শনিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৫

শ্রম কোড কেন বিপদজনক ~ কুশল দেবনাথ

চারটি শ্রম কোড কেন বাতিল করতে হবে

বিজেপি-পরিচালিত এনডিএ সরকার ২৯টি শ্রম আইনকে চারটি লেবার কোডে পরিণত করে সংসদে পাশ করেছে। এই আইন কার্যকর করা যাচ্ছিল না, তার কারণ বিধি (rules) তৈরি হয়নি। বিধি তৈরি না হলে কোনো আইন লাগু করা যায় না। পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের তিনটি রাজ্য বাদ দিয়ে সব রাজ্যই ইতিমধ্যে বিধি তৈরি করেছে। এ বছরের গোড়ায় কেন্দ্রীয় শ্রম দপ্তর ঘোষণা করেছিল, পয়লা এপ্রিল ২০২৫ থেকে সারা দেশে শ্রম কোড লাগু করা হবে। শেষ অবধি তা হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন হল, সারা ভারতে যখন শ্রম কোড চালু হবে, তখন পশ্চিমবঙ্গেও কি আইন লাগু হবে? হ্যাঁ হবে, কারণ শ্রম যে হেতু যুগ্ম তালিকাভুক্ত, তাই কেন্দ্রীয় সরকার নোটিফিকেশন জারি করতে পারে যে, যে রাজ্যগুলি বিধি তৈরি করেনি, সেগুলিতেও কেন্দ্রীয় বিধি লাগু হবে।
২০২০ সালে তিনটি কৃষি আইন ও চারটি শ্রম কোড লোক সভায় বিল আকারে পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্বার কৃষক আন্দোলনের জেরে কেন্দ্রীয় সরকার তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। শ্রম কোডের বিরুদ্ধে গোটা দেশে বিভিন্ন ধরনের ট্রেড ইউনিয়ন যে প্রতিবাদ করেনি, এমনটা নয়। কিন্তু সেই প্রতিবাদের ধার অনেক কম ছিল। শ্রমিক আন্দোলনের দুর্বলতার জন্যই আজ গোটা দেশে শ্রম কোড লাগু হতে চলেছে।
প্রশ্ন আসে, বিভিন্ন সময় আমাদের দেশে যে শ্রম আইন এসেছিল, তার সাথে এই চারটি শ্রম কোডের পার্থক্যটা কী? এ যাবৎ কালে যে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে শ্রম আইন এসেছিল, তার প্রত্যেকটিরই আলাদা আলাদা উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু এই চারটি শ্রম কোড ভিন্ন ভিন্ন আইনকে একটা সূত্রে গেঁথে দিয়েছে। তাই প্রতিটা আইনের যে আলাদা আলাদা উদ্দেশ্যগুলি ছিল, সেগুলি তুলে নেওয়া হয়েছে। একটু উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক। ১৯৭০ সালে যখন 'কন্ট্র্যাক্ট লেবার (রেগুলেশন ও অ্যাবোলিশন)' আইন আসে, তার উদ্দেশ্য ছিল ঠিকা শ্রমিকদের কাজের নিয়মাবলী নির্দিষ্ট করা, ও ঠিকা প্রথার অবসান ঘটানো। যদিও ঐ আইনে ঠিকা শ্রম নির্মূল করা বা 'অ্যাবোলিশন'-এর কোনো কথা লেখা হয়নি, তবু এই উদ্দেশ্যে আইনটি তৈরি হয়েছিল। এ বারে 'অক্যুপেশনাল সেফটি, হেল্থ এবং ওয়ার্কিং কনডিশন' ২০২০ নামক শ্রম কোডটিতে ঠিকা শ্রমিকের বিষয়টা অন্তর্ভুক্ত করা হোলো। ফলে ঠিকা শ্রমিকদের জন্য ১৯৭০ সালে প্রণীত মূল আইনটির তাৎপর্যই হারিয়ে গেল। আমরা দেখি, এই কোডের বিষয়টির 'উদ্দেশ্য' হিসেবে লেখা রয়েছে, পেশাগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও কাজের অবস্থা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ঠিকা শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার যে মূল উদ্দেশ্য ছিল, যার জন্য আইনে ঠিকাদারদের লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল, প্রধান নিয়োগকারীকে সময়মতো মজুরি মেটাতে, এবং অন্যান্য সুবিধা ঠিকা শ্রমিকদের দিতে বাধ্য করা হয়েছিল — সে সব কিছুই আর নতুন আইনে নেই।
আমরা যদি চারটি শ্রম কোড খুঁটিয়ে পড়ি, তা হলে দেখব যে এই কোডগুলির উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণিকে টুকরো টুকরো মানুষে পরিবর্তিত করা। পুঁজিবাদের শুরুর পর্যায়ে শ্রমিক ছিল 'ক্লাস ইন ইটসেল্ফ' — 'শ্রমিক' একটি শ্রেণি-পরিচয়। কিন্তু ধারাবাহিক লড়াইয়ের মাধ্যমে শ্রমিকরা 'ক্লাস ফর ইট সেল্ফ' (নিজেদের জন্য নির্মিত শ্রেণি, স্বরচিত পরিচয়) অবস্থানে পৌঁছয়। লেবার কোডে এমন অনেক বিষয় যুক্ত করা হয়েছে যেখানে শ্রমিকরা সেই 'শ্রেণি' সত্বা হারিয়ে ফেলবে, কেবল 'ব্যক্তি' সত্বায় পরিণত হবে। অর্থাৎ পুঁজির হামলার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভাবে শ্রমিক শ্রেণির প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না। 
দ্বিতীয়ত, শ্রম কোড এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে বেশির ভাগ শ্রমিকই শ্রম আইনের আওতার বাইরে চলে যাবে। উদাহরণ দিয়ে বলা যাক- ১৯৭০ সালে কন্ট্রাক্ট লেবার (রেগুলেশন ও অ্যাবোলিশন) অ্যাক্টে ২০জন শ্রমিক ঠিকাদারের অধীনে কাজ করলে আইনি অধিকার পেতো। শ্রম কোডে সংখ্যাটা ৫০ করে দেওয়া হয়েছে।ফলে একজন কন্ট্রাকটর ৪৯জন শ্রমিককে নিয়ে কাজ করলে আইন তাকে ছুঁতেও পারবে না। আর বিভিন্ন কোম্পানিতে ঠিকা শ্রমিকরা একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত হয় এবং কাজ করে, সেই সংখ্যাটা মাত্রাতিরিক্ত হয় না। উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে নানান ধরনের ঠিকাদারকে নানা কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একজনই ঠিকাদার সব ধরনের কাজ করেন, এমন নয়। কাজ এমন টুকরো টুকরো করে দেওয়ার ফলে, একজন ঠিকাদার ৫০জনের বেশি ঠিকা শ্রমিককে নিয়োগ করবেন, সে সম্ভাবনা কতটুকু? সুতরাং নতুন লেবার কোডে বেশির ভাগ ঠিকা কর্মীকে শ্রম আইনের বাইরেও নিয়ে আসা হলো। ফলত কন্ট্রাকটর কিংবা মূল কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের ওপর যথেষ্ট আক্রমণের চেষ্টা করবে।
এই শ্রম কোডগুলিতে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার, অর্থাৎ ধর্মঘট করার অধিকার সুকৌশলে কেড়ে নেবার চেষ্টা হয়েছে। কেড়ে নেওয়া হয়েছে ছাঁটাই শ্রমিকদের পুনর্বহালের বিষয়টিও। কারখানায় স্থায়ী ভাবে নিযুক্ত হওয়ার যে অধিকার শ্রমিকের ছিল, তা তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। শুধু ঠিকা শ্রমিক নয়, অন্য একটা বিরাট অংশের শ্রমিককেও লেবার আইনের আওতার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, এই শ্রমকোডে 'ফ্যাক্টরি'-র সংজ্ঞাও পাল্টে দেওয়া হয়েছে। এত দিন আইনি সংজ্ঞা ছিল, 'যে প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ-সংযোগ থাকলে অন্তত ১০জন শ্রমিক কাজ করে, অথবা বিদ্যুৎহীন প্রতিষ্ঠানে অন্তত ২০জন শ্রমিক কাজ করে, তা 'ফ্যাক্টরি' বা কারখানার মর্যাদা পাবে। এবং এই আইনের সুবিধা পাবে। কিন্তু শ্রম কোডে শ্রমিক সংখ্যা পূর্বের আইনের দ্বিগুণ করা হয়েছে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ-সংযোগ আছে, এমন প্রতিষ্ঠানে অন্তত ২০জন শ্রমিক কাজ করলে তারা শ্রমিকের মর্যাদা পাবে। আর বিদ্যুৎহীন প্রতিষ্ঠানে অন্তত ৪০জন শ্রমিক কাজ করতে হবে। যে হেতু ভারতে অধিকাংশ কারখানা খুব কম শ্রমিক নিয়ে কাজ করে, তাই আইনে পরিবর্তনের ফলে বিপুল সংখ্যক শ্রমিকদের কোনো আইনি সুবিধা থাকবে না। তাদের শ্রম আইনের সুরক্ষার বাইরে নিয়ে যাবে শ্রম কোড। এই কোড শ্রমিকদের একটি ঐক্যবদ্ধ শ্রেণির পরিবর্তে অগুনতি টুকরো টুকরো মানুষে পরিণত করবে। এ হল সংগ্রাম ও সংগঠন করার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা। এই কোড বাতিলের লড়াই ছাড়া, অন্য কোনো রাস্তা খোলা নেই এ দেশের শ্রমিক শ্রেণির কাছে।
যে চারটি শ্রমিক কোড আইনে রূপান্তরিত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল 'দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস কোড, ২০২০' — শিল্পে শ্রমিক নিযুক্তি, ট্রেড ইউনিয়ন, নিয়োগকারী ও শ্রমিকের মধ্যে বিবাদ সম্পর্কিত আইন। এ বিষয়ে তিনটি পূর্বতন আইন ছিল 'দ্য ট্রেড ইউনিয়ন অ্যাক্ট, ১৯২৬', 'দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল এমপ্লয়মেন্ট (স্ট্যান্ডিং অর্ডার্স' অ্যাক্ট, ১৯৪৬', এবং 'দ্য ইন্ডায়স্ট্রিয়াল ডিসপিউটস, ১৯৪৭।' এই কোডে একটি শব্দ সংযোজিত হয়েছে, 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট।' এতে লেখা হয়েছে, একজন শ্রমিক তার মালিকের সাথে লিখিত চুক্তি করবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। নির্দিষ্ট সময়ের পরে (সেটা কয়েক মাস বা কয়েক বছর হতে পারে) তাকে আবার চুক্তি করতে হবে। অর্থাৎ ধারাবাহিক ভাবে কাজের সুযোগকে খর্ব করা হল, চুক্তিভিত্তিক, স্বল্পমেয়াদী নিয়োগকে আইনত বৈধ করা হল।
নরেন্দ্র মোদি সরকার ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর মরসুমি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি ঢোকায়, সরকারি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। ২০১৮ সালে বস্ত্রশিল্পের জন্য এর 'গেজেট নোটিফিকেশন' জারি হয়। লেবার কোডে শিল্পের সমস্ত বিভাগে 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট' বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে। এটা করতে এই সরকার এতটাই বদ্ধপরিকর যে গ্র্যাচুয়িটি আইনেরও পরিবর্তন করেছে। ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্টের চুক্তি করলে এক বছরে গ্র্যাচুইটি পাবেন শ্রমিক। সরকারি ভাবে গ্র্যাচুইটি পাবার নিয়ম হল, অন্তত পাঁচ বছর কাজ করলে গ্র্যাচুইটি পাওয়া যায়। কিন্তু সময়সীমা কমিয়ে এক বছর করা হল। আমাদের দীর্ঘ দিনের দাবি ছিল গ্র্যাচুইটি আইনের সংশোধন করে পাঁচ বছরের জায়গায় এক বছর কাজ করলেই গ্র্যাচুইটি দেওয়া হোক। সরকার মানেনি। এখন শ্রম কোডে এই সুবিধা দেওয়া হল কেন? এটা শ্রমিককে প্রলোভিত করার জন্য, যাতে 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট'-এর নিয়মে শ্রমিক মালিকের সঙ্গে লিখিত চুক্তি করে৷ কিন্তু স্বল্পমেয়াদী এই চুক্তি যদি মালিক পুনরায় নবীকরণ না করে, তা হলে তো গ্র্যাচুইটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সব পাওনার শেষ হবে। 
অর্থাৎ 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট' চুক্তিতে একবার ঢুকলে স্থায়ী চাকরির সম্ভাবনা, শ্রমিকের বিভিন্ন অধিকার, সব বাতিল হয়ে যাবে। এমনকি শ্রমিকের সংগঠিত হয়ে ইউনিয়ন করার বিষয়টি আর থাকবে না। ফিক্সড টার্মে যে শ্রমিক কাজ করছে তার মধ্যে অহোরহ এই ভয় থাকবে যে যদি সে মালিক বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যায় তাহলে তা লিখিত চুক্তির বিরুদ্ধে হবে৷ সুপরিকল্পিত ভাবে ফিক্সড টার্ম ব্যাপারটা আনা হয়েছে যার ফলে স্থায়ী শ্রমিক থাকবে না, শ্রমিকের কোনো সুরক্ষা পাবে না, শ্রমিকরা ইউনিয়নভুক্ত হবে না বা সংগঠিত প্রতিবাদ করবে না। কারণ, ফিক্সড টার্ম চুক্তিতে যে শ্রমিক কাজ করছে তার মধ্যে অহরহ এই ভয় থাকবে যে যদি সে মালিক বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যায়, তা হলে তা লিখিত চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করবে। সুপরিকল্পিত ভাবে নিয়োগের ক্ষেত্রে 'ফিক্সড টার্ম' চুক্তির ব্যাপারটা আনা হয়েছে যার ফলে স্থায়ী শ্রমিক থাকবে না, শ্রমিকের কোনো সুরক্ষা পাবে না, শ্রমিকরা ইউনিয়নভুক্ত হবে না বা সংগঠিত প্রতিবাদ করবে না। আর এখানে সরকার বা লেবার দপ্তরের কোনো দায়ও থাকবে না। কারণ মালিকের সাথে লিখিত চুক্তি করেই ব্যক্তি শ্রমিক কাজ পেয়েছে৷ সরকার বা শ্রম দপ্তরের এখানে কিছু করার নেই৷ এমনকি শ্রমিক কোনো আইনি সুরক্ষাও পাবে না। কারণ আদালতে যুক্তি আসবে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ লিখিত চুক্তি করে স্বল্পমেয়াদী নিয়োগের শর্তাবলী মেনে নিয়েছে। অর্থাৎ সব দিক থেকেই 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট' একটি আদ্যোপান্ত দানবীয় আইন।
একটা প্রশ্ন আসতে পারে— এ দেশে বিভিন্ন শিল্পে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকই বেশি। 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট'-এর সঙ্গে তা হলে তফাতটা কী হল? মূলগত ভাবে তফাত না থাকলেও একটি তফাত আছে৷ তা হল, চুক্তিভিত্তিক বা কনট্র্যাকচুয়াল শ্রমিকের ক্ষেত্রে সব সময় নিয়োগের নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে না, বা লিখিত চুক্তি করতে হয় না। কিন্তু 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট' ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করে লিখিত চুক্তি থাকতে হবে। আরও বড় সমস্যা হল, শ্রম কোডে এটা অন্তর্ভুক্ত হবার ফলে একে আইনত বৈধ করা হল। আরও যে সমস্যা পরবর্তী কালে আসবে তা হল, শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বা আদালতের যে একটা ভূমিকা থাকে, তা কার্যত নাকচ হয়ে যাবে।
এরপর এই কোডের আরও দুটি বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করব — ধর্মঘট এবং ট্রেড ইউনিয়ন আইন বিষয়ে।
ধর্মঘট বিষয়ে আগে বলা ছিল, এক দল শ্রমিকের কাজ বন্ধ করা বা সংঘবদ্ধ ভাবে কাজ করতে না চাওয়াকে 'স্ট্রাইক' বা ধর্মঘট বলা হবে। এ বার তার সঙ্গে আরও একটি বিষয় যুক্ত করা হয়েছে৷ পঞ্চাশ ভাগের একজন বেশি শ্রমিক যদি ছুটি নেয়, তা হলে সেটাও ধর্মঘট হিসাবে গণ্য হবে। শ্রমিক কাজ করতে চায় না, বা কাজ বন্ধ করে তার অধিকার আদায়ের জন্য। কিন্তু ছুটি তো একটা অধিকার৷ ৫০ ভাগের একজন বেশি শ্রমিক ছুটি নিলে সেটা কেন ধর্মঘট হিসাবে গণ্য হবে? এতে ছুটি বা Leave-কে ধর্মঘটের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে। এটা একটা অধিকার জোর করে কেড়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছু নয়। দ্বিতীয়ত, আগে জনপরিষেবার কোনও ক্ষেত্রে শ্রমিকরা ধর্মঘট করতে চাইলে নোটিস দিতে হত। বাকি শিল্প, যা 'পাবলিক ইউটিলিটি সার্ভিস'-এর মধ্যে পড়ে না সেখানে ধর্মঘটের জন্য আগাম নোটিস দিতে হত না। শ্রম কোডের নিয়ম অনুসারে ধর্মঘট করার বিষয়টি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিলম্বিত হয়ে যাবে — ইউনিয়ন ধর্মঘটের নোটিস দিল, মালিক মানল না, সেটা শ্রম দপ্তরে দু'তরফের বিবাদ বা 'ডিসপ্যুট' হিসেবে গেল। তারপর শুরু হল আলোচনা। আলোচনা চলাকালীন কোনো পক্ষ এক তরফা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, বলছে কোড। অর্থাৎ কার্যত ধর্মঘটের বিষয়টা এক অন্তহীন প্রক্রিয়ার মধ্যে চলে গেল। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কোনো কারখানায় মালিক বা কর্তৃপক্ষ একতরফা কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শ্রমিক কাজ বন্ধ করে দেয়। অথবা, দুর্ঘটনায় কোনো শ্রমিক মারা গেলে, বা গুরুতর আহত হলে শ্রমিকরা তক্ষুণি কাজ বন্ধ করে দেয়। শ্রমিকদের এই সমবেত প্রত্যাঘাতে মালিকপক্ষ অনেক ক্ষেত্রেই পিছু হটেছে। এ যাবৎ এটা বে-আইনি কাজ হিসেবে গণ্য হত না। কিন্তু বর্তমানে কোনও পরিস্থিতিতেই তাৎক্ষণিক কাজ বন্ধ করা যাবে না। শ্রমিকদের নোটিস দিতে হবে, তারপর ধর্মঘট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে। অর্থাৎ আইনের প্যাঁচে এই ধরনের সমস্ত লড়াই চলে যাবে বিশ বাঁও জলে। এই ভাবে ধর্মঘটের অধিকার কার্যত কেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে শ্রম কোডে। 
নতুন শ্রমকোডে ট্রেড ইউনিয়ন সংক্রান্ত প্রশ্নে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়েছে। যে কোনো কারখানায় একের অধিক ইউনিয়ন থাকলে, কোনও শ্রমিক সংগঠনকে আইনত স্বীকৃত বা 'রেকগনাইজড' ইউনিয়ন হতে গেলে মোট শ্রমিকদের ৫১% বা তার বেশি নাম মাস্টার রোলে থাকতে হবে। যদি ৫০%-এর বেশি শ্রমিকের সমর্থন কোনো ইউনিয়ন না পায়, তা হলে আনুপাতিক হারে কাউন্সিল তৈরি করতে হবে। সেই কাউন্সিলই মালিকপক্ষের সঙ্গে দর কষাকষি করবে। আপাত ভাবে মনে হয় ৫১% বেশি শ্রমিকের নাম মাস্টার রোলে থাকলে ব্যাপারটা তো মন্দ নয়। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায় — ৫১% শ্রমিকের নাম মাস্টাররোলে রাখার বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়নি। ফলে ইউনিয়ন তৈরির ক্ষেত্রে রাজ্যের শাসক দলের, বা কারাখানা মালিকের একটা বড় ভূমিকা থাকবে। তাদের পছন্দের ইউনিয়নের শ্রমিকদের ৫১ শতাংশ বা তার বেশি সদস্যের নাম মাস্টাররোলে ওঠানোর চেষ্টা জারি থাকবে। আর ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা যাই হোক,.... প্রধান এজেন্ট হিসেবে নির্বাচনের কোনো কথা এই আইনে নেই। স্বাভাবিক ভাবেই ইউনিয়নের উপর শাসকদলের বা মালিকের নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি থাকবে।
এর আগে আমরা দেখেছি, 'ফ্যাক্টরি'-র সংজ্ঞা বদলে বহু কারখানা শ্রমিককে আইনের সুরক্ষার বাইরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আরও একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় 'স্ট্যান্ডিং অর্ডার'— যার উল্লেখ 'দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস কোড, ২০২০'-তে লেখা আছে। তিনশো বা তার বেশি শ্রমিক যে ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন সেখানে স্ট্যান্ডিং অর্ডার থাকবে। এখন প্রশ্ন হল, স্ট্যান্ডিং অর্ডারের গুরুত্ব কোথায় ছিল? স্ট্যান্ডিং অর্ডারে কী থাকে? শ্রমিকদের বিভাগ নির্ণয় (ক্লাসিফিকেশন) অর্থাৎ শ্রমিকটি স্থায়ী না ক্যাজুয়াল, নাকি বদলি শ্রমিক, ইত্যাদি। এ ছাড়া কাজের সময় থেকে শুরু করে শিফট কী ভাবে চলবে, টিফিনের সময়, বেতন কখন, কবে দেওয়া হবে, ছাঁটাইয়ের শর্ত, খারাপ ব্যবহারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা— অর্থাৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কর ব্যাপারটি নীতিভুক্ত হয়। দু'ভাবে স্ট্যান্ডিং অর্ডার হয়। একটা থাকে মডেল স্ট্যান্ডিং অর্ডার, আরেকটা মালিক-শ্রমিক চুক্তি হয় লেবার দপ্তরের উপস্থিতিতে। এখন কিন্তু ৩০০-র চেয়ে কম শ্রমিক কাজ করলে সেখানে কোনো স্ট্যান্ডিং অর্ডার থাকবে না। অর্থাৎ ফ্যাক্টরি চলার অভ্যন্তরীণ রীতি তুলে দেওয়া হল।
অতএব আমরা দেখতে পাচ্ছি, নতুন আইনে নানা সংজ্ঞা এবং বিধি বদল করে লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে আইনের বাইরে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ সংগঠিত শিল্প-শ্রমিকদের মৌলিক আইনি অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে৷ কাড়া হয়েছে সংগঠন ও সংগ্রামের অধিকার।
অপর দিকে যে সব শ্রমিকেরা আজ শ্রম আইনের আওতায় নেই, সেই লক্ষ লক্ষ শ্রমিকদের বিষয়ে চারটি শ্রম কোড কী অবস্থান নিয়েছে? বেশি ব্যাখ্যা করার দরকার নেই, কিছু উদাহরণই যথেষ্ট। লাখ লাখ গৃহপরিচারিকাদের সম্পর্কে কোডে কোনো কথা বলা নেই। আর আজকের শ্রম-বাজারে যে শ্রমিকদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়, সেই গিগ শ্রমিকদের ব্যাপারে লেখা আছে, 'gig workers means a person who performs work or participates in a work arrangement and earn from such activities outside of traditional employer-employee relationship.' মানে প্রথাগত মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের বাইরে থাকবে গিগ শ্রমিকরা। তাদের কোনো আইনি অধিকার থাকবে না। শুধু কিছু প্রকল্পের সুযোগ পাবে। এ সব থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে চারটি শ্রম কোড সমস্ত ধরনের শ্রমিকের মৌলিক আইনি অধিকার কেড়ে নেওয়ার একটি হাতিয়ার। এই চারটি শ্রম কোডকেই বাতিল করার দাবিতে সমস্ত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
প্রশ্ন হল, আজ ভারতে কেন এই শ্রম কোড আনা হল? বিজেপি সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটা কি? এর পিছনের রাজনীতিটা আমরা বুঝব কী ভাবে? রাজনীতি বুঝতে না পারলে সঠিক প্রতিরোধও গড়া যাবে না।
কয়েকটা প্রশ্নে ভাগ করে এর উত্তর খুঁজব।
১) শ্রমকোড বা শ্রম আইন আনার প্রেক্ষিতটা কী?
বিশ্বে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আসার পর শ্রমিক শ্রেণি পুঁজির আক্রমণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অধিকারের দাবিতে সংগঠিত হওয়া শুরু করে। 'মেশিন-ভাঙা' আন্দোলন থেকে বিভিন্ন বিভাগে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, পরবর্তীতে বিভিন্ন কারখানায় কিংবা শিল্প-ভিত্তিক সংগঠনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। মে দিবসের লড়াই ছিল পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের শ্রেণিগত ভাবে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের একটি চমৎকার উদাহরণ। ইতিমধ্যে ১৮৭১ সালে প্যারি-কমিউন ঘটে। ১৯১৭ সালে শ্রমিকরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে রাশিয়ার। রাশিয়ার বিপ্লব গোটা পৃথিবীতে শ্রমিক আন্দোলনে নতুন জোয়ার আনে। ঐ সময় বিভিন্ন দেশে শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হয়ে আইনি অধিকার পাবার লড়াই জোরদার করে। অপর দিকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লড়াইয়েও অংশগ্রহণ করে। অন্য দিকে বুর্জোয়ারাও ক্ষমতা হারানোর ভয়ে শ্রমিকদের কিছু আইনি অধিকার দিতে বাধ্য হয়। এবং নানান ধরনের শ্রম আইন তৈরি হয় নানান দেশে। মানে রাষ্ট্র একটা নিয়ম প্রবর্তন করে যা শ্রমিক, মালিক, রাষ্ট্র সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। এই সব আইনের মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণি কিছু আইনি অধিকার পায়। শ্রমিক বিপ্লব যাতে না হয়, তার জন্য বুর্জোয়ারা এই অধিকার দিতে কিছুটা বাধ্যও হয়। কিন্তু এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, উত্তাল শ্রমিক আন্দোলন না থাকলে শ্রমিকদের এই আইনি অধিকার অর্জন হতো না। শ্রমিকরা যা কিছু আদায় করেছে, সংগঠনের জোরে, ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের জোরেই করেছে।
আমাদের দেশের সংগঠিত শিল্পও তার ব্যতিক্রম নয়। এ দেশের শ্রমিকরা আন্দোলনের জোরে বেশ কিছু আইনী অধিকার অর্জন করেছে। ভারত রাষ্ট্রে দেশী-বিদেশী একচেটিয়া পুঁজিপতিদের শাসন থাকা সত্ত্বেও অনেক লড়াই করে শ্রমিকরা এই অধিকার অর্জন করেছিল। শ্রমিক আন্দোলন যত দুর্বল হতে থাকে, পুঁজিপতি শ্রেণি ততই শ্রমিকের আইনি অধিকারকে খর্ব করতে তীব্র আক্রমণ নামিয়ে আনে। এর বিরুদ্ধে শ্রমিকরা প্রতিরোধ গড়তে পারেনি। ফলে বহু ক্ষেত্রে পুঁজিপতিরা তাদের ইচ্ছেমতো নিয়ম প্রবর্তন করতে শুরু করে। কাজের ঘন্টা বাড়ানো, স্থায়ী শ্রমিক প্রথা রদ, বেতন সংকোচন, চুক্তি শ্রমিক ও ঠিকা শ্রমিকের সংখ্যায় বৃদ্ধি, ইচ্ছেমতো ছাঁটাই, যখন-তখন কাজ বন্ধ করা, ইত্যাদি চলতে থাকে। এক কথায় শ্রমিকদের ওপর ব্যাপক আক্রমণ নামিয়ে আনে।
২) আর এস এস পরিচালিত বিজেপি সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কি?
এই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে আমাদের দু'টো বিষয় নিয়ে একটু কথা বলে নিতে হবে :
(ক) গত শতাব্দীর ন'য়ের দশক থেকে এই দেশে নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির আগমন ঘটে, কংগ্রেসের নরসীমা রাও ও মনমোহন সিংহের আমলে যার প্রবর্তন হয়। এটি গোটা দেশের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিপুল বদল আনে।  
(খ) এই পর্যায়েই এ দেশের ফ্যাসিস্ট দল বিজেপির বিপুল শক্তিবৃদ্ধি ঘটে। স্বাভাবিক ভাবেই পরবর্তী কালে ভারতের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সবচেয়ে আগ্রাসী, আক্রমণাত্মক, হিংস্র পুঁজিপতি গোষ্ঠী বিজেপি-কে নিঃশর্ত সমর্থন দেয়। ফ্যাসিবাদ সব সময় প্রধান প্রতিপক্ষ করে শ্রমিকশ্রেণিকে। শ্রমিক শ্রেণি যাতে শ্রেণিবদ্ধ ভাবে সংঘবদ্ধ না হতে পারে, শ্রমিকদের শ্রেণিগত ঐক্য ভেঙে যাতে শ্রমিকরা পরস্পর-বিচ্ছিন্ন হয়, মতাদর্শের দিক দিয়েই ফ্যাসিস্টরা তা নিশ্চিত করতে চায়। ফ্যাসিবাদী শাসন ও স্বৈরাচারী শাসনের মধ্যে তফাৎ হলো, ফ্যাসিবাদী শাসনে স্বৈরাচার থাকবে, কিন্তু স্বৈরাচারী শাসনে ফ্যাসিবাদ থাকবেই— এমনটা নয়। একটু আলোচনা করা যাক। ১৯৭০-১৯৭৬ যখন ইন্দিরা গান্ধীর চরম স্বৈরাচারী শাসন চলছে, সেই সময়েই তিনটি শ্রম আইন তৈরি হয় : ১৯৭০ সালে কন্ট্রাক্ট প্রথা (রেগুলেশন ও এ্যবুলেশন) আইন, ১৯৭২ সালে গ্র্যাচুইটি আইন, ১৯৭৬ সালে সমকাজে সমবেতনের আইন। দেশে স্বৈরশাসন চলাকালীনই এই আইনগুলি পাশ হয়েছিলো, যেগুলি শ্রমিক-স্বার্থ কিছুটা হলেও রক্ষা করেছিলো। কিন্তু ২০১৪-২০২৫, এই এগারো বছরে নরেন্দ্র মোদী সরকার শ্রমিক স্বার্থে একটাও আইন তৈরি করেনি। উপরন্তু ২৯টি শ্রম আইনকে চারটে শ্রম কোডে পরিবর্তিত করে শ্রমিকদের আইনি অধিকার কার্যত কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। যে চারটি শ্রম কোডের মাধ্যমে কার্যত এই সরকার বেশির ভাগ শ্রমিককে শ্রম-আইনের বাইরে নিয়ে এসে গেছে। অপর দিকে যেটুকু আইন থাকবে, সেটা প্রত্যক্ষ ভাবে মালিকদের স্বার্থরক্ষা করবে। যেমন ধর্মঘট, ট্রেড ইউনিয়ন করা, মজুরির প্রশ্ন, গিগ-প্ল্যাটফর্ম শ্রমিক-সহ অজস্র শ্রমিকদের বিরুদ্ধে আইনকে দাঁড় করানো, ইত্যাদি। এক কথায় একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থে ফ্যাসিস্ট শক্তি তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা নিয়ে দাঁড়াবে। কোনো মতেই যেন শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হতে না পারে। এটা আরো ভালো ভাবে লক্ষ করা যাবে গুজরাটে। এই পর্যায়ে দুটি রাজ্যে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন তুলনামূলক ভাবে সক্রিয়, গুজরাট ও তামিলনাডু। এ দেশে চারটি শ্রম কোড আইনে রূপ পাওয়ার পরও দেশব্যাপী শ্রমিকদের নানান প্রতিবাদের জন্য আজো শ্রমবিধি তৈরি হয়নি। ফলে চারটি শ্রম কোডকে প্রায়োগিক স্তরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই অন্তত একটি ক্ষেত্রে আট ঘন্টার জায়গায় ১২ ঘন্টা কাজের জন্য অর্ডিন্যান্স গুজরাট সরকার লাগু করেছে। অথচ সপ্তাহে ৪৮ ঘন্টায় কাজের কথাও লেখা আছে। তার মানে এক দিকে দৈনিক ১২ ঘন্টা কাজকে আইনত বৈধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে, অপর দিকে সপ্তাহে চার দিন কাজ করতে হবে। এখন, একটা শিল্প তো তিন দিন বন্ধ রাখা যাবে না! ফলে এই অর্ডিন্যান্সের ফলে বাকি দু'দিন বেআইনি প্রক্রিয়াকে আইনি প্রক্রিয়া করে দেওয়া হলো। ফ্যাসিস্ট শক্তির আঁতুড়ঘর গুজরাট। তাই গুজরাটে অর্ডিন্যান্স করে তারা দেখে নিতে চায় ১২ ঘন্টার কাজকে আইনত বৈধ করলে সমাজ জুড়ে তার কি প্রতিক্রিয়া হয়। আর সেই জন্যই এই অর্ডিন্যান্স। এক কথায়, শ্রম কোড আনার পিছনে এটাই বিজেপি-র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। এক দিকে যেমন বেশির ভাগ শ্রমিককে আইনের আওতার বাইরে নিয়ে যাওয়া, অপর দিকে যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে তা দিয়ে আরো জোরের সাথে একচেটিয়া বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষা করা।
এখন প্রশ্ন হলো, এর বিরুদ্ধে লড়াইটা কিভাবে গড়ে উঠবে? প্রতিরোধ কিভাবে করবে শ্রমিক শ্রেণি? এই আলোচনায় যাবার আগে আমাদের দেশের শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা ও শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে একটু কথা বলে নিতে হবে।
দীর্ঘ দিন ধরে শ্রমিক আন্দোলন একটা ভাটার পর্বের মধ্য দিয়ে চলছে। এক দিকে পুঁজিপতি শ্রেণির নিত্যনতুন, একচেটিয়া হামলা চলছে, সেই সঙ্গে উৎপাদনের পদ্ধতির পরিবর্তন হচ্ছে, অপর দিকে দীর্ঘ লড়াই করে শ্রমিকশ্রেণি যে অধিকার অর্জন করেছিল সেগুলি আস্তে আস্তে হাতছাড়া হচ্ছে। আজকের শ্রম কোডে যে সব অধিকার ধরে রাখার জন্য লড়াই করা হচ্ছে, বাস্তবে সেগুলো হারানোর প্রক্রিয়া অনেক দিন ধরেই সমাজ জুড়ে চলছে। যেমন স্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ প্রথা রদ, চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ ও ঠিকা শ্রমিক বৃদ্ধি, কাজের ঘণ্টা বৃদ্ধি, কাজের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অবাধ ছাঁটাই-সাসপেন্ড, মজুরি কমানো, ধর্মঘট-সহ যে কোনও শ্রমিকদের লড়াইয়ের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, ইত্যাদি। তথ্যপ্রযুক্তি থেকে শুরু করে যে কোন ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প, পরিষেবা শিল্প সর্বত্র অস্থায়ী শ্রমিক ও কাজের ঘণ্টা বৃদ্ধি করা হয়েছে। নতুন ধরনের শ্রমিক, যেমন গিগ শ্রমিক, প্ল্যাটফর্ম শ্রমিকদের আইনি অধিকার দেওয়া হয়নি। গৃহশ্রমিক থেকে মিড ডে মিল কর্মচারী, এদের জন্য কোনো আইন নেই। এক কথায়, কোটি কোটি মানুষ শ্রম দিচ্ছেন, সম্পদ তৈরি করছেন অথচ তাঁদের সুরক্ষার জন্য কোনো আইন নেই। শ্রমিক আন্দোলনের এই ভাঁটার সময়ে এক দিকে দীর্ঘ দিন আগে অর্জিত অধিকারগুলি হারাচ্ছেন, অপর দিকে অজস্র যে নতুন 'শ্রমিক' যোগ দিচ্ছেন নানা ধরনের কর্মক্ষেত্রে, নানা ধরনের শর্তে, তাঁদের জন্য কোনো আইনি ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এই হচ্ছে আজকের শ্রমিক আন্দোলনের অবস্থা। কোথাও যে লড়াই বা প্রতিরোধ হচ্ছে না তা নয়, কিন্তু তা সামগ্রিক পরিস্থিতিকে স্পর্শ করতে পারছে না। এই হচ্ছে আজকের শ্রমিক আন্দোলনের পরিস্থিতি। একটা প্রশ্ন আসবেই— এই তো কিছু দিন আগে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট হয়ে গেল। সেখানেও তো প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কিছু ছবি পাওয়া গেছে। তা হলে? হ্যাঁ, এটা সত্য যে বিজেপি বাদে প্রায় সমস্ত সংসদীয় রাজনৈতিক দল ও তাদের পরিচালিত ইউনিয়ন, অজস্র ছোট ছোট ট্রেড ইউনিয়ন, নকশালপন্থীদের বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, নানা ধরনের স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন এই ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাতে একটা রাজনৈতি

শনিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২৫

গ্যাপ ~ সুনৃতা মাইতি

অপর্ণার মন খুব খুব  খারাপ। শরীরও জুতের নেই। দুগ্গা পুজো হয়ে দীপাবলি, এত পরিশ্রম গেছে যে বলার নয়। উৎসবের দিনকাল মানেই বাড়ির মানুষদের বাড়িতে সকাল থেকে রাত্তির পর্যন্ত পায়ে পা তুলে জেঁকে বসে থাকা তো শুধু নয়, আত্মীয়স্বজনদের যাওয়া আসাও  লেগে থাকে। আনতাবড়ি খাটতে খাটতে  অবস্হা কেরোসিন! শরীর এসব সয়ে নেয়, তার অভ্যেস আছে। বাকি রইল মন। সেও অনেক কিছু সইতে সইতে আজকাল শক্তপোক্ত হয়ে গেছে। নারকোলের মত। ভেতরের সারজলটুকুর সন্ধান পেতে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়। কিন্তু মনের ওই নরম জায়গাটাতে যদি আঘাত লাগে তবে কি আর সহ্য হয়! সে কি সত্যি খারাপ! খারাপ মা? তার মেয়ে তার পিঠপিছে সেটাই বলেছে! মানে ঠিক বলেনি, লিখেছে। সেইটা আবার অপর্ণার গোচরে এসেছে।

লে দে কে অপর্ণার একটিই তো সাফল্য। তার একমাত্র সবেধন নীলমণি মেয়ে শ্রীতমা। বিটস পিলানিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে, পড়াশোনায় যেমন ভাল, তেমনই দুর্দান্ত ফ্যাশানিস্তা। রাস্তায় বেরোলে লোকে হা করে তাকিয়ে থাকে। দীপাবলির ছুটিতে বাড়ি এসেছে। এসেই এমন সব ধুন্ধুমার ড্রেস পড়েছে যে বাড়িতে তার বাবার  সাথে চুলোচুলি হতে বাকি ছিল। অপর্ণা অতি কষ্টে ওই রক্ষনশীল ভদ্রলোক ও মেয়েকে যুগপৎ সামলেছে। মেয়ে পোশাকের ব্যাপারে মঝঝিম পন্থা নিতে বাধ্য হয়েছে মায়ের মধ্যস্থতায়। কিন্তু তাও তার বাপ ব্যাটামানুষের কি রাগ! গজগজ করতে করতে শাশুড়ি মায়ের কাছে কাঁধ মানে পাতি বাংলায় কন্ধা খুঁজতে গিয়েছিল। এদিকে অপর্ণার শাশুড়ি মাও বয়স বাড়ার সাথে সাথে আজকাল হেভি সেয়ানা হয়ে গেছেন। কোন দিকে যাবেন বুঝতে না পারলে বুড়ি আজকাল কানে কম  শোনার একটিং শুরু করেন। সেটাতে কাজ না হলে বলতে থাকেন," হরি বোল! হরি বোল! " যখন ইয়ে বয়স ছিল,সাংঘাতিক সব গা জ্বালানি কমেন্ট করতেন, যাকে বাঙাল ভাষায় বলে, চিমটাইন্যা কথা। আর খুব আস্তে বলতেন ,এত আস্তে যে খুব কাছাকাছি থাকা মানুষরাই শুনতে পেত। অপর্ণার বড় জা মৃদুলা সেই মন্তব্য শুনলেই হাউ হাউ করে দাপাদাপি করে উঠত।  পাড়াশুদ্ধ মানুষ বলত ," আহা! শাশুড়ি মানুষটি কি শান্তিপ্রিয়! গলা পর্যন্ত শোনা যায়না! বড়  বৌ কি দজ্জাল দেখো! "

তারপর তো বড় ভাসুর ও জা আলাদা হয়ে যায় তাদের যৌথ সংসার থেকে। অপর্ণা বরাবরই শান্ত ও ধৈর্যশীল মেয়ে। সবাইকে খুশি করেই চলার চেষ্টা করেছে বরাবর। তাতে অবশ্য ভালই হয়েছে। সকলেরই বিষদাঁত সময়ের সাথে সাথে নড়বড়ে হয়েছে। সব ক্ষত ভুলে সেও একদিন নিজের মত করে জীবনটাকে দেখতে পেরেছে, সাজতে গুজতে পেরেছে, নিজের মত শান্তিনীড় তৈরি করার চেষ্টা করতে পেরেছে। 

কিন্তু মেয়ের ব্যাপারটা ভাবলেই তার চোখ জলে ভিজে উঠছে।রাতে ঘুমোতে গিয়ে সে বার বার তার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করছে, 

"হ্যাঁ গো, এটা কি সত্যি ? মেয়ে তার হোয়া স্ট্যাটাসে তাই লিখেছে! সারা দুনিয়াকে জানিয়েছে,তার মা খারাপ! হ্যাঁ গো,আমি এত খারাপ!"

তার স্বামী চোখ ছোট ছোট করে কূটনী ভঙ্গিমায় বলেছে,

" তবে আর বলছি কি! নিজের চোখে দেখেও তোমার বিশ্বাস হলনা! যাগ্গে, বাদ্দাও। কবে বিয়ে হবে, কবে জামাই হবে! ওই নিয়ে ভেবে কাজ নেই।"

আসলে কিনা তার  কলিজার টুকরো মেয়ে  হোয়া স্ট্যাটাসে তার সামাজিক বায়োডাটা দিয়েছে, তাতে নিজের প্রোস আর কোন্স দিয়েছে। মজা করেই দিয়েছে হবে। মানে তাকে যে বিয়ে করবে, কী কী ভাল - মন্দের সম্মুখীন হবে আর কি। ওই আগাম ঘোষণার মত। আজকালকার নতুন জেনারেশনের ছেলেমেয়েরা মানে যাদের জেন জি বলা হয় তারা এইরকম খুল্লামখুল্লা। মেয়ের ভালর মধ্যে লিখেছে, বয়ফ্রেন্ড একটি ফ্যাশন সচেতন মেয়ে পাবে, ভাল মনের মেয়ে পাবে, আবার খারাপের মধ্যে সে খুব এক্সপেনসিভ, মাথা গরম পদী ইত্যাদি। ফেলু গোয়েন্দা বাপ ডজন খানেক ফেক একাউন্ট খুলে সারাক্ষণ মেয়েকে সোস্যাল মিডিয়ায় স্টক করে বেড়ায়। মেয়ে বিপথে যাচ্ছে কিনা তাই নিয়ে বেজায় ভয় লোকটার। ফেসবুক, ইনস্টা, লিংকডিন তো বটেই, হোয়াতেও নজরদারি বাদ নেই। তাই ওই বাপের চোখেই এই স্ট্যাটাস পড়েছে। ওই বায়োডাটার মধ্যে একটা পয়েন্ট ছিল, জামাই একজন খারাপ শাশুড়ি পাবে। ভালয় না মন্দয়? প্রোসে না কোনে? ঠিক মনে নেই! দেখতে দেখতেই চোখটা ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল কিনা!এইসব ভাবতে ভাবতেই অপর্ণা পরিষ্কার বুঝতে পারে, তার উপচে পড়া দুই চোখ আর জল ধরে রাখতে পারছে না। চোখ মুছতে মুছতে সে মেয়ের ঘরের দিকে রওনা হয়। না না, রাত বারোটা হোক কিংবা একটা এখনই তার ক্লিয়ার পিকচার চাই। যাকে গোদা বাংলায় ক্ল্যারিটি বলে। কীসে ভুল হল তার! মেয়ের কাছে  খারাপ কেন হল সে! তার এতদিনকার সব শ্রম কি বৃথা!

কিছুক্ষণ পর একজন মেয়ের সামনে গিয়ে একজন মাকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে শোনা যায়,

"হ্যাঁ রে, আমি এত খারাপ! এত ব্যাড? তোর বর যে হবে, সে ব্যাড শাশুড়ি পাবে?  ছিঃ!"

"যাব্বাবা! আমি আবার তোমাকে ব্যাড কোথায় বললাম?"মেয়ে ঘুম চোখে আকাশ থেকে পড়ে।

"বলিসনি! ওই যে স্ট্যাটাসে লিখেছিস ,মনে নেই! ইউ ক্যান গেট আ ব্যাডি মাদার ইন ল!বাবা ভাগ্যিস দেখাল,তাই জানলাম!"

মেয়ে বিছানা থেকে অতি কষ্টে বডি তুলে বিরক্ত গলায় বলে, "ফাইন!এতই যখন দেখেছ, ব্যাডের পাশে ডি আর ওয়াই টা  আন্দেখা করছ কেন! ওটা ব্যাডি ছিল।"

"দেখেছি। ব্যাডি। তোর ঠাকুমা হলে বলত, ব্যাডের স্ত্রী লিঙ্গ হবে। আমি যদ্দুর জানি, ওর মানে ক্রিমিনাল গোছের কিছু। " মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে।

"বেশ! অনেক বুঝেছ। তাহলে দয়া করো। আমাকে ঘুমোতে দাও। আর পারলে গুগল করে দেখে নিও মানেটা। "বলেই মেয়ে পাচন গেলা মুখে কী সব বিড়বিড় করতে করতে বালিশে মাথা রাখে।

অপর্না নাক টানে, ভাল ভাবে চোখ মোছে আর তড়িঘড়ি ঘরে এসে মোবাইল নিয়ে ভালভাবে গুগল করে বিস্ফারিত নেত্রে দেখে ব্যাডি আদতে স্ল্যাং এবং এর দুটো অর্থ। এর একটি, জেন জি এর ভাষায় ,কনফিডেন্ট, স্টাইলিশ আর অ্যাটরাকটিভ! কি কেলো! উপরে চোখ তুলে সে ভাবে,এ যে ইয়েদের ভাষায়, হ্যারি হে ডিনোবন্ডু কেস! সে কী বুঝতে কী বুঝেছে!

তার মেয়ে মা সম্পর্কে এই ভাবে! বুকে একরাশ প্রজাপতি ওড়াওড়ি করে তার। এই ডানা ঝাপটানো হৃদয় নিয়ে সে মোবাইলে আবার চোখ রাখতেই দেখে পিরিং করে মেসেঞ্জারে গভীর রাতের মেসেজ ঢুকেছে, "বি টি ডাবলু, ইউ লুক গুড ইন শাড়ি।"

হাসি হাসি মুখে সে ভাবে,তাই না তাই! কিন্তু বি টি ডাবলু আবার কী কেস রে বাবা!

পুলিশের ডাক ~ অনিমেষ বৈশ্য

আমাদের পাড়ায় একটি পুলিশ ফাঁড়ি ছিল। ফাঁড়ির উঠোনে একটি কাঁঠালগাছ। পাশে একটি ছোট শিবমন্দির। আমরা সেই মন্দিরের চাতালে বসে দিনরাত তাস পিটতাম। মাঝে-মাঝে দু-একজন পুলিশ উনুনে ভাত চাপিয়ে আমাদের সঙ্গে দু-হাত তাস খেলে নিতেন। এক বিশাল চেহারার পুলিশ থেবড়ে বসে কুটনো কুটতেন। আর একজন পুলিশের নাম মনে নেই। তাঁর বয়স ছিল কম। তিনি হেমন্তের সকালে রোদে পিঠ দিয়ে নিশ্চিন্তে উল বুনতেন। কার জন্য বুনতেন জানি না। তখনও রেডিমেড সোয়েটারের যুগ আসেনি। মা-মাসি-পিসি-দিদিমণি সবার হাতে থাকত উলের কাঁটা। কিন্তু একজন তাগড়াই চেহারার পুলিশ তাঁর কর্মস্থলে উল বুনছেন, এ দৃশ্য আমি কখনও দেখিনি। শীর্ষেন্দু মুখুজ্জে জানতে পারলে ওঁকে নিয়ে একটা দারুণ গল্প লিখে ফেলতেন। আমি লিখতে পারি না বলে পাঠকরা বঞ্চিত হলেন। 
এই পুলিশ ফাঁড়ির পত্তন হয়েছিল সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে। জরুরি অবস্থার আশপাশে। আমরা তখন ইস্কুলে পড়ি। নেহাতই কচিকাঁচা।

তখন থেকেই ফাঁড়ির পুলিশের সঙ্গে পাড়ার ছেলেদের নিদারুণ সদ্ভাব। এক পুলিশের নাম ছিল রাখাল। বিশাল চেহারা। তাঁর ছেলে রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনে পড়ত। রাখালপুলিশকে আমার এক জেঠামশাই ছোট একটু জায়গা দিয়েছিলেন। তিনি সেখানে পর্ণকুটির তৈরি করে সপুত্র বসবাস করতেন। রাখালপুলিশকে উর্দি পরা অবস্থায় কমই দেখেছি। তিনি কাছে থাকলে চোরেরা স্বস্তি পেত। চোরের মনে হতো, ইনি পুলিশ হবেন কোন দুঃখে? যেন বাড়ির লোক লক-আপে ট্যাংরা মাছ রেঁধে এনেছেন। রাখালপুলিশকে আমরা কাকু বলে ডাকতাম। তাঁর শরীর ও মনে পুলিশের অংশ ছিল সামান্যই। তিনি ছিলেন যাত্রার অভিনেতা। শিবরাত্তিরে ফাঁড়ির সামনের মাঠে হ্যাজাক জ্বেলে যাত্রা হতো। কোনও একটা পালায় দীর্ঘদেহী রাখালকাকুকে শিশুর মতো কাঁদতে দেখেছি। বোধহয় সাবিত্রী-সত্যবান পালায়। তিনি কার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, মনে নেই। সাবিত্রী হওয়াও বিচিত্র নয়। বসন্তকালে বিরহের পালা দেখে আমাদের তনুমন শিরশির করত। চৌদিকে বাতাসের হু হু আর কোকিলের কুহু। পুলিশ যে বসন্তের দূত হতে পারে, এ কথা পাঁচকান হলে পুলিশেরই চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে। কিন্তু গাঁ-গেরামের খবর পুলিশের বড় কর্তারা রাখতেন না। ফলে নিরবচ্ছিন্ন শান্তিতে পুলিশকর্মীরা কালাতিপাত করতেন। শিবরাত্রির বহু আগে যাত্রার মহড়ার হু হু হা হা শুনে তস্করেরও বুঝি বুক কেঁপে উঠত। ফাঁড়ির পিছনে ছিল আকন্দের ঝোপ। বনতুলসী, আসশেওড়া, নিসিন্দার ঝোপঝাড়ও ছিল ইতিউতি। সেই সব গহিন ঝোপঝাড়ে একটা লম্বা কালো পাখি রক্তকরবী-র রাজার মতো গম্ভীর গলায় ডেকে যেত। তাকে দেখা যেত কম। আমাদের জীবনে তখন নন্দিনী আসবে-আসবে করছে। একটু উতল হাওয়া দিলেই ঝিমধরা ভালোলাগা চৌদিকে। ফিসফিসিয়ে হাওয়াকে বলতে ইচ্ছে করত, ধীরে বও, ওগো ধীরে বও।

ফাঁড়িতে খান কতক রাইফেলও ছিল। শেষ কবে ওই রাইফেলের গুলির শব্দ শোনা গেছে, তার কোনও হিসেবনিকেশ নেই। আমরা মাঝে-মাঝে সেই রাইফেলের হিমশীতল শরীর স্পর্শ করে নিজের জীবনযৌবন সার্থক করেছি। কিছুদিন পরে দেখলাম একটা রাইফেলও নেই। কালী পুলিশ বলে একজন রাগী পুলিশ ছিলেন। একদিন দিনমানে ফাঁড়ির ভিতর থেকেই তাঁর সাইকেল চুরি যায়। এই চুরির খবর বোধহয় বড় কর্তাদের কানে পৌঁছেছিল। তার পর থেকেই ফাঁড়িতে রাইফেল রাখার আর কোনও দরকার মনে করেননি কর্তারা। রাইফেলের বদলে বাঁশি আর বেহালা হলে পালা বোধহয় আরও জমে উঠত। 

একদিন রাখালকাকুর বাড়ির সামনের মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বাঁশঝাড়ের দিক থেকে হাওয়া বইছে। শীতকাল। ধানের শীষে সোনালি রং লেগেছে। ফড়িং উড়ছে। সদ্য লাঙল দেওয়া মাটি থেকে গন্ধ আসছে ভুরভুর। কোন একটা গানের দু-লাইন গেয়ে উঠেছিলাম, মনে নেই। হঠাৎ দেখি রাখালকাকু একটা নিমের দাঁতন মুখে নিয়ে বললেন, 'কী রে কচি, পালায় গান গাইবি?' আমি তো চমকে উঠলাম। বলে কী? পালায় গান গাইব? বললাম, 'আমি তো গান গাইতে পারি না।' রাখালকাকু বললেন, 'এই যে গাইলি।' গান গাওয়া আর গান গাইতে পারা কি এককথা ? কিন্তু রাখালকাকুকে কে বোঝাবে সে-কথা। আমি দৌড় লাগালাম। রাখালকাকু বলে চলেছেন, 'আরে শোন, পালাচ্ছিস কেন? নিমাই সন্ন্যাস পালা হবে। ওই দেখো।'

আমি ছুটছি। পুলিশকাকুও ডেকে চলেছেন, 'আরে শোন। এই কচি।' আমি ছুটছি। এই প্রথম পুলিশ দেখে ভয় লাগছে। পায়ের নীচে শুকনো বাঁশপাতা। ধানগাছের হাওয়া লাগছে গায়ে। ওই তো সোনাডাঙ্গা মাঠ, ওই যে পদ্মফুলে ভরা মধুখালি বিল, ওই যে বীরু রায়ের বটতলা...।

মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি। চলে...চলে...এগিয়েই চলে। দূরে পুলিশের বীণ শোনা যায়।

বুধবার, ৫ নভেম্বর, ২০২৫

রবীন্দ্রনাথ বুর্জোয়া কবি - বামপন্থীদের গালাগালি একটি ফ্যাক্ট চেক ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

-"রবীন্দ্রনাথ বুর্জোয়া কবি - বামপন্থীদের গালাগালি একটি ফ্যাক্ট চেক"-

বামপন্থীরা (বা কমিউনিস্টরা) রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া বলে গালাগালি করেছিল - দক্ষিণপন্থীদের দ্বারা এই বহুল প্রচারিত কুৎসা নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। আসলে এটি একটি অর্ধ সত্য (যা কিনা মিথ্যার চেয়েও ভয়ানক।  হ্যাঁ, বলা হয়েছিল। কে বলেছিলেন, কোথায় বলেছিলেন দেখে নেওয়া যাক। 

'মার্কসবাদী' নামক পত্রিকায় "বাংলা প্রগতি সাহিত্যের আত্মসমালোচনা" শীর্ষক প্রবন্ধে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম নেতা (তখনও সিপিআইএম এর জন্ম হয় নি), বুদ্ধিজীবী প্রাবন্ধিক প্রয়াত ভবানী সেন (রবীন্দ্র গুপ্ত ছদ্মনামে ) রবীন্দ্রনাথের যে মূল্যায়ন করেছিলেন তাতে বুর্জোয়া, ভাববাদী ইত্যাদি শব্দ আসে [সূত্র: ধনঞ্জয় দাশ সম্পাদিত 'মার্ক্সবাদী সাহিত্য: বিতর্ক'; প্রথম খন্ড, নতুন পরিবেশ প্রকাশনী]। 

প্রথম কথা ভবানী সেন কবিকে বুর্জোয়া বলার ঢের আগে কবি'র সর্ম্পকে এই মূল্যায়ন চালু ছিল। রবীন্দ্রনাথ নিজে নিজেকে শ্রেনী অবস্থানের দিক থেকে কি ভাবতেন, সেটাও একটু দেখে নেওয়া যাক। ১৭.০৩.১৯৩৯ এর চিঠিতে অমিয় চক্রবর্তীকে তিনি লিখছেন - "যখন ময়মনসিংহগীতিকা হাতে পড়ল, খুব আনন্দ পেয়েছিলুম। শ্রেনীওয়ালাদের মতে এসব কবিতা হয়তো বা প্রোলিটেরিয়েট, কিন্তু আমি তো জাত - বুর্জোয়া, আমার ভালো লাগতে একটুও বাধে নি।" [রবীন্দ্রনাথ, চিঠিপত্র]। 

দ্বিতীয় কথা এই যে কবি সম্পর্কে ভবানী সেনের এই মূল্যায়ন ছিল লেখক হিসেবে সেনের একান্ত একক সিদ্ধান্ত, উনি কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র ছিলেন না বা ওই মূল্যায়ন পার্টির সামগ্রিক সিদ্ধান্তও ছিল না। এর প্রমাণ আমরা পাই অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির আরেক নেতা, পরবর্তীকালে সাংসদ হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এর লেখা থেকে। 

২২সে জুন ১৯৪১ সালে হিটলার দ্বারা সোভিয়েত ভূমি আক্রান্ত হওয়ার পর পরই তাঁর এবং স্নেহাংশু আচার্য, জ্যোতি বসু, গোপাল হালদার চিন্মহণ সেহানবীশ প্রমুখ কমিউনিস্টদের উদ্যোগে গড়ে ওঠে ফ্রেন্ডস অফ সোভিয়েত ইউনিয়ন বা সোভিয়েত সুহৃৎ সমিতি। ড: ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রখ্যাত বামপন্থী নেতা এর সভাপতি হন। 

সদ্য স্থাপিত সমিতির পক্ষ থেকে সুরেন গোস্বামী গেলেন শান্তিনিকেতনে - রবীন্দ্রনাথের স্বাস্থ্য তখন ভেঙ্গে পড়েছে, কিন্তু তাঁর আশীর্বাদের বড় প্রয়োজন ছিল সমিতির। কবি রাজি হলেন সমিতির পৃষ্ঠপোষক হ'তে, তবে সাবধান করে দিয়ে বললেন যে, ইংরেজ নিজের স্বার্থে সোভিয়েতকে সাহায্য করবে বলছে বটে, কিন্তু "বিশ্বাস কোরো না ওদের; তোমরা কমিউনিস্টরা ওদের বিরুদ্ধে লড়াইতে গা-ঢিলা দিয়ো না।" কমিউনিস্ট পার্টির ও চিন্তা তখন ঐরূপই ছিল - তাই সুরেন বাবু দেখালেন রবীন্দ্রনাথকে পার্টির সদ্য গৃহীত প্রস্তাব, কবি পুলকিত হলেন। [সূত্র: হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় , তরী হতে তীর, মনীষা গ্রন্থালয়]।

তৃতীয় কথা এই যে, পরবর্তীকালে স্বয়ং ভবানী সেন তাঁর অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে আসেন সেটা তার লিখিত "একজন মনস্বী ও একটি শতাব্দী" শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করলেই জানা যায়। একটু ছোট্ট অংশ উদ্ধৃত করা যাক। "স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে - ভাববাদ যদি জীবন্ত সত্যের বিরোধী ই হবে তাহলে রবীন্দ্রনাথ কেমন করে ভাববাদের আশ্রয় থেকে জীবনের মহাসত্যকেই রূপ দিতে পারলেন, কেমন করে তাঁর পক্ষে সম্ভব হ'লো ভাববাদের ঊর্ধ্বে উঠে, যে সত্য বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের একান্ত নিজস্ব, তাকে উজ্জীবিত করা? এ প্রশ্নের একমাত্র উত্তর এই যে তিনি ছিলেন মহান শিল্পী, এবং মহান শিল্পীর সৃষ্টি প্রতিভার বৈশিষ্ট্যই এই যে সত্য তাঁর মধ্যে প্রতিফলিত হয়। তাই তাঁর মনের মধ্যে ছিল এমন একটি সত্যানুসন্ধানী আবেগ যা তাঁকে তাঁর দার্শনিক বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে তুলে ধরছে, অতিক্রম করে নিয়ে গেছে তাঁকে সেই ভাববাদী দর্শনের সীমা থেকে।" [সূত্র: নীলরতন সেন সম্পাদিত রবীন্দ্র বীক্ষা, এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি]

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ভবানী সেন আগের অবস্থান থেকে এতটাই সরে এসেছিলেন যে প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক নারায়ন চৌধুরী সেন মশাইকে বিদ্রূপ করে লিখেছিলেন, "হাওয়ামোরগের মত বায়ুর গতি বুঝে কেবলই যদি দিক বদলাতে হয় তাহলে তার মূল্যায়ন নামক অনুশীলনীর কোন সার্থকতা থাকে না" [সূত্র: সংস্কৃতি'  ৭১]

এই লেখা আর দীর্ঘায়িত না করে এবার শেষ করা যেতে পারে কবি'র জীবনের শেষ দিনগুলিতে গিয়ে। বঙ্গের কমিউনিস্টদের স্নেহের চোখে  দেখলেও কমিউনিজম এর স্বরূপ নিয়ে, সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে, সমাজবাদ  নিয়ে কবি'র মনে সংশয় ছিল।  শেষ জীবনে তার অবসান  ঘটে। সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রান্ত হওয়ার পর ছয় সাত সপ্তাহের বেশি তিনি বাঁচেন নি। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে কেবল জানতে চাইতেন যুদ্ধের খবর আর যে দেশে তিনি "লক্ষ্মীর কল্যাণী মূর্তি" দেখেছিলেন সেই সোভিয়েত দেশ এর জেতার সামান্য কোনো খবর পেলেও শিশুর মতো খুশি হতেন, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিস এর মতো অন্তরঙ্গ সহচরকে বলে গিয়েছিলেন যে, "সোভিয়েত কখনো হার মানবে না।" এক বিষন্ন শ্রাবণ দিনে কবি চলে গেলেন, ব্যাথাতুর দেশবাসীর মহাগুরু পতনের আঘাত সইল, উপায়ন্তর ছিল না, মৃত্যু তো অবধারিত ঘটনা । তবে কবির ঋষিবাক্য ব্যর্থ হয় নি, যে দেশে তিনি 'লক্ষীর কল্যানী মূর্তি' দেখেছিলেন সেই সোভিয়েত দেশ পরম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রমাণ করলো যে সমাজবাদ অপরাজেয় [সূত্র: চিন্মহণ সেহানবীশ, রবীন্দ্রনাথ ও বিপ্লবী সমাজ, বিশ্বভারতী প্রকাশ]।

 ফ্যাক্ট চেকটি শেষ হল।

রবিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৫

অঙ্ক আর বিপ্লবের ডুয়েল ~ শুভময় মৈত্র


[যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেই নিয়ে বিভিন্ন ঘটনা এবং লেখা বারবার ফিরে আসে ভাবনায়। যখনই সেখানে কোন অকাজে যাই, সেসব কেজোকথার শেষে বেরোতে বেরোতে সন্ধে। চারপাশে ঝকঝকে পড়ুয়াদের কলতান, পাখির কিচিরমিচির, একটু দূর থেকে ভেসে আসা বাসের হর্নের মধ্যে হঠাৎ করে সময়যানে ফিরতে হয় সাড়ে তিন দশক। অনেক কিছুর মতই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এরকম এক পুরনো লেখা, যা হয়তো দু-এক জায়গায় ছাপা হয়েছে আগে, তবে সেভাবে পেশাদারী কোন কাগজে নয়। তাই আর কারও কোন অনুমতি না নিয়েই আপনাদের সামনে আর একবার টুকেই দিলাম পুরনো সেই তথ্য আর কল্পনার মিশেল, দু এক জায়গায় অল্প এদিক ওদিক করে। গবেষণার ক্ষেত্রে হলে নিশ্চিত চাকরি যেত, ওই যাকে বলে কিনা সেল্ফ প্লেজিয়ারিজম। সেকথা থাক। আগে পড়েছেন সে সম্ভাবনা খুবই কম। আর পড়ে থাকলে তো এই অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পেয়েই গেলেন। লেখাটি আমাদের এক অতিপ্রিয় অঙ্কের মাস্টারমশাই অধ্যাপক তরুণ কুমার মুখার্জীর স্মৃতিতে, সংক্ষেপে যিনি পরিচিত ছিলেন টিকেএম নামে। বহু বছর আগে যখন এই লেখাটা প্রথম লিখি, তখন তিনি সকলের মধ্যেই ছিলেন। আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল এ বছরের জুলাই মাসে যখন নতুন করে এই লেখাটি খুঁজে পেতে রিভাইজ করছি, ঠিক তার কদিন আগেই ফ্রান্সের নির্বাচনে তৃতীয় থেকে একলাফে প্রথম স্থানে চলে এসেছে বামপন্থীরা। এই লেখার প্রেক্ষিত সেই ফ্রান্সকে নিয়েই, তবে দু-আড়াই শতক আগে।]  

ছিপছিপে লম্বা চেহারার তরুণ-বাবু হেঁটে যাচ্ছেন লাল চেয়ারের পাশ দিয়ে। শিরদাঁড়া সোজা, কাঁধে ঝোলান একটা সপ্তর্ষিমন্ডল আকারের আঁকড়া দেওয়া কাঠের ছাতা। এইট-বি বাস-স্ট্যান্ড এর দিক থেকে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে একটু বাঁ দিকে গেলে ছাত্র সংসদের অফিস। রাজ্যে বহু রাজনৈতিক পরিবর্তন সত্ত্বেও অতি বামদের দাপট এই কচি সংসদে কখনও কমে নি। সেখান থেকে সোজা হাঁটলে ডান দিকে খেলার মাঠ আর বাঁদিকে ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া লাল চেয়ার। থুড়ি জায়গাটা আছে, কিন্তু সিমেন্টে বাঁধানো সেই প্লাস্টিকের চেয়ার গুলো আর নেই। সময়টা আশির দশকের শেষ ভাগ, সেপ্টেম্বর মাস প্রায় ফুরিয়ে এসেছে - কলকাতায় পুজোর গন্ধ। স্যার অঙ্কের ক্লাস শেষ করে ফিরছেন। তাঁর হাঁটার গতির সঙ্গে তাল সামলাতে ছাত্রদের রীতিমত ছুটতে হচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে তাঁকে ধরে ফেলল প্রণব। সঙ্গে আমরা আরও অনেকে। যাদবপুরের ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্ররা। কি দুর্ভাগ্য যে প্রযুক্তি বা বিজ্ঞান যাই পড়ো না কেন, অঙ্কের হাত থেকে নিস্তার নেই। ক্লাসে পরীক্ষার খাতা দিয়েছেন তরুণবাবু। আমাদের মত পরীক্ষায় নিয়মিত গাড্ডু খাওয়া ছেলেদের ধান্দা কি করে দু-এক নম্বর বাড়ানো যায়। "স্যার, এখানটা কেন কেটেছেন? আর একটু নম্বর কি এখানে বাড়ত না? আর এক নম্বর বাড়লেই আমার চল্লিশ হয়ে যেত", ইত্যাদি ইত্যাদি। তরুণবাবু রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কারো নম্বর বাড়িয়ে দিচ্ছেন, কাউকে বা একটা ছোট্ট ধমক। উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম হওয়া প্রণবের বক্তব্য অবশ্য অন্য। সে পুরো নম্বর পেয়েছে। কিন্তু তার একটা অঙ্কে সামান্য ভুল আছে, সেখানে স্যার নম্বর কাটেন নি। সে তাই নম্বর কমাতে ছুটেছে। প্রণবের দাবী শুনে চোখ কুঁচকে তাকালেন তরুণবাবু। "বুঝলে হে ছোকরা, অঙ্কের কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল সেটা বোঝার মত বয়স তোমার এখনো হয় নি। যোগ বিয়োগে ভুল হলেই নম্বর কাটা যায় না। ঠিকঠাক বুঝেছ কিনা সেটা দেখতে হয়। তুমি ভেবো না যে আমি মন দিয়ে খাতা দেখি নি। তোমার ভুলটা কোন ভুল-ই নয়। এ বয়েসে মানুষ তো কতরকমের ভুল-ই করে। কিন্তু কোন এক মে মাসের শেষ দিনে তোমাদের বয়সী একটা ছেলে যা ভুল করেছিল সে কথা ভাবলে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।"





আমাদের চোখ চকচক করে উঠল। তার মানে গল্প আছে। আমাদের বয়সী, অর্থাৎ ঊনিশ-কুড়ি। স্যারের গৌরচন্দ্রিকা মানে তো অঙ্কের কোন এক মস্তান লোকের জীবন নিয়ে জমজমাট আলোচনার সূত্রপাত। কিন্তু এত অল্প বয়েসের কে সেই লোক যার ভুল কিনা স্যারের মন খিঁচড়ে দেয়? সে আবার কি গোলমাল পাকাল? স্যারের গল্প কত বছর আগের কে জানে! ঘটনা সুদূর অতীতে যাই হোক না কেন, ঘটমান বর্তমানে আলগা ঘামে ভেজা বিকেলটা যে অসাধারণ কাটতে চলেছে সেটার একটা ক্ষীণ আভাস পাওয়া গেল। ততক্ষণে আমরা লাইব্রেরির কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। ডানদিকে ঘুরেই বউদির ক্যান্টিন। স্যারের পয়সায় হাতে গরম ফিসফ্রাই, বিকেলের শেষ রোদ্দুর আর তার সঙ্গে হাত ধরাধরি করে হেঁটে বেড়াবে অঙ্ক আর ইতিহাস। ফাটা প্লাস্টিকের টেবিলের পাশে গোল করে রাখা চার পাঁচটা চেয়ার। স্যারকে ঘিরে আমরা বসে পড়লাম। প্রণব, সুমিত, অরিন্দম, দেবজ্যোতি আর আমি। অঙ্কের নম্বরের নিরিখে বেশি থেকে কম, একশো থেকে আঠেরো।

"সে ছোকরা জন্মেছিল ১৮১১ সালের ২৫শে অক্টোবর। প্যারিসের দক্ষিণ শহরতলীতে বর‍্যো-লা-রেইন নামের একটা ছোট্ট জায়গায়। ১৭৯২ সালে ফরাসী বিপ্লবের সময় এই জায়গার নাম বদলে রাখা হয়েছিল বর‍্যো-লা-এগালিতে, অর্থাৎ সমতার কথা ঢুকে গেছিল নামের মধ্যে। বিপ্লব দীর্ঘজীবি হল, তবে সে ইতিহাস গত হলে পুরনো নামটা আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছিল ১৮১২ তে। নাহ, অনেকক্ষণ তোদের ঝুলিয়ে রেখেছি। সে সময়ের গোটা প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে। এবার বলেই ফেলা যাক, লোকটার নাম এভারিস্তে গ্যালোয়া। শুনেছিস কেউ?" তুমি থেকে ততক্ষণে আমরা তুই হয়ে গেছি। ফলে বোঝা গেল যে স্যারের মেজাজ দারুণ ফুরফুরে। তার মানে গল্প জমবে এবং কিছুক্ষণ পরে আর একবার চা সিঙ্গারার সম্ভাবনা প্রবল। বাংলা বানানে 'ণ'/'ন' না জানলে আমরা যেমনভাবে মাঝামাঝি লিখি সেরকম একটা মুখের ভাব করছিলাম। কিন্তু প্রণব এখানেও একশো। "হ্যাঁ স্যার জানি। অঙ্কের যাদুকর, মৃত্যু ডুয়েল লড়তে গিয়ে। ৩১শে মে, ১৮৩২, মাত্র ২০ বছর বয়েসে। ইতিহাসে কিছু বিতর্ক আছে, কিন্তু এরকম শোনা যায় যে মৃত্যুর আগের রাতে সে শেষ করে যায় এক অসাধারণ গবেষণা, যেটা গণিতজ্ঞদের মধ্যে গ্যালোয়া ফিল্ড নামে প্রসিদ্ধ।"

— "তাহলে তোরা সবই জানিস। কালকে ক্লাসে ওটাই পড়াব।" স্যার প্রায় উঠে পড়লেন। "না না স্যার, কিচ্ছু জানি না, সত্যি বলছি।"  হৈ হৈ করে আমরা লাফিয়ে উঠলাম। আমাদের দৃষ্টির আগুনে দুর্দান্ত ফরসা প্রণব ততক্ষণে ম্লানমুখ লুকোনোর জায়গা খুঁজছে। বারো ক্লাসে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে এক নম্বরে থেকে শান্তি হয় নি, সঙ্গে কোথাকার কোন ফরাসী গণিতজ্ঞ, সে ব্যাটাকেও গুলে খেয়েছে। আর তার জন্যে কিনা জমজমাট একটা ধারাবিবরণীর সঙ্গে চা সিঙ্গারা ফসকে যেতে বসেছে। যাদবপুরের বিশাল খেলার মাঠের দিক থেকে পথ খুঁজে নেওয়া টুকরো হাওয়া, ঝিল পেরিয়ে পাঁচিলের ওপারে রেল লাইন থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসা ট্রেনের ঘটঘট, সঙ্গে প্যারিসের রাস্তায় মনে মনে হেঁটে বেড়ানো, এতো কিছু একসঙ্গে দফারফা হয়ে যাওয়ার যোগাড়। স্যার উঠে দাঁড়িয়েছেন, পাশে প্রণব-ও। প্রণবের কাঁধে হাত রাখলেন স্যার। "তোর হবে। যা চা বলে আয়।" সমান লম্বা দুজন মানুষ। একই রকম ছিপছিপে চেহারা। একজন প্রায় ষাট, অন্যজন তার তিন ভাগের এক ভাগ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমরা। আমার অঙ্কে আঠেরো পাওয়া ভাঙ্গা মন ততক্ষণে দুঃখ ভুলে প্যারিসের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া শ্যেন-এর ঘোলা জলে ছলাত-ছল। (এবার অলিম্পিকে যার ওপর শোভাযাত্রা সহকারে উদ্বোধন, অর্থাৎ যখন এই লেখা রিভাইজ করছি সেই সময়।) অঙ্কে গোল পেলে কি হবে, ভূগোলে আমাকে হারায় কে? আমি তো ইতিমধ্যে হাঁটা লাগিয়েছি প্যারিসের পোড়া ইঁট সাজানো সরু গলিপথে।

— "গ্যালোয়ার বাবা উদারপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অষ্টাদশ লুই যখন ১৮১৪ সালে ক্ষমতায় ফিরে এলেন তখন তিনি গ্রামের মোড়লও হয়েছিলেন। গ্যালোয়ার মা ছিলেন জজের মেয়ে। ছোটবেলায় ছেলের পড়াশোনা তাঁকেই দেখতে হতো, স্বামী মোড়ল হলে যা হয় আর কি। ঠিক বারো বছরে ইশকুলে ঢোকে গ্যালোয়া। বছর-দুই ল্যাটিন আর পুরনো সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা ভালই চলছিল, কিন্তু এর মধ্যেই অঙ্কের নেশা তাকে পেয়ে বসে। হাতের কাছে পেয়ে যায় আর এক ফরাসী গণিতজ্ঞ অ্যাড্রিয়েন-মেরী লেজেন্ডার-এর (১৮ সেপ্টেম্বর ১৭৫২ — ১০ জানুয়ারী ১৮৩৩) লেখা জ্যামিতির বই। তোরা যেমন করে ফেলুদা পড়িস, সেই গতিতে জ্যামিতির ঐ কঠিন বই এক নিঃশ্বাসে নামিয়ে দিয়েছিল বাচ্ছা ছেলেটা। বছর পনেরো পেরতে না পেরতেই আর এক ফরাসী দিকপাল জোসেফ-লুই ল্যাগ্রাঞ্জের (২৫ জানুয়ারী ১৭৩৬ — ১০ এপ্রিল ১৮১৩) গবেষণার কাজকর্মও হজম করে ফেলেছিল সে।" চায়ে বেশ জোরে একটা চুমুক দিলেন তরুণ-বাবু। স্যারের কথার ফাঁকে অঙ্কের এইসব প্লাতিনি জিদান-দের চেনা নাম শুনে প্রণব মাঝে মাঝেই লাফিয়ে উঠে কিছু বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু পাশেই সদা সতর্ক সুমিত। কখনো কাঁধ চেপে ধরে, কখনো চিমটি কেটে রুখে যাচ্ছে তাকে। নব্বুই-এর দশকের গোড়ায় ইন্টারনেট ছিল না। ফলে আমাদের কাছে আজকালকার পড়ুয়াদের তুলনায় খবর থাকত অনেক কম। তার ওপর লেজেন্ডার সিম্বল কিম্বা ল্যাগ্রাঞ্জের ইন্টারপোলেশন আমাদের মত ফাঁকিবাজদের সঙ্গে যোগাযোগ করত শুধু পরীক্ষার আগের রাতে। তাই এই নামগুলো স্যারের বর্ণণা থেকে আমার কাছে ভেসে আসছিল আবছা আবিল্যির মত।

— "তোরা যেমন বাবার পয়সায় কোচিং এ পড়ে বারো ক্লাসের পর একবারে যাদবপুরে ঢুকে গেছিস, গ্যালোয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কিন্তু অত সহজ হয় নি। সেই সময় ফ্রান্সে অঙ্ক শেখার সবচেয়ে ভাল জায়গা ছিল ইকোলে পলিটেকনিক। ইন্টারভিউ-এ ভাল না করায় সে বেচারি সেখানে সুযোগ পেল না। তার বদলে পড়তে হল ইকোলে প্রিপারেটরিতে, যেটা কিনা সেই সময় অনেক কমা একটা জায়গা। তবে এটা মাথায় রাখিস যে সেই জায়গার নাম এখন ইকোলে নরমালে, আজকের দিনে বেশ নামজাদা। এখানকার মাস্টারদের সঙ্গে গ্যালোয়ার দহরম মহরম বেশ ভালই ছিল। ১৮২৮-এ এখানে ভর্তি হওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই ভগ্নাংশের ওপর একটা বেশ ভালো কাজও করেছিল গ্যালোয়া। তার জীবনের সবচেয়ে বড় অবদান অবশ্য পলিনোমিয়াল ইকুয়েশন, আর সে সমস্ত অঙ্কও এর মধ্যে শুরু করে দিয়েছিল সে। তার বয়েসটা ভাব একবার। তখন মাত্র আঠারো। হ্যাঁ, হ্যাঁ, অঙ্কের খাতায় তুই আজকে যে নম্বর পেয়েছিস সেটাই।" আমার দিকে কটমট করে তাকালেন স্যার। "পরের পরীক্ষায় সামলে নেব ঠিক।" মিনমিন করে বললাম আমি। এর বেশি আর কি-ই বা বলতে পারি? চোখের সামনে তখন সিনেমার মত চলে বেড়াচ্ছে বিশাল বিশাল গম্বুজ দিয়ে বানানো প্যারিসের এক ইউনিভার্সিটি। ছাইরঙা ইটের রাস্তা শেষ হয়ে শ্বেতপাথরের সিঁড়ি, দুপাশে ফোয়ারা আর সাজানো ফুলগাছের সারি। সেখানে ঢুকে অনেকটা গাড়িবারান্দার মত বিশাল জায়গা আর তার দুপাশে উঁচু উঁচু ক্লাসঘর, জানলার কাঁচগুলো রামধনুর রঙে রাঙানো। আমাদের তরুণবাবুর মতই পড়াচ্ছেন এক ফরাসী অধ্যাপক। গায়ে বকলস লাগান সাদা জামা, পরনে কালো প্যান্ট। আমার চারপাশে বিভিন্ন ডেস্কে বসে ঝলমলে চেহারার সব রাজপুত্তুর রাজকন্যেরা। সামনে বড় বড় তিনটে বোর্ডে একটানা লিখে যাচ্ছেন অধ্যাপক, মাঝে মাঝে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। পেন্ডুলামের মত দুলে উঠছে লালচে চুলে মুক্তোর হার ঢেকে যাওয়া ফরাসী রাজকন্যেদের ঘাড়। রাজপুত্রেরা প্রায় স্থির। তাদের চোখ কখনো বোর্ডের দিকে, কখনো বা নিজেদের বাঁধানো খাতায়।

— "এর মধ্যে গ্রামের পুরোহিতের সঙ্গে বিভিন্ন গোলমালে জড়িয়ে পড়ে ১৮২৯ সালে আত্মহত্যা করে বসেন গ্যালোয়ার বাবা। সেই সব ঝামেলার মধ্যে তার কদিন পরেই আবার ইকোলে পলিটেকনিকে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করে গ্যালোয়া। কিন্তু ভাগ্যদেবী এবারেও সহায়তা করলেন না। গ্যালোয়া তার নিজের গবেষণার কাজ যেভাবে বোঝানোর চেষ্টা করল সেটা মানতে পারলেন না পরীক্ষকেরা। সেই বছরের একদম শেষের দিকে ইকোলে প্রিপারেটরিতে থেকেই ডিগ্রি পেল সে। যদিও সে পরীক্ষাতেও নাকি গ্যালোয়ার সমস্ত ব্যাখ্যা বুঝতে পারেন নি পরীক্ষকেরা। এর মধ্যে গবেষণা অবশ্য থেমে থাকে নি। দুর্ভাগ্য যে বার বার তার গবেষণাপত্র ফিরিয়ে দিয়েছেন সেই সময়কার বিশেষজ্ঞরা। শেষপর্যন্ত ১৮৩০-এ গ্যালোয়ার তিনখানা গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় যার মধ্যে একটা খুব গুরুত্বপুর্ণ অংশ গ্যালোয়া থিওরী নামে সারা পৃথিবীতে আজ বিখ্যাত।" স্যার বোধহয় আর একটু হলেই সে সব থিওরী বোঝানোর একটা সৎ প্রয়াসে সামিল হতেন। কিন্তু অরিন্দমের ছোট্ট হাই আর দেবজ্যোতির আরামোড়া ভাঙ্গা দেখে বিরত হলেন।

— "একঘেয়ে লাগছে বুঝি? কিন্তু গল্পের আসল জায়গাটাই তো বাকি। তবে তোদের যদি ভাল না লাগে তাহলে আজকে এই পর্যন্তই থাক। পরে না হয় বাকিটা শুনে নিবি। বাড়ি ফেরার সময় তো তো প্রায় হয়েই এলো।" স্যার আবার উঠে দাঁড়ানোর ভঙ্গী করলেন। এবার কিন্তু প্রণবই বাঁচালো। "পাঁচটা কুড়ির ট্রেন চলে গাছে স্যার। এর পরেরটা ছটা পঁয়তাল্লিশ।" আড়চোখে নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সবে পাঁচটা বেজেছে। স্যার হাতে ঘড়ি পরেন না, আর আশির দশকে কলকাতায় মোবাইলের আবির্ভাব হয় নি। "ঠিক আছে, তাহলে শেষ করে ফেলাই যাক।" স্যার আবার শুরু করলেন। "প্যারিসে তখন চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা। ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ সময় ১৮৩০-এর জুলাই মাস। রাজা দশম চার্লসকে উল্টে দেওয়া হয় এইসময়ে। ২৬শে জুলাই এই বিদ্রোহ সামাল দেওয়ার জন্যে একগাদা জোরালো দমননীতি জারি করার চেষ্টা করেন রাজা। তার মধ্যে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও খর্ব করা হয়। কিন্তু এসব করে কি আর বিদ্রোহ রোখা যায়? প্যারিসে সেদিন বেশ গরম ছিল, বুঝলি। সঙ্গে জনগণের মাথাও। ২৭ তারিখ সকাল থেকেই লোকজন পথে নামতে শুরু করে। আর ২৯ তারিখের মধ্যেই রাজার রাজত্বের পতন এবং মূর্ছা। এইসব রাজনৈতিক কর্মকান্ডে গ্যালোয়াও জড়িয়ে পড়েছিল। সারা প্যারিসের মানুষ যখন রাস্তায় নেমেছে, তখন ছাত্ররাও পিছিয়ে ছিল না। ইকোলে পলিটেকনিকের পড়ুয়ারা বিদ্রোহে যোগ দিলেও, ইকোলে প্রিপারেটরিতের অধিকর্তা সেখানকার ছাত্রদের আটকে রেখেছিলেন। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে খবরের কাগজে চিঠি লেখে গ্যালোয়া এবং এই কারণে পরবর্তীকালে সে বহিষ্কৃত হয় ইউনিভার্সিটি থেকে। যদিও তার আগে সে নিজে থেকেই সেখানকার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল।"

— "জুলাই মাসের গোলমালের পরে ক্ষমতা দখল করেন লুই-ফিলিপ। এই সময় রিপাবলিকানদের সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দেয় গ্যালোয়া। সে দলের নাম ছিল ন্যাশনাল গার্ড। বিভিন্ন রাজনৈতিক বিবাদে ঐ সময় এই দলকে বেআইনি ঘোষণা করা হয় আর এদের কিছু লোককে ভরা হয় জেলে। তারা অবশ্য কয়েকমাসের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যায়। সেই উপলক্ষে ১৮৩১-এর ৯-ই মে এক বিপুল পানভোজনের আয়োজন হয়েছিল। সেখানে রাজা লুই-ফিলিপ থেকে আলেক্সান্ডার দ্যুমার মত বিখ্যাত লেখক-ও উপস্থিত ছিলেন। কথিত আছে যে রাজার সামনে মদের গেলাস তুলে উচ্ছ্বাস দেখানোর সময় গ্যালোয়া নাকি একটা ছুরি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। রাজা অনুমান করেন যে তাঁকে ভয় দেখাচ্ছে গ্যালোয়া এবং সেই অপরাধে তাকে পরের দিনই জেলে ঢোকানো হয়। অবশ্য মাসখানেক বাদেই জেল থেকে মুক্তি পায় সে।" একটানা বলে একটু দম নেওয়ার জন্যে থামলেন তরুণবাবু। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন, "বাস্তিল দূর্গের পতন কবে হয়েছিল?" অঙ্কে টঙ্ক না হলেও, ইতিহাসে আমি মোটেই পাতিহাঁস নই। ফলে গড়গড় করে বলতে শুরু করলাম। "ওটা ফ্রান্সের স্বাধীনতা দিবস স্যার। ১৪-ই জুলাই, ১৭৮৯। বিপ্লবের ধাক্কায় বাস্তিল দূর্গের পতন। দিনটাকে ওরা স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করে।"

— "ঠিকই বলেছিস। আমার গল্পের জন্যে এটুকুই যথেষ্ট।" আমাকে চট করে থামিয়ে দিয়ে আবার শুরু করলেন স্যার। "১৮৩১ সালে ওই দিনটা উদযাপনের আনন্দে গ্যালোয়া এক সশস্ত্র মিছিলের নেতৃত্ব দিতে বেরিয়ে পরে। গায়ে পোশাক ছিল ন্যাশনাল গার্ড-দের, যেটা তখন সম্পুর্ণ বেআইনি। এই অপরাধে আবার ৬ মাসের জন্যে জেলে পোরা হয় তাকে। এবার জেলে থাকার সময় গ্যালোয়া ফের গবেষণাতে মন দেয়। ২৯-শে এপ্রিল, ১৮৩২-এ জেল থেকে ছাড়া পায় সে। কিন্তু আবার শুরু হয়ে যায় জোরদার বৈপ্লবিক কর্মকান্ড। যদিও জটিল বীজগণিত নিয়ে কাজ চলতে থাকে একইসঙ্গে। ভাবাই যায় না যে ছেলেটা কি করে একহাতে ঐরকম ঝুঁকির রাজনীতি আর অন্যহাতে গভীর অঙ্ক সমান্তরালভাবে চালিয়ে যাচ্ছিল। তোদের এক একটা ইউনিয়নের নেতা তো অঙ্কের খাতা ফাঁকা রাখাই বেশি পছন্দ করে।" মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকালেন স্যার। বোধহয় আমার মনের কথাটা বুঝতে পারছিলেন। আমি তখন ভাবছি যে পরের পরীক্ষাতে মাথায় শিরস্ত্রাণ চাপিয়ে আর হাতে ছুরি নিয়ে যোদ্ধার বেশে মোকাবিলা করব অঙ্ক প্রশ্নের। তাতে যদি কয়েকমাস জেলে যেতে হয় তাও ভাল, কিছুদিন তো অঙ্ক থেকে মুক্তি!

— "গ্যালোয়ার জীবনটা যদি শুধু অঙ্ক আর বিপ্লব এই দুই বিন্দুকে যোগ করা সরলরেখার মধ্যে দিয়ে চলত তাহলে হয়ত গল্পটা এভাবে শেষ হত না। কিন্তু বাধ সাধল এক তৃতীয় বিন্দু। যে মহিলার নাম স্তেফানিয়ে-ফেলিসি পোতেরিন দ্যু মোতেল। সে সময় গ্যালোয়া যে হোস্টেলে থাকত সেখানকার ডাক্তারের মেয়ে ছিল এই দ্যু মোতেল। ত্রিকোণ প্রেমের গল্প নাকি রাজনৈতিক শত্রুতা সে কথা আজও সঠিক জানা যায় নি, কিন্তু এটা জানা যায় যে এই মহিলা সম্পর্কিত কোন এক ঘটনায় ডুয়েল-এর চ্যালেঞ্জ নিয়ে বসে গ্যালোয়া। আলেক্সান্ডার দ্যুমার ভাষ্য অনুযায়ী প্রতিদ্বন্দ্বী যুবকের নাম পেসচেউক্স দ্য'হারবিনভিলে। যাদের মুক্তি উপলক্ষে বিরাট পান ভোজনের আয়োজন হয়েছিল, সে নাকি তাদেরই একজন। অন্য একটা মত বলে সম্ভবত সেই ছেলের নাম আরনেস্ট ডুচাটেলেট, যে গ্যালোয়ার সঙ্গে একইসময়ে জেলে গেছিল সশস্ত্র মিছিলে অংশগ্রহণ করে। ডুয়েল হয়েছিল ৩০-শে মে। লড়তে গিয়ে তলপেটে গুলি লাগে গ্যালোয়ার। পরদিন সকালে সে মারা যায়। মৃত্যুর আগে সে নাকি তার ভাইকে বলে গেছিল - কাঁদিস না আলফ্রেড, কুড়িতে মরার জন্যে আমাকে সমস্ত সাহস একসঙ্গে জড়ো করতে হয়েছে।" আমরা সবাই চুপ। স্যার উঠে দাঁড়িয়েছেন। নজরে আসে নি কখন শরতের সন্ধেটা ঝুপ করে আমাদের কাঁধে চেপে বসেছে।

------
~Saibal

শনিবার, ১১ অক্টোবর, ২০২৫

গোয়ালন্দর মুরগিমাংসর ঝোল ~ রঞ্জিত গুহ



বেঁচে বর্তে থাকা একদা পূর্ববঙ্গীয় অতি বৃদ্ধ কারও হয়তোবা এখনও জিহ্বায় গোয়ালন্দ স্টিমারঘাটার সুবিখ্যাত মুরগিমাংসর ঝোলের স্বাদ লেগে আছে। পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্রের ( যমুনা) সঙ্গম গোয়ালন্দ থেকে নারায়নগঞ্জের স্টিমার পথে মাল্লারা নিজেদের জন্য এই মুরগীর ঝোল রান্না করত। ক্রমে ক্রমে আমজনতার প্রিয় পদ হয়ে ওঠে।   কলকাতার লক্ষ্মীবাবুর আসলি সোনাচাঁদি দোকানের মত  গোয়ালন্দ স্টিমার ঘাটায় এখন সারি সারি মকবুল চাচার আসলি দোকান।এই মুরগী মাংসের ঝোলের জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি।এই বিশিষ্ট স্বাদের রান্না নিয়ে অনেক লোকগাথা তৈরি হয়েছে। রন্ধনপ্রণালীর আদি উদগাতা কে তা নিয়েও বেশ আকচাআকচি আছে।দেশবিদেশের রন্ধন বিশারদরা এই রান্নার  রেসিপি জানতে গোপনে হোটেল কর্মচারী সেজে থেকে গেছেন বলে গল্পকথা হাওয়ায় ভাসে। এইসব গল্পকথা নিয়ে একবার  এক শারদীয় পত্রিকায় এক উপন্যাস লেখা হয়েছে।  দেশভাগের পটভূমিতে খানিকটা রহস্য মিশেল দিয়ে প্রেম ও বন্ধুত্বের টানাপোড়েন। পড়তে মন্দ লাগেনা। হোটেল বা হোটেল জীবন নিয়ে বাংলায় কয়েকটা উপন্যাস আছে। একটা মাত্র রান্নার পদ নিয়ে একটা উপন্যাস এর আগে আমি পড়িনি। 

 অনেক বছর আগে এই পদের ঘরোয়া  রন্ধনপ্রণালী জেনেছিলাম জলপাইগুড়ি হাকিম পাড়ার এক প্রিয় বন্ধুর মায়ের কাছে।মাসীমা প্রয়াত হয়েছেন অনেকদিন।  এই সহস্রাব্দের শুরুতে বন্ধুর পাকশালায় হাতেকলমে বার কয়েক রেঁধেছি এই পদ। বেশ ঝকমারি আছে।  সে সব লিখে রাখিনি। ভুলেও যাইনি। সেই বন্ধুর গোয়ালন্দে এখনও যাতায়াত আছে।  দিন কয়েক আগে  ফোনে  জলযন্ত্রনায় বিপর্যস্ত বন্ধুর খোঁজ খবর নেওয়ার ফাঁকে বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় হল।কথায় কথায়  সেই সব পুরানো কথার ঢেউ উঠল।রন্ধনপ্রণালীটাও ঝালিয়ে নিলাম।



প্রস্তুতি,  অর্থাৎ কিনা ম্যারিনেট করা।
১) ব্রয়লারে তেমন স্বাদ হবেনা। যাকে বলে দেশী মুরগি কেটে ধুয়ে জল ঝরিয়ে নুন মাখিয়ে  মিনিট দশেক ঢাকা থাকবে।
২) কালোজিরে বাটা দিয়ে ভালো করে মেখে আবার ঢাকা দশমিনিট। 
৩) আদা জিরে কাঁচালঙ্কা বাটা দিয়ে মেখে মিনিট পাঁচেক ঢাকা।
৪) সরষে তেল দিয়ে মেখে আবার ঢাকা।পাঁচ মিনিট। 
** আদা জিরে লঙ্কা কালোজিরে নুন তেল একসাথে মুরগীর সাথে মাখলে হবেনা কিন্তু।

কড়াইয়ে খুব ঢিমে আঁচে গরম করা সরষে তেলে থেতলানো রসুন কোয়া ভেজে , অনেকটা পেয়াজ কুঁচি   আধ ভাজা করে আদা কুঁচি দিয়ে আন্দাজমত নুন ছড়িয়ে দিতে হবে।
এরপর
১) ঐ কড়াইয়ে অর্ধেকের বেশি মাংস দিয়ে নেড়েচেড়ে ঢাকা চাপা। চাপা উঠিয়ে নেড়েচেড়ে আবার চাপা।
২) দু-চারটে শুকনো লঙ্কা দিয়ে ঢাকা।
৩) বাকি মাংস কড়াইয়ে দিয়ে হলুদবাটা জলে গুলে ঢেলে দিতে হবে। নেড়েচেড়ে আরও খানিকটা আন্দাজমত জল দিয়ে ঢাকার আগে খোসা ছাড়ানো কয়েক টুকরো আলু দিতে হবে। 
৪)ঝোল ফোটা শুরু হলে  আঁচ আরও কমিয়ে  শুকনো লঙ্কা বাটা ও খুব অল্প সরষে বাটা জলে গুলে কড়াইয়ে  দিতে হবে। ফুটুক কয়েক মিনিট। 
এইবার রাঁধুনিরা দ্বিমত বা বহুমত। 
১) কুঁচো চিংড়ি কড়া করে ভেজে দু'হাতের তালুতে পিষে গুড়ো করে ঝোলে দিয়ে টগবগ করে ফুটিয়ে নামিয়ে নাও।
২) যেকোনো কুঁচো মাছ কড়া ভেজে গুড়ো করে দিতে হবে।
৩) লইট্যা বা হিদল( পুঁটি)  শুঁটকি পেয়াজ লঙ্কা  রশুন বেশ কড়া ভেজে পেস্ট করে মাংসের সাথে মিলিয়ে দাও।
** আমি চিংড়ি ভাজা গুড়ো দিয়ে করেছি।

নামাবার আগে কয়েকটা কাঁচালঙ্কা চিরে ছড়িয়ে দিতে হবে।সবার পাতেই যেন একটা দুটো পড়ে।
পাতে দেওয়ার আগে সামান্য ঝোল জিভে দিয়ে বুঝে নিতে হবে নুন কমবেশি হয়েছে কিনা।

** গরম না থাকলে এ ঝোলের স্বাদ অর্ধেক কমে যায়।

রবিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৫

৪০টি নৌযান এবং ৬২৩ জন মেয়ে ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

পাশের বাড়ির বৌদি, বিগত যৌবনা হলেও সাজগোজ করতে কিঞ্চিৎ ভালোবাসেন। আপনি আড় চোখে দেখেন আর পাড়ার চায়ের ঠেকের খাপ পঞ্চায়েতে তাকে আখ্যা দেন ঢলানি মেয়েছেলে বলে। অফিসে নতুন কাজে জয়েন করা মেয়েটি স্বচ্ছন্দে সবার সাথে মেলামেশা করছে দেখে আপনি তাকে আখ্যা দেন বেহায়া বলে। বন্ধু'র কনিষ্ঠ কন্যা, সদ্য কলেজ ছাত্রীকে জিন্স পরতে দেখলে, সিগারেট ফুঁকতে দেখলে আপনার স্থির সিদ্ধান্ত হয়, মামনি গোল্লায় গেছে। কাজ সেরে বাড়ি ফেরার সময় মেট্রো রেল কামরায় হাতল ধরা মহিলার শাড়ির আঁচল অবিন্যস্ত দেখলে আপনার ল্যাম্প পোস্টের নিচে দাঁড়ানো মেয়েদের কথা মনে পড়ে। একটা সময় পশ্চিম ইউরোপের ইতালিতে মেয়েদের দেখে আপনার মতো কিছু নীতি পুলিশ সাজা কাকু/ কাকিমা ওই সিদ্ধান্তে আসতেন যে ওদেশের মেয়েগুলি কিঞ্চিৎ বেহায়া, ঢলানী ও বয়ে যাওয়া এম্পটি হেডেড। 

অথচ কি আশ্চর্য্য দেখুন ওদেশের সেই মেয়েগুলি দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধের সময় কি অবাক কান্ডই না ঘটিয়ে ছিল। আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে যে ওই ইতালি দেশটাতেই ফ্যাসি*বাদ নামক কুখ্যাত মতবাদের জন্ম। ইউরোপের আর পাঁচটা দেশেও ফ্যাসি*স্ট আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ওই দেশে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনী, যাদের পার্টিজান বলে, সেটা গঠিত হয়ে ছিল। কিন্তু আপনার কি জানা আছে যে দু লক্ষ পঞ্চাশ হাজার সংগ্রামী মানুষ দ্বারা গঠিত সেই বাহিনীর  এক লক্ষ পাঁচ হাজার মানে প্রায় চল্লিশ শতাংশ সদস্য ছিল মহিলা ? যারা পুরুষ কমরেডদের পাশাপাশি স্টেনগান হাতে নিয়ে লড়াই দিয়েছিল ? আজ্ঞে হ্যাঁ যেই "বেহায়া", "ঢলানি" "মেয়েছেলে"র দল। আপনাকে কেউ কি কোনোদিন বলেছে যে ওই মেয়েদের মধ্যে চার হাজার ছশ জন গ্রেপ্তার হয়েছিল, দু হাজার সাতশো পঞ্চাশ জনকে পাঠানো হয়েছিল বিভিন্ন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। ওই মহিলাদের আত্মত্যাগ বিফলে যায়নি কিন্তু। ফ্যাসি*বাদীদের পরাজয় হয়েছিল। আঠাশ এপ্রিল, ১৯৪৫ ফ্যাসিবাদের সবচেয়ে বড় নায়ককে পার্টিজানরা গুলি করে মারে। মেরে ফেলে দিয়ে যায় মিলান এর প্রধান রেল স্টেশনের চত্বরে। যার পরে ক্রুদ্ধ বিক্ষুব্ধ জনতা পাশবিক আক্রোশে সেই একনায়কের মৃতদেহ উল্টো করে ঝুলিয়ে দেয় ল্যাম্পপোস্টে, জনতা জড়ো হয়ে উল্লাস করে সেই ল্যাম্পপোস্টের নিচে। এর পরে সবাই ঘরে ফেরে। মেয়েরা বন্দুক ফেলে ফিরে যায় অভ্যস্ত জীবনে, ঘরকন্নয়, গেরস্থালির কাজে, মাঠে ফসল তোলার কাজে, ফ্যাশন শো এর রেম্পে। 

গত কয়েকদিনের মধ্যে চুয়াল্লিশটি দেশের চল্লিশটি নৌযান নিয়ে গঠিত বেসামরিক নৌবহর যার নাম সুমুদ ফ্লোটিলা রওয়ানা দিয়েছিল ইসরায়েলি হানায় বিধ্বস্ত গাজায় ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছিয়ে দিতে। ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবী জুড়ে বেসামরিক, বেসরকারি প্রতিবাদ। ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স ওই নৌযান গুলিকে সাগরের বুকেই ইন্টার্সেপ্ট করেছে। অভিযাত্রীদের এই অসম সাহসী অভিযানকে ঘিরে শুরু হয়েছে দক্ষিণপন্থীদের কুৎসা প্রচার। এই প্রচারকারীদের আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য এই আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী গ্রেটা থুনবার্গ, রিমা হাসান ও অংশগ্রহণকারী অন্যান্য মহিলারা। তাদের চরিত্রে কালি ছেটানো চলছে। ঠিক যেমনটা হয়েছিল সেই ফ্যাসিস্ট ইতালিতে। 

আশার কথা এটাই যে সেই ইতালির মতো আজকের ইতালিতেও খেটে খাওয়া মানুষজন এই অভিযাত্রীদের পাশেই দাঁড়িয়েছে সেই দেশের চরম দক্ষিণপন্থী সরকারের হুশিয়ারি সত্ত্বেও। রাজপথে তাঁদের কন্ঠে ফিরে এসেছে সেই পুরনো ফ্যাসিস্ট বিরোধী "বেলা চাও" গানের সুর ও স্বর। তাদের সাথে সুরে সুর মিলিয়ে কলকাতা সহ পৃথিবীর প্রায় সব শহরের বুকে হচ্ছে মিছিল, জমায়েত। বেলা চাও বারে বারে ফিরে আসছে আমাদের মধ্যে। 

ফেরেনি কেবল ফ্যাসিস্ট/ নাৎসি বাহিনীর হাতে শহীদের মৃত্যু বরণ করা ছশো তেইশ জন মহিলা পার্টিজান। কোনো অজানা সবুজ পাহাড়ের কোলে, আরো সবুজ শান্ত গাছের ছায়ায় তারা চিরকালের মতো ঘুমিয়ে আছে। তাদের মিনি স্কার্ট হাই হিলের খুট খুট শব্দে মুখরিত হবে না আর মিলানের পাথর বাঁধানো রাস্তা। যখনই কেউ  প্রতিবাদে গর্জে ওঠা মেয়েদের "ঢলানি মেয়েছেলে" বলে অপবাদ দেয়, তাদের শরীর নিয়ে নোংরা কথা বলে তাদের বদনাম করতে চায়, তখনই কেন জানি সেই শহীদ পার্টিজান বাহিনীর মেয়েদের কথা মনে পড়ে যায়। গুডবাই বিউটিফুল। বেলা চাও, বেলা চাও, বেলা চাও চাও চাও।

শুক্রবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৫

গান স্যালুট ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত


বিকেল পাঁচটা'র সময় সেদিন এক খুনির হাতে ধরা ইতালিয়ান পিস্তল থেকে গুলি ছুটে গিয়ে গিয়ে ফুঁড়ে দিয়েছিল এক অশক্ত বৃদ্ধের শরীর। বেরেটা সেমি অটোম্যাটিক মডেল নম্বর M1934, সিরিয়াল নম্বর 606824 এর থেকে বেরিয়ে আসা পয়েন্ট 380 ক্যালিবারের গুলি। 



কে এই বৃদ্ধ ? এই বৃদ্ধ যার অনশন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অবিসংবাদী নেতা সাভারকার বিবৃতি দিয়েছিলেন: "সময় এসেছে যে, গান্ধীজির স্বাস্থ্যের গুরুতর অবস্থা নিয়ে যারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং তাঁর মূল্যবান জীবন বাঁচানোর কোনো চেষ্টা বাকি না রাখতে যারা ইচ্ছুক তাদের অবিলম্বে উপলব্ধি করা উচিত যে আমরা এটি পছন্দ করি বা না করি, গান্ধীজীর জীবন বাঁচানোর জন্য সবচেয়ে বেশি কার্যকর হওয়ার একমাত্র উপায় এখন মহাত্মা গান্ধীর কাছে একটি জাতীয় আবেদন জারি করা যা তার সময় শেষ হওয়ার আগে তার উপবাস ভাঙার জন্য আবেদন।" " [সূত্রঃ ১]

এটা বিস্ময়কর ঠেকলে সুধী পাঠক, আমরা দেখে নিতে পারি ওই হত্যাকান্ডের মামলার অন্যতম অভিযুক্ত সাভারকারের আরেকটি উক্তি। বৃদ্ধের জন্মদিনে সাভারকার অভিনন্দন জানালেন: "তাঁর ৭৫ তম জন্মদিনে আমি মহাত্মা গান্ধীজি এবং আমাদের জাতিকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। ঈশ্বর তাঁকে দীর্ঘ জীবন এবং শক্তিশালী স্বাস্থ্য দান করুন" [সূত্র ২:]

কিম্বা আরো বিস্ময়কর উক্তি যেখানে জেল থেকে গান্ধীজির ছাড়া পাওয়ায় সাভারকার আনন্দ প্রকাশ করে লিখছেন: "গান্ধীজির বার্ধক্য এবং সাম্প্রতিক গুরুতর অসুস্থতার কারণে স্বাস্থ্যের অবনতি বিবেচনা করে সরকার তাকে মুক্তি দিয়েছে এই খবরে সমগ্র জাতি স্বস্তি বোধ করছে। এটা ছিল একটি মানবিক প্রচেষ্টা। আমি গান্ধীজির দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। আমি আশা করি সরকার এখন পণ্ডিত নেহেরু এবং সেই সমস্ত ভদ্রলোকদের মুক্তি দেবে যাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য বিচার না করেই কারাবন্দী করা হয়েছে, অথবা প্রকাশ্যে বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি, যাতে দেশ জানতে পারে যে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ কী। [সূত্রঃ ৩]

হাত্যার দায়ে অভিযুক্ত কোনো আসামি সেই নিহত মানুষটি সর্ম্পকে এমন মূল্যায়ন করেছেন এই উদাহরণ খুব একটা আছে বলে তো আমরা জানি না। যাই হোক, সাভরকার তো ছাড়া পেয়েছিলেন শেষ অবধি কিন্তু তিনি যাকে ক্রিমিনাল আখ্যা দিয়েছিলেন, তার এককালের সহকর্মী কাম শিষ্য সেই গডসের কার্যকলাপে আমরা একটু মনোনিবেশ করি। হত্যাকারী গডসে ও তার সঙ্গীরা বহুদিন ধরেই ওই বৃদ্ধকে খুন করার জন্য উপযুক্ত অস্ত্র খুঁজছিল। অস্ত্রটি তাদের হাতে আসে হত্যাকাণ্ডের ঠিক দু'দিন আগে। "গডসে ২৮শে জানুয়ারি ট্রেনে করে গোয়ালীয়র আসে এবং গোয়ালীয়রবাসী ডা: দত্তাত্রেয় পারচুরে, গঙ্গাধর দন্ডবতে, ও সূর্যদেব শর্মা এর সহায়তায় এই পিস্তলটি জোগাড় করে।" [সূত্রঃ ৪]

ডা: পারচুরে তার গ্রেপ্তারের পরে ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেট এর কাছে জবানবন্দিতে জানায় যে সে ওই পিস্তলটি সংগ্রহ করেছে দন্ডবতে'র কাছ থেকে। দন্ডবতে জানায় যে সে সংগ্ৰহ করেছে জগদীশ প্রসাদ গোয়েল এর কাছ থেকে। জগদীশ প্রসাদ গোয়েল কার কাছ থেকে এই পিস্তল সংগ্রহ করেছিল সেটা জানা যায় নি, মুখ খুলতে রাজি হয় নি। "এটা সম্ভব যে মুখ খুলতে নারাজ হয়ে গোয়েল সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের আড়াল করতে চেয়েছে।" [সূত্রঃ ৫]

প্রথমে প্লেনে করে দিল্লি আর তার পরে ট্রেনে করে গডসেদের গোয়ালীয়র যাওয়ার উদ্দেশ্যই ছিল একটা নিখুঁত যন্ত্রের প্রয়োজন। পাওয়ার পরে গডসে ও আপ্তে দিল্লি ফিরে আসে ২৯ তারিখ সকালে।" [সূত্রঃ ৬]

কে ঐ পারচুরে ? গোয়ালীয়র এর ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান, কৃতি ছাত্র, পাস করা চিকিৎসক। তিনি কেন বেরেটা পিস্তল সংগ্রহ করতে যাবেন ?  তাঁর পরিচয়ের আরেকটা দিক হল, তিনি হিন্দুমহাসভার সক্রিয় কর্মকর্তা,  এবং স্থানীয় 'হিন্দু রাষ্ট্র সেনা'র নির্বাচিত ডিরেক্টর। গোয়েল ছিল তার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর একজন সদস্য। [সূত্রঃ ৬]।

খুনি'র মোডাস অপারেন্ডির খানিকটা জানা গেল। খুনীর বিচারটাও কিন্তু খুব কৌতূহলজনক। পাছে একপেশে ন্যারেটিভ এর দায়ে অভিযুক্ত হতে হয় তাই আমরা আবার শরণাপন্ন হবো খুনীর মেন্টর এর। গান্ধীজিকে 'মহাত্মা' সম্বোধন করে তার জঘন্য হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করে সাভারকার লিখলেন, "মহাত্মা গান্ধীর হত্যার আকস্মিক ও মর্মান্তিক সংবাদ আমার কাছে পৌঁছানোর সাথে সাথেই আমি একটি প্রেস-নোটে প্রকাশ্যে এটিকে একটি ভয়াবহ এবং ভ্রাতৃঘাতী অপরাধ বলে নিন্দা জানাই, যা দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘটছে। এবং আজও আমি গান্ধীজীর হত্যার দ্ব্যর্থহীনভাবে নিন্দা জানাই।" [সূত্রঃ ৭]

গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসে, নারায়ণ আপ্তে সহ অন্যান্যদের পরিষ্কার ক্রিমিনাল আখ্যা দিলেন সাভারকার এবং তিনি তার শিষ্যদের কাজের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করলেন: "অনেক অপরাধী তাদের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের গুরু এবং পথপ্রদর্শকদের প্রতি উচ্চ শ্রদ্ধা এবং আনুগত্য পোষণ করে এবং তাদের নীতি অনুসরণ করার দাবি করে। কিন্তু গুরু বা পথপ্রদর্শকের তার অনুসারীদের অপরাধে জড়িত থাকার বিষয়টি কি কেবল সেই অপরাধীদের তাদের গুরুদের প্রতি আনুগত্য এবং শ্রদ্ধার দাবির ভিত্তিতে অনুমান করা এবং প্রমাণিত করা যেতে পারে? [সূত্র: ৭]

শুধু কথামাত্র নয়, কাজেও সাভাকার দেখিয়েছিলেন যে তিনি গান্ধী হত্যাকারীদের কতটা ঘৃণা করেন। গোপাল গডসের উকিল পি এল ইনমাদারের ভাষায়, 
"পুরো বিচার চলাকালীন, আমি কখনও সাভারকরকে এমনকি নাথুরামের দিকে তাকাতে এমনকি ও মাথা ঘোরাতে দেখিনি, যিনি তার পাশে বসে থাকতেন; নাথুরামের সাথে কথা বলা তো অনেক দূরের কথা... সাভারকর সেখানে স্ফিংসের মতো নীরবে বসে ছিলেন, কাঠগড়ায় থাকা তার সহ-অভিযুক্তকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে" [সূত্রঃ ৮]

তার গুরু, আদর্শ-প্রতিমার এই আচরণে হত্যাকারী নাথুরাম গডসে কতটা বিচলিত হয়েছিলেন ও দুঃখ পেয়েছিলেন তার নমুনা সেই উকিল ইনমাদারের ভাষায়: "নাথুরামের সাথে আমার বিভিন্ন আলোচনার সময় তিনি আমাকে বলেছিলেন যে তিনি এতে গভীরভাবে আহত হয়েছেন - লাল কেল্লার বিচারের সমস্ত দিনগুলিতে আদালতে বা লাল কেল্লা কারাগারে তাতিয়ারাও [সাভারকর] তার সাথে সুপরিকল্পিতভাবে সর্ম্পকছেদ প্রদর্শন করেছিলেন। নাথুরাম কীভাবে তাতিয়ারাওয়ের হাতের স্পর্শ, সহানুভূতির একটি শব্দ, অথবা অন্তত করুণার একটি দৃষ্টিপাত দেখার জন্য আকুল ছিলেন? সিমলা হাইকোর্টে তার সাথে আমার শেষ সাক্ষাতের সময়ও নাথুরাম এই বিষয়ে তার আহত অনুভূতির কথা উল্লেখ করেছিলেন।" [সূত্রঃ ৮]

এইবারে আসা যাক আসল বিষযে, হত্যাকান্ডের মোটিভ। কেন সেদিন বিকেলে খুন হতে হয়েছিল ওই বৃদ্ধকে। তিনি কি অপরাধ করেছিলেন। 

খুনের একটু আগে পিছিয়ে যাওয়া যাক। ১৫ই আগস্ট, ১৯৪৭ সাল। গোটা দেশ এর বড় অংশ  স্বাধীনতার আনন্দে মাতোয়ারা। ওই বৃদ্ধের "সবচেয়ে বড় শিষ্য" তখন ক্ষমতার গদিতে বসার আনন্দে তাঁর অন্য সঙ্গী সাথীদের নিয়ে দিল্লির আলো উজ্জ্বল সেন্ট্রাল হলে "নিয়তির সাথে অভিসার" এর গল্প শোনাচ্ছেন দেশ তথা বিশ্বকে তখন দাঙ্গা বিধস্ত কলকাতার বেলেঘাটায় ওই বৃদ্ধ অনশন করছেন, চরকা কাটছেন। প্রতিবাদে। হিন্দু-মুসলিম, তাঁর প্রিয় সন্তানদের মারামারি খুনোখুনির প্রতিবাদে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত এক সৈনিক।

কলকাতা শান্ত হলে তিনি যাবেন দাঙ্গা বিধস্ত পাঞ্জাবে এমনটাই তাঁর ইচ্ছে। তাঁর সাধের জওহরলাল, প্যাটেলদের অনেক কাজ। দেশ চালাতে হবে। তাই তিনিই যাবেন বৃদ্ধ অশক্ত শরীর নিয়ে। কারণ তিনি জানেন যে এখনও ভারতের জীবিত সবচেয়ে বড় মাস লিডার তিনিই। ওসব জহর, প্যাটেল কিস্যু নয়। লর্ড মাউন্টব্যাটেন জানতেন এই সৈনিক একাই একটা সৈন্যদল। তিনি লিখেছেন, "মাই ডিয়ার গান্ধীজি, পাঞ্জাবে আমাদের হাতে আছে ৫৫,০০০ সেনা আর বিশাল মাপের রায়ওটিং। এদিকে বাংলায় আছে একজন মানুষ দিয়ে গড়া সৈন্যদল আর সেখানে কোনও রায়ওটিং নেই" [সূত্রঃ ৯]

'ওয়ান ম্যান আর্মি' সেই বৃদ্ধ তাঁর প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেন নি। তার জন্য তাঁর বহু অনশন দীর্ন অশক্ত শরীর দায়ী নয়। দায়ী অন্যকিছু। ৭ই সেপ্টেম্বর পাঞ্জাব যাবেন বলে দিল্লি রওয়ানা হলেও দিল্লিতে আটকে গেলেন। একদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দলে দলে আগত শিখ আর হিন্দু রিফিউজিদের ক্রোধের আগুনে তখন পুড়তে শুরু করেছে দিল্লির মুসলিম মহল্লা। বৃদ্ধ অনশনে বসলেন। আর অন্য দিকে "বাম" নেহেরু বনাম "দক্ষিণ" প্যাটেল এর প্যাঁচ কষাকষি। দ্বিতীয় জন গান্ধীর ইচ্ছে মেনে নিয়ে প্রথম ক্যাবিনেটে উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ মেনে নিলেও মনে মনে মানেন নি। 

পাকিস্তানের প্রতি জঙ্গি মনোভাব হোক আর কংগ্রেস পার্টি প্রেসিডেন্ট পদে দক্ষিণপন্থী পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডনকে দাঁড় করানো হোক, গান্ধীর তথাকথিত ডান হাত আর বাঁ হাত তখন ক্ষমতার অলিন্দে লড়াই করা দুই প্রতিপক্ষ। বৃদ্ধ আবার অনশনে। [সূত্রঃ ১০]

দেশের অবস্থা শোচনীয়। বৃদ্ধ একা হয়ে গেছেন। নিঃসঙ্গ। প্রিয় শিষ্যরা না পারছে তাকে ফেলতে না পারছে গিলতে। গডসে আপ্তে "নিখুঁত" পিস্তল জোগাড়ে ব্যস্ত। 

বৃদ্ধের মনে পড়ে যাচ্ছে তাঁর আরেক অনুচর এর কথা। নিখোঁজ। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী মৃত। বৃদ্ধের ভাষায় "নেতাজি ওয়াজ লাইক এ সন টু মি"। বৃদ্ধের মনে পড়ে যাচ্ছে তার আশীর্বাদ চেয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রভিনসিয়াল ভারত সরকার ঘোষণার এবং "দিল্লি চলো" আদেশ ঘোষণার প্রাক্কালে নেতাজির সেই ডাক, 
"ভারতের স্বাধীনতা র শেষ মহারণ শুরু হয়ে গেছে। জাতির জনক, ভারতের মুক্তির এই পবিত্র যুদ্ধের জন্য আমরা আপনার আশির্বাদ ও শুভেচ্ছা চাইছি।" [সূত্র ১১] 

আজাদ হিন্দ ফৌজ এর বন্দী সেনানীদের সাথে আলাপ আলোচনার পর বৃদ্ধের নিজস্ব বিশ্লেষণ একটু দেখে নেওয়া যাক,  "যদিও আইএনএ তাঁদের আশু লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, তাঁদের জমার খাতায় গর্ব করার মতো অনেক কিছু আছে। তার মধ্যে মহত্তম হ'ল এক পতাকার তলে ভারতের সব ধরণের ধর্ম, সম্প্ৰদায়, জাতির মানুষকে একজোট করা, তাদের মধ্যে একতা ও সংহতির এক উদ্দীপনা প্রবিষ্ট করা যার মধ্যে সকল প্রকার সাম্প্রদায়িক ভাবনা বর্জিত হয়েছে" [সূত্রঃ ১২]

১২ই সেপ্টেম্বর, আরএসএসের প্রধান গুরু গোলওয়ালকর এর সাথে গান্ধীজি র বৈঠক হল, গান্ধীজি  তাঁকে দাঙ্গা থামানোর অনুরোধ করলেন এবং সোজাসুজি বললেন যে সঙ্ঘের হাত রক্তে মাখা, গোলওয়ালকর উচ্চ সুরে তা অস্বীকার করলেন। [সূত্র ১৩]। বৃদ্ধ বোঝেন নি যে সেইদিনই তাঁর মৃত্যু পরোয়ানায় সই হয়ে গেল। আশাবাদী বৃদ্ধ নিজের জীবনের পরোয়া না করে ১৬ সেপ্টেম্বর তারিখে গেলেন দিল্লির ভাঙি কলোনিতে অবস্থিত আরএসএসের শাখায় তাঁর শান্তির বাণী প্রচার করতে। 

সুধী পাঠক এতক্ষনে নিশ্চয়ই খুঁজে পেয়েছেন সেই হত্যাকারীর মোটিভ। নিঃসঙ্গ অশক্ত ওই বৃদ্ধ বেঁচে থাকতে ভারতের মাটিতে সাম্প্রদায়িক হানাহানির সংস্কৃতি কিছুতেই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। বৃদ্ধ ব্যাগড়া দেবেনই। আর দেশের লোক ওই "বোকা বুড়ো" এর কথায় এখনও নেচে ওঠে, বৃদ্ধ অনশন শুরু করলে তাদের সেন্টিমেন্ট এর বন্যা বয়ে যায়। অতএব মরতে হবেই বৃদ্ধ আপদকে। তাতে অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। কেউ তাকে মূর্তি বানিয়ে ফুর্তি চালিয়ে যাবে, আর কেউ ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখবে সাম্প্রদায়িক ঘেন্না ছড়িয়ে। 

সুধী পাঠক, ক্ষমা করবেন, বৃদ্ধের জন্মদিনে তাঁর আর পাঁচজন ভক্তের মতো "রামধুন" শুনবো না, কারণ আমরা তাঁর ভক্ত নই। আমরা বরং শুনবো সেই গান যা এক হরিজন বস্তিতে তাঁকে শুনিয়েছিলেন গানটির সুরকার আজাদ হিন্দ ফৌজ এর ক্যাপ্টেন রাম সিং। বেহালার ছড় সুর তুলছে "কদম কদম বাড়ায়ে যা"। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে শহীদ ওয়ান ম্যান আর্মির সম্মানে ফৌজের গান চাই। স্যালুট। গডসে বনাম গান্ধীর এই যুদ্ধে আমরা গান্ধীর পক্ষে। 

সূত্র১: পাইওনিয়ার, ২২শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩
সূত্র ২: প্রেস নোট, ২রা অক্টোবর, ১৯৪৩
সূত্র ৩: প্রেস নোট, ৭ই মে, ১৯৪৪
সূত্র ৪: চার্জশিট গান্ধী মার্ডার কেস
সূত্র ৫: মনোহর মালগাঁওকর, দি মেন হু কিল্ড গান্ধী
সূত্র ৬: জাস্টিস জি ডি খোসলা, দি মার্ডার অফ মহাত্মা
সূত্র ৭: সাভারকার এর বিবৃতি, ২০শে নভেম্বর, ১৯৪৮
সূত্র ৮: ইনামদার, আত্মকথা
সূত্র ৯: রাজমোহন গান্ধী, মোহনদাস, এ ট্রু স্টোরি অফ এ ম্যান, হিজ পিপল এন্ড এন এম্পায়ার
সূত্র ১০: অমিত কাপুর, দি এজ অফ এওকেনিং
সূত্র ১১: আজাদ হিন্দ রেডিও 'র : ৬'ই জুলাই ১৯৪৪, রেঙ্গুন ব্রডকাস্ট
সূত্র ১২: হরিজন পত্রিকা, ১৪-০৪-১৯৪৬ সংখ্যা।
সূত্র ১৩: দিনেন্দ্র ঝা, গোলয়ালকর - দ্যা মিথ বিহাইন্ড দ্যা ম্যান।

বৃহস্পতিবার, ২ অক্টোবর, ২০২৫

যদি তোর ডাক শুনে কেউ ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত




সেবাগ্রামে থাকার সময় গান্ধীজি সময় পেলেই লম্বা হাঁটা লাগাতেন। ১৯৩৯ এর ডিসেম্বর আশ্রম থেকে বেড়িয়ে গান্ধীজি দেখলেন  হাতে পুঁটুলি নিয়ে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি এগিয়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করলেন। গান্ধীজি চিনতে পারলেন, শাস্ত্রীজি। গান্ধীজির মুখে একটা চিন্তার ছায়া পড়লো। শাস্ত্রীজি সেটা লক্ষ করেই বললেন, "আপনার কাছে যে চিঠি পাঠিয়েছিলাম তার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করা উচিত ছিল আমার। কিন্তু নিজেকে আটকাতে পারলাম না। হরিদ্বারে বসে নিজের হাতে কাটা সুতো আপনার হাতে তুলে দিতে এসেছি। আমি আশ্রমের ভেতরে যাবো না, এই গাছতলায় শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দেবো  সকালে চলে যাবো"। কে এই শাস্ত্রীজি, কেনই বা তিনি আশ্রমে না ঢুকেই চলে যেতে চাইছেন এটা জানতে গেলে আমাদের একটু ফিরে যেতে হবে।

গান্ধীজি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরে আসেন এবং তার সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। উনি ও অন্য নেতারা গ্রেপ্তার হন, পুনের ইয়েরওয়ারা জেলে পাঠানো হয়। জেলে থাকার সময়, গান্ধীজি জেলসুপার ভান্ডারী সাহেবের কাছে দত্তাত্রেয় পারচুরে শাস্ত্রী নামের সহবন্দী সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন। উনি ভান্ডারী কে অনুরোধ করেন খোঁজ নিতে যে কোথায় শাস্ত্রীজিকে আটকে রাখা আছে, ভান্ডারী কে বলেন " যদি উনি আমার সংগে একসাথে থাকেন তাহলে আমরা একে অন্যকে সংগ দিতে দিতে পারি, আলাপ আলোচনা করে সময় কাটাতে পারি।

ভান্ডারী তার উত্তরে বলেন, " শাস্ত্রীজির কুষ্ঠ আছে বলে তাকে জেলের অন্য সেকশনে রাখা হয়েছে।" এটা শুনে গান্ধীজি স্তম্ভিত হয়ে যান। শাস্ত্রীজি একজন পড়াশোনা করা শিক্ষিত, পন্ডিত মানুষ যার বেদ সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান। এরপরে গাঁধীজি শাস্ত্রীকে একটি চিঠি লেখেন মন খারাপ না করতে এবং অনুরোধ জানান চিঠিপত্র এর মাধ্যমে যোগাযোগ বজায় রাখতে, কোনো প্রয়োজন এ সাহায্য চাইতে।

শাস্ত্রীজি তার উত্তরে লেখেন, " যদি সম্ভব হয় তাহলে কিছু তুলোর ব্যবস্থা করবেন যাতে আমি আমার ক্ষত গুলি পরিস্কার রাখতে পারি; আর যদি কিছু বই এর ব্যবস্থা করা যায়। চিঠি পাওয়ার পরে মহাদেব দেশাই যখন গাঁধীজি কে দেখতে আসেন জেলে, তখন গাঁন্ধীজির নির্দেশে দেশাই ওইসব ব্যাবস্থা করেন ও শাস্ত্রীজিকে খবর পাঠান যে "শরীর আমাদের অসুস্থ হতে পারে কিন্তু চৈতন্য আমাদের জাগিয়ে রাখবে।" গান্ধীজীর এই চিঠি "মৃত সঞ্জীবনী এর মতো কাজ করে শাস্ত্রীজির জন্য এবং তিনি গাঁধীজির এই কথাতে বিপুলভাবে উজ্জীবিত হন।
 
কোনোও সময়ে গাঁধীজি জেলে অনশন করতেন। তাঁর জীবন যখন একটা সুতোয় ঝুলছে, সেই সময়ে সরকার সমঝোতা করেছে।  কে গাঁধীজিকে অনশন ভঙ্গ এর সময় প্রথম ফলের রস খাওয়াবে সে প্রশ্ন উঠে এসেছে। বাপু চেয়েছিলেন শাস্ত্রীজি এই কাজের ভার নিক। সরকার বাহাদুর মেনে নেওয়ার পরে সেটাই হয়। শাস্ত্রী এগিয়ে আসেন।। জেলার ভাণ্ডারী সাহেব এই দৃশ্য দেখে নিজের চোখের জল আটকাতে পারেন নি।

কুষ্ঠরোগীর প্রতি গান্ধীজির এই মনোভাবের শুরু কিন্ত অনেক আগে। দক্ষিণ আফ্রিকায়, নাটাল এ এক জনসভায় বক্তব্য রাখছিলেন গাঁধীজি। হটাৎ খেয়াল করলেন দূরে একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে একদল লোক খুব মন দিয়ে তাঁর কথা শুনছে। হাত নেড়ে কাছে এসে ভিড়ের সাথে মিশে যাওয়ার জন্য ডাকলেও তারা সাড়া দিল না। 

গাঁন্ধীজি ওদের দিকে এগিয়ে এলেন ব্যাপারটা বোঝার জন্য। এগিয়ে আসা মাত্রই ওদের একজন চেঁচিয়ে উঠলো, "গান্ধীভাই আমাদের কাছে আসবেন না।। আমরা লেপার, কুষ্ঠরুগী।" এসব শোনার পরেও গান্ধী এগিয়ে এলেন, কথা বললেন ওদের সাথে।কয়েকজনের হাতের আঙ্গুল খসে গেছে তো কারুর পায়ের আঙ্গুল। কারুর ভুরুর লোম উঠে গেছে। ওরা কে কি চিকিৎসার সুযোগ পায়, গান্ধী জানতে চাইলেন। উত্তর শুনে স্তম্ভিত, স্তব্ধ।

ওদের কথায়, " কোনো ডাক্তার আমাদের চিকিৎসা করতে চায় না; আমরাই যে যার নিজের চিকিৎসা করি নিমপাতার রস দিয়ে।" যখন জানতে চাওয়া হল যে ওই রসে কোনো উপকার হচ্ছে কি না, তখন সবারই উত্তর না, ওরা কেবল ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে। 

ঠিক ওই মুহূর্তে গান্ধীজি ঠিক করলেন যে ওই মানুষগুলির জন্য ওনাকে কিছু করতেই হবে। উনি ওদের বাড়িতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে চলে গেলেন কিন্তু দিনের বেলায় কারুর সাহস হল না তার বাড়ি গিয়ে দরজায় কড়া নাড়ার। গান্ধীজি যখন রাতে ঘুমোতে যাচ্ছেন তখন ওরা গিয়ে উপস্থিত। ওদের ডেকে নিলেন ভেতরে। ওদের ঘা পরিষ্কার করে দিলেন, কিছু খাবার দাবার বের করে খাওয়ালেন, আর ওদের জীবন কাহিনী শুনলেন, কিভাবে ওরা গ্রামের বাইরে একটা খণ্ডহরে বাসা করে থাকে আর বাঁচার চেষ্টা করে। 

ওদের জলের অভাব, নাগাল পায় না, তাই বরুনদেব যখন কৃপা করে মুখ তুলে চান তখন ওরা সেই বারিধারাতে স্নান করে। তা না হলে ওরা ওদের সেই ছেঁড়াখোঁড়া জামাকাপড় ই না কেচে দিনের পর দিন পড়ে থাকে কারণ স্নান করার বা কাপড় কাচার জল থেকে ওরা বঞ্চিত। গ্রামের আনন্দ-অনুষ্ঠানের উচ্ছিষ্ট দিয়েই পেট ভরাতে হয়। জীবন কাহিনী বর্ণনা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে লোকগুলি বিদায় নিতে চায়। গান্ধীজি বিদায়ের সময় বলেন যে তিনি ওদের জন্য কিছু করতে চান। করেওছিলেন,  পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা, ওষুধপত্র এর ব্যবস্থা।

সেবাগ্রামের সেই দিনটাতে ফেরত যাই আমরা। 
এই সেই শাস্ত্রীজি। গাঁধীজি  দক্ষিণ ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবক ভেলাধুনকে নির্দেশ দেন শাস্ত্রীজির জন্য একটি নতুন ধুতি ও বেনিয়ান আনতে। পরের দিন যথানিয়মে প্রার্থনা সভায় মিলিত হলেন সব আশ্রমিকরা। যেখানে গাঁধীজি ঘোষণা করেন, "আজ আমাদের মধ্যে বেদ ও অন্যান্য বিষয়ে পারঙ্গম একজন পন্ডিত মানুষ শাস্ত্রীজি আমাদের মধ্যে উপস্থিত। উনি কুষ্ঠ রোগ এ ভুগছেন। আপনারা কি ওনাকে সমর্থন করবেন  ও ওনাকে এই আশ্রমে থাকতে দেবেন ? " 

চারদিকে তখন সূচ পতনের নীরবতা। আশ্রমিকদের অনুৎসাহিত মনোবাসনা বুঝে গাঁধীজি আবেদন রাখলেন, " যদি আপনাদের বিবেক অনুমোদন দেয় তাহলেই আপনারা সম্মতি দেবেন।" গান্ধীজীর কথায় সেদিন কাজ হয়েছিল। মানুষ তার কথায় ভরসা রেখেছিল। শাস্ত্রীজি আশ্রমেই থেকে যান। আশ্রমের পূর্বদিকে তার জন্য একটি কুটির তৈরি হয়। গান্ধীজি প্রতিদিন সময় পেলে নিজের হাতে তার সেবা করতেন, ক্ষতস্থান ধুয়ে দিতেন, জামাকাপড় পড়িয়ে দিতেন।  তার সাথে সংস্কৃত কাব্য আবৃত্তি করতেন। ডাঃ জীবরাজ মেহেতা এর দেওয়া ওষুধ সেবনের পরে শাস্ত্রীজির উন্নতি দেখে গাঁধীজি খুবই সন্তুষ্ট হন। কাছেই দত্তপুরে ওয়ার্ধায় মনোহর দেওয়ান কুষ্ঠ পুনর্বাসন কেন্দ্র খোলেন। শাস্ত্রীজি সেখানে স্থানান্তরিত হ'ন ও আমৃত্যু সেখানেই থেকে যান। গান্ধীজি এই মনোহর দেওয়ান কে "প্রকৃত মহাত্মা" খেতাবে সম্ভাষিত করেন। 

কুষ্ঠরোগ নিয়ে গান্ধীজির এই অবদানের দুটি বৈশিষ্ট্য আছে। (এক) এটি কোনো বিচ্ছিন্ন লোক দেখানো ঘটনা নয়। এর ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। আগ্রহী পাঠক-পাঠিকার জন্য একটি সংক্ষিপ্ত কালানুক্রম দেওয়া হল। ( দুই) গান্ধীজির এই সেবার মনোভাবের সাথে আগাগোড়া বিজ্ঞান জড়িয়ে ছিল। দেশ বিদেশের বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে সাধারণ স্বাস্থ্যকর্মী যারা কুষ্ঠরোগ নির্মূল করার অভিযানে জড়িত তারা অনেকেই নিয়মিতভাবে ওয়ার্ধা সেবাগ্রামে এসেছেন গান্ধীজির সাথে আলাপ আলোচনা পরামর্শ করেছেন। উনি আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে কিভাবে এই রোগ দূর করা যায় তাতে উৎসাহী ছিলেন। 

ভারতবর্ষ তথা বিশ্বে বহু রাজনীতিবিদ জন্মেছেন বা জন্ম নেবেন। কিন্তু একটি রোগের জন্য একজন রাজনীতিবিদ এর এমন অবদান এর দৃষ্টান্ত সম্ভবত আর নেই। আমাদের দুর্ভাগ্য যে গান্ধীবাদী রাজনীতির অনুসারীরাও এই বিষয়ে গান্ধীজির অবদান নিয়ে বিস্মৃতপ্রায়, গান্ধিবিরোধীদের কথা তো বাদই দিলাম। আমরা যে রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী হই না কেন, একটা অসুখ ঘিরে কুসংস্কার এর বিরুদ্ধে একজন মানুষের প্রায় একক লড়াইকে,  একটা সামাজিক আন্দোলনের স্রষ্টাকে সেলাম জানাতে বাধ্য। আজ ওঁর জন্মদিনে জনস্বাস্থ্যের এক সামান্য কর্মী হিসেবে শ্রদ্ধার্ঘ্য সেই মানুষটিকে যার প্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীত এর নাম, "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে"।

সংক্ষিপ্ত কালানুক্রম:
১৮৯৪-৯৫: ডারবান: রাস্তায় গান্ধীজির সাথে কুষ্ঠরোগীর সাক্ষাৎ।
১৮৯৭: ডারবান: নিজের বাড়িতে গান্ধীজি কুষ্ঠরোগীর পরিচর্যা করলেন।
১৯০৫: দক্ষিণ আফ্রিকা: ভারতে কাজ করতে গিয়ে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়েছেন এমন একজন মিশনারিকে নিয়ে গান্ধীজি একটি ছোট প্রবন্ধ লিখলেন।
১৯১৩-১৪: পুনে: সান্ধ্য ভ্রমণে বেরিয়ে গান্ধীজি একজন কুষ্ঠরোগীকে উদ্ধার করলেন।
১৯১৩-১৫: মাদ্রাজ: একজন কুষ্ঠরোগী যিনি বিশিষ্ট রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন তার ক্ষতস্থান গান্ধীজি নিজের কাপড় দিয়ে মুছে দিলেন।
১৯১৭: চম্পারণ: বিখ্যাত চম্পারণ যাত্রার সময় গান্ধীজি একজন কুষ্ঠরোগীকে সঙ্গে করে  পৌঁছে দিলেন গন্তব্যে।
১৯২৫: কটক: ১৯শে আগস্ট, গান্ধীজি কটক কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন।
১৯২৫: পুরুলিয়া: ১২ই সেপ্টেম্বর গান্ধীজি পুরুলিয়া কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন।
১৯২৭: কটক: ২১শে ডিসেম্বর গান্ধীজি কটক কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন। তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ওয়ার্ড ছেড়ে চলে আসার আগে কয়েকজনের সাথে মেলালেন হাত।
১৯২৯: আলমোড়া: কাঁসাই, বাগেশ্বর এর কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন গান্ধীজি।
১৯৪৪: সেবাগ্রাম: কস্তুরবা ট্রাস্ট গঠিত হ'ল। কুষ্ঠরোগ নিয়ে কর্মসূচি ওই ট্রাস্টের অন্যতম লক্ষ্য।
১৯৪৪: সেবাগ্রাম:  গান্ধীজি দত্তপুর কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন ও তার কর্ণধার মনোহর দেওয়ানকে "প্রকৃত মহাত্মা" বলে আখ্যা দিলেন।
১৯৪৫: সেবাগ্রাম: ৯ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ব বিখ্যাত কুষ্ঠ বিশেষজ্ঞ ডঃ ককরেন এসে দেখা করলেন গান্ধীজির সাথে।
১৯৪৬: মাদ্রাজ: ৪ঠা ফেব্রুয়ারি চেনগেলপুট উইলিংডন কুষ্ঠ হাসপাতালে রুগীদের সাথে দেখা করলেন গান্ধীজি।
১৯৪৭: ১২ই জানুয়ারি গান্ধীজি হরিজন পত্রিকায় কলম ধরলেন সিন্ধ প্রদেশের কুষ্ঠরোগীদের বাধ্যতামূলক বন্ধ্যাকরণ নিয়ে উত্থাপিত বিল কে ধিক্কার জানিয়ে।
১৯৪৭: নোয়াখালী:  ৫ই ফেব্রুয়ারি তার প্রার্থনা শেষে সভায় গান্ধীজি কুষ্ঠরোগী ও অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের বিশেষ প্রতিনিধিত্ব এর কথা উল্লেখ করলেন।
১৯৪৭: কলকাতা: ৪ঠা সেপ্টেম্বর গান্ধীজি দেখতে গেলেন গোবরা মানসিক হাসপাতাল, বললেন যে এদের দুর্দশা কুষ্ঠরোগীদের চেয়েও খারাপ।
১৯৪৭: দিল্লি: ২৩শে ও ২৪শে অকটবর পরপর দু'দিন প্রার্থনা শেষের সভায় গান্ধীজি কুষ্ঠরোগের উল্লেখ করলেন। বার্তা পাঠালেন সারা ভারত কুষ্ঠরোগ কর্মী সম্মেলনে।
১৯৫৪: ৩০শে জানুয়ারি অর্থাৎ গান্ধী হত্যার দিনটিকে সারা ভারত জুড়ে কুষ্ঠ-বিরোধী দিবস হিসেবে পালন শুরু।

মহালয়া চণ্ডীপাঠ ~ শঙ্খ দে



১৯৭৬ এর 'দেবী দুর্গতিহারিনী'তে উত্তম কুমার আর চিরাচরিত ভদ্রবাবু ছাড়াও বাঙালি কিন্তু মহালয়ার সকালে অন্য একজনের কণ্ঠেও চণ্ডীপাঠ শুনেছে।
নাহ্ এটা না জানায় আপনার বাঙালিয়ানা ক্ষুন্ন হবেনা, কারণ তথ্যটা খুব কম মানুষই জানে।
হ্যাঁ, এবার নামটা বলি 'নাজির আহমেদ'। কি? চমকালেন?!

হ্যাঁ, ঠিকই পড়লেন, যেখানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্র উচ্চারণ নিয়েই অনেক মানুষের আপত্তি ছিল সেখানে ভারতের স্বাধীনতার আগের শেষ পাঁচ বছর একটানা আকাশবাণীর সদর থেকে গোটা বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল একজন শুধু অব্রাহ্মণ না, একজন অহিন্দুর কণ্ঠ। দেশ ভাগ না হলে হয় তো আজও সেটাই শুনতাম আমরা।

আসলে ঘটনাটা ঘটে খুবই আশ্চর্যভাবে, ১৯৪২ এর মহালয়ার ভোরে স্টুডিওতে আসতে দেররি করছেন ভদ্রবাবু, এদিকে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে.. অতঃকিম্?
তরুণ বাচিক শিল্পী নাজির এসে প্রস্তাব দিল, "আমি স্কুলে থাকতে সংস্কৃতে পাকা ছিলাম, ম্যাট্রিকে লেটার মার্কসও আছে, অনুমতি দিলে চেষ্টা করে দেখতে পারি।"
কোনো রাস্তা না পেয়ে পঙ্কজ মল্লিক বললেন, "বেশ তবে করো যদি পারো।"
কিছু পরে স্টুডিওতে এসে হাজির বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, স্তোত্র উচ্চারণ শুনে তিনিও মুগ্ধ হয়ে বললেন, "নাজিরই করুক না, বেশ করছে তো।"

অদ্ভুতভাবে পরের বছরও একই ঘটনা, ভদ্রবাবু বলেন, "আহাঃ পঙ্কজদা, নাজির উঠতি শিল্পী, আমরা বুড়োরা আর কতদিন করবো? এরপর থেকে ওইই করুক না। গলা তো ছেলের খাসা।"

এরপর থেকে ১৯৪৬ এর শরৎ পর্যন্ত এই দায়ভার সামলে গেছেন এই মুসলমান ছেলেটাই। 
মাঝে একটা বেশ বড়ো বদল ঘটে গিয়েছিল অবশ্য, কিন্তু তার খোঁজও কেউ রাখে না। ১৯৪৪-৪৫ এর মধ্যে কতৃপক্ষের সাথে মনোমালিন্যের জন্য দ্বায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান পঙ্কজ মল্লিক, তার জায়গায় আসেন উঠতি শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। প্রথম বছর একই সুরে কোনোকিছু না পাল্টে একই ভাবে অনুষ্ঠান হলেও দ্বিতীয় বছরে অন্যরকম কিছু করতে গিয়ে জনগণের মধ্যে তা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ১৯৪৬ এ পঙ্কজ বাবু ফিরে এলে আবার পুরোনো মেজাজে ফেরে মহিষাসুরমর্দিনী।

কিন্তু ভাগ্যের ফের, ১৯৪৭ এর দেশভাগ। নাজির আহমেদ ফিরলেন নিজের মাটিতে। ঢাকা রেডিওতে যোগ দেন তিনি এবং আবার পুরোনো জায়গায় ফিরতেই হয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে।

তবে শুধু বাচিক শিল্পীর কথা কেন, যন্ত্র শিল্পীরা কেন বাদ যাবেন?

সারেঙ্গী নিয়ে বসতেন মুন্সী, চেলো নিয়ে তারই ভাই আলী আর হারমোনিয়ামে মোহাম্মদ। এরা তিনজন তো হিন্দু নয়ই উপরন্তু বাঙালিও নন। মাতৃ ভাষা উর্দু। আর সেই জন্যই ওদের করে ফেলা কিছু ভুলে আমাদের মহালয়ার সকাল অন্য মাত্রা পায়। কি সেই ভুল?

রিহার্সাল শুরুর আগে সবাইকে বোঝানো হয় বাংলা পাঠ চলাকালীন তারা আবহ বাজাবেন কিন্তু সংস্কৃত স্তোত্র উচ্চারণ করার সময় তা থেমে যাবে, কিন্তু ওরা বোঝেননি ভাষা সমস্যায়। বীরেন বাবু ভাষা পাল্টে বাংলা থেকে সংস্কৃততে চলে গেলেও ওঁরা বুঝতে না পেরে বাজাতেই থাকে, সবাই দেখতেও থাকে যে কোনরকম প্রস্তুতি ছাড়াই তিনজন বাজিয়ে চলেছেন আর অদ্ভুত ভাবে তা মিলেও যাচ্ছে ভাষ্যের সাথে।
শুধু ওদের এই ভুলটার জন্যই পঙ্কজকুমার মল্লিক এর মতো আত্মপ্রত্যয়ী মানুষও নিজের পরিকল্পনা থেকে বেরিয়ে এসে সংস্কৃত স্তোত্র উচ্চারনের মাঝেও যন্ত্রানুষঙ্গ যোগ করেন। এ প্রসঙ্গে পরে তিনি বলেছিলেন, "সেদিন মুন্সীদের কান্ডটা আমার চোখ আরও বেশি খুলে দিল হে। আরও বেশি করে স্পষ্ট হল যে সঙ্গীতের কাছে, সুরের কাছে ভাষাটা কোনো ব্যারিয়রই নয়।"

এসবের বাইরেও এই অনুষ্ঠানের অন্যতম একটি গান 'শান্তি দিলে ভরি'র সুরকার কিন্তু হিন্দু নন, মোল্লার ছেলে উস্তাদ সাগীরউদ্দিন খাঁ।

এবার বুঝছেন পঙ্কজ মল্লিকের ওই কথাটা কত বড় সত্যি ?

"উৎসবের আবার বামুন-কায়েত কি? যে ভাষায় নজরুল ইসলাম কীর্তন থেকে শ্যামাসঙ্গীত সব লেখেন সেই ভাষায় কোনো জাতপাত টানবেন না।"


সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

আবার ব্যোমকেশ ~ কৌশিক মজুমদার

বড় মুশকিলে পড়িয়াছি। ১৯৭০ সালে আজিকার দিনে শরদিন্দু বাবুর মৃত্যুর পর হইতে আজ অবধি কলম ধরি নাই। অনভ্যাসে বিদ্যা কিঞ্চিৎ হ্রাস পাইয়াছে। তবু বহুযুগ পরে এই মুখপুস্তিকাখানি পাইয়া কিছু লিখিতে সাধ জাগিল। খোকার পুত্র এখন বড় হইয়াছে। সেই আমাকে এই অ্যাকাউন্টখানি খুলিয়া দিয়া কহিল মনের সকল কথা ইহাতে লিপিবদ্ধ করিতে।


কিন্তু কী লিখি? জানি পাঠকদিগের আমার প্রতি এক চরম ক্ষোভ রহিয়াছে। কেন বিশুপাল বধের কাহিনি সম্পূর্ণ করিলাম না? কেন শরদিন্দু বাবুর মৃত্যুর পরেই লেখনী সংবরণ করিলাম? এতদিন এই কথা প্রকাশ করি নাই। আজ জানাই, উহাই ব্যোমকেশের শেষ কেস ছিল এবং উহাতে তাহার সম্পূর্ণ পরাজয় হয়। আমি চাহিয়াছিলাম পাঠকদের নিকট যে ব্যোমকেশ বীরের আসনে আসীন, তাহা যেন বিন্দুমাত্র লাঘব না হয়।

এই অবধি লিখিয়াছি, আচমকা ঘরে ব্যোমকেশ প্রবেশ করিল। মুচকি হাসিয়া কহিল "কি হে, আজ শরদিন্দুবাবুর উপরে ফেসবুকে কিছু লিখছ নাকি?" আমি চমকিত হইয়া কহিলাম "বুঝলে কি করে?" একখানি সিগারেট ধরাইয়া আরামকেদারায় বসিয়া পা নাচাইতে নাচাইতে ব্যোমকেশ কহিল "এ বুঝতে বুদ্ধি লাগে না। গতকাল থেকেই তোমার মধ্যে কেমন একটা অস্থির ভাব দেখছি। তাক থেকে শরদিন্দু বাবুর লাল লাল বইগুলো টেনে বার করছ। কাল অনেক রাত অবধি খোকার থেকে বাংলায় টাইপ করা শিখলে। আজ ওঁর মৃত্যুদিন। এটুকু আমি কেন পুঁটিরাম-ও বুঝতে পারবে"

ভারি রাগ হইল। কহিলাম "প্রিয় চরিত্র" গল্পে উনি তো ঠারেঠোরে তোমাকেই নিজের প্রিয় চরিত্র বলে গেছেন। ভুলে গেলে? তা তুমিই বল ওঁকে নিয়ে কিছু"। ব্যোমকেশের ভ্রুযুগল উত্থিত হইল। খানিক কী যেন ভাবিয়া কহিল "দেখ ভায়া, আমি সত্যান্বেষী। সত্য বই অন্য কিছু জানি না। ফলে কেঠো তথ্য ছাড়া কিছু বলতে পারব না। জন্ম ১৮৯৯ সালে বিহারের পূর্ণিয়াতে। কলকাতায় এসে মেট্রোপলিটন। প্রথম বই কবিতার। নাম যৌবনস্মৃতি। ১৯৩২ সালে পথের কাঁটা। যেটায়…"

"জানি জানি। মূল লেখা আমিই লিখেছিলাম। আমার ভাষা আর বানানের বহর দেখে উনি সেটা শুধরে দেন। এই তো। এই নিয়ে এত বছর বাদে খোঁটা না দিলেও পারতে"
"আরে তোমার লেখার পুরো বিশ্বাস রাখতে পারেন নি বলেই হয়তো বেনীসংহার কাহিনি নিজেই লিখেছেন" বলিয়া ব্যোমকেশ মিটিমিটি হাসিল। "আর তোমার এই সাধু চলিতের গুরুচন্ডালী। বাপ রে!!!"

ভয়ানক ক্ষুব্ধ হইয়া গুম মারিয়া বসিয়া রহিলাম। দেখিলাম অবরুদ্ধ হাসিতে ব্যোমকেশ ফুলিয়া ফুলিয়া  উঠিতেছে। কহিল "আমার সেই ডাক্তার অনুকুল বাবু কিংবা মণিলালের চেয়েও শরদিন্দুবাবু দেখছি তোমার কাছে বড় ভিলেন!" উত্তর না দিয়া উঠিয়া যাইব ভাবিতেছি এমন সময় ব্যোমকেশ সিগারেটে একটা টান দিয়া বলিল "লেখায় আমাদের ভূতান্বেষী বরদার কথাও রেখ। তাঁর আলোচনা তো আজকাল বিশেষ শুনি না"।কথাটা ভুল নয়। গোলগাল আলুর ন্যায় দেখিতে এই ভদ্রলোক যে প্রেতপুরীর সমস্ত খবরাখবর রাখেন তাহা "রক্ত খদ্যোত", "বহুরূপী" র মত কাহিনি পড়িলেই প্রতীয়মান হয়। এই সেদিন খোকার পুত্র সানডে সাসপেন্স নামক এক বেতারকাহিনীতে উহার কীর্তি শুনিয়া শিহরিত হইতেছিল। ব্যোমকেশ যখন তাহাকে জানায় সে স্বয়ং বরদার সঙ্গে মোলাকাত করিয়াছিল, তাহার পৌত্র অবিশ্বাসের হাসি হাসে। এই আজকালকার দিনের ফ্যাশন হইয়াছে। বয়সের মর্যাদা নাই, কিংবা গেঁয়ো যোগী…। যাহা হউক বরদার কথা লিখিতে হইবে। 

দরজায় বেল বাজিল। পুঁটিরাম দরজা খুলিতেই হাসি মুখে পুরন্দর পান্ডের আবির্ভাব। রিটায়ার করিয়া আমাদের পাড়ায় একখানি ফ্ল্যাট লইয়াছেন। প্রত্যহ সকালে একবার করিয়া ঘুরিয়া যান। ব্যোমকেশ আমার এই লেখার কথা জানাইতেই তিনি আনন্দিত হইয়া কহিলেন "এতো খুব ভাল। তবে আমার মতে আপনি ওঁর ঐতিহাসিক কাহিনিগুলো নিয়ে বেশি করে লিখুন। আহা! কি ভাষা! তিনিই প্রথম লেখক যিনি আগের ভুদেব কিংবা রমেশচন্দ্রর মত ইতিহাসের চোঙ দিয়ে গল্পকে বিশ্লেষণ করে নি। ইতিহাস হাতরান নি। ইতিহাস গল্পরসের হানি ঘটায়নি কোথাও। তুমি সন্ধ্যার মেঘ, কালের মন্দিরা, তুঙ্গভদ্রার তীরে, কুমারসম্ভবের কবি-তে তাঁর কল্পনা যেন আকাশ ছুঁয়েছে। আপনাদের একটা গল্প বলি। ফলিত জ্যোতিষের চর্চা করতেন ভদ্রলোক। নাকি মুখ দেখেই ভবিষ্যৎ বলতে পারতেন। একবার যা হয়েছিল তা মারাত্মক। এক বিখ্যাত মানুষের বাড়ি প্রায়ই যেতেন আড্ডা দিতে। একদিন গেছেন, প্রৌঢ় মানুষটি আনন্দের সঙ্গে শরদিন্দুকে জানালেন তাঁর পুত্র পরীক্ষায় দারুন পাশ দিয়েছে। তিনি খুব খুশি। এবার ছেলেকে বিদেশে পাঠাবেন। শরদিন্দুও দারুণ খুশি। 
ভিতর বাড়ি থেকে ছেলেটি এসে তাঁকে প্রনাম করতেই তাঁর চোখমুখ কেমন বদলে গেল। এদিকে তাঁর বাবা বলে চলেছেন, ভাল সম্বন্ধ এসেছে ছেলের বিয়ের। বিয়ে করেই ছেলে বিদেশ যাবে। ছেলেটি চলে যাবার পর শরদিন্দু গম্ভীর হয়ে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর খুব দৃঢ়ভাবে বললেন, ছেলেকে পারিবারিক ব্যবসার কাজেই লাগান মশাই। বিদেশে পাঠাবেন না। আর হ্যাঁ, বিয়েটা এখনই দেবেন না। প্রৌঢ় অবাক। কেন এমন বলেছেন শরদিন্দু? শরদিন্দু কিছুই ভেঙে বললেন না। উঠে গেলেন।
ভদ্রলোকের মন খচখচ। তবুও বিয়ে হল ঠিক সময়েই। কিন্তু অদ্ভুতভাবে বিয়ের কিছুদন পর থেকেই ছেলেটি খেয়াল করল চোখে ঝাপসা দেখছে। এক বছর ঘুরতে না ঘুরতে পুরো অন্ধ। বিদেশ যাওয়া হল না ছেলেটির। হতে পারে কাকতালীয়। হতে পারে..." 

খেয়াল করি নাই, এর মধ্যেই চায়ের সরঞ্জাম সহ সত্যবতীর প্রবেশ ঘটিয়াছে।পান্ডেজি থামিতেই সে তড়বড় করিয়া কহিল "আমাদের খোকাকেও তো ছেলেবেলায় শরদিন্দুবাবুর লেখা জেনারেল ন্যাপলা, পরীর চুমু, সাপের হাঁচি পড়ে শুনাতাম। আর সদাশিবের গল্পগুলোও দারুণ মজার"

"আমার মোটামুটি লাগে" বলিতেই সত্যবতী এমন কটমট করিয়া আমার দিকে চাহিল, যে পুরাকাল হইলে ভস্ম হইতে কিছুমাত্র সময় লাগিত না। "সে কী ঠাকুরপো! আমার তো তোমার লেখাপড়ার প্রতি বেশ শ্রদ্ধা ছিল। মহারাষ্ট্রের কাহিনিকে বাংলায় এনে অমন দারুণ সব কান্ড আর কে লিখেছেন বল দেখি! আনন্দমেলায় যখন তরুণ মজুমদারের চিত্রনাট্য আর বিমল দাশের ছবিতে প্রকাশ পেত, খোকা যে খোকা, খোকার বাবা, আমি সবাই হামলে পড়তুম, ভুলে গেলে!"
তর্ক বাড়াইলাম না। আমার মুখপুস্তিকার লেখা ঢের বাকি পড়িয়া আছে। অবাক হইয়া বলিলাম "সত্যবতী! তুমিও শরদিন্দু বাবুর ভক্ত!"
"হব নাই বা কেন? কত ভাল রোমান্টিক সব উপন্যাস লিখেছেন ভাব দেখি। দাদার কীর্তি, মেঘদূত, ঝিন্দের বন্দী এমনকি ছোট গল্প ভল্লু সর্দার-ও কত্ সুন্দর। আমার ভারী ভাল লাগে। তোমার লাগে না"
খল হাসিয়া বলিলাম "জানো না বোধহয়, ঝিন্দের বন্দি আসলে প্রিজনার অফ জেন্দার অনুবাদ"
ভীমরুলের চাকে ঢিল পড়িল।"সব জানি ঠাকুরপো। মাকড়সা নিজের পেটের থেকে সুতো তৈরি করে, আর মৌমাছি অন্য ফুল থেকে মধু নিয়ে আসে। কিন্তু তুমি যদি আমায় মধু ছেড়ে মাকড়সার সুতো খেতে বল তা আমার পক্ষে অসম্ভব। তুমি খেলে খাও গে যাও"

অকাট্য যুক্তি। আমাকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া বিজয়িনীর হাসি হাসিয়া সত্যবতী কহিল "তুমি বোধহয় সিনেমা থিয়েটার বিশেষ দেখ না ঠাকুরপো। দেখলে জানতে উত্তমকুমার থেকে আবীর, অনির্বান, সব কালের সব সুপুরুষ নায়কই আমাদের ওঁর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন"। ব্যোমকেশ সলজ্জ হাসি দিল। বুঝিলাম এই বিষয়ে আজ আমার জয়লাভ করা অসম্ভব। 

যে লেখা লিখিতে বসিয়াছিলাম তাহা শেষ হইল না। থাক। এতকাল পরে নূতন করিয়া লেখা শুরু না করাই বুঝি ভাল।মৃত্যুর পর কোন কোন লেখক হারাইয়া যান। কেহ আবার চরম স্রোতস্বতী নদীর মত তীব্রবেগে জনমানসে ফিরিয়া আসেন ।শরদিন্দু এই দ্বিতীয় শ্রেণীর অদ্বিতীয় লেখক।

মৃত্যুদিনে তাঁহাকে প্রণাম জানাই।

শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

যতীন দাস ও রক্তঋণ ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

"রক্তঋণ"

কে এই টেরেন্স ম্যাকসুইনি? তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার রাজদ্রোহ এর অভিযোগে এই তরুণ আইরিশ স্বাধীনতা সংগ্রামীকে ব্রিকস্টন  কারাগারে বন্দী করে। ব্রিটিশদের অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি ৭৪ দিন অনশনের পর প্রাণ ত্যাগ করেন। আজকের দিনটা তাঁকে নিয়ে নয়, এক "ভেতো" বাঙালিকে নিয়ে। যার নাম যতীন দাস। কে এই যতীন দাস?  হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মির সদস্য বিপ্লবী অজয় ঘোষ (পরবর্তীকালে সিপিআই এর সাধারণ সম্পাদক) এর ভাষায়, " কলকাতা থেকে যতীন দাস কে আনা হয়েছিল যাতে তিনি আমাদের বোমা বাঁধতে শেখান।" [সূত্রঃ ১] সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ এসেম্বলি তে ভগৎ সিং যে বোমা ছোঁড়েন সেটি যতীন দাসের বানানো।



আরেক বিপ্লবী সুভাষ চন্দ্র বোস (তিনি তখনো নেতাজি হননি), তাঁর নিজের ভাষায় তাঁর সাথে বিপ্লবী যতীন দাসের যোগাযোগ ও সম্পর্ক বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন,  "At the time of the Calcutta Congress in 1928, and after, he had taken a leading part in organising and training volunteers and in the Bengal Volunteer Corps of which the writer was the Chief officer or G.O.C, he held the rank of Major. ….After the Congress was over, the Volunteer Corps was maintained and branches were opened all over the Province. In this arduous work, Jatin had played an important role. "   [সূত্র ১: ]

লাহোর জেলের বিচারাধীন বন্দীদের উপযুক্ত মর্যাদার দাবিতে ভগত সিং এর সাথে যতীন দাস যোগ দেন অনশনে। ৬৩ দিন অনশন এর শেষে লাহোরে যতীন দাসের মৃত্যু হয় কারণ জেলবন্দী অবস্থায় কর্তৃপক্ষ তাঁকে জোর করে গলায় নল ঢুকিয়ে তরল খাবার খাওয়াতে যায়, যাকে বলা হয় ফোর্স ফিডিং, সেই তরল ভুল করে বুকে ঢুকে নিউমোনিয়া এবং মৃত্যু। কলকাতায় তাঁর শেষ যাত্রার সময় তাঁর বাবা বঙ্কিম বিহারী দাস অকাল মৃত যুবক পুত্রের মুখের দিকে তাকাতে অস্বীকার করলেন। ফোর্স ফিডিং এর চেষ্টায় নিউমোনিয়া আক্রান্ত যন্ত্রনাবিদ্ধ একটা মুখ। বললেন, "ছেলের সেই শেষ মুখটা মনে রাখতে চাই, যেটা লাহোর যাওয়ার আগে দেখেছিলাম।"

যতীন দাসের মরদেহ কলকাতায় (হাওড়ায়) নিয়ে আসার পরে তাঁর মৃতদেহ সারারাত পাহারা দেওয়ার জন্য থাকলেন সুভাষ। পরের দিন কলকাতা জুড়ে বিশাল মিছিল সহকারে অন্তিম যাত্রা কেওড়াতলার ঘাটের উদ্দেশ্যে। সংগঠন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে মেয়র যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত এর সাথে সেই সুভাষ।  [সূত্র ২:]
পথের ধারে অগণিত মানুষ, মহিলা শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। মিছিলে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছে অগণিত ছাত্র যুব। তাদের হাতে প্ল্যাকার্ড। " নবযুগের দধীচি শহীদ বিপ্লবী যতীন দাস লহ প্রণাম"। মুখাগ্নি করলেন দাদা। শেষ অভিবাদন জানালো সুভাষ বসুর নেতৃত্বে বেঙ্গল ভলান্টিয়ারস। [সূত্র: ৩]

সুভাষের নিজের ভাষায়, "So Jatin Das died on September 13. But he died the death of a martyr. After his death the whole country gave him an ovation which few men in the recent history of India has received. As his dead body was removed from Lahore to Calcutta for cremation, people assembled in their thousands or tens of thousands at every station to pay their homage. His martyrdom acted as a profound inspiration to the youths of India and everywhere student and youth organisations began to grow up. " [সূত্র ৪]

স্মরণ সভায় সুভাষ স্মৃতিচারণ করলেন একদা সহকর্মীর। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে আবেগে ভেঙে পড়লো তাঁর গলা। তুলে ধরলেন কিভাবে অনশন-ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার কিছুদিনের ।মধ্যে  অনশনকারীর মনের মধ্যে আসে এক বৈপ্লবিক রূপান্তর। [সূত্র ১:]

আয়ারল্যান্ড থেকে কলকাতার মেয়রকে পাঠানো টেলিগ্রামে মেরি ম্যাকসুইনি লিখলেন, " Family Terrance Mac Swiney unites patriotic India in grief and pride on death of Jatin Das. Freedom will come"। উত্তরে মেয়র লিখলেন, "India feels grateful for your message. Terrancc Mac Swiney showed the way Ireland Freedom. Jatin Das has followed him" ঠিক এইখানেই দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদীদের সাথে বামপন্থী জাতীয়তাবাদীদের তফাৎ কারণ বামপন্থীরা জাতীয়তাবাদী হওয়ার সাথে আন্তর্জাতিকতাবাদী ও বটে। তাই ম্যাকসুইনি পরিবারের এই সমবেদনা হাজার মাইল দূরের যতীন দাসের পরিবারের প্রতি। 

শুধু ম্যাকসুইনী পরিবার নয়, Eamon De Valera, আইরিশ স্বাধীনতা সংগ্রামের মুর্ত প্রতীক টেলিগ্রামে লিখলেন, "Jatin Das has not died in vain. He is the Indian MacSwiney. Freedom is certain" ভ্যালেরার এই আশা বৃথা যায় নি। ভারত দেশটা স্বাধীন হয়েছিল। [সূত্র: ৩]। 

শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সেদিনের রাজপথে নামা ছাত্র যুবরা সঠিকভাবেই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলেছিলেন। অত্যাচারী শাসককে পরাস্ত করার মোক্ষম আয়ুধ প্রস্তুত করতে গেলে আত্মত্যাগ লাগে। লাগে দধীচির হাড়। 

আজ ১৩ই সেপ্টেম্বর। শহীদ দিবস। সেই যতীন দাসের মৃতু বরণের দিন, সেই যতীন দাস কারারুদ্ধ হওয়ার আগে প্রকাশ্যে যার শেষ স্লোগান ছিল "ইনকিলাব জিন্দাবাদ"। আজকে গাজা ভূখণ্ডে প্যালেস্তাইন এর নাগরিকদের ওপর সাম্রাজ্যবাদ এর অত্যাচারের বিরুদ্ধে কলকাতার রাজপথে স্লোগান তোলা বামপন্থী ছাত্র যুবরাই শহীদ যতীন দাসের প্রকৃত উত্তরাধিকারী, মুচলেকা বীরের অনুগামী কোনো দক্ষিণপন্থীরা নয়, তাদের কোনো নৈতিক অধিকারই নেই বামপন্থীদের আন্তর্জাতিকতাবাদ নিয়ে, দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলার। 

"শহীদ স্মরণে, আপন মরণে রক্তঋণ ....."

তথ্যসূত্রঃ
সূত্র ১: লেনার্ড গর্ডন, ব্রাদার্স এগেইনস্ট দ্যা রাজ
সূত্র ২: সুনীতি ঘোষ, দ্যা ট্র্যাজিক পার্টিশন অফ বেঙ্গল
সূত্র ৩: সি এস ভেনু, যতীন দাস দ্যা মারটার, প্রথম সংস্করণ।
সূত্র ৪: সুভাষ চন্দ্র বোস, দ্যা ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল (১৯২০-১৯৪২)

সোমবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

চন্দ্রগ্রহণ ও কুসংস্কার ~ অনির্বাণ অনীক

ইতিহাসবিদ ব্রায়ান লেভ্যাক এবং অন্যান্য গবেষকরা দেখিয়েছেন যে ১৪৫০ সালের পর থেকে প্রিন্টিং প্রেস ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ার পর ডাইনি শিকার বা witch hunt আরও তীব্র হয়ে ওঠে।



এর কারণ, প্রিন্টিং প্রেসের মাধ্যমে ডাইনি ও শয়তান সম্পর্কিত বই, ম্যানুয়াল, প্যামফ্লেট দ্রুত ও সস্তায় ছাপা সম্ভব হয়। উদাহরণ হিসেবে ১৪৮৭ সালে প্রকাশিত  berüchtigte Malleus Maleficarum বইটির কথা বলা যায়। এই বইটি ডাইনি সনাক্ত ও শাস্তি দেওয়ার "গাইডবুক" হয়ে উঠেছিল।

সেদিনের প্রিন্টিং প্রেসের জায়গাটি আজ নিয়েছে ফেসবুক, সমাজ মাধ্যম এবং দুনিয়ার নিকৃষ্টতম সংবাদ মাধ্যম ভারতীয় অনলাইন মিডিয়া।  চন্দ্র গ্রহণের প্রাক্কালে ফেসবুকের গ্রুপগুলো গত দুদিন ধরে কুসংস্কারের আড়ত হয়ে উঠেছে।  আলোচনার বিষয় গ্রহণের সময় কী খেতে নেই, কোনদিকে শুয়ে ঘুমাতে নেই, খাবার বিষাক্ত হয় কিনা -  ইত্যাদি মধ্যযুগীয় বাছ বিচার। তাতে ধুয়ো দিয়ে চলেছে গুচ্ছের অনলাইন মিডিয়া।  

গ্রহণ ঘিরে নানা কুসংস্কার থাকলেও সত্য হলো, এই সময়ে খাওয়া, ঘুমোনো বা গান-নাচ করার মধ্যে কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। খাবারও তখন স্বাভাবিক থাকে; বিষাক্ত হয় না, অতিরিক্ত জীবাণু জন্মায় না, কিংবা কোনো "রেডিয়েশন"ও মিশে যায় না। কিন্তু যারা সারসত্যটা বোঝেন, ভারতীয় সমাজের নিয়ন্ত্রণ এককালে তাঁদের হাতে যতটুকু ছিল, আজ সেটুকু নিয়ন্ত্রণও তাঁরা হারিয়েছেন। এই পোস্ট ট্রুথের যুগে মানুষকে বোঝানোর সাধ্যি কারো নেই!    

অনেক মুক্তচিন্তক বিশ্বাস করেন বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নতির হাত ধরে কুসংস্কার এবং ধর্মমোহের প্রাচীরে ফাটল ধরবে। এ একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা। প্রযুক্তি নিজে নিরপেক্ষ। প্রযুক্তি কার হাতে, কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তার ওপরই নির্ভর করছে সমাজ বিজ্ঞানের পথে এগোবে নাকি কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হবে। দুনিয়ার আর দশটি বিষয়ের মতো এই বিষয়টিও পুরো দস্তুর রাজনৈতিক।  আজকের বাংলা তথা ভারত তা পদে পদে প্রমাণ করে ছাড়ছে!