বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০১৩

আজি হতে শতবর্ষ আগে ৩ ~ অমিতাভ প্রামানিক

তিন – বসন্ত তার গান লিখে যায়



আলফ্রেড নোবেল কে ছিলেন? তাঁর সম্বন্ধে এইটুকু তথ্য প্রায় সর্বজনবিদিত – তিনি একজন বিজ্ঞানী ছিলেন; ডিনামাইট আবিস্কার করেছিলেন; প্রচুর টাকাপয়সা রোজগার করেছিলেন; কয়েকটি বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন, যার অর্থমূল্য ও সম্মান পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ। এর বাইরে ওঁকে নিয়ে সে রকম লেখালিখি বাংলায় খুব বেশি বোধ হয় হয়নি।

প্রশ্ন হল, বিজ্ঞানীই যদি ছিলেন, তাহলে সাহিত্যে পুরস্কার দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হলেন কেন?

সাহিত্য কথাটার অর্থ কী? অক্সফোর্ড ইংরাজী অভিধানে লিটারেচার শব্দের অর্থ হচ্ছে লিখিত কাজ বিশেষ করে যা উচ্চতর বা দীর্ঘস্থায়ী মেধার প্রকাশ হিসাবে বিবেচ্য। ওয়েব্‌স্‌টার ডিক্‌শনারী বলছে ফর্ম বা মত প্রকাশের শ্রেষ্ঠত্ব বহনকারী গদ্য বা পদ্যে লেখা এমন রচনা বা রচনাবলী যা স্থায়ী বা সার্বজনীন ধারণা নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা অনুযায়ী সাহিত্য হচ্ছে স্বতন্ত্র উদ্দেশ্যপ্রসূত এবং নান্দনিক উৎকর্ষ ও কল্পনাপ্রবণ রচনার প্রয়োগধর্মী কবিতা বা গদ্যে লিখিত কাজ। 

এই যে অ্যাস্থেটিক এক্সেলেন্স বা নান্দনিক উৎকর্ষের কথা বলা হচ্ছে, ওটা ছাড়া গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাস যাই লেখার চেষ্টা হোক, তা সাহিত্য বলে গণ্য হবে না। যে কোন বিষয়ে নান্দনিকভাবে উৎকৃষ্ট লেখা নিজস্ব ধারণায় ঋদ্ধ না হলে সম্ভব নয়। আর এই ধারণা অবশ্যই ছাপ ফেলে একজনের ব্যক্তিগত জীবনচর্চায়, আচরণে, ব্যবহারে। গান্ধীজী বলেছিলেন, আমার জীবনই আমার বাণী, তিনি যদিও সাহিত্যিক ছিলেন না। যে কোন সার্থক সাহিত্যিকের বাণী তার জীবনে প্রতিফলিত হবেই। সেই জন্যেই আলফ্রেড নোবেলের জীবনের কথা সাতকাহন করে বললাম। রবি ঠাকুরের জীবনের কথা বাঙালী পাঠকের কাছে বলার দরকার নেই, তা হবে মার কাছে মাসির গল্প শোনানো।

যারা ভাবছেন, কিন্তু গল্পটা তো রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার পাওয়া নিয়ে, আজ থেকে একশো বছর আগে যা ঘটেছিল, এর সঙ্গে নোবেলের জীবনের কী সম্বন্ধ? তাদের জন্যে বলি, আলফ্রেড নোবেল কোন হেঁজিপেঁজি লোক ছিলেন না। তিনি যে পাঁচখানা মালদার পুরস্কারের কথা তার উইলে লিখে গেছিলেন, তার বিষয় কী করে নির্বাচন করলেন? সায়েন্টিস্ট মানুষ, তিনটে সায়েন্সের বিষয়ে প্রাইজ দিতে ইচ্ছে হল – ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, মেডিসিন বা ফিজিওলজি – মেনে নেওয়া গেল। যুদ্ধে আক্রান্ত রাষ্ট্রসমূহ, হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, তার বিরূদ্ধে লড়ছে কিছু মানুষ, শোনাচ্ছে শান্তির বাণী, তার মধ্যে একজন যার প্রতি আলফ্রেডের ব্যক্তিগত দুর্বলতা ছিল, সুতরাং শান্তি পুরস্কার, তাও মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু সাহিত্য? আর আমাদের এই গল্পটা তো রবি ঠাকুরের পুরস্কার পাওয়াকে কেন্দ্র করেই যেটা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। এ প্রশ্ন কি সঙ্গত নয়, আর সব ছেড়ে আলফ্রেড নোবেল হঠাৎ সাহিত্যে পুরস্কার দিতে গেলেন কেন? কেমন সাহিত্য সেই পুরস্কারের হকদার?

এর উত্তর দেওয়ার আগে একটা কথা বলে নিই। একথা অনেকের জানা, তাও বাঙালি হিসাবে আমাদের একটু দুঃখ হবে এটা জেনে যে, অমর্ত্য সেন অর্থনীতিতে যে পুরস্কার পেয়েছেন তা আদৌ নোবেল পুরস্কার নয়। রবীন্দ্রনাথের লেখা এবং সুর করা গানগুলোই যেমন একমাত্র রবীন্দ্রসঙ্গীত, পঙ্কজ মল্লিকের সুরে 'দিনের শেষে ঘুমের দেশে' যেমন রবীন্দ্রনাথের রচনা হলেও রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়, তেমনি অমর্ত্য সেনের পুরস্কারের নাম 'আলফ্রেড নোবেলের স্মৃতিতে প্রদত্ত ব্যাঙ্ক অফ সুইডেন পুরস্কার', নোবেল পুরস্কার নয়। ১৯৬৯ সালে চালু হওয়া এই পুরস্কারের পেছনে অবদান আছে তাঁর দাদার প্রপৌত্র পিটার নোবেলের। অমর্ত্য একজন বিশ্বসেরা অর্থনীতিবিদ, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু আলফ্রেড নোবেল অর্থনীতি বিষয়টির সাথে এতটা সংশ্লিষ্ট ছিলেন না, এই বিষয়ে তিনি পুরস্কার ঘোষণা করেন নি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মধ্যেও তিনি পার্থক্য করে দিয়ে যাননি, ফলে বিজ্ঞানীরাই সাধারণভাবে এই পুরস্কার পেয়েছে, প্রযুক্তিবিদরা নন। গণিতে অসম্ভব পারদর্শী হলেও এই বিষয়ে কেন তিনি পুরস্কার ঘোষণা করেন নি, এটাও একটা প্রহেলিকা। তাঁর একজন জীবনীলেখক মতপ্রকাশ করেছেন, আলফ্রেডের প্রেমিকা তখনকার বিশ্বখ্যাত সুইডিশ গণিতজ্ঞ গোস্তা মিত্তাগ-লেফলারের সঙ্গে প্রেম করছিলেন, তাই নাকি গণিতের পুরস্কারের ব্যাপারে আলফ্রেডের বিতৃষ্ণা! বলা বাহুল্য এটা সর্বৈব ভুল। সুইডেনের রাজা দ্বিতীয় অস্কার অঙ্কশাস্ত্রের ওপর এক পুরস্কার চালু করেছিলেন। হতে পারে আলফ্রেড চাননি এই পুরস্কারের সঙ্গে তার পুরস্কারের অহেতুক প্রতিযোগিতা। তাছাড়া তিনি বিজ্ঞানের যে সমস্ত বিষয়ে পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন, সবগুলোতেই মানবজাতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক আবিস্কারের জন্যে। হতে পারে তিনি ভেবেছিলেন গণিতিশাস্ত্র এত তাত্ত্বিক যে তাতে মানবজাতির ব্যবহারিক উন্নয়ন হয়ত সম্ভব নয়। 

আবিস্কারক বিজ্ঞানী হিসাবে পরিচিত হলেও আলফ্রেড নোবেলের সাহিত্যপ্রতিভা কিছু কম ছিল না। তার নিজস্ব লাইব্রেরীতে ১৫০০র অধিক বই ছিল, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের নিজস্ব ভাষায় লেখা ফিক্‌শনের সংখ্যাই বেশি, তার সঙ্গে দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান, কবিতা। আলফ্রেড নিজেও বেশ কিছু সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। যৌবনে তিনি লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা ও দুটো উপন্যাস। প্রথম উপন্যাস, I ljusaste Afrika অর্থাৎ উজ্জ্বলতম আফ্রিকায় যে বছর লেখেন, সে বছরই কলকাতায় জোড়াসাঁকোয় জন্মগ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ। পরের বছর Systrarna বা ভগিনীরা নামে আর একটি উপন্যাস লেখেন আলফ্রেড। 

আলফ্রেডের সাহিত্যচর্চার শুরুটা কিন্তু ছিল বিচিত্র। ছোটবেলায় স্কুলে যাওয়া বিশেষ হয়নি। মায়ের সঙ্গে রাশিয়ায় যাওয়ার পর শুরু হয় পড়াশুনা, মূলতঃ গৃহশিক্ষক রেখে। লাজুক, মুখচোরা ছেলেটি নিজে নিজেই ফরাসী ভাষা শিখে নিল ভলটেয়ারের লেখা অনুবাদ করে করে, প্রথমে ফরাসী থেকে সুইডিশ ভাষায়, পরে সেটাকেই আবার ফরাসীতে। সেই ফরাসী অনুবাদ তিনি ভলটেয়ারের মূল লেখার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতেন। হোমারের মহাকাব্য Odyssey, পুশকিনের Eugene Onegin আর রাশিয়ান ভাষায় লেখা ইভান তুর্গেনেভের Home of the Gentry পড়ে ফেলেন তিনি এই সময়। মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি পাঁচটা ভাষায় গড়গড়িয়ে কথা বলতে পারতেন। ইংরেজ কবি ওয়ার্ডওয়ার্থ, শেলী আর বিশেষ করে বায়রণ তার ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল।

আলফ্রেডের ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে বায়রণের তের খণ্ড সোনার জলে বাঁধানো বই ছিল। তার প্রথম খণ্ডের ভেতরে কোন এক "হ্যারিয়েট"-এর হাতে লেখা একটা চিরকুট পাওয়া যায়, তাতে ফরাসী ভাষায় লেখা চার লাইনের একটা কবিতা। হ্যারিয়েট যে কে, কাকে উদ্দেশ্য করেই বা কবিতাটা লেখা, তা জানা যায়নি। হাতের লেখা আলফ্রেডের মতই, কবিতাটার বাংলা তর্জমা করলে এই রকম দাঁড়ায় –
আমি যখন থাকব না, কোরো
মধুর চক্ষে আমায় স্মরণ –
আমার হৃদয় নিয়ত পূর্ণ
তোমাতে, তার যে নাইকো মরণ।

জীবন সময়ের মতই এক গতিশীল বিস্ময়, প্রতিটি সাহিত্যিক তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকতে চান। রবীন্দ্রনাথের 'তবু মনে রেখো' বা 'আজি হতে শতবর্ষ পরে' মনে পড়ায় না? 

আলফ্রেড বলেছিলেন, যে নিঃসঙ্গ ব্যক্তির কাছে বই আর কালি নেই, সে জীবন্মৃত। সেই যে বার্থাকে লজ্জাবনত মুখে পড়তে দিয়েছিলেন একটা কবিতার কয়েকটা লাইন, সেটা ৩১৯ লাইনের আত্মজীবনীমূলক কবিতা, পুরোটা ইংরাজীতে লেখা। আঠার বছর বয়সে প্রথম প্যারিস যাত্রাকালে লেখা এই কবিতার শীর্ষক "You Say I Am A Riddle". এটা তিনি উৎসর্গ করেছিলেন এক 'lovely girl'কে, যে কিনা পূর্বযৌবনেই 'wedded to her grave'. তার চারটে লাইন এই রকম – 

তুমি বল আমি এক জটিল ধাঁধাঁ, হ্যাঁ, তা বেশ –
আমরা টুকরো সব ব্যাখ্যা-না-হওয়া যত ধাঁধাঁর।
শুরু যার যন্ত্রণায়, গভীর নির্যাতনে শেষ,
কী কাজ আছে যে এর, এই শ্বাস বহমান কাদার?

ধরে নেওয়া হয়, প্রথম যৌবনের এক নিরাশজনক প্রেমের পরিণতি এই কবিতাটি। পরে বার্থাকেও তিনি এটা পড়িয়েছিলেন, এবং সেখানেও সুবিধে করতে পারেন নি! দাদা রবার্ট তার প্রেমিকা পলিনকে এক চিঠিতে আলফ্রেডের সম্বন্ধে লিখেছিলেন যে আলফ্রেডের ধারণা তার প্রেমের কবিতা শুনে নিশ্চয় সুন্দরী ধনী যুবতীরা তারা পেছনে লাইন দেবে!

Night Thoughts নামে ইংরাজীতে লেখা আলফ্রেডের এক কবিতার প্রথম কিছু লাইন বাংলা করলে দাঁড়ায় –

যামিনীর জমকালো নীরবতা মুক্তি
দেয় আবদ্ধ আত্মার যত শৃঙ্খল –
সত্যান্বেষী চোখে ধুলো দিয়ে যুক্তি
স্বপ্নদর্শী হয়ে বলে, আয়, উড়ি চল।
এ কি প্রতারণা – বুঝবো কি কোন দিনও তা –
এত চঞ্চল করে চলে এই চিত্ত!
বন্য, সাহসী এই অধীনতাহীনতা
মনোমাঝে বাসা বাঁধে কিসের নিমিত্ত?

এই কবিতারই এক অংশে আলফ্রেড নিয়ে এসেছে ঈশ্বরকেও। জানতে চেয়েছেন ঈশ্বর কী করে সৃষ্টি হল, কী করে বেড়ে বেড়ে তাঁর এই জাগতিক দাপট, এও কি মধ্যরাতের শৃংখলহীন ধারণার মতই সৃষ্ট হয়ে ব্যপ্ত হয়ে গেছে জনমানসের অভ্যন্তরে? 

সৃষ্টি হয়েছে কার হাতে এই বিশ্ব? 
ধর্ম দেখাবে আঙুল, বলবে, ঈশ্বর!
তবে বলো দেখি তারও কে উপরওলা?
অনন্ত, শূন্য বা বিশৃংখলা?
অমর সত্তা উপ্ত হয় যে বীজে,
মধ্যরাত্রে বেড়ে চলে তারা নিজে,
তারা প্রাণহীন, তবু কী করে সে ইষ্টের
ক্ষমতা, শক্তি সার্বজনীন অদৃষ্টের!

বিজ্ঞান ও ব্যবসা নিয়ে নিয়ত ব্যস্ত নোবেল সময় সুযোগ পেলেই সাহিত্য রচনায় বসে যেতেন। যখনি মনের কোণায় উঁকি দিত, এই বুঝি ব্যবসা লাটে উঠবে – বাবাকে একাধিকবার এরকম ঘটাতে দেখেছেন – তখনি ভেবেছেন ব্যবসা বন্ধ করে পুরোপুরি সাহিত্যের জগতে ঢুকে পড়বেন। প্যারিসে জুলিয়েট অ্যাডাম ল্যাম্বার নামে একজন এক প্রকাশনা সংস্থা চালাতেন, নোবেল ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ। জুলিয়েটের বাড়িতেই তার মোলাকাৎ হয় ভিক্টর হুগোর সাথে, যার প্রতি প্রবল অনুরাগ জন্মে আলফ্রেডের। সম্ভবত এই বাড়িতে তিনি দেখা পেতেন পিয়ের লতি, পল বর্জে আর মোপাসাঁরও। ভিক্টর হুগো প্যারিসের যে পাড়ায় থাকতেন, সেখানেই কয়েকটা বাড়ির পাশে আলফ্রেড সোফির জন্যে একটা বাড়ি কিনে দিয়েছিলেন। শান্তিকামী বার্থার কল্যাণে ফরাসী বিখ্যাত সাহিত্যপত্রিকার সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল আজীবন।

বিভিন্ন ভাষায় আলফ্রেড বেশ কিছু কবিতা লিখে গেছেন, অনেকগুলিরই সাহিত্যমূল্য অপরিসীম। জীবনের শেষপর্বে The Nemesis নামে একটা ট্রাজেডিমূলক নাটক লিখেছিলেন, তাতে অবশ্য বেশ কিছু অংশ আলফ্রেডের বর্ণময় জীবনের সঙ্গে মানানসই নয়। এটির শতাধিক কপি ছাপানো হয়েছিল, কিন্তু মাত্র তিনটি কপি বাদে বাকিগুলি নষ্ট করে ফেলা হয় তার পরিবারের অনুরোধে।

আলফ্রেড নোবেল এমন কিছু উদ্ধৃতি দিয়ে গেছেন, যেগুলো সর্বকালের কোটেব্‌ল্‌ কোটের তালিকায় থাকার মত। তার এই ওয়ান-লাইনারগুলোতে কটাক্ষময় বাক্যের অভ্যন্তরে লুকানো এক ভয়ঙ্কর অপ্রিয় সত্য ছিল। টুইটারের যুগে এইসব লাইনগুলোর মূল্য অপরিসীম। কয়েকটা উদাহরণ দিচ্ছি –
• পাকস্থলীকে অনুনয় বিনয় করে খাদ্য হজমে যতটা বাধ্য করা যায়, হৃদয়কে তার চেয়ে বেশি ভালবাসতে বাধ্য করা যায় না।
• কৃষিবিদ্যার পরেই হামবাগ বা ভান হচ্ছে আমাদের সময়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্প।
• আমরা বালির ওপরে স্থাপত্য বানাই; যত আমাদের বয়স বাড়ে, ততই ভঙ্গুর হয়ে যায় এর ভিত।
• সত্যনিষ্ঠ মানুষ সাধারণতঃ একজন মিথ্যাবাদী।
• ন্যায়বিচার একমাত্র কল্পনাতেই পাওয়া সম্ভব।
• সম্মানিত হওয়ার জন্য সম্মানযোগ্য হওয়ার প্রয়োজন নেই।
• চিন্তাই পাকস্থলীর সবচেয়ে খারাপ বিষ।
• হেরো লোকদের প্রধান অজুহাত হচ্ছে বিচারপতিও ওদের মতই একজন।
• অন্যকে সম্মান না দেওয়া আত্মসম্মান হল এমন রত্ন যা দিনে দেখা যায় না।
• আশা হচ্ছে সত্যের নগ্নতা ঢাকবার জন্যে প্রকৃতির ঘোমটা।
• মিথ্যাই সর্বশ্রেষ্ঠ পাপ।
• আমার কাছে বাড়ির অর্থ যেখানে আমি কাজ করি, আর আমি সর্বত্র কাজ করি।
• বই-কালি ছাড়া নিভৃত জীবন একটা মৃত মানুষের জীবন।

জীবন সম্বন্ধে প্রকৃত ও কৌতুকময় ধ্যানধারণা না থাকলে এমন উদ্ধৃতি দেওয়া অসম্ভব।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে সাহিত্য সম্বন্ধে আলফ্রেড নোবেলের নিজস্ব ধারণা আর ব্যক্তিগত আকর্ষণ প্রবলভাবে ছিল। বাবা-মা জোর করে বিজ্ঞান আর ব্যবসায় ঢুকিয়ে না দিলে তিনি বেশ বড়মাপের একজন সাহিত্যিক হতেন, সে রকম ইচ্ছেও ছিল তাঁর। বস্তুতঃ পাঁচটা পুরস্কারের মধ্যে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন আর চিকিৎসাবিদ্যা বা শরীরতত্ত্ব – এই তিনটে বিজ্ঞানসংক্রান্ত বিষয় ছাড়া বাকি দুটোর ক্ষেত্রে তিনি বিশদ ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন তাঁর উইলে। সাহিত্যের ব্যাপারে তিনি যোগ করেছিলেন এক অতিরিক্ত বিশেষণ, এই সাহিত্য হতে হবে আইডিয়াল বা আদর্শ অভিমুখী। আদর্শের সংজ্ঞা তো আর এক বিতর্কের বিষয়, বিশেষ করে তা যদি হয় সাহিত্যের প্রতিপাদ্য। নোবেল কমিটি তাই আইডিয়ালকে আইডিয়ালিস্টিক বা আধ্যাত্ম-অভিমুখী বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত নেয়। হেনরিক ইবসেন বা লিও টলস্টয় বিশাল মাপের সাহিত্যিক হলেও সেই সময়ের বিচারে তাঁদের রচনা আধ্যাত্ম বা আদর্শ-অভিমুখী বলে বিবেচ্য হয়নি, তারা এই পুরস্কারের মনোনয়নই পাননি। 

১৯০১ সালে নোবেল পুরস্কার প্রদান শুরু হয়। সাহিত্যে প্রথম এই পুরস্কার পান ফরাসী কবি সুলি প্রুদোম। মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় প্রুদোম সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যান, যদিও তার লেখনী সচল থাকে। তার শ্রেষ্ঠ কাব্য হ্যাপিনেস মহাকাব্যের মর্যাদাপ্রাপ্ত, এটা লেখার সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল সাতাশ বছর। পরের বছর এই সম্মান পান জার্মান পণ্ডিত ও ঐতিহাসিক থিওডর মমসেন। জার্মানীর লাইপেজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক পঁয়তিরিশ বছর বয়সে সুইজারল্যাণ্ডের জুরিখে চলে যান। সেখানে তার বাসনা জাগে নতুন দৃষ্টিভঙ্গীতে রোমের ইতিহাস লেখার। সেই হিষ্ট্রী অফ রোমের জন্যেই তার নোবেল পুরস্কার। নরওয়ের নাট্যকার ইয়র্নস্টার্ণ ইয়র্নসেন ১৯০৩ সালের নোবেল বিজেতা। তার পরের বছর এই পুরস্কার পান যুগ্মভাবে ফরাসী ফ্রেদেরিক মিস্ত্রাল ও স্পেনের হোসে এচেগারাই। পোল্যাণ্ডের ঔপন্যাসিক হেনরিক শিনকিয়েউইচ পান ১৯০৫-এর পদক, পরের বছর ইতালীয় কবি জিওসুয়ে কার্দুচ্চি। ১৯০৭-এর নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ইংরেজ সাহিত্যিক রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর জন্ম ভারতের মুম্বইতে। শিশুসাহিত্য দ্য জাঙ্গল কিং তাকে অমর করে রেখেছে। জার্মান দার্শনিক ও সাহিত্যিক রুডল্‌ফ্‌ ক্রিষ্টফ ইউকেন, সুইডিশ ঔপন্যাসিক সেলমা লাগেরহফ, জার্মান সাহিত্যিক ও অনুবাদক পল জোহান লুডুইগ ফন হাইসে, বেলজিয়ান নাট্যকার, কবি ও প্রাবন্ধিক মরিস মেটারলিঙ্ক (ইনি ফরাসী ভাষায় লিখতেন) ও জার্মান নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক গেরহার্ট হাউপ্টম্যান পান যথাক্রমে ১৯০৮ থেকে ১৯১২ সালের পুরস্কারগুলি। সেলমা প্রথম মহিলা নোবেল পুরস্কারজয়ী সাহিত্যিক। আলফ্রেডের ভাইঝি সেলমার লেখা Gosta Berling's Saga নামে এক উপন্যাস আলফ্রেডকে পড়তে দিয়েছিলেন তার জীবিতকালে, যা পড়ে আলফ্রেড মোহিত হয়ে যান, সেকথা তিনি এক বন্ধুকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন।

বারো বছরকে এক যুগ ধরা হয়। নোবেল পুরস্কারের প্রথম যুগের অন্তে দ্বিতীয় যুগের শুরু হল আজি হতে শতবর্ষ আগে যে সাহিত্যপুরস্কার দিয়ে, সেটাই উঠে এল বঙ্গকুলতিলক, আমাদের নিভৃত প্রাণের দেবতা রবীন্দ্রনাথের হাতে। ব্রিটিশ ভারতের নাগরিক রবীন্দ্রনাথের লেখালিখি অধিকাংশই বাংলায়। গীতাঞ্জলির ইংরাজী অনুবাদ, যার জন্যেই মূলতঃ এই পুরস্কার, মোটেও ততদিনে লেখা রবীন্দ্রনাথ-বিরচিত সমগ্র সাহিত্যের প্রতিনিধি নয়। তা সত্ত্বেও তিনি পিছনে ফেলে দিলেন সেই সময়ের সবচেয়ে ব্রিটিশ জনপ্রিয় সাহিত্যিক টমাস হার্ডিকে, নোবেল পুরস্কার যার অধরাই রয়ে গেল। জনপ্রিয় ইংরেজ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েট্‌স্‌, যিনি রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির অনুবাদে প্রভূত সহায়তা করেছিলেন এবং হয়ে গেছিলেন কবির বন্ধুদের একজন, তাকেও অপেক্ষা করতে হল আরো এক দশক নোবেল পুরস্কার পেতে। পিছনে ফেলে দিলেন ইওরোপের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও দার্শনিক রোমা রঁল্যা এবং জর্জ বার্ণার্ড শ'কেও। কবির বয়স তখন সাড়ে বাহান্ন বছর। 

এতগুলো নামীদামী ব্যক্তিত্বকে অতিক্রম করে কিভাবে সম্ভব হল এই পুরস্কারপ্রাপ্তি? কোথা থেকে এল পাশ্চাত্য সাহিত্যে অপেক্ষাকৃত অনামী এই কবির প্রতি সমর্থন? সে কাহিনী পরের সংখ্যায়। (ক্রমশ)
 — 

আগের ঃ

এক – বাজিলো কাহার বীণা http://pnachforon.blogspot.in/2013/03/blog-post.html
দুই – যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে http://pnachforon.blogspot.in/2013/03/blog-post_3.html

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন