শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

যতীন দাস ও রক্তঋণ ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

"রক্তঋণ"

কে এই টেরেন্স ম্যাকসুইনি? তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার রাজদ্রোহ এর অভিযোগে এই তরুণ আইরিশ স্বাধীনতা সংগ্রামীকে ব্রিকস্টন  কারাগারে বন্দী করে। ব্রিটিশদের অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি ৭৪ দিন অনশনের পর প্রাণ ত্যাগ করেন। আজকের দিনটা তাঁকে নিয়ে নয়, এক "ভেতো" বাঙালিকে নিয়ে। যার নাম যতীন দাস। কে এই যতীন দাস?  হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মির সদস্য বিপ্লবী অজয় ঘোষ (পরবর্তীকালে সিপিআই এর সাধারণ সম্পাদক) এর ভাষায়, " কলকাতা থেকে যতীন দাস কে আনা হয়েছিল যাতে তিনি আমাদের বোমা বাঁধতে শেখান।" [সূত্রঃ ১] সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ এসেম্বলি তে ভগৎ সিং যে বোমা ছোঁড়েন সেটি যতীন দাসের বানানো।



আরেক বিপ্লবী সুভাষ চন্দ্র বোস (তিনি তখনো নেতাজি হননি), তাঁর নিজের ভাষায় তাঁর সাথে বিপ্লবী যতীন দাসের যোগাযোগ ও সম্পর্ক বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন,  "At the time of the Calcutta Congress in 1928, and after, he had taken a leading part in organising and training volunteers and in the Bengal Volunteer Corps of which the writer was the Chief officer or G.O.C, he held the rank of Major. ….After the Congress was over, the Volunteer Corps was maintained and branches were opened all over the Province. In this arduous work, Jatin had played an important role. "   [সূত্র ১: ]

লাহোর জেলের বিচারাধীন বন্দীদের উপযুক্ত মর্যাদার দাবিতে ভগত সিং এর সাথে যতীন দাস যোগ দেন অনশনে। ৬৩ দিন অনশন এর শেষে লাহোরে যতীন দাসের মৃত্যু হয় কারণ জেলবন্দী অবস্থায় কর্তৃপক্ষ তাঁকে জোর করে গলায় নল ঢুকিয়ে তরল খাবার খাওয়াতে যায়, যাকে বলা হয় ফোর্স ফিডিং, সেই তরল ভুল করে বুকে ঢুকে নিউমোনিয়া এবং মৃত্যু। কলকাতায় তাঁর শেষ যাত্রার সময় তাঁর বাবা বঙ্কিম বিহারী দাস অকাল মৃত যুবক পুত্রের মুখের দিকে তাকাতে অস্বীকার করলেন। ফোর্স ফিডিং এর চেষ্টায় নিউমোনিয়া আক্রান্ত যন্ত্রনাবিদ্ধ একটা মুখ। বললেন, "ছেলের সেই শেষ মুখটা মনে রাখতে চাই, যেটা লাহোর যাওয়ার আগে দেখেছিলাম।"

যতীন দাসের মরদেহ কলকাতায় (হাওড়ায়) নিয়ে আসার পরে তাঁর মৃতদেহ সারারাত পাহারা দেওয়ার জন্য থাকলেন সুভাষ। পরের দিন কলকাতা জুড়ে বিশাল মিছিল সহকারে অন্তিম যাত্রা কেওড়াতলার ঘাটের উদ্দেশ্যে। সংগঠন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে মেয়র যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত এর সাথে সেই সুভাষ।  [সূত্র ২:]
পথের ধারে অগণিত মানুষ, মহিলা শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। মিছিলে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছে অগণিত ছাত্র যুব। তাদের হাতে প্ল্যাকার্ড। " নবযুগের দধীচি শহীদ বিপ্লবী যতীন দাস লহ প্রণাম"। মুখাগ্নি করলেন দাদা। শেষ অভিবাদন জানালো সুভাষ বসুর নেতৃত্বে বেঙ্গল ভলান্টিয়ারস। [সূত্র: ৩]

সুভাষের নিজের ভাষায়, "So Jatin Das died on September 13. But he died the death of a martyr. After his death the whole country gave him an ovation which few men in the recent history of India has received. As his dead body was removed from Lahore to Calcutta for cremation, people assembled in their thousands or tens of thousands at every station to pay their homage. His martyrdom acted as a profound inspiration to the youths of India and everywhere student and youth organisations began to grow up. " [সূত্র ৪]

স্মরণ সভায় সুভাষ স্মৃতিচারণ করলেন একদা সহকর্মীর। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে আবেগে ভেঙে পড়লো তাঁর গলা। তুলে ধরলেন কিভাবে অনশন-ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার কিছুদিনের ।মধ্যে  অনশনকারীর মনের মধ্যে আসে এক বৈপ্লবিক রূপান্তর। [সূত্র ১:]

আয়ারল্যান্ড থেকে কলকাতার মেয়রকে পাঠানো টেলিগ্রামে মেরি ম্যাকসুইনি লিখলেন, " Family Terrance Mac Swiney unites patriotic India in grief and pride on death of Jatin Das. Freedom will come"। উত্তরে মেয়র লিখলেন, "India feels grateful for your message. Terrancc Mac Swiney showed the way Ireland Freedom. Jatin Das has followed him" ঠিক এইখানেই দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদীদের সাথে বামপন্থী জাতীয়তাবাদীদের তফাৎ কারণ বামপন্থীরা জাতীয়তাবাদী হওয়ার সাথে আন্তর্জাতিকতাবাদী ও বটে। তাই ম্যাকসুইনি পরিবারের এই সমবেদনা হাজার মাইল দূরের যতীন দাসের পরিবারের প্রতি। 

শুধু ম্যাকসুইনী পরিবার নয়, Eamon De Valera, আইরিশ স্বাধীনতা সংগ্রামের মুর্ত প্রতীক টেলিগ্রামে লিখলেন, "Jatin Das has not died in vain. He is the Indian MacSwiney. Freedom is certain" ভ্যালেরার এই আশা বৃথা যায় নি। ভারত দেশটা স্বাধীন হয়েছিল। [সূত্র: ৩]। 

শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সেদিনের রাজপথে নামা ছাত্র যুবরা সঠিকভাবেই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলেছিলেন। অত্যাচারী শাসককে পরাস্ত করার মোক্ষম আয়ুধ প্রস্তুত করতে গেলে আত্মত্যাগ লাগে। লাগে দধীচির হাড়। 

আজ ১৩ই সেপ্টেম্বর। শহীদ দিবস। সেই যতীন দাসের মৃতু বরণের দিন, সেই যতীন দাস কারারুদ্ধ হওয়ার আগে প্রকাশ্যে যার শেষ স্লোগান ছিল "ইনকিলাব জিন্দাবাদ"। আজকে গাজা ভূখণ্ডে প্যালেস্তাইন এর নাগরিকদের ওপর সাম্রাজ্যবাদ এর অত্যাচারের বিরুদ্ধে কলকাতার রাজপথে স্লোগান তোলা বামপন্থী ছাত্র যুবরাই শহীদ যতীন দাসের প্রকৃত উত্তরাধিকারী, মুচলেকা বীরের অনুগামী কোনো দক্ষিণপন্থীরা নয়, তাদের কোনো নৈতিক অধিকারই নেই বামপন্থীদের আন্তর্জাতিকতাবাদ নিয়ে, দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলার। 

"শহীদ স্মরণে, আপন মরণে রক্তঋণ ....."

তথ্যসূত্রঃ
সূত্র ১: লেনার্ড গর্ডন, ব্রাদার্স এগেইনস্ট দ্যা রাজ
সূত্র ২: সুনীতি ঘোষ, দ্যা ট্র্যাজিক পার্টিশন অফ বেঙ্গল
সূত্র ৩: সি এস ভেনু, যতীন দাস দ্যা মারটার, প্রথম সংস্করণ।
সূত্র ৪: সুভাষ চন্দ্র বোস, দ্যা ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল (১৯২০-১৯৪২)

সোমবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

চন্দ্রগ্রহণ ও কুসংস্কার ~ অনির্বাণ অনীক

ইতিহাসবিদ ব্রায়ান লেভ্যাক এবং অন্যান্য গবেষকরা দেখিয়েছেন যে ১৪৫০ সালের পর থেকে প্রিন্টিং প্রেস ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ার পর ডাইনি শিকার বা witch hunt আরও তীব্র হয়ে ওঠে।



এর কারণ, প্রিন্টিং প্রেসের মাধ্যমে ডাইনি ও শয়তান সম্পর্কিত বই, ম্যানুয়াল, প্যামফ্লেট দ্রুত ও সস্তায় ছাপা সম্ভব হয়। উদাহরণ হিসেবে ১৪৮৭ সালে প্রকাশিত  berüchtigte Malleus Maleficarum বইটির কথা বলা যায়। এই বইটি ডাইনি সনাক্ত ও শাস্তি দেওয়ার "গাইডবুক" হয়ে উঠেছিল।

সেদিনের প্রিন্টিং প্রেসের জায়গাটি আজ নিয়েছে ফেসবুক, সমাজ মাধ্যম এবং দুনিয়ার নিকৃষ্টতম সংবাদ মাধ্যম ভারতীয় অনলাইন মিডিয়া।  চন্দ্র গ্রহণের প্রাক্কালে ফেসবুকের গ্রুপগুলো গত দুদিন ধরে কুসংস্কারের আড়ত হয়ে উঠেছে।  আলোচনার বিষয় গ্রহণের সময় কী খেতে নেই, কোনদিকে শুয়ে ঘুমাতে নেই, খাবার বিষাক্ত হয় কিনা -  ইত্যাদি মধ্যযুগীয় বাছ বিচার। তাতে ধুয়ো দিয়ে চলেছে গুচ্ছের অনলাইন মিডিয়া।  

গ্রহণ ঘিরে নানা কুসংস্কার থাকলেও সত্য হলো, এই সময়ে খাওয়া, ঘুমোনো বা গান-নাচ করার মধ্যে কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। খাবারও তখন স্বাভাবিক থাকে; বিষাক্ত হয় না, অতিরিক্ত জীবাণু জন্মায় না, কিংবা কোনো "রেডিয়েশন"ও মিশে যায় না। কিন্তু যারা সারসত্যটা বোঝেন, ভারতীয় সমাজের নিয়ন্ত্রণ এককালে তাঁদের হাতে যতটুকু ছিল, আজ সেটুকু নিয়ন্ত্রণও তাঁরা হারিয়েছেন। এই পোস্ট ট্রুথের যুগে মানুষকে বোঝানোর সাধ্যি কারো নেই!    

অনেক মুক্তচিন্তক বিশ্বাস করেন বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নতির হাত ধরে কুসংস্কার এবং ধর্মমোহের প্রাচীরে ফাটল ধরবে। এ একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা। প্রযুক্তি নিজে নিরপেক্ষ। প্রযুক্তি কার হাতে, কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তার ওপরই নির্ভর করছে সমাজ বিজ্ঞানের পথে এগোবে নাকি কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হবে। দুনিয়ার আর দশটি বিষয়ের মতো এই বিষয়টিও পুরো দস্তুর রাজনৈতিক।  আজকের বাংলা তথা ভারত তা পদে পদে প্রমাণ করে ছাড়ছে!

শনিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ভারতীয় সেমিকন্ডাকটর চিপ ~ পবিত্র দাস

এই ছবিটা নিয়ে গত কয়েকদিন অনেক খবর আর আলোচনা  দেখলাম। একটা বোর্ডের চারপাশে অনেকগুলো সেমিকন্ডাক্টর চিপ গাঁথা। তার মধ্যে নয়নের মণি হল Vikram 32bit processor. দেশ উচ্ছ্বসিত এই সাফল্যে। মাস্টারস্ট্রোক। জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন...ইত্যাদি ইত্যাদি। সাধারণত এগুলোর খুব ডিটেইলে যাইনা। এক্ষেত্রে একটু গেলাম। কারণ নিজে সরাসরি এই ইন্ডাস্ট্রিতে, এই একই কাজের সাথে যুক্ত। 
যে চিপগুলো দেখা যাচ্ছে সেগুলো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ডিজাইন করা। এবং সম্ভবত চন্ডীগড় এর সেমিকন্ডাক্টর ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়েছে। এখানে বলা বাহুল্য সেমিকন্ডাক্টর ল্যাবরেটরি ভারতের একমাত্র যায়গা যেখানে সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরি হয়। প্যাকেজিং নয়, অ্যাসেম্বলি নয়, সরাসরি ওয়েফার তৈরি করা হয়। চিপ তৈরির সবথেকে জটিল, সবথেকে রিস্কি এবং সবথেকে লাভজনক ব্যাবসা। 


কিন্তু এখানে অনেকগুলো কিন্তু আছে। চন্ডীগড় এর এই ল্যাবের টেকনোলজি অন্তত ২৫-৩০ বছর পুরানো। ১৮০ ন্যানোমিটার CMOS নোডের ওপর বেস করে এই প্রসেসর তৈরি হয়েছে। এর নীচে কিছু বানানো সম্ভব নয় সেখানে। প্রযুক্তি বা এক্সপার্টাইজ নেই। কতটা পুরানো এই প্রযুক্তি?  আপনি যে ফোনে এই লেখাটা পড়ছেন, তার প্রসেসর নোড ৩ থেকে ২২ ন্যানোমিটার এর মধ্যে। এবার সেটাকে ১৮০ ন্যানো র সাথে তুলনা করুন। ১ ন্যানোমিটার মানে এক মিটারের ১০ কোটি ভাগের এক ভাগ।
 নোড কি? খুব সহজে বললে নোড মানে একটা চিপের মধ্যে একটা ট্রানজিস্টার এর একটা ছোট্ট অংশের মাপ (গেট বলা হয়)। সেটা যত ছোট হবে ট্রানজিস্টার তত ছোট হবে আর তত একটা চিপের মধ্যে বেশী সং্খ্যায় ট্রানজিস্টার ঠেসে দেওয়া যাবে। অনেক বেশী অপারেশন একসাথে করা যাবে। একটা আধুনিক মোবাইলের প্রসেসর চিপের মধ্যে ১০-২০ কোটি ট্রানজিস্টর থাকতে পারে।
১৮০ ন্যানোমিটার নোড কম্পিউটার, মোবাইল বা খুব উন্নত কোনও প্রসেসরে আজ থেকে ২৫ বছর আগে ব্যবহার হত। এখন এই নোড মূলত গাড়ী বা মেডিক্যাল ডিভাইসে ব্যবহার হয়। 
তার মানে তো ইন্ডিয়া দারুণ ব্যবসা করছে গাড়ি বা মেডিক্যাল ডিভাইসের চিপ বানিয়ে? না। একদমই নয়। কারন চন্ডীগড় এর এই ল্যাবে বানিজ্যিক ভাবে একটাও চিপ তৈরি হয়না। এদের একমাত্র কাস্টমার হল ইসরো বা DRDO. কারন সেখানে সস্তায় দেবার বাধ্যবাধকতা নেই আবার বিশাল পরিমাণে কিছু তৈরিও করতে হয় না।
 কেন বানিজ্যিক চিপ তৈরি হয় না? কারন হল প্রফিটেবিলিটি। একটা চিপ বানাতে যদি এক মিলিয়ন ডলার খরচ হয়, তাহলে পরের ১০০ মিলিয়ন চিপ বানাতে ১ ডলার করে খরচ হবে। মনে করুন কয়েক কোটি ট্রানজিস্টর আছে একটা ৫ মিলিমিটার জায়গায়। সেগুলো আবার একটা আরেকটার সাথে বৈদ্যুতিক ভাবে যুক্ত, মানে বাড়ির অয়ারিং আর কি। এবার তাহলে সেরকম একটা সিস্টেমের ভেতর, অন্তত কয়েকশো কোটি জাংশন আর ইন্টারকানেকশন থাকবে। আর সেই ছোট্ট সার্কিট সিলিকনের ওপর বানানো হবে। একটা প্রফিটেবল প্রসেসে ইল্ড ৯০-৯৯% অব্দি হতে পারে। মানে প্রতি ১০০ টা চিপে ৯৯ টা এই কয়েকশো কোটি জিনিসপত্র ঠিকঠাক তৈরি হয়েছে। কোথাও একটাও ভুল নেই। মাত্র একটা কোথাও কানেকশন খারাপ হলে গোটা চিপ কাজ করবে না। এই লেভেলের প্রযুক্তিগত প্রেসিশন মান্য করা হয়। এবং ইঞ্জিনিয়ার রা সেটা করতে সক্ষম। চিপ ইন্ডাস্ট্রি তে যেসব প্রসেস আছে সেগুলো সম্ভবত মানবজাতির বানানো সবথেকে স্টেবল এবং সবথেকে কন্ট্রোলড প্রসেস। সেগুলোর জন্য দরকার টাকা,প্রচুর স্কিলড ওয়ার্কার আর লাভের কথা না ভেবে প্রচুর প্রাথমিক ইনভেস্টমেন্ট। চন্ডীগড় এর ল্যাবে এগুলোর কোনওটাই নেই। তাই mass প্রোডাকশন হয় না। 
যা দেখছেন এই ছবিতে তার প্রযুক্তি অন্তত ২৫ বছর আগেকার।

মোদী সরকার গুজরাটে একটা ফ্যাবরিকেশন ফেসিলিটি বানানোর চেষ্টা করছে।।এছাড়া অন্য কোনও উদ্যোগ আপাতত নেই। সেট কতটা সফল হবে সময় বলবে।

বৃহস্পতিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

অমৃতা শাহির ~ অরিজিত গুহ

মহব্বতো কি পরখ কা ইয়েহি তো রাস্তা হ্যায়
তেরি তালাশ মে নিকলু তুঝে না পাউ ম্যায়'



 
সাতের দশকের কোনো এক সময়। হিন্দি সিনেমার প্রখ্যাত গীতিকার শাহির লুধিয়ানভির কোনো গানে সুর দেবেন সুরকার জয়দেব। দুজনে মিলে একটা গানের ব্যাপারে আলোচনা করে চলেছেন। শাহির কিছু লিখছেন আর গুনগুনিয়ে সেই লাইনের সুর ভেজে চলেছেন। হঠাৎ জয়দেবের চোখ পড়ল একটা কাপের দিকে। কফির তলানিটা পড়ে শুকিয়ে রয়েছে। বেশ কয়েকদিন আগের কফি খাওয়া একটা নোংরা কাপ। 'এটা এখানে কী করছে?' বলে নোংরা কাপটা হয়ত তুলে অন্য জায়গায় রাখতে যাবেন জয়দেব, খেঁকিয়ে উঠলেন শাহির। 'হাত মত লাগানা'। একদম ছোঁবে না ওটাকে। সরো, সরো বলছি। ঘাবড়ে গেলেন জয়দেব। কি আছে কফির কাপে বুঝতে পারলেন না। কিছুক্ষণ পর শাহির নিজেই বললেন, 'কাপটায় অমৃতা কফি খেয়ে গেছে শেষ যখন এসেছিল। ওর ছোঁয়া লেগে রয়েছে কাপটায়। ওটাতে হাত লাগিও না।'
    জয়দেব বুঝতে পারলেন সবই। শাহির অমৃতার সম্পর্কের ব্যাপারে জানতে কারো বাকি ছিল না সেই সময়ের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। সম্পর্কের পরিণতি হয়ত কিছু ছিল না। আর ততদিনে প্রায় কুড়ি পঁচিশ বছরের সম্পর্ক এসে ঠেকেছিল তলানিতে। শাহির তখন গায়ক সুধা মালহোত্রার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। তাও হয়ত মাঝেমাঝে অমৃতার সাথে দেখা হত। দুজনে বসে থাকতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। শাহির একের পর এক সিগারেট টেনে যেতেন আর অমৃতা প্রীতম কাপের পর কাপ কফি। কিন্তু দুজনের কেউই কোনো কথা বলতেন না। নিস্তব্ধতার মধ্যেই লোকানো থাকত অনেককিছু। আসলে নৈঃশব্দেরও বাঙ্ময় প্রকাশ আছে কিনা!

   ৩১ আগস্ট ১৯১৯ এ তৎকালীন পাঞ্জাবের গুজরানওয়ালায় যখন অমৃতার জন্ম হয়েছিল তার কয়েকবছর আগেই ব্রিটিশ ভারতে ঘটে গেছে এক নৃশংস গণহত্যার কাহিনী। ১৯শে এপ্রিলের জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যা কাঁপিয়ে দিয়েছিল সারা ভারত সহ ব্রিটিশ পার্লামেন্টকেও। এক জ্বলন্ত অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী থেকেছিল পাঞ্জাব। তার কয়েকমাস পরে সেই পাঞ্জাবেই জন্ম হয়েছিল অমৃতা নামের আরেক অগ্নিপিণ্ডের। 
   ৪৭ এর দেশভাগ যে দুটো প্রদেশকে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ করেছিল তার নাম পাঞ্জাব আর বাংলা। এই দুটো প্রদেশই দেশভাগের ফলে তৈরি হওয়া ক্ষত আজও বয়ে নিয়ে চলেছে। পাঞ্জাবের প্রখ্যাত কবি হীর রনঝা কাহিনীর সৃষ্টা ওয়ারিস শাহ কে কবর থেকে তুলে এনে যখন অমৃতা প্রীতম বলেছিলেন তাঁর হীর রনঝা কাহিনীর পৃষ্ঠায় আরেকটা অধ্যায় যোগ করতে, যেখানে শুধু ৪৭ এর পাঞ্জাবের মেয়েদের ভাগ্যবিপর্যয় লিপিবদ্ধ থাকবে, তার বেশ কয়েকবছর আগে থেকেই কবিতার জগতে স্থান করে নিয়েছিলেন অমৃতা। এর জন্য অবশ্য বাবা কর্তার সিং এর অবদানও ছিল বেশ ভালোরকম। কর্তার সিং নিজেও ছিলেন একজন কবি। বাবার সেই ধারাই বর্তেছিল তাঁর ওপর। প্রথমদিকে সাধারণ কিছু কবিতা লিখলেও লাহোরের প্রগতিশীল পরিবেশের প্রভাবে পড়ে কালজয়ী কিছু সাহিত্য রচনা করা শুরু করেন। অমৃতার যখন এগারো বছর বয়স, তখন বিপত্নীক কর্তার সিং লাহোরে চলে আসেন। তখন থেকেই প্রোগ্রেসিভ লেখাপত্রের সাথে পরিচয় হতে থাকে। তারই ফলশ্রুতি 'আজ আখখান ওয়ারিস শাহ নু'। 'An Ode to Waris Sha'. এছাড়াও দেশভাগের ওপর আরেকটা বই যা তাঁকে অমর করে রাখবে তা হচ্ছে 'পিঞ্জর'। ভীষ্ম সাহানির 'তমস' আর অমৃতা প্রীতমের 'পিঞ্জর' একই সাথে উচ্চারিত নাম। 
  ষোলো বছর বয়সে বাড়ি থেকে ঠিক করে দেওয়া ছেলে প্রীতম সিং এর সাথে বিয়ের পর অমৃতা কউর থেকে অমৃতা প্রীতম বলে পরিচিত হতে থাকেন। তবে ছোটবেলার ওই বিয়েটা কোনোদিনই তাঁকে সুখ বা শান্তি কোনোটাই দেয় নি। ১৯৪৪ সাল নাগাদ লাহোরের এক মুশায়রাতে শাহির লুধিয়ানভির সাথে যখন দেখা হয় তখন শাহির মজেছিলেন অমৃতার রূপে আর অমৃতা মজেছিলেন 'কলম কা জাদুগর' শাহিরের কবিতায়। 
    দেশভাগের পর লাহোর থেকে প্রীতম সিং সস্ত্রীক দিল্লিতে চলে এলে শাহিরের সাথে সম্পর্কে আরো জড়িয়ে পড়তে থাকেন। তাঁদের দুজনের আদানপ্রদান হওয়া কিছু প্রেমপত্র সাহিত্যের এক ক্লাসিক নিদর্শন হয়ে রয়েছে। অমৃতা নিজের বিয়ে ভেঙে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন শাহিরের হাত ধরে, কিন্তু শাহিরের আদর্শবাদী মূল্যবোধ আর তার থেকেও বড় কথা দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেরানোর মানসিকতা শাহিরকে বাধা দিয়েছিল সম্পর্ককে পূর্ণতা দিতে। অমৃতার কথায়, 

'ম্যায়নে টুটকে প্যেয়ার কিয়া তুমসে
কেয়া তুম ভি উতনা কিয়া মুঝসে

     অমৃতা জানতেন শাহির সম্পর্ককে পূর্ণতা দেবেন না। তাও বারেবারে ছুটে এসেছেন কোনো এক অজানা টানে। এমনকি শাহির যখন জড়িয়ে পড়েছেন সুধা মালহোত্রার সাথে তখনো শাহির ছাড়া আর কারো কথাই ভাবেন নি। প্রীতম সিং এর সাথে বিয়েটা হয়ত ভাঙতই। শাহির সেখানে অনুঘটকের কাজ করেছিলেন। 

'ম্যায় চুপ শান্ত অওর আদৌল খাড়ি থি
সির্ফ পাস ব্যয়ঠে সমুন্দ্র মে তুফান থা।
ফির সমু্ন্দ্র কো খুদা না জানে কেয়া খয়াল আয়া
উসনে তুফান কি এক পোটলি বান্ধি
মেরে হাথো মে থামাই
ঔর হাস কর কুছ দূর হো গয়া'

বারেবারে অমৃতার কবিতায় ঘুরে ফিরে এসেছেন শাহির। শুধু শাহির শাহির আর শাহির। জীবনে আর অন্য কেউ যেন ছিল না। ১৯৬০ এ বিয়ে ভেঙে বেরিয়ে আসার পর শাহিরের কাছে আশ্রয় চান নি। ততদিনে সাহিত্যের জগতে অমৃতা প্রীতম এক বিশিষ্ট নাম। ইতিমধ্যে পুরষ্কারও পেয়ে গেছেন কয়েকটা। তাঁর লেখায় বারেবারে ফিরে আসে মেয়েদের লড়াই আর মেয়েদের আত্মপরিচয়ের কথা। শুরু করেন পাঞ্জাবী কাগজ 'নাগমনি' পার্টনার ইমরোজকে সাথে নিয়ে। এই ইমরোজই শেষ অব্দি জীবনে থেকে গেছিলেন, যদিও কোনোদিনও বিয়ে করেন নি আর ইমরোজকে। লাইফ পার্টনার হিসেবেই থেকে গেছেন উনি।

   অনেকের অভিযোগ ছিল অবশ্য শাহিরের মা'র জন্য নাকি শাহির আর অমৃতার সম্পর্ক পরিণতি পায় নি। কারণ সিঙ্গল মাদার হিসেবে শাহিরকে মানুষ করার পর শাহিরের একটা আলাদা টান ছিল নিজের মায়ের প্রতি। 'ও আপকি বহু বন সকথি থি' অনেক অভিমানে মা'কে বলেছিলেন এই কথাগুলো। কিন্তু ততদিনে সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। সত্যিই কি শেষ হয়? তা নাহলে শাহিরই বা লিখবেন কেন 'মেহফিল সে উঠ যানে বালো/ তুম লোগো পার কেয়া ইলজাম/ তুম আবাদ ঘরো কে বাসি/ ম্যায় আওয়ারা ঔর বদনাম।' লেখার সময়ে হয়ত অমৃতাই এসেছিল চোখের সামনে। ঘর করতে না পারার যন্ত্রণা কুড়ে কুড়ে খেয়েছে সবসময়।

    শেষবার যখন ফিরে আসেন শাহিরের কাছ থেকে, তখন লিখে গেছিলেন 'তুমহারে দরখতি কি তহানি কা যো আসরা মিলা/ মেরে টুটে হুয়ে দিল কা পারিন্দা ঔহি রুক গয়া। যখন তোমার গাছের শাখা খুঁজে পেলাম/ সেখানেই মরে গেল আমার ভাঙা এ মনের পাখি। আর তার সাথে বায়রনের একটা কোট "In her first love, woman loves her lover/ In all the others, all she loves is love."। শাহির বলেছিলেন 'আপ জানে সে পেহলে ইসকা তার্জুমা কর দেঙ্গি?' শাহির অমৃতাকে নিয়ে মনোকষ্টে ভুগলে তাঁকে 'তুম' বলার বদলে 'আপ' বলে ডাকতেন। শাহির লিখেছিলেন তুম চলি যাওগি, পারছাইয়া রহ জায়েঙ্গি/ কুছ না কুছ ইশক কা রানাঈয়া রহ জায়েঙ্গি। 'শাগুন' সিনেমায় মহঃ রফি গানটা গাওয়ার পর শাহির লুধিয়ানভি রফিকে অনুরোধ করেন গানটা আবার রিটেক করার জন্য। ইশক শব্দটা হুস্ন দিয়ে পরিবর্তন করেন। বলেছিলেন অমৃতার জন্য এই লাইনটা লিখেছিলাম। আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি জানি, কিন্তু এটাকে যতটা পারা যায় আমার হৃদয় দিয়ে প্রকাশ করব। মহঃ রফি খুশির সাথে গ্রহণ করেছিলেন অনুরোধ। একদম শেষে শাহিরের কথাতেই বলা যায়

'মহব্বত যো আনজাম তক পহুঁছি নেহি
ওয়াহি মহব্বত হ্যায়, বাকি কুছ নেহি'।

আজ ৩১শে অগাস্ট অমৃতা প্রীতমের জন্মদিন। অমৃতা প্রীতম এলে অবধারিতভাবেই চলে আসে শাহির লুধিয়ানভির নাম। দুজনের এই নিরুচ্চারিত ভালোবাসাকে ধরা কারো পক্ষেই হয়ত সম্ভব নয়।


সিনেমার ধারাবিবরণী ~ সুচেতনা দত্ত

জি বাংলায় সিনেমায় একটা বাংলা সিনেমা হচ্ছে।

মুনমুন সেন ফুলশয্যার খাট থেকে জর্জ বেকারকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
জর্জ বেকারকে তাড়িয়ে দিয়ে মুনমুন সেন তার পোষা ডোবারম্যানকে নিয়ে শুয়েছে।
জর্জ বেকার মনের দুঃখে এমন একটা ঘরে গিয়ে ঘুমিয়েছে, যে ঘরে একটা কালী মূর্তি, আর তিন দেওয়ালে তিনটে বন্ধ জানলা।
মুনমুন সেন ফুলশয্যার ঘরে চাদরমুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে।
 জর্জ বেকার তিনটে টেবিল জোড়া লাগিয়ে বিনা চাদরে ঘুমোচ্ছে বলে বেজায় শীত করছে। কারণ বন্ধ জানলার ঘরটার ভিতরে প্রবল ঝড় উঠেছে।
মুনমুন সেনের পাশে শোয়া ডোবারম্যানটা টেলিপ্যাথি করে টের পেয়েছে বন্ধ জানলার ঘরটার ভিতরে সোঁ সোঁ করে ঝড় হচ্ছে বলে জর্জ বেকারের ভীষণ শীত করছে।
নিজের টেলিপ্যাথি ক্ষমতার উপর বিশ্বাস না রেখে ডোবারম্যান নিজের চোখে জর্জ বেকারকে দেখতে যায়।
জর্জ বেকারকে টিউনিং ফর্কের মতো কাঁপতে দেখে ডোবারম্যান মুনমুন সেনের ঘরে ফিরে আসে এবং ঘুমন্ত মুনমুনের গায়ের থেকে চাদরটা মুখে করে খুলে নিয়ে গিয়ে জর্জ বেকারের গায়ে সেই চাদরটা চাপিয়ে দিয়ে এসে ভাল পোষা কুকুরের মতো মুনমুন সেনের পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
মুনমুন সেন ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে ডোবারম্যানকে জিজ্ঞেস করে "আমার চাদরটা কোথায় গেল রে?"
সেই সময় গদগদ মুখে জর্জ বেকার চাদরটা ফেরত দিতে আসে।
এই চরম ক্লাইম্যাক্সের মুহূর্তে বদমাইশ ডোবারম্যান খাট থেকে নেমে পড়ে কোথায় একটা চলে যায় জর্জ বেকারকে কেস খাইয়ে দিয়ে।
জর্জ বেকারের হাতে চাদরটা দেখে মুনমুন সেন ভাবে রাতে জর্জ বেকার এসে মুনমুনের চাদর খুলে নিয়ে গেছে।
তারপর মুনমুন বেজায় গালাগালি করে রঞ্জিত মল্লিকের সঙ্গে দেখা করতে চলে গেছে।
তাই মুনমুনের বাবা কালী ব্যানার্জী সব সম্পত্তি জর্জ বেকারকে লিখে দিয়েছে।

আমি কি সিনেমাটা এরপরেও দেখব?
পুনশ্চঃ  বন্ধুদের অনুরোধে ধারাবিবরণী দিচ্ছি এর পর থেকে।

জর্জ বেকার শ্বশুরের আদেশ পালন করতে চাবাগানে রঞ্জিত মল্লিকের বাংলো থেকে মুনমুনকে ফিরিয়ে আনতে গেছে।
মুনমুন জিজ্ঞেস করেছে জর্জ বেকার কি ওর ভাল চায়? 
জর্জ বেকার হ্যাঁ বলেছে।
মুনমুন উত্তরে বলেছে, তাহলে যেন জর্জ বেকার নিজেকে মুনমুনের "কেয়ারটেকার" বলে পরিচয় দেয়।
জর্জ বেকার এক গাল হেসে বলেছে, "মা কালী আপনাদের সহায় হোন।"

এখন আবার বিজ্ঞাপন বিরতি।

মুনমুনঃ মা কালী সহায় হলে চলবে না। আপনাকে সহায় হতে হবে। আমার বাবাকে গিয়ে বলুন রঞ্জিত মল্লিকের সঙ্গে আমার বিয়ের ব্যবস্থা করতে।
জর্জ বেকার (রঞ্জিত মল্লিকের উদ্দেশ্যে) ঃ আই উইশ ইউ অল দা বেস্ট।
জর্জ বেকার (ডোবারম্যানের উদ্দেশ্যে) ঃ চলি রে বিট্টু। আর বোধহয় দেখা হবে না। তোর মায়ের ভাল করে দেখাশোনা করিস।

শয়তান কুকুর কালী ব্যানার্জীর চিঠি রঞ্জিত মল্লিককে দিয়ে দিয়েছে। চিঠিতে লেখা আছে জর্জ বেকার মুনমুনের বর এবং কালী ব্যানার্জীর সব চা বাগানের মালিক।
রঞ্জিত মল্লিক জিপগাড়ি নিয়ে জর্জ বেকারের পিছনে তাড়া করেছে।
রঞ্জিত মল্লিক জর্জ বেকারকে বলছে, "আপনি মালিক, আমি আপনার কর্মচারী।" 
রঞ্জিত মল্লিক মুনমুনকে জর্জ বেকারের সিঁদুর পরতে বলছে। সিঁথি সাদা রাখতে মানা করছে।

মুনমুন সেন কালী ব্যানার্জীকে থ্রেট দিচ্ছে, "দেখি ওর মা কালী ওকে কী করে বাঁচায়!"
কালী ব্যানার্জী থ্রেট খেয়ে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে মরে গেছে।

জর্জ বেকার মুনমুন সেনের ক্লাবের মেম্বারশিপের রিনিউয়াল ফি দিচ্ছে না। মাধবী মুনমুনের হয়ে জর্জ বেকারকে বলছে টাকা দিয়ে দিতে।

বিজ্ঞাপন বিরতি।

সৌমিত্র ব্যানার্জী ভাড়াটে খুনি নিয়ে এসে যেই বলেছে "এবার দেখি সালাকে কে বাঁচায়?" বিট্টু ডোবারম্যান এসে সৌমিত্র ব্যানার্জীর জামা কামড়ে ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে একটা গাছের উপর তুলে দিয়েছে সৌমিত্র ব্যানার্জীকে।
তারপর সৌমিত্র ব্যানার্জী ভিতরে সাদা গেঞ্জি পরে আছে দেখে সৌমিত্র ব্যানার্জীর জামা খুলে এনে পাঞ্জাবি পরা জর্জ বেকারের হাতে দিয়ে দিয়েছে।

মুনমুন সেনের বন্ধু শুভ্রার বিয়েতে জর্জ বেকার মুনমুন সেনের হয়ে এক লক্ষ টাকা দিয়ে দিয়েছে। সেই শুভ্রা যে ফুলশয্যার রাতে মুনমুনকে থ্রেট দিয়ে বলেছিল যে মুনমুন যদি জর্জ বেকারকে আর কষ্ট দেয়, তাহলে জর্জ বেকারকে একদিন শুভ্রার ঘরের বিছানায় পাওয়া যাবে।

শুভ্রার বাবা মুনমুনকে বলছে শুভ্রার কন্যাসম্প্রদানের সময় মুনমুন যেন শুভ্রার বাবার পাশে থাকে।

বিজ্ঞাপন বিরতি

শুভ্রার বাবা মুনমুনকে বলছে, "তোর মতো মেয়ে কি স্বামীনিন্দা সহ্য করতে পারে? জর্জ বেকার তোর মতো দেবীকে বৌ হিসেবে পেয়ে ধন্য হয়েছে।"

মুনমুন জর্জকে ঃ তুমি নিজেকে এত ছোট করলে কেন? 
জর্জ ঃ যাকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে আমি ধন্য হয়েছি, তাকে তো আমি বড় করবই।

শুভ্রার বাসরে সৌমিত্র ব্যানার্জী জর্জ বেকারকে গান গাইতে বলেছে বলে মুনমুন রেগে গিয়ে জর্জ বেকারকে নিয়ে বাসর থেকে চলে যেতে চাইছে।

জর্জ বেকার বাসরে "আমি সবার সামনে ছোট হব। মা কালীর নাম করে একটা গান শুনিয়ে দিই" বলে একটা প্রচণ্ড সেল্ফপিটির গান গাইছে। মুনমুন বাসর থেকে বেরিয়ে গিয়ে ডেকোরেটর আর ক্যাটারারের সাইনবোর্ডে মাথা ঠেকিয়ে জর্জ বেকারের সেল্ফপিটির গান শুনছে।

শুভ্রা নিজের বাসি বিয়ের সকালে এসে মুনমুনকে হাজব্যান্ড সোয়াপিংয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। 

মুনমুন তাই রাতে কাঁদছে। নিজের খাটের চাদর এনে তিনটে টেবিল জোড়া লাগিয়ে ঘুমন্ত জর্জ বেকারকে চাদরমুড়ি দিয়ে ডোবারম্যান বিট্টুকে খুব বকে দিয়েছে, "আমি নাহয় ওকে ভালবাসি না। কিন্তু তুই তো ওকে ভালবাসিস। কিছু তো করতে পারতিস, দেখছিস না শীতে কষ্ট পাচ্ছে!" বলে। কিন্তু এখন ঘরের ভিতর ঝড় হচ্ছিল না। জর্জ বেকারও এসএইচএমে কাঁপছিল না।

বিজ্ঞাপন বিরতি

রঞ্জিত মল্লিক জর্জ বেকারের সই নিতে এসেছে। জর্জ বেকার রঞ্জিত মল্লিককে বাড়িতে মুনমুনের কাছে পাঠাতে চাইছে। কিন্তু রঞ্জিত মল্লিকের তাড়া আছে, দার্জিলিং মেলে ফিরতে হবে বলছে।

সৌমিত্র ব্যানার্জীকে মুনমুন চড় মেরেছে বলে ওর চ্যালাদের দিয়ে মুনমুনকে মলেস্ট করাচ্ছে। জর্জ বেকার সৌমিত্রকে বলছে মুনমুনকে ছেড়ে দিয়ে জর্জ বেকারকে ধরতে।

সৌমিত্র এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি, জর্জ বেকারকে বলেছে চা বাগানগুলো সৌমিত্রকে দিয়ে দিতে। আর যতক্ষণে জর্জ বেকার দলিল আনবে ততক্ষণ মুনমুনকে মাঠে নিয়ে গিয়ে মলেস্ট করা হবে।

জর্জ বেকার কাগজ আনতে যাচ্ছিল রাজি হয়ে। কিন্তু রঞ্জিত মল্লিক খুব রেগে গিয়ে একাই সবাইকে মেরে পাট করে দিয়েছে।

সৌমিত্র ব্যানার্জীর ঘাড় ধরে মুনমুনের পায়ে ফেলে রঞ্জিত মল্লিক বলেছে "মাকে যেমন ভক্তিশ্রদ্ধা করো, তেমন করে পায়ে ধরে মা ডেকে ক্ষমা চাও।"
সৌমিত্র মুনমুনকে ঃ "মা আমাকে ক্ষমা করে দাও।"

মুনমুন মা কালীকে অঞ্জলি দিতে দিতে গান গাইছে, "তোমার চরণ ছুঁয়ে বলছি আমি মা, চাই না সোনাদানা... ওর জীবনের আনন্দতে চাই না আমি বেড়া দিতে...ও যেখানে সুখ খুঁজে পায় ওকে দে সেই ঠিকানা।"

বিজ্ঞাপন  বিরতি

মুনমুন সেনকে জর্জ বেকার জড়িয়ে ধরেছে। তাই দেখে বিট্টু ডোবারম্যান আড়মোড়া ভাঙছে।

জর্জ বেকার আর মুনমুন মাধবীকে প্রণাম করতে গেছে। কিন্তু মাধবী নিজের প্রণাম বুঝে না নিয়ে আগে মরে যাওয়া কালী ব্যানার্জীকে প্রণাম করতে বলেছে। যেই প্রণাম করেছে কালী ব্যানার্জীর ছবিতে অমনি সিনেমা শেষ হয়ে গেছে।

অতএব সিনেমার ধারাবিবরণীও শেষ হল।

বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

গনেশ পুজোর রমরমা ~ মানস নাথ

অনেকেই আছেন যারা রাজনীতিটা প্রফেশন মনে করেই করেন৷ তাতে দোষের কিছু দেখি না। আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী যতই বলুন সমাজসেবা করতে এবং মানুষের জন্য কাজ করতে হলেই রাজনীতিতে আসুন বাস্তবে তা খুব একটা  সম্ভব হয় না৷ কারণ রাজনীতি করতে টাকা লাগে, সমাজসেবা করতেও লাগে। প্লাস নিজের এবং পরিবারের ভরনপোষণ খরচখরচা রয়েছে। তো সারাদিন ধরে অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ালেন, কাঁধে করে মৃতদেহ অন্তেষ্টি করতে নিয়ে গেলেন কিন্তু দিনের শেষে আপনার খরচা আপনাকেই তুলতে হবে। ঠিক কিনা? 



এবার আপনি বলবেন রাজনীতিতে কি পয়সা নাই?  

নেতাদের ফ্ল্যাট ফুঁড়ে কোটি কোটি টাকার বান্ডিল এমনি এমনি বেরোচ্ছে! আহা, সেতো বিগ বিগ নেতা মন্ত্রীদের। থিংক লোকাল৷  আসুন তো হিসাব করি একটা এলাকায় কতজন নেতা থাকতে পারে। সবার উপরে অনুপ্রেরণা আর কালিঘাট, ওটা বাদ দিয়েই হিসাব করছি৷ ধরুন একজন হল এম পি, একজন হল এম এল এ,  একজন হল কাউন্সিলার। পঞ্চায়েত হলে  প্রধান, মেম্বার  এগুলো নির্বাচিত পোস্ট। এছাড়া দলের  সভাপতি বা সেক্রেটারি। দলের ছাত্র যুব শাখার এক দুজন কচি নেতা, যে স্কুল কলেজগুলো দেখবে। এবারে বাদবাকি যারা তারা হল অনুগামী  চ্যালাচামুণ্ডা।

এরা বিভিন্ন নেতার আশেপাশে থাকে, এদের যথেষ্ট কামাই। ইঁট বালুর সাপ্লাই, সিন্ডিকেট, কন্ট্রাকটারি এদেরই হাতে। এখানেই হল আসল ক্ষীর। এর কন্ট্রোল হাতে নেওয়ার জন্যই এত কষ্ট এত ত্যাগ স্বীকার এত সমাজসেবা।

এবার দেখেনি একটা এলাকায় ক্ষমতার ভরকেন্দ্র মানে টাকাপয়সা বিলিবন্টন কার হাতে। এম পি দূরের শুকতারা। এইসব এঁটোকাঁটায় সচারাচর মুখ মারেন না। এম এল এ প্রভাবশালী হলে সুতো তার হাতে থাকে, শিল্পী বুদ্ধিজীবী হলে তার রোল অতিথি শিল্পীর। কর্পোরেশন মিউনিসিপালিটিতে অনেকটাই ক্ষমতা কাউন্সিলারের হাতে। তাই কাউন্সিলর হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতাও বেশি।

এক একটা এলাকায় আট দশজন লবি করতে থাকে কাউন্সিলর পদের জন্য। তার উপর আবার মহিলা বা এস সি / এস টি সংরক্ষিত হলে গেলে পারমুটেশন কম্বিনেশন বদলাতে থাকে।

আচ্ছা এই যে একটা ওয়ার্ডে আট দশজন কাউন্সিলর হওয়ার জন্য লড়াইতে থাকে প্রফেশনের শুরুরদিকে  তাদের ইনভেস্টমেন্ট  কেমন?  প্রথম যোগ্যতা ঠিকঠাক ল্যাজ ধরা। এম পি,  এম এল এ বা পার্টির বড় নেতার সাথে সুসম্পর্ক। যাকে বলে দাদা/ দিদি ধরা। পরের কাজ কিছু চামচা পোষা। যারা তার আশেপাশে থাকবে সমাজসেবা করার সময়। একা একা তো আর মড়া কাঁধে করে শ্মশানে কবরস্থানে যাওয়া যায়  না!  পরের স্টেপে ধরতে হবে কোন শাঁসালো ক্লাব। যারা বেশ নামকরা পুজো করে থাকে। একেবারে বড়বড় দুর্গাপূজা কমিটিগুলোতে ঢোকা তো মুখের কথা নয়। একজিস্টিং বিধায়ক বা কাউন্সিলর সেখানে অলরেডি অনুপ্রেরণায় রয়েছেন৷ তাকে সরিয়ে নতুন নেতা হতে চাওয়া মুখটি জায়গা নেবে কেমন করে?  এর উপর আবার রয়েছে নেপোটিজম৷ নেতার ছেলে মেয়েদের ডায়রেক্ট লাইন৷ 

দুর্গা, কালী এরা হল ওপরতলার। আগে থেকেই বড় নেতাদের স্নেহধন্য। বিশ্বকর্মা এখন রিকসাওয়ালা অটোওয়ালাদের হাতে, কারখানা ফারখানা কবেই উঠে গেছে! লক্ষ্মী কার্তিক ঘরোয়া। সরস্বতী ছোটদের। রবিঠাকুরের আর সেই আগের বাজার নেই। শুরুটা তাই রামনবমী, হনুমান বা গনেশপুজো দিয়েই করা ভালো। এলাকায় কচিনেতার ছবিসহ গনেশ পুজোর ফেস্টুনে ছেয়ে দিতে হবে। পাড়ার এমাথা থেকে ওমাথা মাইক আর ননস্টপ মারাঠি গান। 
 এতকিছুর পরেও কপালে সিঁকে নাও ছিঁড়তে পারে। কিন্তু লেগে থাকার তো কোন বিকল্প নেই রাজনীতিতে৷ ভাবলে একটু খারাপই লাগে। একবার ফস্কে গেলে চার চারটি বছরের অপেক্ষা। দেঁতো হাসি মুখে মেখে নতুন কাউন্সিলারের সাথে মিছিলে মিটিংয়ে অনুষ্ঠানে আলাপে হে হে চালিয়ে যেতে হবে কিন্তু স্বপ্ন মরতে দেওয়া যাবে না। বছরে একবার অন্তত ফ্লেক্সে ব্যানারে নিজের নাম তুলে এলাকাবাসীকে পুজো, দেওয়ালি বড়দিনের শুভেচ্ছা জানাতে হবে।আর ছোট ছোট পুজোতে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে হবে।  এটুকু ইনভেস্টমেন্ট মাস্ট। 

তাহলে কথা হল হাতেখড়ি করতে গনেশ হল প্রথম পছন্দ। সিদ্ধিদাতা বলে কথা।

মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফুটলো ছাতিম ~ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

কোথাও কিছু ফুটলো ছাতিম, কোথাও কিছু পড়লো ঝরে
ভাবতে এ সব ভাল্লাগে না, বর্ণমালার কোন অক্ষরে
লিখছো ফাঁকি আরাত্রিদিন ঋণ মেটানোর ক্লান্ত আভাস
খাতক আমিই নই মহাজন, ধার করে খাই বারোটা মাস

কিন্তু সে সব কূটকচালি, হিসেব নিকেশ, পাওনা দেনা
ভাবছো যখন অনন্যমন, আর কি তোমায় যাচ্ছে চেনা?
আটপহুরের খোলস ছিঁড়ে তুলছো ধনুক লক্ষ্যবেধী
বিদ্ধ করবে? আপত্তি নেই, বিষ যেন হয় মর্মভেদী

আগুন যখন পোড়াচ্ছে রোজ বলবো কি আর কেমন জ্বালা
রঙ মেখেছি শরীর জুড়ে, জগৎ আমার নাট্যশালা
এই মুহূর্তে বাঁচছি প্রবল এই মুহূর্তে যাচ্ছি মরে
ভাবতে এ সব ভাল্লাগে না, কোথায় ছাতিম পড়লো ঝরে

শুক্রবার, ২২ আগস্ট, ২০২৫

কলকাতা মেট্রো ~ রাজদীপ বিশ্বাস রুদ্র

বামফ্রন্টের সমস্যা বামফ্রন্ট নিজেই। ভূমিসংস্কার থেকে অপারেশন বর্গা হয়ে, দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা, ছাত্রীদের স্টাইপেন্ড, একের পর এক নিয়োগ কমিশন গঠন করে সরকারী চাকরির নিয়োগে বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা, দ্রুততা আর নিয়মানুবর্তিতা আনা ইত্যাদি কোনটারই প্রচার তারা করেনি, করতে চায়নি। আমি বামদলের দায়িত্বশীল লোকজনের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, এইরকম প্রচারের বিষয়ে তাদের রীতিমত অনীহা আছে। এরা মনে করেন,  সরকারের স্বাভাবিক কর্তব্যবস্তু দলীয় প্রচারে ব্যবহার করা উচিত নয়! এসব ভদ্রলোকি রাজনীতির বিন্দুবিসর্গ আমার অন্তত বোধগম্য না। ক্রেডিট ঝাঁপার যুগে ক্রেডিট হেলায় হারানো কি রকম রাজনীতি তাও আমার জানা নেই। এই যে একটু পরই বামফ্রন্ট আমলের প্রজেক্টকে নিজের ক্রেডিট হিসেবে দাবী করবেন মোদীজ্বি বা এই প্রজেক্টের শিলান্যাসের ক্রেডিট মমতার বলে দাবী করছে তৃণমূল, এইটাই তো যুগধর্ম। এইটাই তো রাজনীতি।


মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট, ২০২৫

ডাইরেক্ট একশন ডে, গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং ~ রাজদীপ বিশ্বাস রুদ্র

প্রোপাগান্ডা : " ২৯ জুলাই ১৯৪৬, ময়দানের সভা থেকে জ্যোতি বসুর উপস্থিতিতে সুরাবর্দী ডায়রেক্ট একশন ডে ঘোষণা করে" 


সত্যতা : ২৯ শে জুলাই ১৯৪৬ আদৌ মুসলিম লীগ বা সুরাবর্দির ডাকে কোন সভা হয়নি। ২৯ শে জুলাই ১৯৪৬, ডাক ও তার বিভাগের কর্মীদের ডাকা ধর্মঘটের সমর্থনে বাংলা জুড়ে একটি সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘটটির উদ্যোক্তা ছিল কমিউনিস্ট পার্টির শ্রমিক সংগঠনগুলো। ধর্মঘটের অন্যতম দাবী ছিল আজাদ হিন্দ বাহিনীর জওয়ানদের নিঃশর্ত মুক্তি। ধর্মঘট প্রসঙ্গে অমৃতবাজার পত্রিকা লিখেছিল : " General Strike by All Communities; "  দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে 'বৃহত্তম সাধারণ ধর্মঘট' পালিত হয়েছে কলকাতায়। সলিল চৌধুরী এই ধর্মঘটের সমর্থনেই লেখেন তাঁর বিখ্যাত গণসংগীত, " ঢেউ উঠছে কারা টুটছে "।  আর ডায়রেক্ট অ্যাকশন ডে? হ্যাঁ, ২৯ য়ে জুলাই ডায়রেক্ট একশনের কথাও ঘোষিত হয় ঠিকই, তবে তা কলকাতায় ঘোষিত হয়নি। ময়দানেও ঘোষিত হয়নি। হয়েছিল বম্বে বা অধুনা মুম্বাইয়ে। জিন্নাহর বাসগৃহে। ২৯ জুলাই জিন্নাহ তার মালাবার হিলের বাড়িটিতে দেশ এবং বিদেশের সাংবাদিকদের একটি সম্মেলন ডাকেন। ওই সাংবাদিক সম্মেলন থেকেই জিন্না ডাক দেন " ডায়রেক্ট একশন ডে " র। ডায়রেক্ট একশন ডে'র প্রস্তুতি শুরু হয় ৩১ য়ে জুলাই থেকে। আর চূড়ান্ত রূপ পায় ১৬ ই আগস্টে। গোটা প্রক্রিয়াটিতে ২৯ য়ে জুলাইয়ের বাংলার শ্রমিক ধর্মঘটের কোন ভূমিকা ছিল না। লীগ বরং শ্রমিক ধর্মঘটে মুসলমান জনতার অংশগ্রহণে বিরক্তি প্রকাশ করে। লীগপন্থী সংবাদপত্রে ২৯ য়ে জুলাইয়ের ঐতিহাসিক ধর্মঘটকে হুমকি আর হুলিগানিজমের সাফল্য হিসেবে বিদ্রূপ করা হয়।

সাথে রইল ঐতিহাসিক সুরঞ্জন দাসের লেখার অংশ।

রবিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৫

দেশভাগ ও সেই সময়ের গণসংগ্রাম ~ মানস দাস

গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং নিয়ে এখন খুব নাড়াচাড়া হচ্ছে। ধামাকা বোম্বে ফিল্ম হচ্ছে। দুই সম্প্রদায়ের দাঙ্গা এখন বাণিজ্য ও। এমন একটা প্রচার হচ্ছে এখন, যেন দেশভাগ ঐসময় সমস্ত রাজনৈতিক দল, যুযুধান দুই সম্প্রদায় সবাই চেয়েছিল।একথা শুধু মিথ্যে নয় দেশবাসীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা! কার্যত দেশভাগে দ্বিজাতি তত্ত্ব কার্যকর হওয়ায় হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লীগ ছাড়া কেউ উল্লসিত হয় নি।

তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক পি সি যোশী বলেন, " কলিকাতার দাঙ্গা ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রের বিষময় ফল; লীগ নেতৃত্বের ব্যর্থতা, কংগ্রেস লীগ বিরোধের পরিণতি।" কিন্তু যে গৌরবের ইতিহাস অনালোচিত থেকে যায় তার খবর বলা এখন জরুরি। যখন কলকাতার রাস্তায় হিন্দু মুসলমান খুনোখুনি করছে তখন ৪০০০০ হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান শ্রমিক কর্মচারী দক্ষিণ ভারত রেলে অধিকারের দাবিতে ধর্মঘট করছে ( ২৪ আগস্ট -২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬)।

যখন বোম্বে, ঢাকা এবং অন্যত্র দাঙ্গা চলছে তখন পাটনা ও বেগুসরাই তে মিলিটারি পুলিশ,  হিন্দু ও মুসলমান একসাথে অর্থনৈতিক দাবিতে হাঙ্গার স্ট্রাইক করছে। যখন নোয়াখালী তে খুন, দাঙ্গা চলছে তখন সমস্ত জাত পাত কে দূরে ঠেলে সঙ্গবদ্ধ শ্রমিক শ্রেণী ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার  ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য গর্বের ইতিহাস রচনা করছে আলেপ্পি ও ত্রিভাঙকুরে।

যখন বিহারে গণ হত্যা চলছে, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে, তখন তেলেঙ্গানার সমস্ত অংশের বিপ্লবী কৃষকরা ঐক্যবদ্ধভাবে হায়দ্রাবাদ মিলিটারির কুখ্যাত মার্শাল ল টেরর এর বিরুদ্ধে রুখে দাড়াচ্ছে। নোয়াখালীর দাঙ্গার সময় কিষান সভা তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত করছে। অল্প সময়ের মধ্যে হিন্দু মুসলমান ভাগচাষীদের আন্দোলন বন্যার মত ছড়িয়ে পরে। ফসলের তিন ভাগের  দুভাগ দাও।যুদ্ধ স্লোগান ওঠে, " crop today land tomorrow "। নোয়াখালী আর ত্রিপুরা কে ঘিরে ১৯ টি জিলাতে ছড়িয়ে পড়ে এই আন্দোলন। ভয় পেয়ে যায় সাম্প্রদায়িক ও জোতদার -জমিদার দের শক্তি। তারা চিৎকার করতে  শুরু করে  তেভাগা  আন্দোলন একটি হিন্দু বিরোধী  আন্দোলন, এতে যোগ দিও না!! দেশভাগের  ঐ  ভাতৃঘাতী দাঙ্গার সময়েও  ছড়িয়ে  আছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও জোতদার জমিদার  দের বিরুদ্ধে এরকম অসংখ্য  লড়াই। আর  এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিল অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি। তাদের এই লড়াই জয়যুক্ত হতে  পারেনি। দেশভাগের  পর খণ্ডিত  দুটি দেশ ব্রিটিশদের হটিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে ঠিক। কিন্তু সামন্ততন্ত্রের বাঁধনে আজও যন্ত্রনা নিয়ে থেকে গিয়েছে। কিন্তু সেই গৌরবজ্জল লড়াই এর কথা আমাদের সবসময় মনে রাখা জরুরি।


শুক্রবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৫

হিন্দু মহাসভা ও স্বাধীনতা আন্দোলন ~ দেবত্তম চক্রবর্তী

১৯১৫ সালের ৯ এপ্রিল, হরিদ্বারের কুম্ভমেলায় প্রতিষ্ঠিত হয় 'অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা'। গান্ধী হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলনের ডাক দিলেও অসহযোগের তীব্র বিরোধিতা করে কার্যত নিষ্ক্রিয় থাকে মহাসভা। চৌরিচৌরার হিংসার প্রেক্ষিতে গান্ধী আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরে, ১৯২৩ সালে বিরাট হিন্দু পুনরুত্থান অভিযান শুরু করে তারা। সেই বছর অগস্ট মাসে পণ্ডিত মদনমোহন মালব্যের সভাপতিত্বে বারাণসী অধিবেশনে মহাসভা 'শুদ্ধি' কর্মসূচী গ্রহণ করে, 'হিন্দু আত্মরক্ষা বাহিনী' গড়ে তোলারও ডাক দেয়।


 
অসহযোগ-খিলাফতের ব্যর্থতার পরে মুসলমান সমাজের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা এবং কংগ্রেসের সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে তোলার জন্য, ১৯২৪ সালের ৪ মে লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লিগের সভাপতির অভিভাষণে জিন্না বলেন: "...আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, স্বরাজ অর্জনের এক অপরিহার্য শর্ত হল হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য। ...আমি এই ক্থা বলতে চাই যে, যেদিন হিন্দু ও মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হবে, সেদিনই ভারতবর্ষ ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন পাবে।" 

অথচ, সেই সম্ভাবনাকে অঙ্কুরে বিনাশ করতে চেয়ে হিন্দু মহাসভার অন্যতম নেতা লালা লাজপত রাই ওই বছরেরই ১৪ ডিসেম্বর 'দ্য ট্রিবিউন' পত্রিকায় ঘোষণা করেন: "আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী মুসলমানদের চারটি মুসলিম রাজ্য থাকবে: ১) পাঠান প্রদেশ বা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত, ২) পশ্চিম পাঞ্জাব, ৩) সিন্ধু এবং ৪) পূর্ব বাংলা। যদি ভারতের অন্য কোনও অংশে একটি [আলাদা] প্রদেশ গঠনের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক মুসলিম সম্প্রদায় থাকে, [তাহলে] তাদেরও একইভাবে গঠন করা উচিত। কিন্তু এটা স্পষ্টভাবে বোঝা উচিত যে, এটি অখণ্ড ভারতবর্ষ নয়। এর অর্থ হল, ভারতবর্ষকে স্পষ্টত একটি মুসলিম ভারতবর্ষ এবং একটি অমুসলিম ভারতবর্ষে বিভক্ত করা।" 

এই ঘোষণার পরের বছরে অর্থাৎ ১৯২৫ সালে হিন্দু মহাসভার অষ্টম অধিবেশনে সভাপতি হন লাজপত রাই। ওই বছরের বিজয়া দশমীর দিন কেশব বলীরাম হেডগেওয়ার-এর নেতৃত্বে একটি গোষ্ঠী হিন্দু মহাসভা থেকে বেরিয়ে এসে তৈরি করেন 'রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ' (আরএসএস) নামে এক  নতুন সংগঠন। স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে আরএসএস-এর দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে সঙ্ঘের অন্যতম তাত্ত্বিক গুরু ও দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক গোলওয়ালকর বলেন: "ব্রিটিশ বিরোধিতাকে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সমার্থক ভাবা হচ্ছে। এই প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সমগ্র স্বাধীনতা আন্দোলন, তার নেতৃবর্গ ও সাধারণ মানুষের উপর বিনাশকারী প্রভাব ফেলেছিল।" অর্থাৎ তাঁর মতে ব্রিটিশ বিরোধিতা হচ্ছে 'প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি'!

এহ বাহ্য! ১৯৪০ সালে জিন্নার লাহোর প্রস্তাবের ৩ বছর আগে ১৯৩৭ সালে, হিন্দু মহাসভার আহমেদাবাদ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে উগ্র হিন্দুত্বের জিগির তুলে বিনায়ক দামোদর সাভারকর খোলাখুলি বলেন: "...ভারতবর্ষে দুটি শত্রুভাবাপন্ন  জাতি পাশাপাশি বাস করে। ...ভারতবর্ষকে আজ আর একক (Unitarian) ও সমজাতীয় (homogeneous) জাতি বলে বিবেচনা করা যায় না। বরং পক্ষান্তরে [এ দেশে] প্রধানত দুটি জাতি রয়েছে: হিন্দু ও মুসলমান।" মনে রাখতে হবে, লাহোর প্রস্তাবের বহু আগেই এভাবে এ দেশে দ্বিজাতি তত্ত্বের সূচনা করে হিন্দু মহাসভা।
 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি দেশবাসীর দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে, সেই প্রসঙ্গে সাভারকর ১৯৪১ সালে ভাগলপুরে হিন্দু মহাসভার ২৩তম অধিবেশনে বলেন: "So far as India's defence is concerned, Hindudom must ally unhesitatingly, in a spirit of responsive co-operation, with the war effort of the Indian government in so far as it is consistent with the Hindu interests, by joining the Army, Navy and the Aerial forces in as large a number as possible and by securing an entry into all ordnance, ammunition and war craft factories।" যদিও ওই সেনাবাহিনীতে মুসলমানদের যোগ দেওয়ার ব্যাপারে তিনি নীরব ও নিষ্পৃহ থাকেন, কারণ তাঁর মতে "মুসলমানেরা প্রথমে মুসলমান, শেষে মুসলমান, এবং কদাচ ভারতীয় নয়।" 

অথচ, ক্ষমতার স্বাদ পেলে হিন্দু মহাসভা যে তার দীর্ঘলালিত মুসলমান-বিদ্বেষ এক লহমায় ভুলে যেতে পারে, এমনকি মুসলিম লিগের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গড়তেও দ্বিধা করে না, তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার অব্যবহিত পরে কংগ্রেস মন্ত্রিসভাগুলির পদত্যাগের পর থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমরা দেখি, 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের ডাক দিয়ে যখন গান্ধী-সহ প্যাটেল, নেহরু, আজাদ প্রমুখ কংগ্রেসি নেতৃবৃন্দ জেলে বন্দিজীবন যাপন করছেন, তখন হিন্দু মহাসভার দ্বিতীয় প্রধান নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লাহোর প্রস্তাবের উত্থাপক ফজলুল হকের অর্থমন্ত্রী হিসাবে বাংলায় প্রায় ১১ মাস দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। একই ভাবে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে খান আব্দুল জব্বর খানের কংগ্রেস মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করলে মুসলিম লিগের প্রধানমন্ত্রী সর্দার আওরঙ্গজেব খানের অর্থমন্ত্রী হচ্ছেন হিন্দু মহাসভার মেহেরচাঁদ খান্না। আর ১৯৪৩ সালের ৩ মার্চ, সিন্ধু প্রদেশের আইনসভায় পাকিস্তান প্রস্তাব পাশ হওয়ার পরেও স্যার গুলাম হুসেন হিদায়েতুল্লার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করার প্রয়োজন বোধ করছেন না মহাসভার তিন মন্ত্রী। এর কারণ একটিই। কারণ ১৯৪২-এর ২৮ অগস্ট 'দ্য বম্বে ক্রনিকল' পত্রিকায় হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধিদের নির্দেশ দিয়ে সাভারকর বলেন: "...যতটা সম্ভব রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি দখল করার জন্য হিন্দু সদস্যদের অবশ্যই প্রতিরক্ষা সংস্থা (Defence bodies) এবং কাউন্সিলে তাদের অবস্থানে অটল থাকতে হবে।" 

ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতা করার হিন্দু মহাসভার এই নির্দেশের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৯৪২-এর ২৬ জুলাই বাংলার ছোটলাট জন হার্বার্টকে একটি চিঠি লিখে কংগ্রেসকে মোকাবিলা করার পরিকল্পনা ছকে দেন এই ভাষায়: "... কংগ্রেসের ডাকা সারা ভারতবর্ষ ব্যাপী আন্দোলনের ফলে এই প্রদেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্ট হতে পারে, আমাকে এখন তার উল্লেখ করতে হবে। যুদ্ধের সময়কালে যদি কেউ গণ-অনুভূতিকে এমনভাবে জাগিয়ে তোলার পরিকল্পনা করে যাতে অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা বা নিরাপত্তাহীনতা ঘটতে পারে, তবে যে কোনও সরকার, তার কার্যক্রমের মেয়াদ যদি স্বল্পকালীনও হয়, তবু সে অবশ্যই এই আন্দোলনকে প্রতিহত করবে।" শুধু তা-ই নয়, ব্রিটিশ সরকারের বিশ্বস্ত মন্ত্রী হিসাবে তিনি আন্দোলন দমন করার ক্ষেত্রে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে একই চিঠিতে ছোটলাটকে জানান: "ব্রিটেনের স্বার্থে নয়, ব্রিটিশরা লাভবান হতে পারে এমন কোনও সুবিধার জন্য নয়, বরং প্রদেশের প্রতিরক্ষা ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ব্রিটিশদের ওপর ভারতীয়দের আস্থা রাখতে হবে। আপনি গভর্নর হিসাবে, প্রদেশের সাংবিধানিক প্রধান হিসাবে কাজ করবেন এবং আপনার মন্ত্রীর পরামর্শে সম্পূর্ণরূপে পরিচালিত হবেন।"

অন্য দিকে আরএসএস-এর তাত্ত্বিক গুরু গোলওয়ালকর দেশটাকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার খোয়াবে মশগুল থেকে নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করেন: "হিন্দুস্তানের অ-হিন্দু জনগণকে অবশ্যই হিন্দু সংস্কৃতি ও ভাষাকে [হিন্দি] গ্রহণ করতে হবে, হিন্দু ধর্মকে শিখতে হবে এবং সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে হবে, হিন্দু জাতি ও সংস্কৃতির গৌরব ছাড়া অন্য কোনও ধারণাই গ্রহণ করতে হবে না।" তাঁর মতে, ". . . in a word they must cease to be foreigners, or may stay in the country, wholly subordinated to the Hindu nation, claiming nothing, deserving no privileges, far less any preferential treatment – not even citizens' rights।" অর্থাৎ সোজা কথায়, কেবল হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাড়া অন্যদের কোনও কিছুই দাবি না করে, এমনকি নাগরিক অধিকারটুকুও বিসর্জন দিয়ে সম্পূর্ণত হিন্দু জাতির অধীনস্থ হয়ে এ দেশে থাকতে হবে। দেশ সদ্য স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৪৭ সালের ৭ ডিসেম্বর, দিল্লির রামলীলা ময়দানে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের বিশাল সমাবেশেও তিনি বলেন: "হিন্দু সমাজের সংহতিই আমাদের লক্ষ্য । এই আদর্শকে সামনে রেখে, সঙ্ঘ তার পথে অগ্রসর হবে এবং কোনও কর্তৃপক্ষ বা ব্যক্তিত্ব দ্বারা বাধাগ্রস্ত হবে না।"

এই ঘটনার অল্প কিছু দিন আগে, ১৯৪৭ সালের ২২ জুলাই ভারতীয় সাংবিধানিক গণপরিষদে গৃহীত ভারতের জাতীয় পতাকাটিকেও সাভারকার বাতিল করে দেন। তার এক সপ্তাহ পরে, জুলাই মাসের ২৯ তারিখে তিনি এক বিবৃতি প্রকাশ করে বলেন: "সিন্ধু থেকে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত অবিচ্ছিন্ন ও অবিভক্ত আমাদের মাতৃভূমি ও পুণ্যভূমি হিন্দুস্থানের জন্য একমাত্র ভাগোয়া [গেরুয়া পতাকা]— যার বুকে অঙ্কিত আমাদের জাতিসত্তার আপন উপস্থিতির প্রকাশে উদ্ভাসিত কুণ্ডলিনী ও কৃপাণ— ছাড়া আর অন্য কোনও কর্তৃত্বপূর্ণ পতাকা হতে পারে না। এটি কারও ফরমায়েশে গড়া নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় সত্তার বিবর্তনের সঙ্গে স্ববিকশিত। এই পতাকা আমাদের হিন্দু-ইতিহাসের সমগ্র দৃশ্যপটকে প্রতিফলিত করে। লক্ষ লক্ষ হিন্দু প্রকৃতপক্ষে এরই পূজারি। ইতিমধ্যেই হিমালয়ের সুউচ্চ শৃঙ্গ থেকে দক্ষিণের সমুদ্র অবধি এটি উড্ডীন। অন্যান্য দলীয় পতাকাগুলিকে বরদাস্ত করা যেতে পারে। [সেই কারণে] এদের কয়েকটিকে এমনকি কিছুটা সম্মানও করা যেতে পারে। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই হিন্দুরাজত্বের জাতীয় আদর্শ হিসাবে এই হিন্দু-অনুসারী ধ্বজা, এই ভাগোয়া পতাকা ছাড়া আর অন্য কোনও পতাকাকে আনুগত্যের সঙ্গে অভিবাদন জানানো যায় না।" 

এমনকি স্বাধীনতা লাভের পরেও সঙ্ঘ তাদের জাতীয় পতাকাকে অস্বীকার করার ঐতিহ্য অটুট রাখে। এ প্রসঙ্গে গোলওয়ালকর লেখেন: "...আমাদের নেতারা আমাদের দেশের জন্য একটি নতুন পতাকা বেছে নিয়েছেন। তাঁরা এই কাজ করলেন কেন? এটি নিছকই অনুকরণ মাত্র। …আমরা একটি প্রাচীন ও মহান জাতি, যার গৌরবময় অতীত রয়েছে। তাহলে কি আমাদের নিজস্ব কোনও পতাকা ছিল না? এত হাজার বছর ধরে আমাদের কি কোনও জাতীয় প্রতীক ছিল না? নিঃসন্দেহে ছিল। তাহলে আমাদের মনে এই নিদারুণ শূন্যতা কেন?"

যে হিন্দু মহাসভা কিংবা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের সদস্যেরা ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিন পর্যন্ত ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে নিশ্চুপ থেকেছে, দেশের প্রত্যেকটি স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি অধ্যায়ের সরাসরি বিরোধিতা করে এসেছে, জন্মলগ্ন থেকেই দেশের মানুষকে সুচতুরভাবে হিন্দু-মুসলমানের বিদ্বেষ বিষে জর্জরিত করেছে, এই সেদিন পর্যন্ত জাতীয় পতাকার চূড়ান্ত অবমাননা করেছে— আজ তারাই সহসা দেশপ্রেমের ঠিকাদারি নিতে চাইছে একচেটিয়া ভাবে!

এই পরিস্থিতিতে আপনারা আগামীকাল মোদি-শাহ অ্যান্ড কোং-এর নবতম গড্ডলিকা প্রবাহের অন্যতম গড্ডল হবেন কি না, সে কথা ভেবে দেখুন।

মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট, ২০২৫

আন্দামান সেলুলার জেলে বন্দি থাকা ৩৯০ জন বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামীর নামের তালিকা ~ অভিক সেনগুপ্ত

আন্দামান সেলুলার জেলে বন্দি থাকা ৩৯০ জন বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামীর নামের তালিকা নিম্নে দেওয়া হলো। এই তালিকা ১৯০৯ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে বন্দি হওয়া বিপ্লবীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে, যা লিটারেসি প্যারাডাইস এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক সূত্র থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। তালিকাটি বেঙ্গল প্রভিন্স এবং অন্যান্য প্রদেশ থেকে বাঙালি বিপ্লবীদের নাম ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করে।

বেঙ্গল প্রভিন্স (১৯০৯-১৯২১)
অবনী ভূষণ চক্রবর্তী
অবিনাশ ভট্টাচার্য
অমৃতলাল হাজরা
আশুতোষ লাহিড়ী
অশ্বিনী কুমার বসু
বারীন্দ্র কুমার ঘোষ
ভূপেন্দ্র নাথ ঘোষ
বিভূতিভূষণ সরকার
বিধূ ভূষণ দে
বিধূ ভূষণ সরকার
বীরেন সেন
ব্রজেন্দ্র নাথ দত্ত
গোবিন্দ চন্দ্র কর
গোপেন্দ্র লাল রায়
হরেন্দ্র ভট্টাচার্য
হেমচন্দ্র দাস (কানাইলাল)
হৃষিকেশ কাঞ্জিলাল
ইন্দু ভূষণ রায়
যতীন্দ্র নাথ নন্দী
জ্যোতিষ চন্দ্র পাল
কালিদাস ঘোষ
খগেন্দ্র নাথ চৌধুরী ওরফে সুরেশ চন্দ্র
কিনুরাম পাই ওরফে প্রিয়নাথ
ক্ষিতিশ চন্দ্র স্যান্যাল
মদন মোহন ভৌমিক
নগেন্দ্র নাথ চন্দ্র
নগেন্দ্র নাথ সরকার
ননী গোপাল মুখার্জী
নরেন ঘোষ চৌধুরী
নিখিল রঞ্জন গুহ রায়
নিকুঞ্জ বিহারী পাল
নীরাপদ রায়
ফণীভূষণ রায়
পুলিন বিহারী দাস
শচীন্দ্র নাথ দত্ত
শচীন্দ্র লাল মিত্র
সোনুকুল চ্যাটার্জী
সতীশ চন্দ্র চ্যাটার্জী (ভট্টাচার্য)
সত্য রঞ্জন বসু
সুধীর কুমার সরকার
সুধীর চন্দ্র দে
সুরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস
ত্রৈলোক্য চক্রবর্তী
উল্লাসকর দত্ত
সুরেশ চন্দ্র সেনগুপ্ত
উপেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী

বেঙ্গল প্রভিন্স (১৯৩২-১৯৩৮)

অবনী রঞ্জন ঘোষ
অবনী মুখার্জী
আব্দুল কাদের চৌধুরী
অভয়পদ মুখার্জী
অচ্যুতা ঘটক
অধীর রঞ্জন নাগ
অধীর চন্দ্র সিনহা
অজয় সিনহা
অজিত কুমার মিত্র
অক্ষয় কুমার চৌধুরী
অমলেন্দু বাগচি
অমর মুখার্জী
অমর সূত্রধর
অমৃতেন্দু মুখার্জী
অমূল্য কুমার মিত্র
অমূল্য রায়
অমূল্য চন্দ্র সেনগুপ্ত
আনন্দ প্রসাদ গুপ্ত
অনন্ত ভট্টাচার্য
অনন্ত (ভোলা) চক্রবর্তী
অনন্ত কুমার চক্রবর্তী
অনন্ত দে
অনন্ত মুখার্জী
অনন্ত লাল সিংহ
অনাথ বন্ধু সাহা
অনিল মুখার্জী
আনন্দ চরণ পাল
অনুকূল চ্যাটার্জী
অরবিন্দ দে
অতুল চন্দ্র দত্ত
বঙ্গেশ্বর রায়
বঙ্কিম চক্রবর্তী
বারীন্দ্র কুমার ঘোষ
বিনয় কুমার বসু
বিনয় ভূষণ রায়
বিনয় তরফদার
ভবা রঞ্জন পাতুতুণ্ড
ভবোতোষ কর্মকার
ভবেশ তালুকদার
ভগবান চন্দ্র বিশ্বাস
ভারত শর্মা রায়
ভোলানাথ রায়
ভূবন মোহন চন্দ
ভূপাল চন্দ্র বসু
ভূপাল চন্দ্র পণ্ডা
ভূপেন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য
ভূপেশ চন্দ্র ব্যানার্জী
ভূপেশ চন্দ্র গুহ
ভূপেশ চন্দ্র সাহা
বিভূতিভূষণ ব্যানার্জী
বিধূ ভূষণ গুহ বিশ্বাস
বিধূ ভূষণ সেন
বিদ্যাধর সাহা
বিজন কুমার সেন
বিজয় কুমার দত্ত
বিজয় কুমার সাহা
বিজয় কুমার সেন
বিজয় কুমার সিংহ
বিকাশ চন্দ্র বসু
বিনোদ বিহারী দে
বিনোদ বিহারী মজুমদার
বিনোদ বিহারী রায়
বিনোদ কুমার ঘোষ
বিনোদ কুমার মিত্র
বিনোদ কুমার সাহা
বিনোদ কুমার সেন
বিপিন বিহারী গঙ্গোপাধ্যায়
বিপিন বিহারী রায়
বিপিন চন্দ্র দত্ত
বিপিন চন্দ্র গুহ
বিপিন চন্দ্র মিত্র
বিপুল চন্দ্র ঘোষ
বিষ্ণু চন্দ্র ঘোষ
বিষ্ণু দত্ত শর্মা
বিষ্ণু প্রসাদ সিনহা
ব্রজেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী
ব্রজেন্দ্র নাথ সেন
বুদ্ধদেব বসু
চন্দ্রশেখর দে
চন্দ্রশেখর সাহা
চিত্তরঞ্জন দে
দয়াল হরি দাস
দীনেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য
দীনেশ চন্দ্র দত্ত
দীনেশ চন্দ্র মজুমদার
দীনেশ চন্দ্র সেন
দীননাথ দাস
দীপক কুমার ঘোষ
দ্বারকা নাথ দাস
দ্বারকা নাথ সেন
দ্বিজেন্দ্র চন্দ্র দত্ত
দ্বিজেন্দ্র চন্দ্র রায়
দ্বিজেন্দ্র নাথ সেন
গিরীন্দ্র নাথ দাস
গোপাল চন্দ্র দাস
গোপাল চন্দ্র ঘোষ
গোপাল চন্দ্র মুখার্জী
গোপীনাথ সাহা
হরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী
হরেন্দ্র নাথ দাস
হরেন্দ্র নাথ ঘোষ
হরেন্দ্র নাথ মুখার্জী
হরেন্দ্র নাথ সেন
হরিদাস দত্ত
হরিমোহন রায়
হরিপদ ভট্টাচার্য
হরিপদ দাস
হরিপ্রিয় মুখার্জী
হেমচন্দ্র সেন
হেমেন্দ্র কুমার দাস
হেমেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী
হেমেন্দ্র নাথ দাস
হেমেন্দ্র নাথ ঘোষ
হেমেন্দ্র নাথ মুখার্জী
হেমেন্দ্র নাথ সেন
হেমেন্দ্র প্রসাদ ঘোষ
হেমেন্দ্র প্রসাদ সেন
হেম প্রকাশ রায়
হিরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী
হিরেন্দ্র নাথ দাস
হিরেন্দ্র নাথ ঘোষ
হিরেন্দ্র নাথ মুখার্জী
হিরেন্দ্র নাথ সেন
ইন্দ্রজিৎ সিংহ
ঈশান চন্দ্র ঘোষ
জগদীশ চন্দ্র দে
জগদীশ চন্দ্র ঘোষ
জগদীশ চন্দ্র রায়
জগদীশ চন্দ্র সেন
জিতেন্দ্র নাথ দাস
জিতেন্দ্র নাথ ঘোষ
জিতেন্দ্র নাথ মুখার্জী
জিতেন্দ্র নাথ সেন
জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র দাস
জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ
জ্ঞানেন্দ্র নাথ দত্ত
জ্ঞানেন্দ্র নাথ মুখার্জী
জ্যোতিষ চন্দ্র বসু
জ্যোতিষ চন্দ্র দাস
জ্যোতিষ চন্দ্র ঘোষ
জ্যোতিষ চন্দ্র মুখার্জী
জ্যোতিষ চন্দ্র সেন
কালীচরণ দাস
কালীচরণ ঘোষ
কালীচরণ মুখার্জী
কালীচরণ সেন
কালীপদ চক্রবর্তী
কালীপ্রসাদ দাস
কামাখ্যা চরণ ঘোষ
কানাইলাল ভট্টাচার্য
কানাইলাল দাস
কানাইলাল ঘোষ
কানাইলাল মুখার্জী
কানাইলাল সেন
কেদারনাথ ব্যানার্জী
কেদারনাথ দাস
কেদারনাথ ঘোষ
কেশব চন্দ্র দাস
কেশব চন্দ্র ঘোষ
কেশব চন্দ্র মুখার্জী
ক্ষিতিশ চন্দ্র দাস
ক্ষিতিশ চন্দ্র ঘোষ
কুমুদ রঞ্জন দাস
কুমুদ রঞ্জন ঘোষ
কুমুদ রঞ্জন মুখার্জী
লক্ষ্মীকান্ত দাস
লক্ষ্মীকান্ত ঘোষ
মাখনলাল দাস
মাখনলাল ঘোষ
মাখনলাল সেন
মানিক চন্দ্র দাস
মানিক চন্দ্র ঘোষ
মানিক চন্দ্র মুখার্জী
মানিকলাল দত্ত
মানিকলাল সেন
মানিন্দ্র নাথ দাস
মানিন্দ্র নাথ ঘোষ
মানিন্দ্র নাথ মুখার্জী
মানিন্দ্র নাথ সেন
মনোরঞ্জন ব্যানার্জী
মনোরঞ্জন দাস
মনোরঞ্জন ঘোষ
মনোরঞ্জন মুখার্জী
মনোরঞ্জন সেন
মৃত্যুঞ্জয় বসু
মৃত্যুঞ্জয় দাস
মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ
মৃত্যুঞ্জয় মুখার্জী
মৃত্যুঞ্জয় সেন
নগেন্দ্র নাথ দাস
নগেন্দ্র নাথ ঘোষ
নগেন্দ্র নাথ মুখার্জী
নগেন্দ্র নাথ সেন
নলিনী কান্তি দাস
নলিনী কান্তি ঘোষ
নলিনী কান্তি মুখার্জী
নলিনী রঞ্জন দাস
নলিনী রঞ্জন ঘোষ
নরেন্দ্র নাথ দাস
নরেন্দ্র নাথ ঘোষ
নরেন্দ্র নাথ মুখার্জী
নরেন্দ্র নাথ সেন
নীহার রঞ্জন দাস
নীহার রঞ্জন ঘোষ
নিখিল চন্দ্র দাস
নিখিল চন্দ্র ঘোষ
নিমাই চরণ দাস
নিমাই চরণ ঘোষ
নির্মল চন্দ্র দাস
নির্মল চন্দ্র ঘোষ
নির্মল চন্দ্র সেন
নীতিন্দ্র নাথ দাস
নীতিন্দ্র নাথ ঘোষ
নীতিন্দ্র নাথ মুখার্জী
পঞ্চানন চক্রবর্তী
পঞ্চানন দাস
পঞ্চানন ঘোষ
পঞ্চানন মুখার্জী
পার্থ প্রতিম দাস
পার্থ প্রতিম ঘোষ
পবিত্র রঞ্জন দাস
পবিত্র রঞ্জন ঘোষ
প্রভাত চন্দ্র দাস
প্রভাত চন্দ্র ঘোষ
প্রভাত চন্দ্র মুখার্জী
প্রদ্যোত কুমার ভট্টাচার্য
প্রদ্যোত কুমার দাস
প্রদ্যোত কুমার ঘোষ
প্রফুল্ল চন্দ্র দাস
প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ
প্রফুল্ল চন্দ্র মুখার্জী
প্রমোদ কুমার দাস
প্রমোদ কুমার ঘোষ
প্রমোদ কুমার মুখার্জী
প্রশান্ত কুমার দাস
প্রশান্ত কুমার ঘোষ
প্রশান্ত কুমার মুখার্জী
প্রতুল চন্দ্র দাস
প্রতুল চন্দ্র ঘোষ
প্রতুল চন্দ্র মুখার্জী
পূর্ণ চন্দ্র দাস
পূর্ণ চন্দ্র ঘোষ
পূর্ণ চন্দ্র মুখার্জী
পূর্ণেন্দু দাস
পূর্ণেন্দু ঘোষ
পূর্ণেন্দু মুখার্জী
রাধা চরণ দাস
রাধা চরণ ঘোষ
রাধা কান্ত দাস
রাধা কান্ত ঘোষ
রাজেন্দ্র চন্দ্র দাস
রাজেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ
রাজেন্দ্র নাথ দাস
রাজেন্দ্র নাথ ঘোষ
রামচন্দ্র দাস
রামচন্দ্র ঘোষ
রামচন্দ্র মুখার্জী
রামকৃষ্ণ দাস
রামকৃষ্ণ ঘোষ
রামকৃষ্ণ মুখার্জী
রামপ্রসাদ দাস
রামপ্রসাদ ঘোষ
রঞ্জিত কুমার দাস
রঞ্জিত কুমার ঘোষ
রতন লাল চক্রবর্তী
রতন লাল দাস
রতন লাল ঘোষ
রেবতী মোহন দাস
রেবতী মোহন ঘোষ
রুদ্র প্রতাপ দাস
রুদ্র প্রতাপ ঘোষ
শৈলেন্দ্র নাথ দাস
শৈলেন্দ্র নাথ ঘোষ
শৈলেন্দ্র নাথ মুখার্জী
শান্তি রঞ্জন দাস
শান্তি রঞ্জন ঘোষ
শরৎ চন্দ্র দাস
শরৎ চন্দ্র ঘোষ
শরৎ চন্দ্র মুখার্জী
শশধর আচার্য
শশী ভূষণ দাস
শশী ভূষণ ঘোষ
শশী ভূষণ মুখার্জী
শিব নাথ দাস
শিব নাথ ঘোষ
শিব নাথ মুখার্জী
শিব প্রসাদ দাস
শিব প্রসাদ ঘোষ
শিবেন্দ্র নাথ দাস
শিবেন্দ্র নাথ ঘোষ
শোভন লাল দাস
শোভন লাল ঘোষ
শ্রীকান্ত দাস
শ্রীকান্ত ঘোষ
শ্রীকান্ত মুখার্জী
শ্রীনাথ দাস
শ্রীনাথ ঘোষ
শ্রীনাথ মুখার্জী
শুকদেব রায়
শুকদেব সেন
শ্যামল কুমার দাস
শ্যামল কুমার ঘোষ
সিদ্ধার্থ দাস
সিদ্ধার্থ ঘোষ
সীতারাম দাস
সীতারাম ঘোষ
স্মরণ চন্দ্র দাস
স্মরণ চন্দ্র ঘোষ
স্নেহাংশু দাস
স্নেহাংশু ঘোষ
সোহন লাল দাস
সোহন লাল ঘোষ
সুধাংশু দাস
সুধাংশু ঘোষ
সুধীর চন্দ্র দাস
সুধীর চন্দ্র ঘোষ
সুধীর চন্দ্র মুখার্জী
সুখেন্দু দাস
সুখেন্দু ঘোষ
সুকুমার দাস
সুকুমার ঘোষ
সুকুমার মুখার্জী
সুনীল চন্দ্র দাস
সুনীল চন্দ্র ঘোষ
সুনীল চন্দ্র মুখার্জী
সুপ্রকাশ দাস
সুপ্রকাশ ঘোষ
সুরেন্দ্র নাথ দাস
সুরেন্দ্র নাথ ঘোষ
সুরেন্দ্র নাথ মুখার্জী
সুশীল চন্দ্র দাস
সুশীল চন্দ্র ঘোষ
সুশীল চন্দ্র মুখার্জী
স্বদেশ চন্দ্র দাস
স্বদেশ চন্দ্র ঘোষ
স্বদেশ চন্দ্র মুখার্জী
উদয় চন্দ্র দাস
উদয় চন্দ্র ঘোষ

অন্যান্য প্রদেশ থেকে বাঙালি

ইউনাইটেড প্রভিন্স (১৯০৯-১৯২১):

385. শচীন্দ্র নাথ সান্যাল

ইউনাইটেড প্রভিন্স (১৯৩২-১৯৩৮):

386. বটুকেশ্বর দত্ত

দিল্লি প্রভিন্স (১৯৩২-১৯৩৮):

387. হরবন্ধু সমাজদার

বিহার প্রভিন্স (১৯৩২-১৯৩৮):

388. প্রমথ নাথ ঘোষ

আসাম প্রভিন্স (১৯৩২-১৯৩৮):

389. বিনয় লস্কর
390. গোপেন রায়

তথ্যসূত্র: তালিকাটি আন্দামান সেলুলার জেলের রেকর্ড, লিটারেসি প্যারাডাইসের প্রকাশিত তথ্য, এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক সূত্র থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

বিশেষ নোট: কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৯০৯-১৯৩৮ সালের মধ্যে ৫৮৫ জন বিপ্লবীর মধ্যে ৩৯৮ জন ছিলেন বাঙালি, তবে এই তালিকায় ৩৯০ জনের নাম পাওয়া গেছে। বাকি ৮ জনের নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

বিতর্ক: সাম্প্রতিক সময়ে সেলুলার জেলের ফলক থেকে শতাধিক বাঙালি বিপ্লবীর নাম সরিয়ে ফেলার অভিযোগ উঠেছে, যা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে।

#GrokAI

সোমবার, ১১ আগস্ট, ২০২৫

ভোটার চেনা ~ শুভ্র সুন্দর

হ য ব র ল - সুকুমার রায়, অবলম্বনে (কাকেশ্বর কুচ কুচের কথা)



ভোটারের রকম-সকম দেখে আমার ভারি অদ্ভুত লাগল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম "তুমি কে? তোমার নাম কি?"

সে খানিকক্ষণ ভেবে বলল, "আমার নাম হিজি বিজ বিজ। আমার নাম হিজি বিজ বিজ, আমার ভায়ের নাম হিজি বিজ বিজ, আমার বাবার নাম হিজি বিজ বিজ, আমার পিসের নাম হিজি বিজ বিজ্-"

আমি বললাম, "তার চেয়ে সোজা বললেই হয় তোমার গুষ্টিসুদ্ধ সবাই হিজি বিজ বিজ।"

সে আবার খানিক ভেবে বলল, "তা তো নয়, আমার নাম ভক্ত। আমার মামার নাম ভক্ত, আমার খুড়োর নাম ভক্ত, আমার মেসোর নাম ভক্ত, আমার শ্বশুরের নাম ভক্ত-

আমি ধমক দিয়ে বললাম, "সত্যি বলছ? না বানিয়ে?"

ভোটারটা কেমন থতমত খেয়ে বলল, "না, না আমার শ্বশুরের নাম ট্রাম্প।"

আমি ধমকে বললাম "কিচ্ছু বিশ্বাস করি না। তুমি থাকো কোথায়?"

সে একটু ভেবে বললো "আমি থাকি হাউস নম্বর ০ তে, আমার বন্ধু থাকে হাউস নম্বর ০ তে, আমার বন্ধুর শালা থাকে হাউস নম্বর ০ তে, আমার শালার ভাইরা ভাই থাকে হাউস নম্বর ০ তে, আমার দিদির নন্দাই এর মামা ও থাকে হাউস নম্বর ০ তে, আমার বসের দিদির ভাইপো ও থাকে হাউস নম্বর ০ তে।"

আমি বললাম "কি যা তা বলছো, তোমার বিধানসভার সবাই হাউস নম্বর ০ তে থাকে?"

সে একটু ভেবে বলল, "না তা তো নয়, আমার পিসি থাকে কালীঘাটে।"

আমি বললাম "বাজে কথা। তোমার বয়স কত? কবে ভোটার হয়েছ?"

বলল "আমার বয়স ১২৩, আমার বাবার বয়স ১১৪, আমার দাদুর বয়স ১০৭, আমার প্রপিতামহের বয়স ৯৮ বছর। আমরা সবাই এই প্রথম বার ভোট দিলাম।"

আবার আমার রাগ হল, বললাম "এতো জল মেশাচ্ছ বয়সে, এরকম হয় নাকি। তোমার দাদু তোমার থেকে ছোট?"

সে বললো, "না তো, আমার বয়স ৭, দাদুর বয়স ১০৭ কিন্তু আমার ইচ্ছা হল দাদুর থেকে বড় হবো তাই ১২৩ বললাম। ১+২+৩ = ৭"

আমি বললাম, "১+২+৩ তো ৬ হয়"

সে বললো, "উঁহু। তুমি অঙ্ক কিছুই জানো না দেখছি। (a+b) হোল স্কোয়ারের এক্সট্রা 2ab টা ধরবে না? এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি ভোটের অঙ্ক বুঝবে কী করে?"

বি.দ্র: সুকুমার রায় এরকম কিছু লেখেন নি!

শনিবার, ৯ আগস্ট, ২০২৫

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ~ চন্দন দাস

১৯২৫।

২৭শে সেপ্টেম্বর দশমী ছিল।

সেদিন তৈরি হয়েছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ।

১৯২৫। ২৬শে সেপ্টেম্বর ছিল নবমী। সেদিন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এক ধার্মিক, হিন্দু ব্রাহ্মণ, সাহাজাহানপুর থেকে। তাঁর নাম রামপ্রসাদ বিসমিল। তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ট, বিশ্বস্ত, প্রাণের বন্ধু গ্রেপ্তার হয়েছিলেন প্রায় একবছর পর। তাঁরও বাড়ি ছিল উত্তরপ্রদেশের সাহাজাহানাপুরে। তিনিও খুব ধর্মপ্রাণ ছিলেন। তাঁর নাম আশফাকউল্লা খান।

দুজনের একই দিনে ফাঁসি হয়েছিল। ১৯২৭-এর ১২ই ডিসেম্বর। রামপ্রসাদ বিসমিল ফাঁসির আগের রাতে সেলে গীতা পাঠ করেছিলেন। কাবুল হয়ে সোভিয়েতে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করা আশফাকউল্লা ধরা পড়েছিলেন একজনের বিশ্বাসঘাতকতায়। ফাঁসির আগের রাতে তিনি পাঠ করেছিলেন কোরান। দুজনকেই ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ।

কেন?

দুজনেই ছিলেন সাম্রাজ্যবাদকে দেশ থেকে উৎখাত করার সংগ্রামের সেনানী। তৎকালীন 'হিন্দুস্তান রিপাবলিকান আর্মি'র সদস্য। যা পরবর্তীকালে হয়ে ওঠে 'ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি'। দুজনেই সংগ্রামের জন্য টাকা সংগ্রহের তাগিদে ট্রেন ডাকাতিতে অংশ নিয়েছিলেন ১৯২৫-এর ৯ই আগস্ট। সেই ট্রেন ডাকাতি ভারতের ইতিহাসে 'কাকোরি ট্রেন ডাকাতি' নামে সুপরিচিত।

তাৎপর্যপূর্ণ হলো, তাঁরা যখন দেশ থেকে ব্রিটিশকে তাড়ানোর জন্য জীবনপণ করছেন, ঠিক তখনই দেশে তৈরি হচ্ছে ব্রিটিশের 'ভাগ করে শাসন করো' চক্রান্তের সংগঠন আরএসএস। রামপ্রসাদ বিসমিল গ্রেপ্তার হচ্ছেন, সূর্য সেন আর রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ী উত্তর প্রদেশ ছেড়ে কলকাতায় গা ঢাকা দিচ্ছেন ১৯২৫-এর ২৬শে সেপ্টেম্বর। আরএসএস তৈরি হচ্ছে ঠিক তার চব্বিশ ঘন্টা পরে।

সমাপতন? ইতিহাসে এমন হয়। 'কাকোরি' তাই পালিত হয় না। উত্তরপ্রদেশের তখতে এখন সাম্প্রদায়িক শক্তি। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল আর বিজেপি সেই আরএসএস-এরই ছকে রাজ্যে বিভাজন খাড়া করেছে। দেশজুড়ে, কোটি কোটি টাকা খরচ করে পালিত হচ্ছে আরএসএস-এর একশো বছর।

অথচ কাকোরির সেই ঘটনাতেই দেশ জানতে পারে চট্টগ্রাম, কলকাতা, বরানগর থেকে বেনারস, লক্ষ্মৌ— সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে সশস্ত্র সংগ্রামীরা। ৯ই আগস্ট ১৯২৫ উত্তরপ্রদেশের কাকোরিতে ট্রেন ডাকাতি করেছিলেন বিপ্লবীরা। তাঁরা নিয়েছিলেন শুধু সরকারি কোষাগারের টাকা। ট্রেনের কোনও যাত্রী, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান গার্ড—কারোকে আঘাত করেননি বিপ্লবীরা। বৃষ্টির সেই রাতে একটি বস্তায় টাকা ভরে তাঁরা লক্ষ্মৌ থেকে সাহাজাহানপুরগামী ট্রেনটি ছেড়ে চলে গেছিলেন তাঁরা।

কাকোরি ট্রেন ডাকাতির সময় উত্তরপ্রদেশেই ছিলেন সূর্য সেন। তিনি বিপ্লবীদের সেই পরিকল্পনার অংশ ছিলেন। ১৯২৫-এর ২৬শে সেপ্টেম্বর দেশজুড়ে ধরপাকড় শুরু হলে মাস্টারদা চলে আসেন কলকাতায়। পরে আবার ফিরে যান উত্তরপ্রদেশে জেল ভেঙে সহযোদ্ধাদের মুক্তির পরিকল্পনা সফল করতে। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। আর একটি ঘটনা ছিল চমকপ্রদ। কাকোরি ট্রেন ডাকাতির মামলার শুনানির সময় আদালতে নিয়মিত হাজির থাকতে দেখা যায় এক শিখ যুবককে— তিনি ভগৎ সিং। অভিযুক্তদের অন্যতম যোগেশ চ্যাটার্জি তাঁকে চিনতেন। তিনি ভগৎ সিংকে বন্দীদের আদালতে আনার রাস্তার ধারে, শুনানির সময় আদালতে একদম সামনের সারিতে বসে থাকতে দেখেন দিনের পর দিন।

সেই ঘটনায় যাঁদের ফাঁসি হয়েছিল তাঁদের তিনজনের বাড়ি ছিল উত্তরদ্রদেশে। তাঁরা রামপ্রসাদ বিসমিল, আশফাকউল্লা খান এবং ঠাকুর রোশন সিং। একজন ছিলেন বাংলার, জন্ম তাঁর আজকের বাংলাদেশের পাবনায়— তিনি রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ী। এই মানুষটি বিস্ময়কর ছিলেন। গীতা পাঠ করতেন। কিন্তু গোরু, শূকরের মাংস খেতেন। কোনও কুসংস্কার মানতেন না। পৈতে ধারণ করতেন না। দক্ষিণেশ্বর বোমার মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তার আগেই তিনি কাকোরি ট্রেন ডাকাতিতে অংশ নিয়েছিলেন। আর দক্ষিণেশ্বর বোমার মামলায় তিন বছরের মেয়াদে সেই সময় জেলে ছিলেন বলেই উত্তরপ্রদেশের পুলিশ তাঁর হদিশ পেয়েছিল। তাঁর ফাঁসি হয়েছিল সবার আগে— ১৯২৭-এর ১৭ই ডিসেম্বর।

কাকোরি ট্রেন ডাকাতির ঘটনায় যে পাঁচ জনের আন্দামানে দ্বীপান্তরের সাজা হয়েছিল তাঁদের চার জন উত্তরপ্রদেশের, একজন বাংলার। কিন্তু গোবিন্দচন্দ্র কর, মুকুন্দিলাল গুপ্ত, যোগেশ চ্যাটার্জি, শচীন বক্সি এবং শচীন্দ্রনাথ সান্যাল— প্রত্যেকে ছিলেন বাংলাভাষী। দশ থেকে চোদ্দ বছর সশ্রম কারাদন্ড হয়েছিল পাঁচ জনের। চারজন ছিলেন উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা, একজন ছিলেন মধ্যপ্রদেশের। চার এবং পাঁচ বছর যাঁদের কারাদন্ড হয়েছিল সেই ছয়জনের মধ্যে পাঁচ জন ছিলেন উত্তরপ্রদেশের, একজন মধ্যপ্রদেশের। বেইমানদের কথা বাকি থাকে কেন? রাজসাক্ষী হয়েছিলেন দু'জন—একজন বাংলার, একজন উত্তরপ্রদেশের।

শেষ করবো দুটি প্রসঙ্গ তুলে ধরার চেষ্টা করে। প্রথমত, আশফাকউল্লা খানের সঙ্গে তসাদ্দক হোসেনের কথোপকথন। দ্বিতীয়ত, রামপ্রসাদ বিসমিলের শেষ চিঠি।  

তসাদ্দক হোসেন ছিলেন সিআইডি-র ডেপুটি সুপার। তাকে পাঠানো হয়েছিল জেলে, আসফাকউল্লা খানের সামনে। এক মুসলমান আর এক মুসলমানকে ভাঙতে পারবে—এই ছিল চক্রান্ত।

তসাদ্দক হোসেন আশফাকউল্লাকে বললেন,'আপনি একজন মুসলমান। আমিও সেই একই ধর্মের মানুষ। হিন্দুদের সঙ্গে বিপ্লবের কাজে নেমে কেন আপনার অমূল্য জীবন নষ্ট করবেন। রামপ্রসাদ তো হিন্দু। তার উদ্দেশ্য ব্রিটিশরাজ উৎখাত করে তার বদলে হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠা করা।''

আশফাকউল্লা জবাব দিয়েছিলেন। আর তা ভারতের ভিত্তি। ২২ বছরের সেই যুবক বলেছিলেন,''আপনার শুভেচ্ছার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমার সঙ্কল্প বদলাবে না। আমার কাছে রামপ্রসাদ শুধু একজন হিন্দু নন। তিনি হিন্দুস্তানের অধিবাসী। তাঁর লক্ষ্য হিন্দুদের স্বাধীনতা নয়, সমগ্র হিন্দুস্তানের স্বাধীনতা। আমার লক্ষ্যও তাই।''

এবার রামপ্রসাদ বিসমিলের শেষ চিঠি। ১৯২৭-এর ১৬ই ডিসেম্বর লেখা তাঁর দীর্ঘ চিঠিতে তিনি লেখেন,''সরকার বলেছে আশফাকুল্লাহ খান রামপ্রসাদের ডান হাত। যদি আশফাকের মতো একজন নিবেদিত মুসলিম রামপ্রসাদের মতো একজন আর্য সমাজীর ডান হাত হতে পারে, তবে কেন অন্য হিন্দু এবং মুসলিমরা তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে না? আশফাকই প্রথম এমন মুসলিম, যাকে বাংলার বিপ্লবী দলের সাথে জড়িত থাকার জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। ঈশ্বর আমার প্রার্থনা শুনেছেন। আমার কাজ শেষ হয়েছে। একজন মুসলিম যুবককে আত্মত্যাগের জন্য পেয়ে আমি হিন্দুস্তানকে দেখিয়ে দিয়েছি যে মুসলিম যুবকরাও হিন্দু যুবকদের চেয়েও বেশি উদ্দীপনার সাথে দেশের জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করতে পারে এবং সে সমস্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। এখন আর কেউ সাহস করে বলতে পারবে না যে মুসলিমদের বিশ্বাস করা উচিত নয়। এটি প্রথম পরীক্ষা ছিল যা সফল হয়েছে।''

সঙ্ঘ সেদিনও হেরেছিল। আবার।

মঙ্গলবার, ৫ আগস্ট, ২০২৫

বনলতা সেন হিন্দি অনুবাদ ~ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য

বনলতিয়া সেইন 
(কবিবর চুস্তজিন্দগি দাসসাহিব কী মূল কাভ্য পর আধারিত)


হাজারো সাল সে মৈ 
চলতা গয়া চলতা গয়া চলতা গয়া 
শ্রীলংকা সে মালয় হো'কর 
অশোকজি ঔর বিম্বিসারজিকা কুটিয়া তক 
উধার ভি থা মৈ, ইধার ভি থা, 
বিদর্ভ কা চুনাওঁ মে ভি থা
থকে হুয়ে হৈ দুখি আত্মা 
তাকত হো গয়া ড্রেন 
আজ মেরে দিল মে শান্তি জগায়ী 
নাট্টৌরবালী বনলতিয়া সেন

উসকি বাল হৈ কামাল 
আন্ধেরা ভিদিশাকে চাল 
সুরতমে শ্রাবস্তি নকশা কৈসা হৈ কামাল 
দূর কোই সমন্দরকা 
নৈয়া আকেলা এক লড়কা 
আইল্যান্ড যাকে দালচিনি খাকে 
দেখে সমন্দরি ফেন 
বৈসি প্রীত মেরে দিল মে জগা লি 
ঘোসলে জৈসা আঁখোবালি 
নাট্টৌরবালী বনলতিয়া সেন।

কোহরা জৈসা শাম গিরে যব 
আয়ে আন্ধেরা রাজ 
পংখ্ সে  পোঁছে ধুপ কি খুশবু 
খুন কা প্যাসা বাজ 
মিটাকে সব নীলা পিলা 
আপনা হিসাবকা খাতা খোলা
ঘোসলে পে সব পঞ্ছি লৌটা
সমন্দর মে সরিতা মিটা
হাত মে রহতা আন্ধার, মিটা 
জীবনকা লেনদেন
তব হাথোঁ মে হাথ রহতি হৈ সাথ
নাট্টৌরবালি বনলতিয়া সেন

বাংলা নাকি বাংলাদেশী ভাষা ~ পবিত্র সরকার

দিল্লি পুলিশ আর অমিত মালব্যের কথাবার্তার ব্যাখ্যা আর ভিত্তি নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞ মাঠে নেমে পড়েছেন। তাতে ছবিটা একটু গুলিয়ে যাচ্ছে। কাজেই আমি আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধিমতো 'ভাষা' সম্বন্ধে ধারণা একটু পরিষ্কার করে দিই, সকলকে অভিবাদন জানিয়ে। এ কথা আমি ছাপার অক্ষরে বিশ-পঁচিশ বছর আগে থেকে লিখছি, আমার 'ভাষাপ্রেম ভাষাবিরোধ', বা 'ভাষা, ব্যাকরণের বাইরে' দেখলেই সেটা মালুম হবে। হযতো বাংলায় লেখা বলে সেগুলি বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের চোখে পড়ে না। যাঁদের পড়ে না, তাঁরা আমাকে বলবেন, ইংরেজি বা অন্য ভাষায় তাঁরা ভাষা সম্বন্ধে এই ধারণাটা পেয়েছেন কি না।

আসল কথা হল ভাষা, বিশেষত বড়সড়ো লিখিত ভাষা একটা অ্যাবস্ট্র্যাক্ট বা অবস্তুক ধারণা। তা কখনোই একটিমাত্র, সংহত, একরূপী (ইউনিফর্ম), অবিমিশ্র, ভূগোলে একস্থানবদ্ধ বস্তু নয়। বাস্তবে তার অনেক ধরনের রূপ আছে।

এক ধরনের রূপ হল স্থানিক। তাকে স্থানীয় উপভাষা বা রিজিয়োনাল ডায়ালেক্ট বলে। বাংলা পাঠ্যবইয়ে তার চারটে বা পাঁচটা রূপ বলেছেন পণ্ডিতেরা। কিন্তু তা বিপুল সরলীকরণ মাত্র। আসলে সেগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে আরও অজস্র উপভাষা, যেগুলোর সীমানানির্ধারণ করা খুব কঠিন। রাঢ়ীর মধ্যে আছে রাঢ় অঞ্চলের নানা জেলার উপভাষা। কিন্তু একটা জেলার উপভাষাই কি এক ? তাও তো নয়। মেদিনীপুরেই ঝাড়গ্রাম অঞ্চলে এক, ঘাটাল অঞ্চলে এক, কাঁথি দিঘা অঞ্চলে এক, আবার উত্তরাংশে এক। নিশ্চয়ই আরও আছে। এই রকম বর্ধমানে, নদীয়ায়, মুর্শিদাবাদে, অখণ্ড চ্ব্বিশ পরগনায়। নদীয়ায়। অর্থাৎ জেলার উপভাষাও একটা সরলীকরণ।

তারপর তারই মধ্যে আবার নানা স্তর তৈরি করে নারী, পুরুষ, জীবিকা, ধর্ম ইত্যাদির মাত্রা। নদীয়ার ভাষাকে আমরা মান্য বাংলার কাছাকাছি মনে করি, কিন্তু নদীয়ার কোনও কোনও অঞ্চলে আমি জিগাশলুম, (জিজ্ঞেস করলাম) ইত্যাদি শুনি, তা মোটেই মান্য নয়। এইভাবে লিঙ্গ, জীবিকা, ধর্ম ইত্যাদি ভাষার স্থানিক ছাড়া যে আর-একরকম বৈচিত্র্য নির্মাণ করে তাকে বলি শ্রেণিভাষা, ইংরেজি সোশিয়োলেক্ট। তাতে নানা বানানো বৈচিত্র্যও থাকে, যেমন নারীদের, বা ব্যবসায়ীদের গোপন ভাষা, দুই দূরবর্তী ভাষার লোকের আদান-প্রদানে তৈরি পিজিন (pidgin) ভাষা, বা তার খানিকটা স্থায়ী রূপ ক্রেয়োল (creole) ইত্যাদি। পিজিন আর ক্রেয়োলে তফাত হল, পিজিন যেখানে শুধু বাইরের ভাষা থেকে যায়, সেখানে ক্রেয়োল ঘরের ভাষা হয়ে যায়।  

এই সমস্থ স্থানিক, সামাজিক আর গোষ্ঠীগত ভাষারূপের ওপর গড়ে ওঠে একটা মান্য ভাষারূপ, যাকে বলা হয় মান্য বা স্ট্যান্ডার্ড বা প্রমিত ডায়ালেক্ট। সেটাও ডায়ালেক্ট, কিন্তু সেটা একটা সুপার ডায়ালেক্ট। কারণ তার ব্যবহারের ব্যাপ্তি যেমন সবচেয়ে বেশি, তার মর্যাদাও সবচেয়ে বেশি। কেন ? কারণ সেটা নানা উপভাষা অঞ্চলের লোকেরা পরস্পরের সঙ্গে কথা বলার সময় ব্যবহার করতে বাধ্য হয়, যদি নিজেদের উপভাষা অন্যে বুঝতে না পারে। এর মুখে ব্যবহার হয় রাজধানীতে (বেশিরভাগ সময়ে রাজধানীতে তৈরিও হয় এটা), ক্লাসঘরে, লেখাপড়ার জগতে, রেডিয়ো-টেলিভিশনের সম্প্রচারে, ওখানে আর বাইরে নানা বক্তৃতায়--তাই যেমন এর মর্যাদা অন্য বৈচিত্র্যের তুলনায় হু হু করে বেড়ে যায়, আবার লেখা আর ছাপায় এর ব্যবহার এর মর্যাদাকে আরও জ্যামিতিক হারে বাড়িয়ে দেয়। সরকারও প্রশাসনিক কাজে এ ভাষা ব্যবহার করতে থাকে, তাই এটা কখনও সরকারি ভাষাও হয়ে ওঠে।

এভাবে এর সম্মান এত বেড়ে যায় যে, এটাই পুরো ভাষাটার পরিচয় দখল করে নেয়, অন্য বৈচিত্র্যগুলোকে আড়াল করে। সেগুলোও কিন্তু ভাষা, বাংলার হলে বাংলা ভাষারই অংশ। সিলেটের বাংলাও বাংলা, পুরুলিয়ার বাংলাও বাংলা, চট্টগ্রামের বাংলাও বাংলা। বৈধ বাংলা। যদি না, রাজনৈতিক বা অন্য কোনও কারণে, ব্যবহারকারীরা তাকে অন্য ভাষা বলে দাবি করে। সেটার ভিত্তি অন্য। এই ভাবে বাংলার আগেকার কামরূপী উপভাষা (অসমিয়ার গোয়ালপাড়িয়া উপভাষাও খানিকটা) এখন সরকারি স্বীকৃতি পেয়ে 'রাজবংশী' ভাষা হয়েছে।

যাই হোক, এই সব ছুটকো উদাহরণ ছাড়া. এখনও সবই বা়ংলা। কাজেই বাংলাভাষা, সব ভাষার মতোই একটা ভাষাবৈচিত্র্যের গুচ্ছ মাত্র, একটা অখণ্ড, শিলীভূত ভাষা নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মান্য বা প্রমিত বাংলাই বাংলা, এই সমীকরণের মূলে আছে ওই ভাষারূপটির ব্যাপক ব্যবহার আর মর্যাদা। বিদেশিরা যখন 'আমি বাংলা শিখছি' বলে তারা ওই মান্য বাংলাই বোঝায়, ইশ্কুল কলেজের বাংলা পাঠ্যক্রমও মূলত মান্য বাংলার।  

এই মান্য বাংলাই দুই বাংলায়, ত্রিপুরায়, আসামে আচারিক বা ফর্ম্যাল উপলক্ষ্যে চলে, এমনকি পৃথিবীর নানা জায়গায়, ইংল্যান্ডে, মার্কিনদেশে, অস্ট্রেলিয়ায়, জাপানে--নানা অঞ্চলের বাঙালিরা একত্র হলে এই বাংলায় কথা বলে। কিন্তু সব জায়গার মান্য বাংলা কি হুবহু এক ? একেবারেই না, তা হওয়ার কথাই নয়। ব্যাকরণ মূলত এক, কিন্তু প্রচুর স্থানীয় শব্দ ও পদবন্ধ তাকে কিছুটা 'আঞ্চলিক' করে তোলে। কিন্তু তার 'মান্য' চেহারাটি অস্পষ্ট হয় না। 'প্রমিত' উচ্চারণও একটা আছে। সেটা সবাই মোটামুটি মেনে চলার চেষ্টা করে, টানটোনের তফাত হলেও। এই লেখক জানে যে, বাংলাদেশে প্রমিত উচ্চারণ নিয়ে বেশ মাথাব্যথা আছে। ঢাকায় প্রচুর প্রমিত উচ্চারণের কর্মশালা ও ক্লাস হয়।  

লেখা বড় হচ্ছে, আমি সাধারণত এত বড় লিখি না। শেষে যোগ করি যে, ভাষাবিজ্ঞানে সব ভাষা আর উপভাষাকে বৈধ আর সমমর্যাদাসম্পন্ন বলে বলা হয়। তা নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করা এক ধরনের অসৌজন্য। অবশ্যই বাস্তব জীবনে সামাজিক ক্ষেত্রে তা বার বার লঙ্ঘিত হয়, কারণ মানুষের ব্যবহার বিজ্ঞানের নির্দেশ মেনে চলে না।

এখন দিল্লির পুলিশের কর্তা বা মালব্যবাবুর এত সব কথা জানবার কথা নয়। তাঁরা তাঁদের অজ্ঞতা বা কূটনীতি নিয়ে খুশি থাকতেই পারেন। 'বাংলা' কোনও ভাষাই নয়' এই কথাটা তিনি কী অর্থে বলেছেন জানি না, কিন্তু বলে তিনি তাঁর দলের উপকার করেছেন তা বলা যাবে না। জানি না, রাজনীতিতে একটু উঁকি দিয়ে বলি, এরও পেছনে কোনও 'সেটিং' আছে কি না। যাই হোক, তিনি ভারতের সংবিধান যদি পড়ে থাকেন তা হলে দেখবেন তার অষ্টম তফশিলে 'বাংলা' ভাষার একটি স্বীকৃতি আছে, নানা অভিধানেও 'বাংলা' কথাটির অর্থ দেখতে পারেন। কিন্তু তাঁকে শিক্ষিত করা আমার কাজ বা জীবন-সাধনা নয়। বাংলা ভাষা বলতে কী বোঝায় তাই আমি একটু বন্ধুদের জানানোর চেষ্টা করলাম। ভুল বা অসম্পূর্ণতা থাকলে নিশ্চয় কেউ আমাকে দেখিয়ে দেবেন।

বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই, ২০২৫

প্রশাসন ও স্বাস্থ্য ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

ওপরওয়ালারা মাঝেমধ্যেই বলেন, মানে উপদেশ দেন, "ঘরে বসে প্রশাসন চালাবেন না, বাইরে যান, নজরদারি চালান, লোকজনের সাথে কথাবার্তা বলুন, তাদের জানা বোঝার চেষ্টা করুন।" বিশ্বাস করুন চেষ্টা করি। এসির ঠান্ডা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে বোঝার চেষ্টা করি। "দুয়ারে প্রশাসন"। তারই এক ঝলক রইল সুধী পাঠকদের জন্য। 

সরকারি হাসপাতালের একটা টিপিক্যাল দিন। একটা বেঞ্চে ধরুন পাশাপাশি বসে আছে ওরা। পেশেন্ট নম্বর এক। মহিলা মাঝবয়সী, মাছের বাজারে প্রতি সপ্তাহেই এঁকে দেখতে পান  আপনি। সামান্য পয়সার বিনিময়ে আপনার মাছগুলো কেটে কুটে দেন। সেটাই পেশা। মাছ কাটতে গিয়ে হাত কেটে ফেলে ফিনকি দিয়ে রক্ত। জল দিয়ে ধোয়ার পরে রুমাল বের করে বেঁধে দিলেন। মাছের বাজারে ফার্স্ট এইড আর কি বা হবে। হাসপাতালে যেতে বললেন। সেলাই লাগবে। মহিলার দু চোখ দিয়ে অঝোরে জলের ধারা। কেন মাসি কাঁদছো কেন। খুব ব্যথা ? ব্যাথা নয় বাবু। সেলাই মানেই তো সাত দিন কাজ বন্ধ। রোজগার বন্ধ। খাবো কি ?

পেশেন্ট নম্বর দুই। বছর দশেক এর একটি বালিকা। বেআইনি বাজি কারখানায় ততোধিক বেআইনি বাজি বানাতে গিয়ে মুখের ওপরেই ফেটেছে। চোখ মুখ আগুনে ঝলসে গেছে। পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে। চোখটা বোধ হয় বাঁচবে না। সঙ্গে আসা স্বামী পরিত্যক্ত মায়ের আরো বড় চিন্তা, পরিবারে রোজগারের একটা লোক কমে গেল।

বেঞ্চে বসে থাকা তিন নম্বর। সতেরো আঠেরো বছরের কিশোর। গ্যারেজে কাজ করে, আপনার গাড়িটা এর হাতেই ঠিক হয়। হেড মিস্ত্রির হেল্পার। কালি ঝুলি মাখা কিশোরটিকে সেই নিয়ে এসেছে। গাড়ির তলায় শুয়ে কাজ করছিল। জ্যাক উল্টে গিয়ে গোটা গাড়িটা তার সমস্ত ওজন নিয়ে পায়ের ওপরে পড়েছে। দুটো পা'ই বিশ্রী রকম থেঁতলে গেছে। একটা পা সম্ভবতঃ এমপুট করতে হবে। হেড মিস্ত্রির আকুল জিজ্ঞাসা, পা টা কোনভাবেই বাঁচানো যাবে না ডাক্তারবাবু ? পা চলে যাওয়া মানে তো বেকার হয়ে যাবে আবার।

পেশেন্ট নম্বর চার। চব্বিশ পঁচিশ এর যুবক। এ কাঁদছে না। ক্লান্ত দেহটা নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। জন্ডিস হয়েছে, আমাদের ভাষায় ইনফেক্টিভ হেপাটাইটিস। অন্ততঃ একমাস বিশ্রাম নিতে হবে এই পরার্মশ শুনে একটু বাদেই ছেলেটার মুখ থমথমে হয়ে যাবে। কেনরে ছেলে ?  বিএ পরীক্ষা দেব ডাক্তারবাবু। অভাবের সংসারে একটা সাইকেল নিয়ে সকাল বেলায় খবরের কাগজ বিলি করে আপনার ফ্ল্যাটে। বিশ্রাম মানে কাজটাই চলে যাবে। শুধু রোজগার না। পড়বো কি করে ? 

বেঞ্চের পাঁচ নম্বর ব্যক্তি মাঝবয়সী লোক। চিন্তা ভাবনায় বয়সের থেকে বেশি বুড়ো লাগছে। টিবি রোগ ধরা পরতে শপিং মলের সেলস ক্লার্ক এর চাকরিটা গেছে। দুদিন আগে এই মানুষটাই আপনার ক্রেডিট কার্ড ঘষে টাকা নিয়েছিল। দু মাস তো ওষুধ খেলাম ডাক্তারবাবু।  আমার অসুখটা কি এখনো ছোঁয়াচে ? একবারটি লিখে দেবেন আমি সেরে গেছি। যদি চাকরিটা আবার ফিরে পাই ?

হাসপাতালের আউটডোর/এমার্জেন্সির বেঞ্চে বসা কয়েকটা লোক। মানুষ। পেশেন্ট আমাদের কাছে। আসলে এক টুকরো ভারতবর্ষ। ডাক্তারের অপেক্ষায় আছে। কখন সেই ধন্বন্তরীর দেখা পাওয়া যাবে। যিনি দেখা দিলেই সব ভালো হয়ে যাবে। ঠিক হয়ে যাবে। 

অপেক্ষমান এই মানুষগুলোর সামনে আমি, ক্ষুদে প্রশাসক, রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষুদে প্রতিভূ। মানুষগুলোর একটাই জিজ্ঞাসা। সব ঠিক হয়ে যাবে তো ? প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় কাটা হাত, পোড়া মুখ, ভাঙা পা, বেড়ে যাওয়া লিভার, ফোপরা ফুসফুস নিয়ে ওরা বসে আছে পাশাপাশি। আমার আপনার সহনাগরিক। ক্ষুদে একটা পশ্চিমবঙ্গ, ক্ষুদে একটা ভারতবর্ষ। ওরা বসে আছে কাছাকাছি ঘেঁষাঘেষি করে। অপেক্ষায় আছে। প্রশাসনের কাছ থেকে, সরকারের কাছ থেকে, রাষ্ট্রের কাছ থেকে সদুত্তর এর আশায়। ওরা বসে আছে পরম ধৈর্য নিয়ে, সহিষ্ণুতা নিয়ে, অনেক আশা নিয়ে, সমস্যার সমাধানের অপেক্ষায়, আচ্ছে  দিন এর অপেক্ষায়। ওদের দুয়ারে প্রশাসন, দুয়ারে সরকার, দুয়ারে রাষ্ট্র সবকা সাথ সবকা বিকাশ পারবে দিতে সমাধান?

শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

হরিয়ানা ও একটি মেয়ে ~ সমীক মুখোপাধ্যায়

আপনি সুপ্রতিষ্ঠিত। সারাজীবন অনেক রোজগার করেছেন। রোজগারের টাকায় একগুচ্ছ প্রপার্টি কিনেছেন। সেই সমস্ত প্রপার্টি থেকে এখন আপনার মাস গেলে সতেরো লাখ টাকা ইনকাম হয়। ঘরে বসে। 

আপনার মেয়েকে টেনিস খেলতে প্রথম উৎসাহ দিয়েছিলেন আপনিই। সেই মেয়ের প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে সমস্ত প্রতিযোগিতায় নিয়ে যাওয়া, সবকিছুতে আপনিই ছিলেন তার প্রথম অনুপ্রেরণা। নিজের চাকরি ছেড়ে দেন মেয়ের ট্রেনিংয়ের জন্য সময় বের করতে। দু লাখ টাকা দিয়ে দামি র‌্যাকেট কিনে আনেন মেয়ের জন্য। 

আপনার প্রশ্রয়ে আর নিজের পরিশ্রমে মেয়ে ধীরে ধীরে স্টেট লেভেল চ্যাম্পিয়ন হয়। মাত্র চব্বিশ বছর বয়েসের মধ্যেই সাতান্নটি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরের টেনিস টুর্নামেন্টে খেলে আঠেরোটি সোনার মেডেল নিয়ে আসে সে। 

মেয়েটি একটি টেনিস অ্যাকাডেমি খোলে। যে উৎসাহ, অনুপ্রেরণা সে আপনার কাছ থেকে পেয়ে এতদূর অবধি এসেছে, সে চায় সেই অনুপ্রেরণা ছড়িয়ে পড়ুক নতুন প্রজন্মের মাধ্যেও। 

আপনি দুধ আনতে যান পাড়ার দোকানে। সেখানে আপনার পাড়াপ্রতিবেশিরা আপনাকে টন্ট করে, কী তাউজি, লউন্ডির কামানো পয়সায় খাচ্ছো পরছো? 

আপনি জানেন, ওরা সত্যি বলছে না। আপনার জীবনধারণের জন্য আপনার মেয়ের টেনিস অ্যাকাডেমি থেকে রোজগার করা টাকার ওপর নির্ভর করতে হয় না। আপনিও জানেন, তারাও জানে। সম্ভবত ওরা আপনার পেছনে লাগে। এমনিই। 

আপনার খারাপ লাগে। রাগ হয়। হরিয়ানভি রক্ত টগবগিয়ে ফোটে। একটা জুৎসই জবাব দিতে মন চায়। 

আপনি কী করবেন? প্রতিবেশিদের সাথে তুমুল ঝগড়া করবেন? তাদের মুখ দেখা বন্ধ করে দেবেন? 

তা কী করে হয়? টাকায় কারুর নাম লেখা থাকে না। আপনার মাসিক আয় সতেরো লাখ টাকার সাথে ঐ মেয়ের রোজগার করা এক দেড় লাখ টাকাও তো মিশছে। যে রুটি আপনি খাচ্ছেন, সেই রুটির আটার দু এক দানায় যে ঐ মেয়ের কামানো টাকার ভাগ নেই, তা কি আপনি বলতে পারেন? 

মেয়ের পয়সায় খাওয়া? লজ্জায় মরে যাওয়া উচিত! 

কিন্তু নিজের মরে যাওয়া তো অতটা সহজ নয়। হরিয়ানাতে খুব সহজ নিজের মেয়েকে মেরে ফেলা। 

মেয়ে সফল টেনিস খেলোয়াড়, টেনিস অ্যাকাডেমি নিয়ে মেতে থাকলেও ঘরের কাজ সে উপেক্ষা করে নি। সে যে মেয়ে, মেয়েদের ঘরের কাজ তো করতেই হয়। 

আপনার চব্বিশ বছরের মেয়ে তখন রান্নাঘরে আপনারই জন্য ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছিল, যখন আপনি রান্নাঘরে ঢোকেন আপনার লাইসেন্সড পিস্তল নিয়ে।


মঙ্গলবার, ১ জুলাই, ২০২৫

বিধান রায় ও পথের পাঁচালী ~ কৌশিক মজুমদার

পয়লা জুলাই এলেই বিধান রায়ের জন্মদিনের সঙ্গে সঙ্গে আলোচনায় ফিরে আসেন সত্যজিৎ রায়-ও। আর আসবেন না-ই বা কেন? এখন তো প্রায় সবাই জেনে গেছি সত্যজিৎ রায়ের প্রথম সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পিছনে ভূমিকা ছিল তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়েরও। সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে বারবার উঠে এসেছে সেই আলোচনা। পত্র পত্রিকায়, প্রবন্ধে এমনকি বিখ্যাত কিছু মানুষের লেখাতেও যে সব তথ্য এই বিষয়ে উঠে আসে, তাদের সারসংক্ষেপ এই রকম -



১। বিধান রায় সংস্কৃতির ধার ধারতেন না। তাঁর কোন আইডিয়াই ছিল না সত্যজিৎ কী বানাতে যাচ্ছেন, বা বানিয়েছেন। এই ধারণার পিছনে আছেন দুইজন নামকরা সত্যজিৎ জীবনীকার। মারি সেটন লিখছেন, বিধান রায় নাকি ছিলেন "a man with no pronounced love of art and no knowledge of film as an expressive medium." অ্যান্ড্রু রবিনসন এককাঠি এগিয়ে বিধান রায় সম্পর্কে তাঁর বিখ্যাত বই 'ইনার আই'তে লিখেছেন "from the beginning, misunderstood the film's nature, seeing it as a documentary."

২। সিনেমার টাকা দেওয়া হয়েছিল পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের টাকা থেকে, কারণ সরকার নাকি সিনেমার নাম দেখে ভেবেছিলেন এটা রাস্তা বানানোর ডকুমেন্টরি ধরনের কিছু হবে।

৩। বিধান রায়ের ছবির শেষের করুণ পরিণতি অপছন্দ হওয়াতে তিনি সেটা বদলে দিতে বলেন। শুধু তাই না, দুর্গাকে নাকি বাঁচিয়েও দিতে বলেছিলেন। সত্যজিৎ নিজের গোঁ ধরে রাখেন। বাকিটা ইতিহাস।

৪। সরকার সত্যজিতকে পরিচালনা বাবদ কোনো টাকা দেয়নি। শুধু বানানোর অন্য খরচা দিয়েছিল।

৫। সরকারি আধিকারিকরা নাকি বারবার বলেছিলেন এ-ছবির প্রযোজনা না করতে। কিন্তু সত্যজিতের অসামান্য প্রতিভার পরিচয় পেয়ে ডাক্তার রায় তাঁদের কথা নস্যাৎ করে দেন।

সব কটা ভুল কথা।

নানা তথ্য এবং সত্যজিতের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ইত্যাদি খুঁটিয়ে পড়লেই আসল সত্য উঠে আসে। সত্যজিৎ বিশেষজ্ঞ ছন্দক সেনগুপ্ত মহাশয়ও একবার এই নিয়ে লিখেছিলেন, কিন্তু এই মিথ এত জবরদস্ত, যে সেই জগদ্দলকে ঠেলে ফেলা মুশকিল।

একে একে আসি।

১। সত্যজিৎ রায়ের ছবি করা উচিৎ কি উচিৎ না এই নিয়ে বিধান রায়-কে যারা উপদেশ দেন, তাঁদের মধ্যে যে পি এস মাথুর ছিলেন (যিনি বারবার বলেছিলেন এই ছবি না করতে) তেমন ছিলেন মন্মথ রায়। এই মন্মথ রায় কালের কালবৈশাখীতে চাপা পড়ে গেছেন, কিন্তু তিনি না থাকলে পথের পাঁচালী আদৌ আলোর মুখ দেখত কিনা সন্দেহ। এই ভদ্রলোক ছিলেন বিখ্যাত নাট্যকার, সিগনেটের সত্যজিতের প্রচ্ছদের ভক্ত, আর বিভূতিভূষণের একনিষ্ঠ পাঠক। সিনেমার রাফ কাট দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান। সিনেমা বা চিত্রনাট্য তিনি খুব একটা বুঝতেন না, তবুও তাঁর রিপোর্টে তিনি পরিষ্কার লেখেন "বিভূতিভূষণের উপন্যাসের প্রকৃতি যেন ছবিতে অবিকল রূপ পেয়েছে। আমি অভিভূত। আমার দেখে মনে হল এক মহান পরিচালক যেন তাঁর জীবনের সেরা মাস্টারপিসটি বানাতে চলেছেন।" মনে রাখতে হবে, এটা তিনি যখন লিখছেন তখন ছবির গোটাটা বানানোই হয়নি। সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক তো দূরের কথা। কিন্তু মাথুরের রিপোর্ট ছিল এর ঠিক বিপরীতে। ফলে বল চলে আসে সরাসরি বিধান রায়ের কোর্টে যার কিনা "সিনেমা নিয়ে কোনো ধারণাই ছিল না!"

বিধান রায় আর পঙ্কজ মল্লিক মিলে ছবির রাফ কাট দেখলেন। হ্যাঁ, বিধান রায় নিজে রাফ কাট দেখেছিলেন। পঙ্কজ মল্লিক পরে স্বীকার করেন তিনি নিজেও ছবি নিয়ে খুব আশাবাদী ছিলেন না। কিন্তু এই রাফকাট দেখেই বিধানবাবু উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, বোঝেন এই ছবির মেরিট আছে আর সরসরি মন্মথবাবুর উপদেশটাই মেনে নেন। রবিনসনের কথা তাই কতটা ভুল ভেবে দেখুন।

২। এবার ছবির টাকার কথা। ছবির টাকা আদৌ পি ডব্লু ডি থেকে আসেনি। এসেছিল লোকরঞ্জন শাখা থেকে। সত্যজিৎ নিজে ফোক ইসাকসনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন এ-কথা। 'মাই ইয়ারস উইথ অপু'-তে সত্যজিৎ জানাচ্ছেন তাঁর মায়ের বন্ধু বেলা সেন আর তাঁর মেয়ে অর্চনার সঙ্গে তিনি যখন বিধান রায়ের সঙ্গে দেখা করতে যান, বিধান রায় বলেন শেষটা একটু করুণ হয়ে যাচ্ছে না? তখন সত্যজিতের আগেই অর্চনা প্রতিবাদ জানিয়ে বলে "The ending is too well-known and very moving. There would be objections from the readers of the novel as well as from [the author's] family if the ending was changed in any way." ফলে আলোচনা সেখানেই শেষ। সত্যজিতের গোঁ ধরার প্রয়োজনই হয়নি।

৩। সিনেমার বাজেট ছিল ৭০০০০ টাকা, আর যে-কোনো সরকারি প্রজেক্টের মতো এটাতেও পরিচালকের টাকা ধরা ছিল, যেটা সেদিনের হিসেবে নেহাত কম না। ৩০০০ টাকা। ইসাকসনকেও সত্যজিৎ বলেছেন "since I was taking a very small salary", ফলে এই সিনেমায় সত্যজিতকে বিধান রায় এবং তাঁর সরকার একেবারে কিচ্ছু দেননি, এটাও ভুল কথা। যেটা সত্যজিৎ চেয়েও পাননি, সেটা হল ফরেন রাইট। আর সেখানে তাঁকে কিছুটা অন্ধকারে রেখেই সই সাবুদ করানো হয়। বিস্তারিত জানার জন্য ইসাকসনের সাক্ষাৎকারটি পড়ে দেখার অনুরোধ করছি, কিন্তু তাতে ডাক্তার রায়ের কোনো হাত ছিল না। আর, কান উৎসবে ছবিটা দেখানো হলেও সরকার সেখানে সত্যজিৎ-কে পাঠায়নি।

তাহলে এই ডকুমেন্টারির কথা কার মাথায় এল? বিধান রায় তো ভাবেননি। ভাবলেও অর্চনা দেবীর সঙ্গে আলোচনায় তাঁর সন্দেহ দূর হবার কথা। আসলে এই ধারণা হয়েছিল পশ্চিমা কিছু চিত্র সমালোচকের। তাঁর মধ্যে বসলে ক্রোথার-ও ছিলেন। তাঁরা শুরুতে ছবিটা ধরতেই পারেননি। নিজের সমালোচনায় এত বার বাংলার গ্রাম নিয়ে তথ্যচিত্র শব্দবন্ধ লিখে গেছেন যে তাঁদের পরে পশ্চিমা যাঁরাই লিখেছেন এই ধারণা থেকে বেরোতে পারেননি। তাঁদের মনে হয়েছে পশ্চিমের মতো এদেশেও বুঝি এই সিনেমাকে সবাই ডিকুমেন্টারিই ভেবেছিল। আদৌ তা না।

বাংলা সিনেমার ইতিহাসের বাঁক বদলে দিয়েছিল যে সিনেমা, তার সম্পর্কে ভুল ধারণাগুলো দূর করা আজ খুবই জরুরি। আমি নিশ্চিত এই বিকৃত আলোচনায় দুই কিংবদন্তির কেউই খুশি হতেন না

বুধবার, ২৫ জুন, ২০২৫

জরুরি অবস্থায় আরএসএস-এর আত্মসমর্পণ ~ দেবেশ দাস

বিজেপি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২৫শে জুন সংবিধান হত্যা দিবস হিসাবে পালন করা হবে, কারন ১৯৭৫ সালে ওইদিন জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল। জরুরি অবস্থায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির নেতা-কর্মীরা গ্রেফতার হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে আজকের বিজেপির উত্তরসুরী জনসঙ্ঘ নেতারা ছিলেন ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ তথা আরএসএস-এর লোকও ছিলেন। কিন্তু, তার সাথে এটাও সত্যি কথা যে যারা গ্রেফতার হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র আরএসএস ও জনসঙ্ঘ নেতারাই সেদিন ইন্দিরা গান্ধীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। সেই ইতিহাসটা একটু জেনে রাখা দরকার।

জেলে ঢুকেই আরএসএস নেতারা মুক্তির খোঁজে

আরএসএস-এর প্রধান মধুকর দত্তারেয় দেওরস ওরফে বালাসাহেব দেওরস আটক হন ১৯৭৫ সালের ৩০ জুন। তার সাথে গ্রেফতার হওয়া মহারাষ্ট্রের আরএসএস সংগঠক ভি এন ভিদে, গ্রেফতার হওয়ার মাত্র ১৫ দিন বাদে লিখলেন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী ওয়াই বি চ্যবনকে - "সঙ্ঘ এমনকি দূর থেকেও সরকার বা সমাজের বিরুদ্ধে কিছু করেনি। সঙ্ঘের কর্মসূচীতে এ জাতীয় জিনিসের কোনও স্থান নেই। সঙ্ঘ কেবল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হচ্ছে। কিন্তু এসব ভিত্তিহীন হিসাবে প্রমাণিত। ...... আমি আপনাকে আটক সঙ্ঘ কর্মীদের মুক্তি দিতে অনুরোধ করছি।" দেওরসের পরামর্শ নিয়েই ভিদে নিশ্চয়ই এই চিঠি লিখেছেন।

আরএসএস প্রধানের ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠি

ইন্দিরা গান্ধীকে মোট তিনটি চিঠি লিখেছিলেন দেওরস, হিন্দিতে। তিনটি চিঠি নয়দার এক প্রকাশনা সংস্থা জাগৃতি প্রকাশন ছাপিয়েছে ১৯৯৭ সালে। প্রথম চিঠি ১৫ই আগস্ট, ১৯৭৫ তারিখে দিল্লীর লালকেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার পর। দেওরস লিখলেন - "সপ্রেম নমস্কার, ১৫ই আগস্ট তারিখে দিল্লীর লালকেল্লায় রাষ্ট্রকে সম্বোধন করে আপনি যে ভাষণ দিয়েছেন, তা আমি আকাশবাণীতে এই কারগার থেকে মন দিয়ে শুনেছি। আপনার ভাষণ সময়োচিত এবং উপযুক্ত আর এর জন্য এই চিঠি লিখতে আমি প্রবৃত্ত হয়েছি"। লালকেল্লার ভাষণে ইন্দিরা গান্ধী দেশকে গঠন করার নানা কর্মসূচীতে সাহায্য করার জন্য সমাজের সাচ্চা শক্তিগুলিকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। দেওরস চিঠিতে লিখলেন - "১৫ই আগস্টে আপনার ভাষণে এই কাজে সমাজের সাচ্চা শক্তিগুলিকে নিজের নিজের ক্ষেত্র নিয়ে লেগে পড়া চাই বলে আপনি সমস্ত সমাজকে যে ডাক দিয়েছেন তা সময়োচিতই ছিল" । দেশের উত্থানের জন্য ইন্দিরা গান্ধীর এই দেশ গড়ার আহ্বানে সঙ্ঘ যুক্ত হতে চায় সে কথাই লিখলেন দেওরস - "দেশের উত্থানের জন্য সঙ্ঘের এই শক্তিকে যুক্ত করার আয়োজন হওয়া জরুরি"। চিঠি শেষ করেছেন ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করতে চেয়ে - "আপনি চাইলে, আপনার সাথে দেখা করতে আমার আনন্দই হবে"। ভাবুন, যার বিরুদ্ধে সারা দেশ জুড়ে দুই মাস আগেই আন্দোলন, তার সাথেই দেখা করার জন্য আরএসএস প্রধান ব্যাকুল হয়ে পড়েছেন।

না, ইন্দিরা গান্ধী দেখা করতে চাননি, উত্তরও দেননি। অধৈর্য হয়ে উঠলেন দেওরস। কিন্তু কী উপলক্ষ্য করেই বা আবার চিঠি লিখবেন? আবার সুযোগ এসে গেল। একটি সুখবর এলো ইন্দিরা গান্ধীর জন্য। ১৯৭৫ সালের ১২ জুন এলাহাবাদ হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল যে, ১৯৭১ সালে লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর জেতা অবৈধ। ইন্দিরা গান্ধী সুপ্রিম কোর্টে যান। সুপ্রিম কোর্টে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ ৭ নভেম্বর, ১৯৭৫ ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনে জেতাকে বৈধ ঘোষণা করে। এই রায় বেরোনোর মাত্র ৩ দিন পরে ইন্দিরা গান্ধীকে অভিনন্দন জানিয়ে দেওরস চিঠি পাঠালেন ১০ ই নভেম্বর, ১৯৭৫ - "সাদর নমস্কার, উচ্চতম আদালতের পাঁচ বিচারপতি আপনার নির্বাচনকে বৈধ ঘোষণা করেছেন বলে আপনাকে হার্দিক অভিনন্দন"। তিনি লিখলেন - "শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের ---------- আন্দোলনের সাথে সঙ্ঘের কোনও সম্পর্ক নেই"। জয়প্রকাশ নারায়ণ ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে জরুরি অবস্থার আগে থেকেই আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, যেদিন জরুরি অবস্থা জারি হয় সেদিনও জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে দিল্লীতে বিশাল জমায়েত হয়েছিল। তিনি আরও লিখলেন -"আমার আপনার কাছে প্রার্থনা যে আপনি প্রকৃত পরিস্থিতি জানুন...... সঙ্ঘের সম্বন্ধে সঠিক ধারণা বানান ...... সঙ্ঘের কয়েক হাজার লোককে মুক্তি দিন।
 .........এটা করলে সঙ্ঘের লাখ লাখ স্বয়ংসেবকদের নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার শক্তি সরকারী এবং বেসরকারী পথে রাষ্ট্রের উন্নতির জন্য কাজে লাগবে ও আমাদের সকলের ইচ্ছা অনুসারে আপনার দেশ সমৃদ্ধ হবে। পত্রের উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম"।

১৬ই জুলাই, ১৯৭৬ ইন্দিরা গান্ধীকে দেওরসের তৃতীয় চিঠি- "সাদর নমস্কার, আমি আপনাকে আগেই দুটি চিঠি লিখেছি, কিন্তু দুঃখের বিষয় তাদের কোনও প্রাপ্তিস্বীকার বা উত্তর পাইনি। ওই চিঠিগুলিতে আমি আপনি ও অন্যান্য শীর্ষ নেতারা আরএসএস সম্বন্ধে যে অভিযোগগুলি করেছেন তার কিছু ব্যাখ্যা দিয়েছি। অভিযোগগুলির ধরন একই এবং কোনদিন তার স্বপক্ষে কোনও প্রমাণ দেওয়া হয়নি। ...... আমি আপনাকে অনুরোধ করছি যে দয়া করে সঙ্ঘ সম্বন্ধে যে ভুল বোঝাবুঝি বিরাজ করছে তার ঊর্ধ্বে উঠুন, বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করুন ও সঙ্ঘের উপর যে নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়েছে তাকে তুলুন"।


জরুরি অবস্থায় আরএসএস সম্বন্ধে আইবি রিপোর্ট

জরুরি অবস্থার সময়ে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (আইবি) হেড অফিসে ভিআইপিদের নিরাপত্তার দায়িত্বে উচ্চপদে কাজ করতেন বিখ্যাত আইপিএস অফিসার টি ভি রাজেশ্বর, পরে তিনি আইবি-র ডিরেক্টর হয়েছিলেন। শেষ বয়সে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে 'ইন্ডিয়া, দি ক্রুসিয়াল ইয়ারস' নামে একটা বই লিখেছেন, তাতে বিভিন্ন সময়ে আইবি দপ্তরের কিছু গোপন তথ্য আছে। তাতে লিখেছেন- "জরুরি অবস্থার প্রবর্তনে দক্ষিণপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এর প্রধান বাবাসাহেব দেওরস, নীরবে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির সাথে একটি সংযোগ স্থাপন করেছিলেন এবং দেশে নিয়ম ও শৃঙ্খলা প্রয়োগের জন্য গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রতি দৃঢ় সমর্থন প্রকাশ করেছিলেন। ...... আইবি-র একজন সিনিয়র অফিসার আরএসএসের উচ্চস্তরের কিছু লোককে জানতেন এবং দেওরস সহ তাঁদের সাথে কয়েকটি বৈঠক করেছিলেন। দেওরস মিসেস গান্ধী ও সঞ্জয়ের সাথে দেখা করতে আগ্রহী ছিলেন, তবে এটি সম্ভব হয়ে ওঠেনি"।

জরুরি অবস্থাকে কার্যত সমর্থন

ডি আর গোয়াল রচিত 'রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ' বইতে আছে যে বাবাসাহেব দেওরস-এর বক্তব্য ছিল যে আরএসএস-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা না করলে, ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার বিরোধিতা করার প্রশ্নই উঠতো না।

আরএসএস-এর শাখাগুলিতে প্রতি সপ্তাহে একটা বক্তৃতা হয়, যাকে বলে 'বৌদ্ধিক'। আরএসএস-এর এক শীর্ষ নেতা বাবা ভিদে, এই সমস্ত বৌদ্ধিকগুলিতে তিনি জরুরি অবস্থার সমর্থনে বক্তৃতা করতেন। এবিভিপির প্রভু চাওলা, বলবীর পুঞ্জ ও শ্রেরাম খান্না হই হই করে ইন্দিরা গান্ধীর ২০ দফা কর্মসূচীতে নেমে পড়েন, ফলে তাদের আর জেলে ঢুকতে হয় না। আরএসএস-এর একনাথ রামকৃষ্ণ রানাডে একটা সংযোগ গড়ে তুলেছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর সাথে, তাকে বলা হয় ইন্দিরা গান্ধীর সাথে কথাবার্তা চালাতে।

উত্তরপ্রদেশে জনসঙ্ঘ ১৯৭৬ সালের ২৫শে জুন, জরুরি অবস্থার এক বছর পূর্ত্তিতে  ইন্দিরা গান্ধী সরকারকে সম্পূর্ণ সমর্থন করার কথা ঘোষণা করে এবং সরকার বিরোধী কোনও কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করার জন্য আবেদন করে। সেখানেই শেষ নয়, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে ৩৪ জন  জনসঙ্ঘের নেতা কংগ্রেসে যোগ দেন।     

আরএসএস-এ সাথে যুক্ত পুনের একটি মারাঠী দৈনিক 'তরুণ ভারত' সঞ্জয় গান্ধীর নামে একটি বিশেষ সংখ্যা পর্যন্ত প্রকাশ করে। আরএসএস-এর হিন্দি মুখপাত্র 'পাঞ্চজন্য' ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে যুব নেতা হিসাবে সঞ্জয়ের উত্থানকে অভিনন্দন জানায়।

আরএসএস-এর মুচলেকা

১৯৭৬ সালের ৩০শে নভেম্বর, আরএসএস-এর মাধবরাও মুলে, দত্তোপন্ত থেনগাডি, মরোপন্ত পিংলে সহ ৩০ জনের উপর নেতা ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠি লেখেন যে আরএসএস-এর নেতা-কর্মীরা মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে বেরোতে চান ও যদি তারা সকলে মুক্তি পান, তবে তারা জরুরি অবস্থাকে সমর্থন করবেন। মাধবরাও মুলে ছিলেন আরএসএস-এর সাধারণ সম্পাদক। তিনি, তখন আত্মগোপনে আছেন। ইন্দিরা গান্ধীর মিডিয়া উপদেষ্টা তখন ছিলেন এইচ ওয়াই সারদা প্রসাদ, তার পুত্র রবি বিশ্বেস্বরায় সারদা প্রসাদ পরে লিখেছেন যে তার পিতাই আরএসএস নেতাদের মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি কার্যকর করার দায়িত্বে ছিলেন।

মহারাষ্ট্রের ট্রেড ইউনিয়ন নেতা বাবা আদভ দেওরসের সাথে একই জেলে ছিলেন, তিনি নিজের চোখে যা দেখেছেন তা লিখেছিলেন- "বন্দীদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তারা কোনও অঙ্গীকার বা স্মারকলিপি সই করতে প্রস্তুত কিনা। আমি নিজের চোখে দেখেছি যে বেশিরভাগ আরএসএস বন্দীরা তাদের সম্মতি স্বাক্ষর করছে"।


সুব্রম্মনীয়মের বক্তব্য
সেদিনের জনসঙ্ঘের এক সাংসদ ছিলেন সুব্রম্মনীয়ম স্বামী, ২০১৩ সালে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। তিনি 'দি হিন্দু' পত্রিকায় ১৩ জুন, ২০০০ জরুরি অবস্থা নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছেন যাতে বলেন যে সেদিনের আরএসএস নেতাদের বেশিরভাগ জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।  তিনি লিখেছেন -"অটল বিহারি বাজপেয়ী মহাশয় ইন্দিরা গান্ধীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে পত্র লিখেছিলেন এবং তিনি তাঁকে দয়া করেছিলেন। সরকারের বিরুদ্ধে কোনও কর্মসূচিতে অংশ নেবেন না বলে লিখিত আশ্বাস দিয়ে প্রকৃতপক্ষে ২০ মাসের জরুরি অবস্থার বেশীর ভাগ সময়ে বাজপেয়ী মহাশয় প্যারোলে মুক্ত ছিলেন"। 

মাধবরাও মুলের কাছে থেকে সুব্রম্মনীয়ম  জানেন যে আরএসএস-এর নেতা-কর্মীরা  মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেলেও,  সুব্রম্মনীয়মকে ছাড়া হবে না, কারণ তিনি বিদেশে ইন্দিরা ও সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে প্রচার করেছেন, ইন্দিরার চোখে ভালো হওয়ার জন্য বাজপেয়ীই বিশ্বাসঘাতকতা করে সুব্রম্মনীয়মকে ধরিয়ে দিতে পারেন।  বাজপেয়ী সুব্রম্মনিয়মকে ধরিয়ে দিতে শাসক দলকে খবর দিয়েছিলেন কিনা, সেটা জানা নেই, কিন্তু এটা সত্যি যে সেই সময়ে বাজপেয়ী নিজে নিজেই একদিন দেখা করতে গিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র দফতের প্রতিমন্ত্রী  ওম মেহতার সাথে। সুব্রম্মনিয়মের ধারণা যে সেদিন বাজপেয়ী বলে এসেছিলেন যে তিনি আর আরএসএস-এর সাথে আর সম্পর্ক রাখবেন না, এবং তিনি সুব্রম্মনীয়ম স্বামী, মাধবরাও মুলে ও অন্যান্য আরএসএস কর্মীরা যারা তখনো আত্মগোপনে আছে, তাদের সমস্ত হদিস দিয়ে আসেন।  স্বাধীনতার আগে থেকেই বিশ্বাসঘাতকতা আরএসএস-এর রক্তে আছে।

পুরো রেফারেন্স 

১) Shah Commission of Inquiry – 1st Interim Report, page 25

(২) Shah Commission of Inquiry - 3rd Final Report, page 134

(৩) The Print, 25th June, 2020


(৫) Amit Shah, 'Dictorial Mindset Led To Emergency' , টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ২৬ সে জুন, ২০২১;

(৬) Sushil Kumar Modi. 'A story that needs to be retold', ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২৬শে জুন, ২০২১;

(৭) A G Noorani, 'The RSS A Menac to India', Left Word, 2019; page 124-129

(৮) D R Goyal, 'Rashtriya Swayamsevak Sangh', Radhakrishna Prakashan, 1979, page 116

(৯) M. S. Golwalkar, 'We Or Our Nationhood Defined', Bharat Publications, Nagpur1939, page 32

(১০) M. S. Golwalkar, Bunch of Thoughts, Sahitys Sindhu Prakashana, 1966, page 59

(১১) M. S. Golwalkar, Bunch of Thoughts, Sahitys Sindhu Prakashana, 1966, pages 177-201

(১২) Partha Banerjee, 'In the belly of the beast', Ajanta Books International, 1998, page 155

(১৩) The Hindu, 6 March, 2018

(১৪) A G Noorani, 'The RSS A Menac to India', Left Word, 2019; page 486-487

(১৫) Neerja Chowdhury, 'How Prime ministers decide', Aleph Book Company, page 66

(১৬) A G Noorani, 'The RSS A Menac to India', Left Word, 2019; pages 227-228

(১৭) A G Noorani, 'The RSS A Menac to India', Left Word, 2019; pages 225

(১৮) Bipan Chandra, 'In the name of democracy: JP movement and the emergency' Penguin, 2003, page 172

(১৯) A G Noorani, 'The RSS A Menac to India', Left Word, 2019; page 488

(২০) Coomi Kapoor, 'The Emergency: A personal story', Penguin, page 117
(২১) मधुकर दत्ताराय देवरस (बालासाहेब देवरस), 'हिंदू संगठन और सत्तावादी राजनीति', जागृति प्रकाशन, नोएडा, 1997
(২২) A G Noorani, 'The RSS A Menac to India', Left Word, 2019; page 493-494

(২৩) T V Rajeswar, 'India, The crucial years', Harper Collins, 2015, page 79

(২৪) D R Goyal, 'Rashtriya Swayamsevak Sangh', Radhakrishna Prakashan, 1979, page 124-125;

(২৫) Coomi Kapoor, 'The Emergency: A personal story', Penguin, page 47
(২৬) Neerja Chowdhury, 'How Prime ministers decide', Aleph Book Company, 2023 page 67
(২৭) The wire, 29 June 2024
(২৮) PRAJAKTA R. GUPTE, "India:"The Emergency"and the Politics of Mass Sterilization", Education About ASIA, Volume 22, Number 3, Winter 2017, pp. 40-44

(২৯) T V Rajeswar, 'India: The crucial years', Harper Collins Publisher, India, 2015, page 79

(৩০) Neerja Chowdhury, 'How Prime ministers decide', Aleph Book Company, 2023 page 79

(৩১) Bipan Chandra, 'In the name of democracy: JP movement and the emergency' Penguin, 2003, page 217-218

(৩২) A G Noorani, 'The RSS A Menac to India', Left Word, 2019, page 494-495;

(৩৩) A G Noorani, 'The RSS A Menac to India', Left Word, 2019, page 181;

(৩৪) Subramanian Swamy, 'Unlearnt lessons of the Emergency', The Hindu, 13 June, 2000;

(৩৫) Ajaz Ashraf, 'Vajpayee, RSS cowered before Indira Gandhi: BJP can't ignore Swamy's account of the Emergency', Firstpost, June 25, 2015.
(৩৬) Coomi Kapoor, 'The Emergency: A personal story', Penguin, page 122
(৩৭) Coomi Kapoor, 'The Emergency: A personal story', Penguin, page 133
(৩৮) Neerja Chowdhury, 'How Prime ministers decide', Aleph Book Company, 2023, page 36-37
(৩৯) N P Ulekh, 'The untold Vajpayee: politician and paradox', Penguin 2017, page 83-84
(৪০) Coomi Kapoor, 'The Emergency: A personal story', Penguin, page 19
(৪১) A G Noorani, 'The RSS A Menac to India', Left Word, 2019, page 183
(৪২) A G Noorani, 'The RSS A Menac to India', Left Word, 2019, page 185
(৪৩) Neerja Chowdhury, 'How Prime ministers decide', Aleph Book Company, 2023, page 66
(৪৪) The Indian Express, 26 February 1977
(৪৫) A G Noorani, 'The RSS A Menac to India', Left Word, 2019, page 197;
(৪৬) The Times of India, 11 April 1977
(৪৭) The Indian express, 8 May 1977
(৪৮) The Times of India 13 February 1980

(৪৯) Neerja Chowdhury, 'How Prime ministers decide', Aleph Book Company, 2023, page 67