বুধবার, ৮ জুলাই, ২০২০

ভারতীয় রেল বেসরকারীকরণ ~ শতদ্রু দাস

রেলের বেসরকারীকরণ নিয়ে কিছু ভুল ভাল মিথ্যে কথা বাজারে ঘুরছে,  যারা কিছু না জেনে না বুঝেই "basarkari hola bhalo hoba" বলে থাকে তারা সেগুলো চোখ কান বুজে খাচ্ছেও। তাই কয়েকটা কথা বলা জরুরি।

১. বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে, যেখানে বহু মানুষ ট্রেন ব্যবহার করেন, সেখানে রেল সরকারি সংস্থা বা পাবলিক সেক্টর ইউনিট।

২. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ক্যানাডাতে রেল বেসরকারী কিন্তু ওই দেশগুলোতে খুব কম সংখ্যক মানুষ রেল ব্যবহার করেন। এসব দেশগুলোয় সাধারণ মানুষের যাতায়াতের উপায় হলো গাড়ি বা বিমান। আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায়  অধিকাংশ স্থানে বিমান ভাড়া রেল ভাড়ার চেয়ে সস্তা বিশেষ করে দূরপাল্লার যাত্রায়। এসব দেশগুলোতে রেল মূলত  বিলাসবহুল যাত্রার জন্য ব্যবহৃত হয়, পর্যটকরা ব্যবহার করে। 

৩. ইউরোপের সর্ববৃহৎ রেল সংস্থা ফ্রান্সের এসএনসিএফ, সরকারী সংস্থা। দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ হলো জার্মানির ডয়েচ বান, সেটাও পাবলিক সেক্টর ইউনিট।

৪. বিশ্বের সর্ববৃহৎ রেল নেটওয়ার্ক যে দেশের সেটি হলো চীন। বলাই বাহুল্য যে সেখানে রেল সরকারী সংস্থা।

৫. জাপান হলো এক মাত্র দেশ যেখানে  সাধারণ মানুষ রেল ব্যবহার করেন, রেলের নেটওয়ার্ক বৃহৎ, এবং রেল মূলত বেসরকারী (সরকারীও আছে, তবে সবচেয়ে ব্যস্ত রুটগুলো বেসরকারী।) কিন্তু জাপানের রেল বেসরকারীকরণ হয়েছে এক বৃহৎ কেলেঙ্কারির ওপর দাঁড়িয়ে, যার গল্প  ভারতের ক্ষেত্রে খুবই প্রযোজ্য। ভারতের মতোই জাপানের রেলও সম্পূর্ণ সরকারী সংস্থা ছিল ৮০-এর দশক অবধি। ৮০-এর দশকে জাপানে রেল বেসরকারীকরণ হয়, কিন্তু জাপানের রেলের বিপুল ঋণভার কোনো বেসরকারী সংস্থাই নিতে নারাজ হয়। তাই বেসরকারীকরণের জন্য এক অভিনব পন্থা অবলম্বন করে জাপান সরকার। একটি সরকারী সংস্থা বানিয়ে রেলের যাবতীয় ঋণ সেই সংস্থার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। সেই ঋণের মোট পরিমাণ ২৪ লক্ষ কোটি টাকা আজকের টাকার অংকে, তৎকালীন জাপানের জাতীয় আয়ের চেয়েও বেশি। যে সব বেসরকারী সংস্থা রেলের নেটওয়ার্ক কিনবে তাদের সাথে এই মর্মে চুক্তি হয় যে প্রতি বছর রেল চালিয়ে লাভের একটা অংশ তারা দেবে এই ঋণগ্রস্ত সরকারী সংস্থাটিকে যা দিয়ে সেই ঋণকে একটু একটু করে শোধ করা হবে। যদি লোকসান হয় বা লাভ খুব কম হয় তাহলে বেসরকারী সংস্থাগুলোর কোনো দায় থাকবে না ঋণ শোধের। অর্থাৎ ভালোটা প্রাইভেট কোম্পানির, খারাপের বোঝা শুধু সরকারের। এরপর রেল চালাতে গিয়ে দেখা যায় যে বেসরকারী সংস্থার ল্যাজে গোবরে দশা, বিপুল কর্মী ছাঁটাই করেও তারা লাভ করতে হিমশিম খাচ্ছে, ঋণ শোধ করতে গিয়ে রেলের লাইন বা স্টেশন বা জমি বিক্রি করতে হচ্ছে। তখন সরকার ঠিক করে যে মানুষের করের টাকা থেকেই ধার মেটানো হবে, বেসরকারী সংস্থার দায় নেই। সেই ২৪ লক্ষ কোটি টাকার ভেতর ১৬ লক্ষ কোটি টাকা এখনো পর্যন্ত মানুষের করের টাকা থেকেই মিটেছে, বাকিটা এখনো বকেয়াই পড়ে আছে। অর্থাৎ ভাবুন, বেসরকারীকরণ করতে গিয়ে মানুষের কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে বেসরকারী সংস্থাকেই সাবসিডি দিতে হয়েছে। 

ভারতে রেল বেসরকারীকরণ হলে সেটাও ওই জাপানী পথেই হওয়ার সম্ভাবনা। ভারতীয় রেল একসময় অনেক অংশেই বেসরকারী ছিল, সেগুলোকে সরকার বাধ্য হয়ে গ্রহণ করে কারণ বেসরকারী সংস্থাগুলো একে একে বন্ধ হয়েছিল। রেলের কোচ, কামরা, রেল লাইন বানানোর বহু সংস্থা কয়েক দশক আগেও বেসরকারী ছিল, তাদের ভরাডুবি হতেই সরকার বাধ্য হয়ে সেগুলো গ্রহণ করে। চোখের সামনেই উদাহরণ বার্ন স্ট্যান্ডার্ড আর টেক্সম্যাকো। বার্ন স্ট্যান্ডার্ড সরকার অধিগ্রহণ করে, আর টেকসম্যাকো ধুঁকছে, সরকারী খয়রাতির ওপর বেঁচে আছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন