এক্সকিউস মি! আপনি কি হিন্দু? তাহলে চাপ নেবেন না প্লিজ। বিজেপি ক্ষমতায় থাকতে কোন বাপের ব্যাটার হিম্মত হবে না হিন্দুদের একইঞ্চি ক্ষতি করার!
দেখলেন না কেমন কায়দা করে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে বাংলাদেশ-পাকিস্তান-আফগানিস্তানে ধর্মীয় উৎপীড়নের শিকার 'হিন্দু শরণার্থীদের' নাগরিকত্ব দেওয়ার বন্দোবস্ত করে দিল। মাস্টারস্ট্রোক! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবার বলছেন "দেশ জুড়ে NRC হবে।" হুইস্কি অন দি রক্স। জাস্ট ভাবুন, কাল সকালে পশ্চিমবঙ্গে NRC চালু হচ্ছে। এক লহমায় আপনি-আমি, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষ রাজ্যের ৯কোটি মানুষ অ-নাগরিক হয়ে যাচ্ছে। ঘরে রাত জেগে চলছে পুরনো নথি জোগাড়ের চিরুনি তল্লাশি। আপনি অফিস-স্কুল-কাছারি ছেড়ে, আপনার বৌ ছোলার ডালটা সেদ্ধ করতে ওভেনে বসিয়ে, আপনার বুড়ো বাপ হাঁপানি নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে, আপনার মা বাতের ব্যথা নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে, দিনের পর দিন সরকারী অফিসের চক্কর কাটছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছেন। নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণের সম্ভাব্য নথি হাতে নিয়ে আর পরিচয় হারানোর দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে। কি থ্রিলিং ব্যাপার তাই না? আমার তো মশাই ভেবেই কেমন একটা রোমাঞ্চ হচ্ছে! আর আপনার?
জমা দেওয়া নথি বিজেপির পছন্দ হলেই কেল্লাফতে। আপনি হলেন গিয়ে 'নাগরিক'। আর বাদ পড়লে 'অ-নাগরিক'। ঐ যেমন আসামে বাদ পড়া ১৯লক্ষের ১২ লক্ষই হিন্দু। কিন্তু আপনি একদম ঘাবড়াবেন না! মনে মনে ১০৮বার বলবেন 'মাস্টারস্ট্রোক।' তারপর সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে আবেদন করবেন। সিম্পল!
ধরুন আপনি ৫পুরুষ ধরে এদেশে আছেন, রেশন তুলেছেন, পড়াশুনা করেছেন, চাকরি পেয়েছেন, এমনকি এই লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি কে ভোটও দিয়েছেন; কিন্তু নাগরিকত্ব প্রমাণের নথি আপনি গুগল সার্চ করেও জোগাড় করতে পারেন নি। তাহলে আর কি? 'পুরানো সেই দিনের কথা' ভুলে গিয়ে, নতুন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে আবেদন করে, জাস্ট স্বীকার করে নিতে হবে যে আপনি এতদিন এদেশে ছিলেন 'অবৈধ শরণার্থী' হয়ে আর বাংলাদেশ-পাকিস্তান-আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছিলেন ধর্মীয় নিপীড়নের তাড়া খেয়ে। ব্যাস! তারপর ধর্মীয় নিপীড়নের ছোট্ট একটা প্রমাণ ঠুকে দিলেই ল্যাঠা চুকে গেলো। এবার বিজেপির আশীর্বাদ পেলেই আপনি কমপক্ষে ৫বছরের জন্য হয়ে যাবেন 'বৈধ শরণার্থী'। মানে ছিলেন 'নাগরিক' হবেন 'বৈধ শরণার্থী'। কিউট ব্যাপার না? হিন্দু হয়ে এইটুকু স্যাকরিফাইস করবেন না মশাই? কাম-অন। মনে রাখবেন বিজেপি ক্ষমতায় থাকতে কোন বাপের ব্যাটার হিম্মত হবে না হিন্দুদের একইঞ্চি ক্ষতি করার!
অমিত শাহ বলেছেন, নাগরিকত্ব আইনে সংশোধনের ফলে "লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি" মানুষ উপকৃত হবেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার হিসেব, সুবিধা পাবেন গোটা দেশে মাত্র ৩১,৩১৩ জন। ২৫,৪৪৭ জন হিন্দু, ৫,৮০৭ জন শিখ, খ্রিস্টান ৫৫ জন, ২ জন বৌদ্ধ, ২ জন পার্সি। তা শুধুমাত্র এই ৩১,৩১৩ জন মানুষ কে নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য দেশের ১৩২ কোটি মানুষ কে লাইনে দাঁড় করিয়ে দেওয়াটা কি মশা মারতে কামান দাগার আদর্শ উদাহরণ হিসেবে স্কুলের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে? এরকম প্রশ্ন যদি কেউ করে তাহলে বুঝবেন সে 'দেশদ্রোহী'। হিন্দু হিসেবে আপনার কর্তব্য চোখ-কান বন্ধ রেখে, বুদ্ধি-বিবেক বেচে দিয়ে, দিনের দু-বার গোমূত্র সেবন করে, বিজেপির উপর পূর্ণ আস্থা বজায় রাখা।
আপনার নোট বাতিল মনে নেই? আচ্ছা বুকে হাত রেখে একজনও হিন্দুর নাম আপনি বলতে পারবেন যাকে নোট বাতিলের সময় ATM-র লাইনে দাঁড়াতে হয়েছিল? পারবেন না। কারণ, হিন্দুরা তো তখন শীতের সকালে ব্যালকনির মিঠে রোদ্দুরে বসে গ্রিন টি খাচ্ছিল আর ব্যাঙ্ক গুলো হিন্দুদের বাড়ি বয়ে নগদ জোগান দিয়ে গিয়েছিল। সে RBI যতই বলুক নোট বাতিলে কোন কালো টাকা উদ্ধার হয়নি, জাল নোট ধরা পড়েনি, দেশকে ক্যাশলেশ করা যায়নি। রঘুরাম রাজন যতই চিৎকার করুক নোট বাতিলে কারও কোন লাভ হয়নি। খবরদার বিশ্বাস করবেন না। কারণ আপনি চোখের সামনে দেখেছেন নোট বাতিলের পরই জয় শাহ'র কোম্পানির রেভিনিউ বেড়েছিল ১৬,০০০%। আর অমিত শাহ পরিচালিত সমবায় ব্যাঙ্কে জমা পড়েছিল দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩,১১৮ কোটির বাতিল নোট। তাহলে কোন হরিদাস পাল বলে যে নোট বাতিলে হিন্দুদের লাভ হয়নি? এঁরা দুজন কি হিন্দু নয়? বললাম না, বিজেপি ক্ষমতায় থাকতে কোন বাপের ব্যাটার হিম্মত হবে না হিন্দুদের একইঞ্চি ক্ষতি করার!
নিন্দুকে বলছে, দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার নাকি ৪.৫%। ৬বছরে সর্বনিম্ন। এতে কি হিন্দুদের কোন ক্ষতি হচ্ছে? এক্কেবারেই না। হিন্দুদের জিডিপি তো মোদীজি আলাদা করে ক্যালকুলেশন করছেন। এই যে দেশে বেকারত্বের হার ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ। কি ভাবছেন হিন্দুদের বেকারত্বের জ্বালায় ভুগতে হচ্ছে? এক্কেবারেই না। দেশে হিন্দু বেকার গ্যালিলিও নিজেও দূরবীন দিয়ে খুঁজে পাবেন না। এই যে অটো-মোবাইল সেক্টরে সেল ২১বছরে সর্বনিম্ন, কারখানার ঝাঁপ পড়ছে। এই যে ঋণের দায়ে দেশে ১২হাজার কৃষক বছরে গড়ে আত্মহত্যা করেছ। চেষ্টা করলেও এতে আপনি একজনও ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু শ্রমিক-কৃষক দেখাতে পারবেন না!
রাম রাজত্বে বাজারে পেঁয়াজের ১৫০টাকা/কেজি বিক্রি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু হিন্দুরা আজকাল পেঁয়াজ ফ্রিতেই পাচ্ছে। উচ্চ-শিক্ষার ফিস দেশে আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু হিন্দুদের তো কলেজে ফ্রিতেই অ্যাডমিশন দিচ্ছে। বিদেশি অপশক্তির হাঙ্গার ইনডেক্সে ভারতে ১১৭ দেশের মধ্যে ১০২-এ ঠিকই, কিন্তু গুপী-বাঘার মত তালি ঠুকলেই সরকার হিন্দুদের মণ্ডা-মিঠাই সাপ্লাই দিচ্ছে। গ্যাস সিলিন্ডারে এক্সট্রা ভর্তুকি দিচ্ছে, PF-এ বর্ধিত হারে সুদ বসাচ্ছে। এমনকি হিন্দুদের পাম্পের আশে পাশে দেখতে পেলেই সরকার ধরে বেঁধে সস্তায় গাড়িতে পেট্রোল-ডিজেল ফুল টাঙ্কি করে দিচ্ছে।
বিশ্বাস না হলে সম্প্রতি ফোর্বসে প্রকাশিত ১০০জন ধনীতম ভারতীয়দের তালিকা দেখুন। ৮ধাপ উঠে দ্বিতীয় স্থানে আছেন গৌতম আদানি। আর এই নিয়ে টানা ১২বছর প্রথম স্থানে মুকেশ আম্বানি। ২০১৪-২০১৯, মুকেশ আম্বানির সম্পত্তি ১.৬৮লক্ষ কোটি থেকে বেড়ে ৩.৬৫লক্ষ কোটি হয়েছে। বৃদ্ধির হার ১১৮%। আর গৌতম আদানির সম্পত্তি ৫০.৪ হাজার কোটি থেকে বেড়ে ১.১লক্ষ কোটি হয়েছে। বৃদ্ধির হার ১২১%। তাহলেই বুঝুন, আদানি কিম্বা আম্বানির মত হিন্দুরা মোদীজির আশীর্বাদে এই পাঁচ বছরে কত্ত উন্নতি করেছেন।
ও! বাই দা ওয়ে, আপনিও তো মশাই হিন্দু। তা এই ৫ বছরে মোদীজির আশীর্বাদ আপনার সম্পত্তি কত শতাংশ বেড়েছে? ১১৮%? ১২১%? না অমিত শাহ'র ব্যাটা জয় শাহর মত এক্কেরে ১৬,০০০%?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন