে ইউনিকোডভিত্তিক কীবোর্ড বানানোর চেষ্টা। এভাবেই একদিন মেহদী তৈরি করে ফেললেন একটি প্রোটোটাইপ।

 
এই অ্যাপ্লিকেশনটি মেহদী প্রথমে বানিয়েছিলেন মাইক্রোসফটের ডটনেট ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করে। কারণ অ্যাপ্লিকেশনটি তিনি বানিয়েছিলেন উইন্ডোজের জন্য। এইসময় ভারতে আয়োজিত বাংলা ফন্ট তৈরির একটি প্রতিযোগীতায় মেহদী নিজের তৈরি প্রোটোটাইপটি বাংলাদেশ থেকে পাঠালেন। মেহদীকে উদ্যোক্তারা জানালেন, তাঁর তৈরি প্রোটোটাইপটি ঘন ঘন ক্র্যাশ হচ্ছে।

 

মেহদী এবার ডটনেট বাদ দিয়ে 'ক্ল্যাসিক ভিজু্য়্যাল' এর ওপর ভিত্তি করে আবার একটি প্রোটোটাইপ তৈরি করলেন। আর ক্র্যাশের সমস্যা রইলো না। আর এভাবেই তৈরি হলো অভ্রর বর্তমান ফ্রেমওয়ার্ক। সফল হলো বইমেলায় 'বায়োস' এর তৈরি ফন্ট দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে শুরু করা মেহেদীর যাত্রা।

মেহদীর তৈরী অভ্রর ওয়েবসাইটটির নাম ওমিক্রন ল্যাব। অভ্রর সঙ্গে ওমিক্রন ল্যাবের জন্ম। অভ্রর এই অফিসিয়াল সাইট 'ওমিক্রন ল্যাব' কে ছড়িয়ে দেওয়াটা ছিল আরেকটি চ্যালেঞ্জ। সাইটটিকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতেও তাঁকে বেশ পরিশ্রম করতে হয়।

 

পড়াশোনায় অমনোযোগী মেহদীকে কয়েকজন শিক্ষক এবং পরিচালন কমিটির লোকজন একসময় মেডিকেল ছেড়ে দিতে বলেন বলেও শোনা যায়। কিন্তু তিনি তখন সাইটে নিয়মিত আপডেট দিতে, ম্যানুয়াল লিখতে, ভার্সন নম্বর বাড়াতে এবং ব্যবহারকারীদের প্রশ্নের উত্তর দিতেই ব্যস্ত। এভাবেই কালক্রমে অভ্র পৌঁছে যায় ব্যবহারকারীদের কম্পিউটারে। 'কম্পিউটার টু-মরো' নামের একটি মাসিক পত্রিকায় সেই খবর প্রকাশিত হয়।

 

এই কর্মকাণ্ড মেহদী একা শুরু করলেও চলার পথে তিনি সঙ্গে পেয়েছিলেন দেশ বিদেশের বন্ধুদের। অভ্রর ম্যাক ভার্সন প্রস্তুতকারী রিফাত উন নবী, অভ্রর কালপুরুষ ও সিয়াম রুপালী ফন্টের জনক সিয়াম, অভ্রর বর্তমান ওয়েবসাইট ও লিনাক্স ভার্সন প্রস্তুতকারী সারিম এবং মেহদীর স্ত্রী সুমাইয়া নাজমুনসহ আরো অনেকের সহযোগিতা পেয়েছিলেন মেহেদী।   

 

'ভাষার জন্য টাকা নেবো কেন?' বলা তরুণটি শেষ পর্যন্ত সত্যিই তাঁর নিজ মাতৃভাষাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন সকলের জন্য। অভ্র কীবোর্ড পোর্টালটি বিনামূল্যে উন্মুক্ত করেন তিনি। তথ্য প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা উন্মুক্ত হতে থাকে। তৈরী হয় ডিজিটাল মাধ্যমে ভাষার নতুন ইতিহাস।

 
স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সর্বত্রই অভ্র বিনামূল্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিনামূল্যে বাঙালি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলা লিখতে পারছে, প্রচারবিমুখ মেহদীর স্বপ্ন সফল হচ্ছে প্রতিটি অক্ষর টাইপের মধ্য দিয়ে। তাঁর স্লোগানই ছিল, 'ভাষা হোক উন্মুক্ত'।

মেহদী হাসান খানের সফটওয়্যার অভ্র বাংলা ভাষাকে দিয়েছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বাংলাভাষায় লেখালিখি করার চটজলদি সুযোগ। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি না পেলেও মেহদী পেয়েছেন বেশ কিছু সম্মাননা। মাইক্রোসফটের অনলাইন সংগ্রহশালায় ইন্ডিক ভাষাসমূহের সমাধানের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে অভ্র কীবোর্ডকে। 
অভ্রকে বাংলা কীবোর্ড রিসোর্স হিসেবে ইউনিকোড সংস্থার ওয়েবসাইটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া বাংলা তথ্য প্রযুক্তিতে বিশেষ অবদানের জন্য 'অভ্র টিম' কে বেসিস বাংলা থেকে দেওয়া হয় 'স্পেশাল কন্ট্রিবিউশন' পুরস্কার। ২০১৬ সালে মেহদী হাসান টপ টেন 'আউটস্ট্যান্ডিং ইয়ং পার্সনস' হিসেবে স্বীকৃতি পান।  

শিক্ষকদের আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করে ভালো ফল নিয়ে উত্তীর্ণ হলেও চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে নেননি। তিনি প্রোগ্রামিংয়ের নেশাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন।

বাংলা ভাষাকে ডিজিটাল মাধ্যমে উন্মুক্তকারী মেহদী হাসান খান একজন 'যথাযথ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়া ভাষা সৈনিক'। সালাম, বরকত, জব্বারদের উত্তরসূরী মেহদী। তিনিও লড়াই করেছেন বাংলা ভাষাকে উন্মুক্ত করার স্বপ্ন নিয়ে। অনেকাংশেই তিনি সফল। 

কিন্তু আজও তাঁর বানানো সফটওয়্যার ব্যবহার করে যখন কেউ লেখেন, 'মোল্লারা কবে বাঙালি হলো?' অথবা 'বাংলাদেশি' শব্দ বিকৃত করে গালাগালি দেওয়া দেখলে মনেহয়, আমাদের আরও লড়ে যেতে হবে, মাতৃভাষার জন্য, বাঙালিয়ানার জন্য। যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, ভাষার ইতিহাস থাকবে, বাঙালি সন্তান মেহদী হাসান থাকবেন! ডিজিটাল মাধ্যমে অভ্র ব্যবহার করে লেখা প্রতিটি বাংলা অক্ষর তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যাবে অজান্তেই।  

তথ্যসূত্রঃ বিভিন্ন বাংলাদেশি ওয়েবসাইট। লেখার মূল তথ্যগুলো সেখান থেকেই ধার করা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন