বুধবার, ১১ আগস্ট, ২০২১

ক্ষুদিরাম বসু ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

কিংসফোর্ডকে লক্ষ্য করে ক্ষুদিরাম বসুর ছোঁড়া বোমাটা সেদিন সঠিক লক্ষ্যে লাগেনি। এক অর্থে ব্যর্থ। সেই ব্যর্থ মানুষটিকে নিয়ে লিখতে বসার কিছুতো কারণ থাকবে। সেটা জানার ইচ্ছে হলে সুধী পাঠক এই লেখাটার বাকি অংশ পড়ে দেখতে পারেন।

কে এই কিংসফোর্ড, কেন তাঁকে মারার জন্য বিপ্লবীরা তৎপর হয়েছিলেন জানতে একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। বন্দে মাতরম পত্রিকায় রাজদ্রোহমূলক প্রবন্ধের জন্য অরবিন্দ ঘোষ অভিযুক্ত হয়েছিলেন। সেই মামলায় সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করায় বিপিন চন্দ্র পাল অভিযুক্ত হন। তার বিচারের দিন লালবাজার পুলিশ কোর্টের সামনে জমায়েত হওয়া জনতার ওপর এক ইউরোপীয় ইন্সপেক্টর লাঠি চালানোর নির্দেশ দেয়। তাতে উত্তজিত হয়ে সুশীল সেন ওই ইন্সপেক্টর এর মুখে ঘুষি চালায়। এই অপরাধে সেই ১৪ বছরের কিশোর কে ১৪ ঘা বেতের বাড়ি খেতে হয় যে বিচারকের আদেশে তার নাম ম্যাজিষ্ট্রেট কিংসফোর্ড। (হেমচন্দ্র কানুনগো: বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা)

নিজের দেশে মহান "বুর্জোয়া লিবারাল গণতন্ত্রী" সাজা বৃটিশরা এভাবেই ভারতের বুকে তাদের "ব্রুট" শাসন চালিয়ে এসেছিল। তাতে সাথে পেয়েছিল এই দেশেরই কিছু অনুচর কে। কিংসফোর্ড কে হত্যার চেষ্টায় জড়িত ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকির এই কাজ কে সমর্থন করে বাল গন্ধাধর তিলক তার মারাঠি পত্রিকা কেশরী তে লিখেছিলেন যদিও তিনি ভায়োলেন্স কে সমর্থন করেন না, তবুও "The rulers who always exercise unrestrained power must remember that there is always a limit to the patience of humanity". And so, 'violence', however deplorable, became inevitable"

এই কারণে তিলক এর বিরুদ্ধে মামলা হয়। ভারতীয় জুরীরা তাকে নির্দোষ বলে ঘোষণা করলেও ইউরোপীয় জুরীদের রায়ে বার্মার মান্দালয় জেলে তাঁর ছয় বছরের কারাবাসের সাজা হয়। 

সেই রায়ের খবর শুনে প্রতিক্রিয়া দিলেন কয়েক হাজার মাইল দূরে থাকা এক রাশিয়ান বিপ্লবী। জেনিভার এক ছোট্ট কুঠুরি থেকে সেকেন্ড হ্যান্ড ট্রেডল মেশিন থেকে পত্রিকায় ছাপা হ'ল সেই বিখ্যাত প্রবন্ধ "বিশ্ব রাজনীতির বিস্ফোরক মালমসলা"। কি অদ্ভুত যোগাযোগ। সেই লেখকও নিজের দেশ থেকে নির্বাসিত। নাম ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। কাগজের নাম প্রলেটারী। সংখ্যা তেত্রিশ।

"ব্রিটিশ খ্যাকশিয়ালরা ভারতীয় গণতন্ত্রী তিলক কে যে কুখ্যাত সাজা শুনিয়েছে" তার তীব্র সমালোচনা করে, বিপ্লবী তিলক এর অবমাননার প্রতিবাদে তথাকথিত সভ্য, নিজেদের দেশে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের চর্চা করা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মুখোশ খুলে নিজের লেখনী তে উলঙ্গ করে দিলেন লেনিন লিখলেন, "In India lately, the native slaves of the "civilised" British capitalists have been a source of worry to their "masters". There Is no end to the acts of violence and plunder which goes under the name of the British system of government in India." (লেনিন: ইনফ্লেমেবল মেটেরিয়াল ইন ওয়ার্ল্ড পলিটিক্স)

"মহান" ব্রিটিশ ন্যায়বিচার কে ব্যঙ্গ করে লেনিন আরো লেখেন, "The infamous sentence pronounced by the British jackals on the Indian democrat Tilak—he was sentenced to a long term of exile, the question in the British House of Commons the other day revealing that the Indian jurors had declared for acquittal and that the verdict had been passed by the vote of the British jurors!—this revenge against a democrat by the lackeys of the money-bag evoked street demonstrations and a strike in Bombay."

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে দুই বিপ্লবীর বুকে আলোড়ন তুলে দেওয়া ক্ষুদিরাম এর মতো মানুষরা নিজেদের জন্য বিপ্লবী, মুক্তিযোদ্ধা, দেশের জন্য বলিপ্রদত্ত, স্বাধীনতা সংগ্রামী— এই সব বিশেষণই ব্যবহার করতেন। কিন্তু এই জাতীয় সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামীদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য ব্রিটিশ গুপ্তচর বিভাগের অফিসাররা 'অ্যানার্কিস্ট', 'টেররিস্ট' ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেন। ডিরেক্টর অব ইন্টেলিজেন্স সি আর মিডল্যান্ড তো এঁদের 'পলিটিকো-ক্রিমিনাল কনস্পিরেটর' বলে নিন্দা করেন। সশস্ত্র সংগ্রামীদের সন্ত্রাসবাদী তকমা ব্রিটিশরাই দিয়েছে। (দ্র: অনুশীলন সমিতির ইতিহাস, সম্পা: অমলেন্দু দে, পৃ ১৬-১৭)। 

কলোনিয়াল শাসক ও তাদের ধামাধরা ইতিহাসবিদদের লেখা পড়ে আমাদের পূর্বসূরী ও আমাদের প্রজন্মের অনেকেই বড় হয়েছি। ওই "সন্ত্রাসবাদী" শব্দটা আমাদের মনে শিকড় গেঁড়ে বসে আছে। তাই স্বাধীনতার পরে পরেই স্বাধীন ভারতের প্রধান ক্ষুদিরাম এর মূর্তি উন্মোচন করতে অস্বীকার করেন। উনি ভিন্নধারার রাজনীতিবিদ বলে নয় শুধু, উনি "পন্ডিত" মানুষ ছিলেন, জানতেন যে ক্ষুদিরাম জাতীয় মানুষরা শুধু বৃটিশ নয়, তাঁর পক্ষেও বিপদজনক। তাঁর ধারা ধরে আমাদের অনেকেই এখনো ক্ষুদিরামকে নিয়ে বলতে ইতস্ততঃ করেন। মানুষটা "টেরোরিস্ট" ছিল যে। 

ক্ষুদিরাম ও তার সহযোগীরা ঠিক কি ছিলেন সেটা বুঝতে সম্পূর্ণ আলাদা দৃষ্টিকোন এর আশ্রয় নিতে হচ্ছে। তথ্য এক) বিপ্লবীদের দমনের জন্য সবচেয়ে কুখ্যাত ব্রিটিশ আইন এর নাম "রাউলাট বিল"। বিলটার পোশাকি নাম খেয়াল করুন সুধী পাঠক, "দি এনারকিক্যাল এন্ড রেভলিউশনারী ক্রাইম এক্ট"। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ লিখছে "রেভলিউশনারী"!! লিখতে বাধ্য হচ্ছে। 

তথ্য দুই) স্যার চার্লস টেগার্ট তার বক্তৃতায় বলছেন, "বিপ্লবীদের কর্মতৎপরতায় সরকারি যন্ত্র অচল হওয়ার মতো বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল" ( টেরোরিসম ইন ইন্ডিয়া, ১লা নভেম্বর, ১৯৩২, রয়েল এম্পায়ার সোসাইটি)

১৮ বছরের একটা বাঙালি ছেলে ভুল লোককে বোমা ছুঁড়ে যদি সরকারি যন্ত্র তথা রাষ্ট্র যন্ত্রের ভিত কাঁপিয়ে দিতে পারে তাহলে তাকে নিয়ে লেখাই যায় কি বলুন সুধী পাঠক। আজ ১১ আগস্ট তাঁর আত্মবলিদান দিবস। মনটা ভার হয়ে আছে। তাঁর জীবন কাহিনী নিয়ে আরেক দিন লেখা যাবে। আজ শুধু এইটুকু থাক যে আমাদেরই কেউ একজন পেরেছিল। তাঁকে শ্রদ্ধা, প্রণাম, সেলাম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন