শনিবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৪

গগন ~ অমিতাভ প্রামাণিক

শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে এক জমজমাট দুপুর। বাড়িতে অতিথি হয়ে এসেছেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিজেন্দ্রলাল। উনি জমিদারের বন্ধু, ওঁর তদারকিতে ব্যস্ত সব মানুষজন।

এসব আতিথ্যে গানবাজনা তো আছেই। দ্বিজুবাবুকে দুবার অনুরোধ করতে হয় না। হাসির ছড়া, নাটক আর গান তার কলমের নিবেই বাস করে, কাগজ পেতে বসলেই হয়। হারমোনিয়াম বাজিয়ে তিনি বেশ রসিয়ে রসিয়ে পরিবেশন করলেন – বাহবা, বাহবা নন্দলাল। সকলেই বাহবা, বাহবা করতে লাগল।

জমিদারমশাইয়ের গলায় আজ অল্প ব্যথা। তিনি বন্ধুবরকে বললেন, আমার গান তো শুনেছেন অনেক, আজ এর গান শুনুন। ফরাসের ওপর সঙ্কুচিত হয়ে বসে থাকা এক রোগা-প্যাংলা মানুষের দিকে নির্দেশ করতে সে আরো কাঁচুমাচু হয়ে গেল। ভাবটা যেন, সত্যি আমাকে ডাকছেন?

একে এলাকার সবাই চেনে। দ্বিজুবাবুকে এর পরিচয় দেওয়া হল, এখানকার ডাকঘরের ডাক হরকরা, এর নাম গগন। আপনারা লালন ফকিরের গান তো শুনেছেন নিশ্চয়, এবার এর গান শুনুন।

গগনের দিকে একবার তাকিয়ে কার উদ্দেশে নমস্কার ঠুকে গগন গান ধরল, আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে ...

উদাত্ত কণ্ঠের গান, প্রাণের গান, এই মাটির গান। শেষ হলে অনেকক্ষণ কারো মুখ দিয়েই কথা বেরোলো না।

অনুষ্ঠান ও খাওয়া দাওয়া শেষে দ্বিজুবাবুকে নিয়ে চারপাশটা একটু ঘুরতে যাওয়া হল। দ্বিজুবাবু পন্ডিত মানুষ, বিদেশ থেকে চাষবাস নিয়ে পড়াশুনা করে এসেছেন। বন্ধুকে বললেন, নদীর চরে এখানে এত উর্বর পলির জমি, কচু-ঘেঁচু হয়ে জঙ্গল হয়ে আছে। এসব পরিস্কার করে এখানে আলুর চাষ করুন। আমি ভাল আলুর বীজ পাঠিয়ে দেব, দেখবেন খুব সুন্দর আলু হবে এখানে।

জমিদারমশাই ঘাড় নেড়ে তাকে সমর্থন জানাতেই কোত্থেকে একপাল লোক এসে সেই মানকচুর জঙ্গল সাফ করতে লেগে গেল।

বিদায় নেবার সময় অন্যান্য কিছু স্মারক উপহারের সঙ্গে প্রত্যেক অতিথিদের দেওয়া হল সেই মানকচু। জমিদারমশাই বললেন, এ আমাদের অতি প্রাচীন খাদ্য, আলু অবশ্য চাষ করব এখানে, তবে একে অবহেলা করা অন্যায় হবে। কত রকম যে সুখাদ্য এ থেকে প্রস্তুত করা যায়, আপনারা চেষ্টা করে দেখুন।

জমিদারপত্নী আড়াল থেকে শুনে মৃদু হাস্য করলেন। কিছুদিন আগেই নাছোড়বান্দা পতির নির্দেশে তাকে মানকচুর জিলিপি বানাতে হয়েছিল। সে পরীক্ষায় তিনি সসম্মানে উত্তীর্ণও হয়েছিলেন।

কয়েক সপ্তাহ পরে আবার সেই গৃহে জলসা। দ্বিজেন্দ্রলাল-গগন-পাড়ার মোড়ল-পোস্টমাস্টার সবাই এসেছেন। দ্বিজেন্দ্রলালের স্ত্রী রান্না করে এনেছেন মানকচুর কালিয়া। মানকচুর কোপ্তা বানিয়ে এনেছে মোড়লগিন্নী।

আজ আর রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করতে হল না। কেউ কিছু বলার আগেই তিনি গান ধরলেন, রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান ...

18 January 2014

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন