মঙ্গলবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

"হিজাব একটি বিতর্ক" ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

হিজাব কি একটি অমানবিক সামাজিক প্রথা? অমানবিক বলতে আমরা সাধারণত বুঝি, যে সামাজিক প্রথা মানলে দেহ ও মনের অপূরণীয় চূড়ান্ত ক্ষতি হয় যেমন সতীদাহ বা সহমরণ প্রথা বা তিন তালাক প্রথা বা মেয়েদের খতনা ইত্যাদি ইত্যাদি। মাথায় সিঁদুর দিলে বা পাগড়ি বাঁধলে বা গলায় পৈতে ঝোলালে বা হিজাব পরলে আপাতদৃষ্টিতে ততটা ক্ষতি হয় বলে আমাদের মনে হয় না। কিন্তু ক্ষতি যে হয় সেটা  অনেকেই মনে করেন এবং তাদের যুক্তিতে সারবত্তা আছে এটা বুঝে নিয়েই আলোচনাটা শুরু করা যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে এটা মনে রাখতে হবে যে হিজাব নিষিদ্ধ করার, বিশেষত বিদ্যায়তনে নিষিদ্ধ করার সপক্ষে যারা আছেন তারা একটা যুক্তি খাড়া করেন যে এর ফলে ছাত্র ছাত্রীদের যে ইউনিফর্ম পরে আসার প্রচলন আছে, সেটা নষ্ট হবে, ডিসিপ্লিন নষ্ট হবে। এর বিরুদ্ধে দুটো কথা বলার। প্রথমত সারা পৃথিবী জুড়ে এমন অসংখ্য স্কুল আছে যেখানে ইউনিফর্মের কোনো বালাই নেই। সে সব ছেলেপুলের লেখাপড়া হচ্ছে না, তাদের ভবিষ্যত ঝরঝরে হয়ে গেছে এমনটা নয়। দ্বিতীয়ত ভারতের সবচেয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ ফোর্সের দিকে তাকানো যাক, ভারতীয় সেনাবাহিনী। তাতে দিব্যি বছরের পর বছর ধরে একদল সৈন্য মাথায় পাগড়ি বেঁধে আসছে। এর জন্য সেনাবাহিনীর ডিসিপ্লিন নষ্ট হয়ে গেছে এমন দাবি অতি বড় পাগলেও করবে না। 

এ প্রসঙ্গে কর্ণাটক সরকার "পাবলিক স্পেস" এর কথা তুলেছে। তাদের যুক্তি স্কুল যেহেতু পাবলিক স্পেস সে জন্য বাড়ি থেকে হিজাব পরে এলেও সেটা খুলে স্কুলে ঢুকতে হবে। ওই একই যুক্তিতে বলা যায় যে তাহলে এবার থেকে নিয়ম করা হোক যে লোকসভা বা বিধানসভায় বা মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে গেরুয়া পরে আসা যাবে না, ওটা খুলে অন্য কাপড় পরে ঢুকতে হবে। 

হিজাব কি চয়েস? এই মানবিক/ অমানবিক  প্রসঙ্গে এই চয়েস বিষয়টিও উঠে আসে বারেবারে। বাড়ি/পরিবার থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, মানা/ না মানার কোনো সুযোগ নেই এমন নিদর্শন এর পাশাপাশি স্বেচ্ছায় হিজাব পরেন তারও কিন্তু নিদর্শন আছে। যারা চয়েস করেছেন তাদের সবার চয়েস যে informed choice এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। যারা মনে করেন যে হিজাব অমানবিক তারা বড়জোর ওই ইনফর্মেশন ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন, সংবিধান প্রদত্ত বাক স্বাধীনতার অধিকারকে কাজে লাগিয়ে জনমত তৈরির চেষ্টা করতে পারেন যেমনটা হয়েছিল তিন তালাকের সময়। কিন্তু গায়ের জোরে হিজাব পরা বন্ধ করতে পারেন না। 

হিজাব কি একটি পুরুষতান্ত্রিক প্রথা? যারা নিজেদের কিঞ্চিৎ আলোকপ্রাপ্ত শিক্ষিত ইত্যাদি মনে করেন তারা সবাই মিলে রে রে করে তেড়ে আসবেন। এটা কোনো প্রশ্ন হল? সব্বাই জানে যে এটা পুরুষতান্ত্রিক প্রথা, এ নিয়ে আলোচনার কোনো অবকাশই নেই। গোল বেঁধে যায় এইখানেই। প্রথাটি যে পুরুষতান্ত্রিক সেই বক্তব্য মেনে নিয়েই এই অবকাশ থেকে যায় যে এই মতামতটা রাষ্ট্র বা সরকার এর পক্ষ থেকে চাপিয়ে দেওয়া যায় কি না। মানুষকে নিজেকে নিজের মতো করে উপলব্ধি করার সুযোগ না দিয়ে, জনমত গঠন না করে এ ভাবে চাপিয়ে দিলে যেটা হয়, যে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস এ ভোগা মানুষ তার এথনিক কালচারাল আইডেন্টিটিকে আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরে, সেটা ভালো না খারাপ বিচারে না গিয়ে, বিশেষ করে সেই মানুষজন যারা যেদেশে সংখ্যালঘু। 

আরো মস্ত ফাঁকির জায়গা এখানেই যে হিজাব পুরুষতান্ত্রিক বলে চিল্লানোর দলের একটা বড় অংশ সিঁদুর শাঁখা নিয়ে একেবারেই চুপচাপ। যে রাজনৈতিক দল হিজাব নিষিদ্ধ করতে কোমর বেঁধে লেগেছে, তাদের দিকে তাকালেই এই চরম দ্বিচারিতাটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। এই আলোকপ্রাপ্তির ধ্যান ধারণাটা আমরা যে পাশ্চাত্য থেকে পেরেছি তার তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত নারী পুরুষদের একটা বড় অংশ ভিয়েতনাম বা ইরাকে নির্বিচারে তাদের সেনা দ্বারা হত্যালীলা নিয়ে সম্পূর্ন নীরব ছিল। 

হিজাব পরার কী সাংবিধানিক অধিকার আছে? সংবিধানে সরাসরি ভাবে হিজাব পরার কোনো উল্লেখ নেই, থাকার কথাও ছিল না। Article 25(1) এ সুস্পষ্ট ভাবে বলা আছে "Freedom of conscience and the right to freely profess, practise, and propagate religion." সুপ্রীম কোর্ট বিভিন্ন সময়ে নিদান দিয়েছেন যে অত্যাবশ্যক ধর্মীয় আচরণ পালনে বাধা দেওয়া যাবে না। হিজাব নিষিদ্ধ করার গা জোয়ারির বিরুদ্ধে যারা সংবিধান প্রদত্ত ধর্মাচরণ এর মৌলিক অধিকারের কথা তুলছেন তাদের মুখ বন্ধ করার জন্য বলা হচ্ছে যে হিজাব কোনো অত্যাবশ্যক ধর্মীয় আচারের অঙ্গ নয়। উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে যে আমাদের দেশে তো বটেই, পৃথিবীর নানান দেশে ইসলাম অনুরাগীরা হিজাব ব্যবহার করেন না। ধরুন একই যুক্তিতে বলা যায় যে আমিষ খাওয়াটাও হিন্দু ধর্মের অত্যাবশ্যক অঙ্গ নয়। তাই কাল থেকে আমিষ ভক্ষণ নিষিদ্ধ করে দিলে কিছুই কিন্তু বলার থাকবে না। ফাঁকিটা আসলে অন্যখানে। কোন আচার আচরণ অত্যাবশ্যক আর কোনটা নয় এটা ঠিক করে দেওয়ার অধিকার কে কাকে দিল এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। আমার ধর্মকে আমার মতো করে ব্যক্তিগত পরিসরে ব্যাখ্যা করার সুযোগটাই কেড়ে নেওয়া হল। 

হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা নিয়ে আদৌ মাথা ঘামানোর দরকার আছে? যারা মনে করেন দরকার নেই তাদের পক্ষের সবচেয়ে শক্তিশালী যুক্তিটা হল এই যে এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট করলে "আসল সমস্যা" থেকে নজর সরে যাবে, রুটি রুজির লড়াইটা পেছনে চলে যাবে। এর বিরুদ্ধে এটাই বলা যায় যে রুটিরুজির লড়াইটা ঠিক মতো করতে গেলে একজোট হয়ে থাকাটা খুব জরুরী আর একজোট যাতে না থাকতে পারে লোকজন, সেটা ভেস্তে দেয়ার জন্যই প্রতিক্রিয়ার শক্তিদের এসব আয়োজন। 

হিজাব নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কারা করবেন? যারা বলছেন যে হিজাব পরার পক্ষে হুল্লোড় করে একদল "বাম-ইসলামিক" আসলে মুসলিম সমাজকে পিছিয়ে রাখতে চাইছে, তাদের "অপর" করে রাখতে চাইছে, মেনস্ট্রিম হতে দিচ্ছে না তাদের মনে রাখতে হবে যে এই আলোচনাটা কোনো একটা ভ্যাকুয়াম স্পেসে হচ্ছে না। যে পরিসরে হচ্ছে সেটা ভারত নামের একটা দেশ যার অঙ্গরাজ্য কর্ণাটক যেখানে একটা ফ্যাসিস্ট দল পরিচালিত সরকার হিজাব নিষিদ্ধ করার এই এক্সপেরিমেন্টটা করে দেখছে, সফল হলে গোটা দেশ জুড়ে করবে ভবিষ্যতে। 

সেই এক্সপেরিমেন্টের আঁচ আমার আপনার সবার ব্যক্তিগত জীবনেও আজ বা কাল লাগবে। তখন আর এসব আলোচনা করারই কোনো অবকাশ থাকবে না। শুধু মুসলিমরা নয়, খ্রিস্টান, শিখ এমন কি হিন্দুরাও পার পাবে না। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে এই অধিকার হরণের খেলাটা কেবল একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে নিশানা বানিয়ে খেলা হবে।

জীবনযাত্রার প্রতিটা পদক্ষেপ ওই ফ্যাসিস্ট শক্তি নিয়ন্ত্রণ করবে। ওদের ইচ্ছে হলে আমিষ খাওয়া নিষিদ্ধ করে দেবে, ভারতীয় সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে মহিলাদের জিন্স পরা বন্ধ করবে, পার্কে নারী পুরুষের বসা বন্ধ করবে, রাষ্ট্র বিরোধী দোহাই দিয়ে নানান বইপত্র পড়া নিষিদ্ধ করবে, নাস্তিককে সরস্বতী বন্দনা করতে বাধ্য করবে, হিন্দু বাঙালিকে বাধ্য করবে দ্বিভূজা সরস্বতীর বদলে চতুর্ভুজ সরস্বতীর উপাসনা করতে – ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণের এই পিচ্ছিল অবনমনের কোনোই শেষ নেই। ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির বদলে তার জায়গা নেবে সংঘ পরিবারের মনোমত "নাগপুরীয়" সংস্কৃতি। শেষের সেদিন বড় ভয়ংকর। তাই হিন্দু মুসলিম শিখ, নাস্তিক ডান-বাম বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশেষে মানুষকে প্রতিবাদ করতে হবে। 

ঠিক কিসের দাবিতে বিক্ষোভ? যারা এতসব জানেন না তাদের কথা বাদ দেওয়া যায়, যারা এসব কিছু জেনেও না জানার ভান করে এই বিতর্কটাকে নিছক একটা একাডেমিক খোলস পরানোর চেষ্টা করেন, একটা "শ্রীনিরপেক্ষ" সাজার চেষ্টা করেন, তাদের অবস্থান সবচেয়ে বিপদজনক। এখনো সময় আছে, সুযোগ আছে, সুবিধাবাদী হাবভাব ছেড়ে স্পষ্ট কথা স্পষ্ট করে বলার, পক্ষ নেওয়ার। হিজাব পরতে দেওয়ার দাবিতে নয়, হিজাব নিষিদ্ধ করার এই ফ্যাসিস্ট কায়দার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবেই। হিজাব পরা বা না পরার অধিকার সবার আছে। কোনোটাই জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার তালিবানি কায়দা মেনে নেওয়া যাবে না।

1 টি মন্তব্য:

  1. ইদানিং প্রতিটা পদক্ষেপ মুসলিমদের কে টার্গেট করে নিচ্ছে! আমি একজন বাংলাদেশী, ভারতের পাশে থেকে আমরা গর্ববোধ করতাম,কিন্তু গত ৭-৮ বছর,ঠিক মেলানো যাচ্ছে না। সেই উদার,মহান ভারত আবার ফেরত আসুক

    উত্তরমুছুন