কিছুদিন আগে কথা। কাজের দায়িত্বের অঙ্গ হিসেবে একটা বড় হাসপাতালে গিয়েছিলাম প্রেসক্রিপশন অডিট করতে সঙ্গে আরো কিছু দেখতে। সময়টা ছিল বড়দিন এর আশপাশে। সেই ভিজিটের রিপোর্ট লিখতে বসে ভেবেছিলাম যে অনেক কিছুই ভালো দেখলাম। লেবার রুম খুব সুন্দর, সাজানো গোছানো। ডাক্তার সিস্টারদের বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা ও জ্ঞানও খুবই ভালো। কেবল একটা জিনিস একটু আপত্তিজনক মনে হয়েছিল। মায়েদের একটু বেশি কড়া হায়ার জেনারেশন এন্টিবায়োটিক লেখা হচ্ছে যা স্ট্যান্ডার্ড ট্রিটমেন্ট প্রটোকল অনুযায়ী ঠিক নয়। এনিয়ে সুপারের সাথে আলোচনার ফাঁকে গাইনোকলজিস্ট আসলেন। ঘটনাচক্রে সে আমার পুরানো বন্ধু বেরিয়ে গেল। মেডিক্যাল কলেজের সহপাঠী।
একথা সেকথার পরে আমার আপত্তির প্রসঙ্গটা তোলার পরেই হঠাৎ খেপে গেলো বন্ধুটি। আমার হাত ধরে টানতে টানতে ওয়ার্ডে নিয়ে গেল। সেখানে এত ভিড় যে মায়েদেরও মেঝেতে রাখতে হচ্ছে। তাদের দেখিয়ে বন্ধু বললো উত্তেজিত হয়ে, "এই যে দেখছিস, মেঝেতে শুয়ে আছে, এরা মানুষ নয়, কুকুর, আর ওদের সাথে শুয়ে আছে, ওরা মানুষের বাচ্ছা নয়, ওরা কুকুরের বাচ্চা। আর আমি মানুষ নয়, কুকুরের ডাক্তারি করি। তোর কোন টেক্সট বই বা স্ট্যান্ডার্ড প্রটোকলে লেখা আছে যে প্রসব বা সিজার হওয়া মাকে মেঝেতে শুতে হয় ? "
বন্ধু তখন উত্তেজিত হয়ে যা তা অবস্থা, আমাকে প্রায় চিৎকার করে বলছে, " হ্যাঁ আমি জানি, আমি হায়ার এন্টিব্যাওটিক লিখি। ইচ্ছে করেই লিখি, যাতে মেঝেতে থাকা এদের ইনফেকশন না হয়, কাল থেকে তুই এদের বেডে শোয়ার ব্যবস্থা করে দে, আর লিখবো না।"
সত্যি বলতে কি আমি এতদিনের আগের বন্ধুর এই অবস্থা দেখে নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নিয়েই ফেরত এসেছি। এসে নেট ঘেঁটে দেখছিলাম যে ভারত সরকার সত্যিই স্বাস্থ্য নিয়ে কতটা চিন্তাভাবনা করে।
এ বছরের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট ৬,২১,৯৪০ কোটি, গ্রামীণ খাতে বাজেট ২,৬৫,৮০৮ কোটি, কৃষি খাতে ১,৫১,৮৫১ কোটি, গৃহ মন্ত্রক খাতে ১,৫০,৯৮৩ কোটি, শিক্ষা খাতে ১,২৫,৬৩৮ কোটি, আই টি টেলিকম খাতে ১,১৬,৩৪২ কোটি টাকা বরাদ্দ আর সাত নম্বরে আছে স্বাস্থ্য যার বরাদ্দ মাত্র ৮৯,২৮৭ কোটি টাকা।
ফিরে আসার আগে আমার সেই বন্ধুর সাথে আবার দেখা। তখন ওর মেজাজ অনেক ঠান্ডা হয়ে এসেছে। হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে অনেক পুরোনো সুখ দুঃখের গল্প হল। বলেছিল, "রাগের মাথায় বলেছি, তুই কিছু মনে করিস না, আমার অসহায় অবস্থা টা একটু বোঝার চেষ্টা করিস।"
ফিরে এসে রিপোর্টে আমাকে লিখতেই হয়েছিল সেই স্ট্যান্ডার্ড ট্রিটমেন্ট প্রটোকল ভাঙার কথা, বন্ধুকে যতই ভালোবাসি। আমি নিরুপায়। কিন্তু রিপোর্ট লিখতে বসে ওর সেই রাগী মুখটা বারবার মনে পরে যাচ্ছিল আর সেই কথাটা। "আমি মানুষের নয়, কুকুরের চিকিৎসা করি"।
আমরা ভারতের নাগরিকরা স্বাধীনতার এত বছর বাদেও ভারত সরকারের চোখে সত্যিই বোধহয় "মানুষ" হয়ে উঠতে পারলাম না। পারলে প্রসূতি মাকে তার সদ্যজাত শিশুকে নিয়ে হাসপাতালের মেঝেতে ঠাঁই নিতে হত না।
আমরা আবার আমাদের দেশ নিয়ে বড়াই করি। লেটেস্ট রাফায়েল জেট বিমান আমাদের অস্ত্র সম্ভারে যোগ করে আমরা উল্লসিত হই। ভারতের মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী তাঁর চিরাচরিত ধুতি খুলে ফাইটার পাইলট এর ড্রেস পরে ছবি তুলে, লেবু ঝুলিয়ে পোজ দেন ফটোর জন্য। সেই ছবি হাজার লক্ষ শেয়ার হয়, লাইক হয়। আমরাই করি।
অনেকদিন আগে আস্তাবলে এক দেবশিশুর নাকি জন্ম হয়েছিল। সেই দিনটা যাকে আমরা বড়দিন বলে মানি। সেটাও কনকনে ঠান্ডার দিন ছিল। আজও তাই। আজও অনেক দেবশিশুর জন্ম হবে। আমাদের কেবল ভাবা দরকার যে তাদের কজন মানুষের বাচ্চা আর কজন তালিকায় সাত নম্বর এ থাকা "কুকুরের বাচ্ছা" আমার সেই বন্ধুর ভাষায় ?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন