রবিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৫

অঙ্ক আর বিপ্লবের ডুয়েল ~ শুভময় মৈত্র


[যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেই নিয়ে বিভিন্ন ঘটনা এবং লেখা বারবার ফিরে আসে ভাবনায়। যখনই সেখানে কোন অকাজে যাই, সেসব কেজোকথার শেষে বেরোতে বেরোতে সন্ধে। চারপাশে ঝকঝকে পড়ুয়াদের কলতান, পাখির কিচিরমিচির, একটু দূর থেকে ভেসে আসা বাসের হর্নের মধ্যে হঠাৎ করে সময়যানে ফিরতে হয় সাড়ে তিন দশক। অনেক কিছুর মতই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এরকম এক পুরনো লেখা, যা হয়তো দু-এক জায়গায় ছাপা হয়েছে আগে, তবে সেভাবে পেশাদারী কোন কাগজে নয়। তাই আর কারও কোন অনুমতি না নিয়েই আপনাদের সামনে আর একবার টুকেই দিলাম পুরনো সেই তথ্য আর কল্পনার মিশেল, দু এক জায়গায় অল্প এদিক ওদিক করে। গবেষণার ক্ষেত্রে হলে নিশ্চিত চাকরি যেত, ওই যাকে বলে কিনা সেল্ফ প্লেজিয়ারিজম। সেকথা থাক। আগে পড়েছেন সে সম্ভাবনা খুবই কম। আর পড়ে থাকলে তো এই অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পেয়েই গেলেন। লেখাটি আমাদের এক অতিপ্রিয় অঙ্কের মাস্টারমশাই অধ্যাপক তরুণ কুমার মুখার্জীর স্মৃতিতে, সংক্ষেপে যিনি পরিচিত ছিলেন টিকেএম নামে। বহু বছর আগে যখন এই লেখাটা প্রথম লিখি, তখন তিনি সকলের মধ্যেই ছিলেন। আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল এ বছরের জুলাই মাসে যখন নতুন করে এই লেখাটি খুঁজে পেতে রিভাইজ করছি, ঠিক তার কদিন আগেই ফ্রান্সের নির্বাচনে তৃতীয় থেকে একলাফে প্রথম স্থানে চলে এসেছে বামপন্থীরা। এই লেখার প্রেক্ষিত সেই ফ্রান্সকে নিয়েই, তবে দু-আড়াই শতক আগে।]  

ছিপছিপে লম্বা চেহারার তরুণ-বাবু হেঁটে যাচ্ছেন লাল চেয়ারের পাশ দিয়ে। শিরদাঁড়া সোজা, কাঁধে ঝোলান একটা সপ্তর্ষিমন্ডল আকারের আঁকড়া দেওয়া কাঠের ছাতা। এইট-বি বাস-স্ট্যান্ড এর দিক থেকে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে একটু বাঁ দিকে গেলে ছাত্র সংসদের অফিস। রাজ্যে বহু রাজনৈতিক পরিবর্তন সত্ত্বেও অতি বামদের দাপট এই কচি সংসদে কখনও কমে নি। সেখান থেকে সোজা হাঁটলে ডান দিকে খেলার মাঠ আর বাঁদিকে ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া লাল চেয়ার। থুড়ি জায়গাটা আছে, কিন্তু সিমেন্টে বাঁধানো সেই প্লাস্টিকের চেয়ার গুলো আর নেই। সময়টা আশির দশকের শেষ ভাগ, সেপ্টেম্বর মাস প্রায় ফুরিয়ে এসেছে - কলকাতায় পুজোর গন্ধ। স্যার অঙ্কের ক্লাস শেষ করে ফিরছেন। তাঁর হাঁটার গতির সঙ্গে তাল সামলাতে ছাত্রদের রীতিমত ছুটতে হচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে তাঁকে ধরে ফেলল প্রণব। সঙ্গে আমরা আরও অনেকে। যাদবপুরের ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্ররা। কি দুর্ভাগ্য যে প্রযুক্তি বা বিজ্ঞান যাই পড়ো না কেন, অঙ্কের হাত থেকে নিস্তার নেই। ক্লাসে পরীক্ষার খাতা দিয়েছেন তরুণবাবু। আমাদের মত পরীক্ষায় নিয়মিত গাড্ডু খাওয়া ছেলেদের ধান্দা কি করে দু-এক নম্বর বাড়ানো যায়। "স্যার, এখানটা কেন কেটেছেন? আর একটু নম্বর কি এখানে বাড়ত না? আর এক নম্বর বাড়লেই আমার চল্লিশ হয়ে যেত", ইত্যাদি ইত্যাদি। তরুণবাবু রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কারো নম্বর বাড়িয়ে দিচ্ছেন, কাউকে বা একটা ছোট্ট ধমক। উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম হওয়া প্রণবের বক্তব্য অবশ্য অন্য। সে পুরো নম্বর পেয়েছে। কিন্তু তার একটা অঙ্কে সামান্য ভুল আছে, সেখানে স্যার নম্বর কাটেন নি। সে তাই নম্বর কমাতে ছুটেছে। প্রণবের দাবী শুনে চোখ কুঁচকে তাকালেন তরুণবাবু। "বুঝলে হে ছোকরা, অঙ্কের কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল সেটা বোঝার মত বয়স তোমার এখনো হয় নি। যোগ বিয়োগে ভুল হলেই নম্বর কাটা যায় না। ঠিকঠাক বুঝেছ কিনা সেটা দেখতে হয়। তুমি ভেবো না যে আমি মন দিয়ে খাতা দেখি নি। তোমার ভুলটা কোন ভুল-ই নয়। এ বয়েসে মানুষ তো কতরকমের ভুল-ই করে। কিন্তু কোন এক মে মাসের শেষ দিনে তোমাদের বয়সী একটা ছেলে যা ভুল করেছিল সে কথা ভাবলে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।"





আমাদের চোখ চকচক করে উঠল। তার মানে গল্প আছে। আমাদের বয়সী, অর্থাৎ ঊনিশ-কুড়ি। স্যারের গৌরচন্দ্রিকা মানে তো অঙ্কের কোন এক মস্তান লোকের জীবন নিয়ে জমজমাট আলোচনার সূত্রপাত। কিন্তু এত অল্প বয়েসের কে সেই লোক যার ভুল কিনা স্যারের মন খিঁচড়ে দেয়? সে আবার কি গোলমাল পাকাল? স্যারের গল্প কত বছর আগের কে জানে! ঘটনা সুদূর অতীতে যাই হোক না কেন, ঘটমান বর্তমানে আলগা ঘামে ভেজা বিকেলটা যে অসাধারণ কাটতে চলেছে সেটার একটা ক্ষীণ আভাস পাওয়া গেল। ততক্ষণে আমরা লাইব্রেরির কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। ডানদিকে ঘুরেই বউদির ক্যান্টিন। স্যারের পয়সায় হাতে গরম ফিসফ্রাই, বিকেলের শেষ রোদ্দুর আর তার সঙ্গে হাত ধরাধরি করে হেঁটে বেড়াবে অঙ্ক আর ইতিহাস। ফাটা প্লাস্টিকের টেবিলের পাশে গোল করে রাখা চার পাঁচটা চেয়ার। স্যারকে ঘিরে আমরা বসে পড়লাম। প্রণব, সুমিত, অরিন্দম, দেবজ্যোতি আর আমি। অঙ্কের নম্বরের নিরিখে বেশি থেকে কম, একশো থেকে আঠেরো।

"সে ছোকরা জন্মেছিল ১৮১১ সালের ২৫শে অক্টোবর। প্যারিসের দক্ষিণ শহরতলীতে বর‍্যো-লা-রেইন নামের একটা ছোট্ট জায়গায়। ১৭৯২ সালে ফরাসী বিপ্লবের সময় এই জায়গার নাম বদলে রাখা হয়েছিল বর‍্যো-লা-এগালিতে, অর্থাৎ সমতার কথা ঢুকে গেছিল নামের মধ্যে। বিপ্লব দীর্ঘজীবি হল, তবে সে ইতিহাস গত হলে পুরনো নামটা আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছিল ১৮১২ তে। নাহ, অনেকক্ষণ তোদের ঝুলিয়ে রেখেছি। সে সময়ের গোটা প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে। এবার বলেই ফেলা যাক, লোকটার নাম এভারিস্তে গ্যালোয়া। শুনেছিস কেউ?" তুমি থেকে ততক্ষণে আমরা তুই হয়ে গেছি। ফলে বোঝা গেল যে স্যারের মেজাজ দারুণ ফুরফুরে। তার মানে গল্প জমবে এবং কিছুক্ষণ পরে আর একবার চা সিঙ্গারার সম্ভাবনা প্রবল। বাংলা বানানে 'ণ'/'ন' না জানলে আমরা যেমনভাবে মাঝামাঝি লিখি সেরকম একটা মুখের ভাব করছিলাম। কিন্তু প্রণব এখানেও একশো। "হ্যাঁ স্যার জানি। অঙ্কের যাদুকর, মৃত্যু ডুয়েল লড়তে গিয়ে। ৩১শে মে, ১৮৩২, মাত্র ২০ বছর বয়েসে। ইতিহাসে কিছু বিতর্ক আছে, কিন্তু এরকম শোনা যায় যে মৃত্যুর আগের রাতে সে শেষ করে যায় এক অসাধারণ গবেষণা, যেটা গণিতজ্ঞদের মধ্যে গ্যালোয়া ফিল্ড নামে প্রসিদ্ধ।"

— "তাহলে তোরা সবই জানিস। কালকে ক্লাসে ওটাই পড়াব।" স্যার প্রায় উঠে পড়লেন। "না না স্যার, কিচ্ছু জানি না, সত্যি বলছি।"  হৈ হৈ করে আমরা লাফিয়ে উঠলাম। আমাদের দৃষ্টির আগুনে দুর্দান্ত ফরসা প্রণব ততক্ষণে ম্লানমুখ লুকোনোর জায়গা খুঁজছে। বারো ক্লাসে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে এক নম্বরে থেকে শান্তি হয় নি, সঙ্গে কোথাকার কোন ফরাসী গণিতজ্ঞ, সে ব্যাটাকেও গুলে খেয়েছে। আর তার জন্যে কিনা জমজমাট একটা ধারাবিবরণীর সঙ্গে চা সিঙ্গারা ফসকে যেতে বসেছে। যাদবপুরের বিশাল খেলার মাঠের দিক থেকে পথ খুঁজে নেওয়া টুকরো হাওয়া, ঝিল পেরিয়ে পাঁচিলের ওপারে রেল লাইন থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসা ট্রেনের ঘটঘট, সঙ্গে প্যারিসের রাস্তায় মনে মনে হেঁটে বেড়ানো, এতো কিছু একসঙ্গে দফারফা হয়ে যাওয়ার যোগাড়। স্যার উঠে দাঁড়িয়েছেন, পাশে প্রণব-ও। প্রণবের কাঁধে হাত রাখলেন স্যার। "তোর হবে। যা চা বলে আয়।" সমান লম্বা দুজন মানুষ। একই রকম ছিপছিপে চেহারা। একজন প্রায় ষাট, অন্যজন তার তিন ভাগের এক ভাগ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমরা। আমার অঙ্কে আঠেরো পাওয়া ভাঙ্গা মন ততক্ষণে দুঃখ ভুলে প্যারিসের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া শ্যেন-এর ঘোলা জলে ছলাত-ছল। (এবার অলিম্পিকে যার ওপর শোভাযাত্রা সহকারে উদ্বোধন, অর্থাৎ যখন এই লেখা রিভাইজ করছি সেই সময়।) অঙ্কে গোল পেলে কি হবে, ভূগোলে আমাকে হারায় কে? আমি তো ইতিমধ্যে হাঁটা লাগিয়েছি প্যারিসের পোড়া ইঁট সাজানো সরু গলিপথে।

— "গ্যালোয়ার বাবা উদারপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অষ্টাদশ লুই যখন ১৮১৪ সালে ক্ষমতায় ফিরে এলেন তখন তিনি গ্রামের মোড়লও হয়েছিলেন। গ্যালোয়ার মা ছিলেন জজের মেয়ে। ছোটবেলায় ছেলের পড়াশোনা তাঁকেই দেখতে হতো, স্বামী মোড়ল হলে যা হয় আর কি। ঠিক বারো বছরে ইশকুলে ঢোকে গ্যালোয়া। বছর-দুই ল্যাটিন আর পুরনো সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা ভালই চলছিল, কিন্তু এর মধ্যেই অঙ্কের নেশা তাকে পেয়ে বসে। হাতের কাছে পেয়ে যায় আর এক ফরাসী গণিতজ্ঞ অ্যাড্রিয়েন-মেরী লেজেন্ডার-এর (১৮ সেপ্টেম্বর ১৭৫২ — ১০ জানুয়ারী ১৮৩৩) লেখা জ্যামিতির বই। তোরা যেমন করে ফেলুদা পড়িস, সেই গতিতে জ্যামিতির ঐ কঠিন বই এক নিঃশ্বাসে নামিয়ে দিয়েছিল বাচ্ছা ছেলেটা। বছর পনেরো পেরতে না পেরতেই আর এক ফরাসী দিকপাল জোসেফ-লুই ল্যাগ্রাঞ্জের (২৫ জানুয়ারী ১৭৩৬ — ১০ এপ্রিল ১৮১৩) গবেষণার কাজকর্মও হজম করে ফেলেছিল সে।" চায়ে বেশ জোরে একটা চুমুক দিলেন তরুণ-বাবু। স্যারের কথার ফাঁকে অঙ্কের এইসব প্লাতিনি জিদান-দের চেনা নাম শুনে প্রণব মাঝে মাঝেই লাফিয়ে উঠে কিছু বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু পাশেই সদা সতর্ক সুমিত। কখনো কাঁধ চেপে ধরে, কখনো চিমটি কেটে রুখে যাচ্ছে তাকে। নব্বুই-এর দশকের গোড়ায় ইন্টারনেট ছিল না। ফলে আমাদের কাছে আজকালকার পড়ুয়াদের তুলনায় খবর থাকত অনেক কম। তার ওপর লেজেন্ডার সিম্বল কিম্বা ল্যাগ্রাঞ্জের ইন্টারপোলেশন আমাদের মত ফাঁকিবাজদের সঙ্গে যোগাযোগ করত শুধু পরীক্ষার আগের রাতে। তাই এই নামগুলো স্যারের বর্ণণা থেকে আমার কাছে ভেসে আসছিল আবছা আবিল্যির মত।

— "তোরা যেমন বাবার পয়সায় কোচিং এ পড়ে বারো ক্লাসের পর একবারে যাদবপুরে ঢুকে গেছিস, গ্যালোয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কিন্তু অত সহজ হয় নি। সেই সময় ফ্রান্সে অঙ্ক শেখার সবচেয়ে ভাল জায়গা ছিল ইকোলে পলিটেকনিক। ইন্টারভিউ-এ ভাল না করায় সে বেচারি সেখানে সুযোগ পেল না। তার বদলে পড়তে হল ইকোলে প্রিপারেটরিতে, যেটা কিনা সেই সময় অনেক কমা একটা জায়গা। তবে এটা মাথায় রাখিস যে সেই জায়গার নাম এখন ইকোলে নরমালে, আজকের দিনে বেশ নামজাদা। এখানকার মাস্টারদের সঙ্গে গ্যালোয়ার দহরম মহরম বেশ ভালই ছিল। ১৮২৮-এ এখানে ভর্তি হওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই ভগ্নাংশের ওপর একটা বেশ ভালো কাজও করেছিল গ্যালোয়া। তার জীবনের সবচেয়ে বড় অবদান অবশ্য পলিনোমিয়াল ইকুয়েশন, আর সে সমস্ত অঙ্কও এর মধ্যে শুরু করে দিয়েছিল সে। তার বয়েসটা ভাব একবার। তখন মাত্র আঠারো। হ্যাঁ, হ্যাঁ, অঙ্কের খাতায় তুই আজকে যে নম্বর পেয়েছিস সেটাই।" আমার দিকে কটমট করে তাকালেন স্যার। "পরের পরীক্ষায় সামলে নেব ঠিক।" মিনমিন করে বললাম আমি। এর বেশি আর কি-ই বা বলতে পারি? চোখের সামনে তখন সিনেমার মত চলে বেড়াচ্ছে বিশাল বিশাল গম্বুজ দিয়ে বানানো প্যারিসের এক ইউনিভার্সিটি। ছাইরঙা ইটের রাস্তা শেষ হয়ে শ্বেতপাথরের সিঁড়ি, দুপাশে ফোয়ারা আর সাজানো ফুলগাছের সারি। সেখানে ঢুকে অনেকটা গাড়িবারান্দার মত বিশাল জায়গা আর তার দুপাশে উঁচু উঁচু ক্লাসঘর, জানলার কাঁচগুলো রামধনুর রঙে রাঙানো। আমাদের তরুণবাবুর মতই পড়াচ্ছেন এক ফরাসী অধ্যাপক। গায়ে বকলস লাগান সাদা জামা, পরনে কালো প্যান্ট। আমার চারপাশে বিভিন্ন ডেস্কে বসে ঝলমলে চেহারার সব রাজপুত্তুর রাজকন্যেরা। সামনে বড় বড় তিনটে বোর্ডে একটানা লিখে যাচ্ছেন অধ্যাপক, মাঝে মাঝে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। পেন্ডুলামের মত দুলে উঠছে লালচে চুলে মুক্তোর হার ঢেকে যাওয়া ফরাসী রাজকন্যেদের ঘাড়। রাজপুত্রেরা প্রায় স্থির। তাদের চোখ কখনো বোর্ডের দিকে, কখনো বা নিজেদের বাঁধানো খাতায়।

— "এর মধ্যে গ্রামের পুরোহিতের সঙ্গে বিভিন্ন গোলমালে জড়িয়ে পড়ে ১৮২৯ সালে আত্মহত্যা করে বসেন গ্যালোয়ার বাবা। সেই সব ঝামেলার মধ্যে তার কদিন পরেই আবার ইকোলে পলিটেকনিকে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করে গ্যালোয়া। কিন্তু ভাগ্যদেবী এবারেও সহায়তা করলেন না। গ্যালোয়া তার নিজের গবেষণার কাজ যেভাবে বোঝানোর চেষ্টা করল সেটা মানতে পারলেন না পরীক্ষকেরা। সেই বছরের একদম শেষের দিকে ইকোলে প্রিপারেটরিতে থেকেই ডিগ্রি পেল সে। যদিও সে পরীক্ষাতেও নাকি গ্যালোয়ার সমস্ত ব্যাখ্যা বুঝতে পারেন নি পরীক্ষকেরা। এর মধ্যে গবেষণা অবশ্য থেমে থাকে নি। দুর্ভাগ্য যে বার বার তার গবেষণাপত্র ফিরিয়ে দিয়েছেন সেই সময়কার বিশেষজ্ঞরা। শেষপর্যন্ত ১৮৩০-এ গ্যালোয়ার তিনখানা গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় যার মধ্যে একটা খুব গুরুত্বপুর্ণ অংশ গ্যালোয়া থিওরী নামে সারা পৃথিবীতে আজ বিখ্যাত।" স্যার বোধহয় আর একটু হলেই সে সব থিওরী বোঝানোর একটা সৎ প্রয়াসে সামিল হতেন। কিন্তু অরিন্দমের ছোট্ট হাই আর দেবজ্যোতির আরামোড়া ভাঙ্গা দেখে বিরত হলেন।

— "একঘেয়ে লাগছে বুঝি? কিন্তু গল্পের আসল জায়গাটাই তো বাকি। তবে তোদের যদি ভাল না লাগে তাহলে আজকে এই পর্যন্তই থাক। পরে না হয় বাকিটা শুনে নিবি। বাড়ি ফেরার সময় তো তো প্রায় হয়েই এলো।" স্যার আবার উঠে দাঁড়ানোর ভঙ্গী করলেন। এবার কিন্তু প্রণবই বাঁচালো। "পাঁচটা কুড়ির ট্রেন চলে গাছে স্যার। এর পরেরটা ছটা পঁয়তাল্লিশ।" আড়চোখে নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সবে পাঁচটা বেজেছে। স্যার হাতে ঘড়ি পরেন না, আর আশির দশকে কলকাতায় মোবাইলের আবির্ভাব হয় নি। "ঠিক আছে, তাহলে শেষ করে ফেলাই যাক।" স্যার আবার শুরু করলেন। "প্যারিসে তখন চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা। ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ সময় ১৮৩০-এর জুলাই মাস। রাজা দশম চার্লসকে উল্টে দেওয়া হয় এইসময়ে। ২৬শে জুলাই এই বিদ্রোহ সামাল দেওয়ার জন্যে একগাদা জোরালো দমননীতি জারি করার চেষ্টা করেন রাজা। তার মধ্যে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও খর্ব করা হয়। কিন্তু এসব করে কি আর বিদ্রোহ রোখা যায়? প্যারিসে সেদিন বেশ গরম ছিল, বুঝলি। সঙ্গে জনগণের মাথাও। ২৭ তারিখ সকাল থেকেই লোকজন পথে নামতে শুরু করে। আর ২৯ তারিখের মধ্যেই রাজার রাজত্বের পতন এবং মূর্ছা। এইসব রাজনৈতিক কর্মকান্ডে গ্যালোয়াও জড়িয়ে পড়েছিল। সারা প্যারিসের মানুষ যখন রাস্তায় নেমেছে, তখন ছাত্ররাও পিছিয়ে ছিল না। ইকোলে পলিটেকনিকের পড়ুয়ারা বিদ্রোহে যোগ দিলেও, ইকোলে প্রিপারেটরিতের অধিকর্তা সেখানকার ছাত্রদের আটকে রেখেছিলেন। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে খবরের কাগজে চিঠি লেখে গ্যালোয়া এবং এই কারণে পরবর্তীকালে সে বহিষ্কৃত হয় ইউনিভার্সিটি থেকে। যদিও তার আগে সে নিজে থেকেই সেখানকার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল।"

— "জুলাই মাসের গোলমালের পরে ক্ষমতা দখল করেন লুই-ফিলিপ। এই সময় রিপাবলিকানদের সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দেয় গ্যালোয়া। সে দলের নাম ছিল ন্যাশনাল গার্ড। বিভিন্ন রাজনৈতিক বিবাদে ঐ সময় এই দলকে বেআইনি ঘোষণা করা হয় আর এদের কিছু লোককে ভরা হয় জেলে। তারা অবশ্য কয়েকমাসের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যায়। সেই উপলক্ষে ১৮৩১-এর ৯-ই মে এক বিপুল পানভোজনের আয়োজন হয়েছিল। সেখানে রাজা লুই-ফিলিপ থেকে আলেক্সান্ডার দ্যুমার মত বিখ্যাত লেখক-ও উপস্থিত ছিলেন। কথিত আছে যে রাজার সামনে মদের গেলাস তুলে উচ্ছ্বাস দেখানোর সময় গ্যালোয়া নাকি একটা ছুরি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। রাজা অনুমান করেন যে তাঁকে ভয় দেখাচ্ছে গ্যালোয়া এবং সেই অপরাধে তাকে পরের দিনই জেলে ঢোকানো হয়। অবশ্য মাসখানেক বাদেই জেল থেকে মুক্তি পায় সে।" একটানা বলে একটু দম নেওয়ার জন্যে থামলেন তরুণবাবু। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন, "বাস্তিল দূর্গের পতন কবে হয়েছিল?" অঙ্কে টঙ্ক না হলেও, ইতিহাসে আমি মোটেই পাতিহাঁস নই। ফলে গড়গড় করে বলতে শুরু করলাম। "ওটা ফ্রান্সের স্বাধীনতা দিবস স্যার। ১৪-ই জুলাই, ১৭৮৯। বিপ্লবের ধাক্কায় বাস্তিল দূর্গের পতন। দিনটাকে ওরা স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করে।"

— "ঠিকই বলেছিস। আমার গল্পের জন্যে এটুকুই যথেষ্ট।" আমাকে চট করে থামিয়ে দিয়ে আবার শুরু করলেন স্যার। "১৮৩১ সালে ওই দিনটা উদযাপনের আনন্দে গ্যালোয়া এক সশস্ত্র মিছিলের নেতৃত্ব দিতে বেরিয়ে পরে। গায়ে পোশাক ছিল ন্যাশনাল গার্ড-দের, যেটা তখন সম্পুর্ণ বেআইনি। এই অপরাধে আবার ৬ মাসের জন্যে জেলে পোরা হয় তাকে। এবার জেলে থাকার সময় গ্যালোয়া ফের গবেষণাতে মন দেয়। ২৯-শে এপ্রিল, ১৮৩২-এ জেল থেকে ছাড়া পায় সে। কিন্তু আবার শুরু হয়ে যায় জোরদার বৈপ্লবিক কর্মকান্ড। যদিও জটিল বীজগণিত নিয়ে কাজ চলতে থাকে একইসঙ্গে। ভাবাই যায় না যে ছেলেটা কি করে একহাতে ঐরকম ঝুঁকির রাজনীতি আর অন্যহাতে গভীর অঙ্ক সমান্তরালভাবে চালিয়ে যাচ্ছিল। তোদের এক একটা ইউনিয়নের নেতা তো অঙ্কের খাতা ফাঁকা রাখাই বেশি পছন্দ করে।" মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকালেন স্যার। বোধহয় আমার মনের কথাটা বুঝতে পারছিলেন। আমি তখন ভাবছি যে পরের পরীক্ষাতে মাথায় শিরস্ত্রাণ চাপিয়ে আর হাতে ছুরি নিয়ে যোদ্ধার বেশে মোকাবিলা করব অঙ্ক প্রশ্নের। তাতে যদি কয়েকমাস জেলে যেতে হয় তাও ভাল, কিছুদিন তো অঙ্ক থেকে মুক্তি!

— "গ্যালোয়ার জীবনটা যদি শুধু অঙ্ক আর বিপ্লব এই দুই বিন্দুকে যোগ করা সরলরেখার মধ্যে দিয়ে চলত তাহলে হয়ত গল্পটা এভাবে শেষ হত না। কিন্তু বাধ সাধল এক তৃতীয় বিন্দু। যে মহিলার নাম স্তেফানিয়ে-ফেলিসি পোতেরিন দ্যু মোতেল। সে সময় গ্যালোয়া যে হোস্টেলে থাকত সেখানকার ডাক্তারের মেয়ে ছিল এই দ্যু মোতেল। ত্রিকোণ প্রেমের গল্প নাকি রাজনৈতিক শত্রুতা সে কথা আজও সঠিক জানা যায় নি, কিন্তু এটা জানা যায় যে এই মহিলা সম্পর্কিত কোন এক ঘটনায় ডুয়েল-এর চ্যালেঞ্জ নিয়ে বসে গ্যালোয়া। আলেক্সান্ডার দ্যুমার ভাষ্য অনুযায়ী প্রতিদ্বন্দ্বী যুবকের নাম পেসচেউক্স দ্য'হারবিনভিলে। যাদের মুক্তি উপলক্ষে বিরাট পান ভোজনের আয়োজন হয়েছিল, সে নাকি তাদেরই একজন। অন্য একটা মত বলে সম্ভবত সেই ছেলের নাম আরনেস্ট ডুচাটেলেট, যে গ্যালোয়ার সঙ্গে একইসময়ে জেলে গেছিল সশস্ত্র মিছিলে অংশগ্রহণ করে। ডুয়েল হয়েছিল ৩০-শে মে। লড়তে গিয়ে তলপেটে গুলি লাগে গ্যালোয়ার। পরদিন সকালে সে মারা যায়। মৃত্যুর আগে সে নাকি তার ভাইকে বলে গেছিল - কাঁদিস না আলফ্রেড, কুড়িতে মরার জন্যে আমাকে সমস্ত সাহস একসঙ্গে জড়ো করতে হয়েছে।" আমরা সবাই চুপ। স্যার উঠে দাঁড়িয়েছেন। নজরে আসে নি কখন শরতের সন্ধেটা ঝুপ করে আমাদের কাঁধে চেপে বসেছে।

------
~Saibal

শনিবার, ১১ অক্টোবর, ২০২৫

গোয়ালন্দর মুরগিমাংসর ঝোল ~ রঞ্জিত গুহ



বেঁচে বর্তে থাকা একদা পূর্ববঙ্গীয় অতি বৃদ্ধ কারও হয়তোবা এখনও জিহ্বায় গোয়ালন্দ স্টিমারঘাটার সুবিখ্যাত মুরগিমাংসর ঝোলের স্বাদ লেগে আছে। পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্রের ( যমুনা) সঙ্গম গোয়ালন্দ থেকে নারায়নগঞ্জের স্টিমার পথে মাল্লারা নিজেদের জন্য এই মুরগীর ঝোল রান্না করত। ক্রমে ক্রমে আমজনতার প্রিয় পদ হয়ে ওঠে।   কলকাতার লক্ষ্মীবাবুর আসলি সোনাচাঁদি দোকানের মত  গোয়ালন্দ স্টিমার ঘাটায় এখন সারি সারি মকবুল চাচার আসলি দোকান।এই মুরগী মাংসের ঝোলের জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি।এই বিশিষ্ট স্বাদের রান্না নিয়ে অনেক লোকগাথা তৈরি হয়েছে। রন্ধনপ্রণালীর আদি উদগাতা কে তা নিয়েও বেশ আকচাআকচি আছে।দেশবিদেশের রন্ধন বিশারদরা এই রান্নার  রেসিপি জানতে গোপনে হোটেল কর্মচারী সেজে থেকে গেছেন বলে গল্পকথা হাওয়ায় ভাসে। এইসব গল্পকথা নিয়ে একবার  এক শারদীয় পত্রিকায় এক উপন্যাস লেখা হয়েছে।  দেশভাগের পটভূমিতে খানিকটা রহস্য মিশেল দিয়ে প্রেম ও বন্ধুত্বের টানাপোড়েন। পড়তে মন্দ লাগেনা। হোটেল বা হোটেল জীবন নিয়ে বাংলায় কয়েকটা উপন্যাস আছে। একটা মাত্র রান্নার পদ নিয়ে একটা উপন্যাস এর আগে আমি পড়িনি। 

 অনেক বছর আগে এই পদের ঘরোয়া  রন্ধনপ্রণালী জেনেছিলাম জলপাইগুড়ি হাকিম পাড়ার এক প্রিয় বন্ধুর মায়ের কাছে।মাসীমা প্রয়াত হয়েছেন অনেকদিন।  এই সহস্রাব্দের শুরুতে বন্ধুর পাকশালায় হাতেকলমে বার কয়েক রেঁধেছি এই পদ। বেশ ঝকমারি আছে।  সে সব লিখে রাখিনি। ভুলেও যাইনি। সেই বন্ধুর গোয়ালন্দে এখনও যাতায়াত আছে।  দিন কয়েক আগে  ফোনে  জলযন্ত্রনায় বিপর্যস্ত বন্ধুর খোঁজ খবর নেওয়ার ফাঁকে বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় হল।কথায় কথায়  সেই সব পুরানো কথার ঢেউ উঠল।রন্ধনপ্রণালীটাও ঝালিয়ে নিলাম।



প্রস্তুতি,  অর্থাৎ কিনা ম্যারিনেট করা।
১) ব্রয়লারে তেমন স্বাদ হবেনা। যাকে বলে দেশী মুরগি কেটে ধুয়ে জল ঝরিয়ে নুন মাখিয়ে  মিনিট দশেক ঢাকা থাকবে।
২) কালোজিরে বাটা দিয়ে ভালো করে মেখে আবার ঢাকা দশমিনিট। 
৩) আদা জিরে কাঁচালঙ্কা বাটা দিয়ে মেখে মিনিট পাঁচেক ঢাকা।
৪) সরষে তেল দিয়ে মেখে আবার ঢাকা।পাঁচ মিনিট। 
** আদা জিরে লঙ্কা কালোজিরে নুন তেল একসাথে মুরগীর সাথে মাখলে হবেনা কিন্তু।

কড়াইয়ে খুব ঢিমে আঁচে গরম করা সরষে তেলে থেতলানো রসুন কোয়া ভেজে , অনেকটা পেয়াজ কুঁচি   আধ ভাজা করে আদা কুঁচি দিয়ে আন্দাজমত নুন ছড়িয়ে দিতে হবে।
এরপর
১) ঐ কড়াইয়ে অর্ধেকের বেশি মাংস দিয়ে নেড়েচেড়ে ঢাকা চাপা। চাপা উঠিয়ে নেড়েচেড়ে আবার চাপা।
২) দু-চারটে শুকনো লঙ্কা দিয়ে ঢাকা।
৩) বাকি মাংস কড়াইয়ে দিয়ে হলুদবাটা জলে গুলে ঢেলে দিতে হবে। নেড়েচেড়ে আরও খানিকটা আন্দাজমত জল দিয়ে ঢাকার আগে খোসা ছাড়ানো কয়েক টুকরো আলু দিতে হবে। 
৪)ঝোল ফোটা শুরু হলে  আঁচ আরও কমিয়ে  শুকনো লঙ্কা বাটা ও খুব অল্প সরষে বাটা জলে গুলে কড়াইয়ে  দিতে হবে। ফুটুক কয়েক মিনিট। 
এইবার রাঁধুনিরা দ্বিমত বা বহুমত। 
১) কুঁচো চিংড়ি কড়া করে ভেজে দু'হাতের তালুতে পিষে গুড়ো করে ঝোলে দিয়ে টগবগ করে ফুটিয়ে নামিয়ে নাও।
২) যেকোনো কুঁচো মাছ কড়া ভেজে গুড়ো করে দিতে হবে।
৩) লইট্যা বা হিদল( পুঁটি)  শুঁটকি পেয়াজ লঙ্কা  রশুন বেশ কড়া ভেজে পেস্ট করে মাংসের সাথে মিলিয়ে দাও।
** আমি চিংড়ি ভাজা গুড়ো দিয়ে করেছি।

নামাবার আগে কয়েকটা কাঁচালঙ্কা চিরে ছড়িয়ে দিতে হবে।সবার পাতেই যেন একটা দুটো পড়ে।
পাতে দেওয়ার আগে সামান্য ঝোল জিভে দিয়ে বুঝে নিতে হবে নুন কমবেশি হয়েছে কিনা।

** গরম না থাকলে এ ঝোলের স্বাদ অর্ধেক কমে যায়।

রবিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৫

৪০টি নৌযান এবং ৬২৩ জন মেয়ে ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

পাশের বাড়ির বৌদি, বিগত যৌবনা হলেও সাজগোজ করতে কিঞ্চিৎ ভালোবাসেন। আপনি আড় চোখে দেখেন আর পাড়ার চায়ের ঠেকের খাপ পঞ্চায়েতে তাকে আখ্যা দেন ঢলানি মেয়েছেলে বলে। অফিসে নতুন কাজে জয়েন করা মেয়েটি স্বচ্ছন্দে সবার সাথে মেলামেশা করছে দেখে আপনি তাকে আখ্যা দেন বেহায়া বলে। বন্ধু'র কনিষ্ঠ কন্যা, সদ্য কলেজ ছাত্রীকে জিন্স পরতে দেখলে, সিগারেট ফুঁকতে দেখলে আপনার স্থির সিদ্ধান্ত হয়, মামনি গোল্লায় গেছে। কাজ সেরে বাড়ি ফেরার সময় মেট্রো রেল কামরায় হাতল ধরা মহিলার শাড়ির আঁচল অবিন্যস্ত দেখলে আপনার ল্যাম্প পোস্টের নিচে দাঁড়ানো মেয়েদের কথা মনে পড়ে। একটা সময় পশ্চিম ইউরোপের ইতালিতে মেয়েদের দেখে আপনার মতো কিছু নীতি পুলিশ সাজা কাকু/ কাকিমা ওই সিদ্ধান্তে আসতেন যে ওদেশের মেয়েগুলি কিঞ্চিৎ বেহায়া, ঢলানী ও বয়ে যাওয়া এম্পটি হেডেড। 

অথচ কি আশ্চর্য্য দেখুন ওদেশের সেই মেয়েগুলি দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধের সময় কি অবাক কান্ডই না ঘটিয়ে ছিল। আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে যে ওই ইতালি দেশটাতেই ফ্যাসি*বাদ নামক কুখ্যাত মতবাদের জন্ম। ইউরোপের আর পাঁচটা দেশেও ফ্যাসি*স্ট আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ওই দেশে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনী, যাদের পার্টিজান বলে, সেটা গঠিত হয়ে ছিল। কিন্তু আপনার কি জানা আছে যে দু লক্ষ পঞ্চাশ হাজার সংগ্রামী মানুষ দ্বারা গঠিত সেই বাহিনীর  এক লক্ষ পাঁচ হাজার মানে প্রায় চল্লিশ শতাংশ সদস্য ছিল মহিলা ? যারা পুরুষ কমরেডদের পাশাপাশি স্টেনগান হাতে নিয়ে লড়াই দিয়েছিল ? আজ্ঞে হ্যাঁ যেই "বেহায়া", "ঢলানি" "মেয়েছেলে"র দল। আপনাকে কেউ কি কোনোদিন বলেছে যে ওই মেয়েদের মধ্যে চার হাজার ছশ জন গ্রেপ্তার হয়েছিল, দু হাজার সাতশো পঞ্চাশ জনকে পাঠানো হয়েছিল বিভিন্ন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। ওই মহিলাদের আত্মত্যাগ বিফলে যায়নি কিন্তু। ফ্যাসি*বাদীদের পরাজয় হয়েছিল। আঠাশ এপ্রিল, ১৯৪৫ ফ্যাসিবাদের সবচেয়ে বড় নায়ককে পার্টিজানরা গুলি করে মারে। মেরে ফেলে দিয়ে যায় মিলান এর প্রধান রেল স্টেশনের চত্বরে। যার পরে ক্রুদ্ধ বিক্ষুব্ধ জনতা পাশবিক আক্রোশে সেই একনায়কের মৃতদেহ উল্টো করে ঝুলিয়ে দেয় ল্যাম্পপোস্টে, জনতা জড়ো হয়ে উল্লাস করে সেই ল্যাম্পপোস্টের নিচে। এর পরে সবাই ঘরে ফেরে। মেয়েরা বন্দুক ফেলে ফিরে যায় অভ্যস্ত জীবনে, ঘরকন্নয়, গেরস্থালির কাজে, মাঠে ফসল তোলার কাজে, ফ্যাশন শো এর রেম্পে। 

গত কয়েকদিনের মধ্যে চুয়াল্লিশটি দেশের চল্লিশটি নৌযান নিয়ে গঠিত বেসামরিক নৌবহর যার নাম সুমুদ ফ্লোটিলা রওয়ানা দিয়েছিল ইসরায়েলি হানায় বিধ্বস্ত গাজায় ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছিয়ে দিতে। ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবী জুড়ে বেসামরিক, বেসরকারি প্রতিবাদ। ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স ওই নৌযান গুলিকে সাগরের বুকেই ইন্টার্সেপ্ট করেছে। অভিযাত্রীদের এই অসম সাহসী অভিযানকে ঘিরে শুরু হয়েছে দক্ষিণপন্থীদের কুৎসা প্রচার। এই প্রচারকারীদের আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য এই আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী গ্রেটা থুনবার্গ, রিমা হাসান ও অংশগ্রহণকারী অন্যান্য মহিলারা। তাদের চরিত্রে কালি ছেটানো চলছে। ঠিক যেমনটা হয়েছিল সেই ফ্যাসিস্ট ইতালিতে। 

আশার কথা এটাই যে সেই ইতালির মতো আজকের ইতালিতেও খেটে খাওয়া মানুষজন এই অভিযাত্রীদের পাশেই দাঁড়িয়েছে সেই দেশের চরম দক্ষিণপন্থী সরকারের হুশিয়ারি সত্ত্বেও। রাজপথে তাঁদের কন্ঠে ফিরে এসেছে সেই পুরনো ফ্যাসিস্ট বিরোধী "বেলা চাও" গানের সুর ও স্বর। তাদের সাথে সুরে সুর মিলিয়ে কলকাতা সহ পৃথিবীর প্রায় সব শহরের বুকে হচ্ছে মিছিল, জমায়েত। বেলা চাও বারে বারে ফিরে আসছে আমাদের মধ্যে। 

ফেরেনি কেবল ফ্যাসিস্ট/ নাৎসি বাহিনীর হাতে শহীদের মৃত্যু বরণ করা ছশো তেইশ জন মহিলা পার্টিজান। কোনো অজানা সবুজ পাহাড়ের কোলে, আরো সবুজ শান্ত গাছের ছায়ায় তারা চিরকালের মতো ঘুমিয়ে আছে। তাদের মিনি স্কার্ট হাই হিলের খুট খুট শব্দে মুখরিত হবে না আর মিলানের পাথর বাঁধানো রাস্তা। যখনই কেউ  প্রতিবাদে গর্জে ওঠা মেয়েদের "ঢলানি মেয়েছেলে" বলে অপবাদ দেয়, তাদের শরীর নিয়ে নোংরা কথা বলে তাদের বদনাম করতে চায়, তখনই কেন জানি সেই শহীদ পার্টিজান বাহিনীর মেয়েদের কথা মনে পড়ে যায়। গুডবাই বিউটিফুল। বেলা চাও, বেলা চাও, বেলা চাও চাও চাও।

শুক্রবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৫

গান স্যালুট ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত


বিকেল পাঁচটা'র সময় সেদিন এক খুনির হাতে ধরা ইতালিয়ান পিস্তল থেকে গুলি ছুটে গিয়ে গিয়ে ফুঁড়ে দিয়েছিল এক অশক্ত বৃদ্ধের শরীর। বেরেটা সেমি অটোম্যাটিক মডেল নম্বর M1934, সিরিয়াল নম্বর 606824 এর থেকে বেরিয়ে আসা পয়েন্ট 380 ক্যালিবারের গুলি। 



কে এই বৃদ্ধ ? এই বৃদ্ধ যার অনশন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অবিসংবাদী নেতা সাভারকার বিবৃতি দিয়েছিলেন: "সময় এসেছে যে, গান্ধীজির স্বাস্থ্যের গুরুতর অবস্থা নিয়ে যারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং তাঁর মূল্যবান জীবন বাঁচানোর কোনো চেষ্টা বাকি না রাখতে যারা ইচ্ছুক তাদের অবিলম্বে উপলব্ধি করা উচিত যে আমরা এটি পছন্দ করি বা না করি, গান্ধীজীর জীবন বাঁচানোর জন্য সবচেয়ে বেশি কার্যকর হওয়ার একমাত্র উপায় এখন মহাত্মা গান্ধীর কাছে একটি জাতীয় আবেদন জারি করা যা তার সময় শেষ হওয়ার আগে তার উপবাস ভাঙার জন্য আবেদন।" " [সূত্রঃ ১]

এটা বিস্ময়কর ঠেকলে সুধী পাঠক, আমরা দেখে নিতে পারি ওই হত্যাকান্ডের মামলার অন্যতম অভিযুক্ত সাভারকারের আরেকটি উক্তি। বৃদ্ধের জন্মদিনে সাভারকার অভিনন্দন জানালেন: "তাঁর ৭৫ তম জন্মদিনে আমি মহাত্মা গান্ধীজি এবং আমাদের জাতিকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। ঈশ্বর তাঁকে দীর্ঘ জীবন এবং শক্তিশালী স্বাস্থ্য দান করুন" [সূত্র ২:]

কিম্বা আরো বিস্ময়কর উক্তি যেখানে জেল থেকে গান্ধীজির ছাড়া পাওয়ায় সাভারকার আনন্দ প্রকাশ করে লিখছেন: "গান্ধীজির বার্ধক্য এবং সাম্প্রতিক গুরুতর অসুস্থতার কারণে স্বাস্থ্যের অবনতি বিবেচনা করে সরকার তাকে মুক্তি দিয়েছে এই খবরে সমগ্র জাতি স্বস্তি বোধ করছে। এটা ছিল একটি মানবিক প্রচেষ্টা। আমি গান্ধীজির দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। আমি আশা করি সরকার এখন পণ্ডিত নেহেরু এবং সেই সমস্ত ভদ্রলোকদের মুক্তি দেবে যাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য বিচার না করেই কারাবন্দী করা হয়েছে, অথবা প্রকাশ্যে বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি, যাতে দেশ জানতে পারে যে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ কী। [সূত্রঃ ৩]

হাত্যার দায়ে অভিযুক্ত কোনো আসামি সেই নিহত মানুষটি সর্ম্পকে এমন মূল্যায়ন করেছেন এই উদাহরণ খুব একটা আছে বলে তো আমরা জানি না। যাই হোক, সাভরকার তো ছাড়া পেয়েছিলেন শেষ অবধি কিন্তু তিনি যাকে ক্রিমিনাল আখ্যা দিয়েছিলেন, তার এককালের সহকর্মী কাম শিষ্য সেই গডসের কার্যকলাপে আমরা একটু মনোনিবেশ করি। হত্যাকারী গডসে ও তার সঙ্গীরা বহুদিন ধরেই ওই বৃদ্ধকে খুন করার জন্য উপযুক্ত অস্ত্র খুঁজছিল। অস্ত্রটি তাদের হাতে আসে হত্যাকাণ্ডের ঠিক দু'দিন আগে। "গডসে ২৮শে জানুয়ারি ট্রেনে করে গোয়ালীয়র আসে এবং গোয়ালীয়রবাসী ডা: দত্তাত্রেয় পারচুরে, গঙ্গাধর দন্ডবতে, ও সূর্যদেব শর্মা এর সহায়তায় এই পিস্তলটি জোগাড় করে।" [সূত্রঃ ৪]

ডা: পারচুরে তার গ্রেপ্তারের পরে ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেট এর কাছে জবানবন্দিতে জানায় যে সে ওই পিস্তলটি সংগ্রহ করেছে দন্ডবতে'র কাছ থেকে। দন্ডবতে জানায় যে সে সংগ্ৰহ করেছে জগদীশ প্রসাদ গোয়েল এর কাছ থেকে। জগদীশ প্রসাদ গোয়েল কার কাছ থেকে এই পিস্তল সংগ্রহ করেছিল সেটা জানা যায় নি, মুখ খুলতে রাজি হয় নি। "এটা সম্ভব যে মুখ খুলতে নারাজ হয়ে গোয়েল সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের আড়াল করতে চেয়েছে।" [সূত্রঃ ৫]

প্রথমে প্লেনে করে দিল্লি আর তার পরে ট্রেনে করে গডসেদের গোয়ালীয়র যাওয়ার উদ্দেশ্যই ছিল একটা নিখুঁত যন্ত্রের প্রয়োজন। পাওয়ার পরে গডসে ও আপ্তে দিল্লি ফিরে আসে ২৯ তারিখ সকালে।" [সূত্রঃ ৬]

কে ঐ পারচুরে ? গোয়ালীয়র এর ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান, কৃতি ছাত্র, পাস করা চিকিৎসক। তিনি কেন বেরেটা পিস্তল সংগ্রহ করতে যাবেন ?  তাঁর পরিচয়ের আরেকটা দিক হল, তিনি হিন্দুমহাসভার সক্রিয় কর্মকর্তা,  এবং স্থানীয় 'হিন্দু রাষ্ট্র সেনা'র নির্বাচিত ডিরেক্টর। গোয়েল ছিল তার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর একজন সদস্য। [সূত্রঃ ৬]।

খুনি'র মোডাস অপারেন্ডির খানিকটা জানা গেল। খুনীর বিচারটাও কিন্তু খুব কৌতূহলজনক। পাছে একপেশে ন্যারেটিভ এর দায়ে অভিযুক্ত হতে হয় তাই আমরা আবার শরণাপন্ন হবো খুনীর মেন্টর এর। গান্ধীজিকে 'মহাত্মা' সম্বোধন করে তার জঘন্য হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করে সাভারকার লিখলেন, "মহাত্মা গান্ধীর হত্যার আকস্মিক ও মর্মান্তিক সংবাদ আমার কাছে পৌঁছানোর সাথে সাথেই আমি একটি প্রেস-নোটে প্রকাশ্যে এটিকে একটি ভয়াবহ এবং ভ্রাতৃঘাতী অপরাধ বলে নিন্দা জানাই, যা দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘটছে। এবং আজও আমি গান্ধীজীর হত্যার দ্ব্যর্থহীনভাবে নিন্দা জানাই।" [সূত্রঃ ৭]

গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসে, নারায়ণ আপ্তে সহ অন্যান্যদের পরিষ্কার ক্রিমিনাল আখ্যা দিলেন সাভারকার এবং তিনি তার শিষ্যদের কাজের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করলেন: "অনেক অপরাধী তাদের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের গুরু এবং পথপ্রদর্শকদের প্রতি উচ্চ শ্রদ্ধা এবং আনুগত্য পোষণ করে এবং তাদের নীতি অনুসরণ করার দাবি করে। কিন্তু গুরু বা পথপ্রদর্শকের তার অনুসারীদের অপরাধে জড়িত থাকার বিষয়টি কি কেবল সেই অপরাধীদের তাদের গুরুদের প্রতি আনুগত্য এবং শ্রদ্ধার দাবির ভিত্তিতে অনুমান করা এবং প্রমাণিত করা যেতে পারে? [সূত্র: ৭]

শুধু কথামাত্র নয়, কাজেও সাভাকার দেখিয়েছিলেন যে তিনি গান্ধী হত্যাকারীদের কতটা ঘৃণা করেন। গোপাল গডসের উকিল পি এল ইনমাদারের ভাষায়, 
"পুরো বিচার চলাকালীন, আমি কখনও সাভারকরকে এমনকি নাথুরামের দিকে তাকাতে এমনকি ও মাথা ঘোরাতে দেখিনি, যিনি তার পাশে বসে থাকতেন; নাথুরামের সাথে কথা বলা তো অনেক দূরের কথা... সাভারকর সেখানে স্ফিংসের মতো নীরবে বসে ছিলেন, কাঠগড়ায় থাকা তার সহ-অভিযুক্তকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে" [সূত্রঃ ৮]

তার গুরু, আদর্শ-প্রতিমার এই আচরণে হত্যাকারী নাথুরাম গডসে কতটা বিচলিত হয়েছিলেন ও দুঃখ পেয়েছিলেন তার নমুনা সেই উকিল ইনমাদারের ভাষায়: "নাথুরামের সাথে আমার বিভিন্ন আলোচনার সময় তিনি আমাকে বলেছিলেন যে তিনি এতে গভীরভাবে আহত হয়েছেন - লাল কেল্লার বিচারের সমস্ত দিনগুলিতে আদালতে বা লাল কেল্লা কারাগারে তাতিয়ারাও [সাভারকর] তার সাথে সুপরিকল্পিতভাবে সর্ম্পকছেদ প্রদর্শন করেছিলেন। নাথুরাম কীভাবে তাতিয়ারাওয়ের হাতের স্পর্শ, সহানুভূতির একটি শব্দ, অথবা অন্তত করুণার একটি দৃষ্টিপাত দেখার জন্য আকুল ছিলেন? সিমলা হাইকোর্টে তার সাথে আমার শেষ সাক্ষাতের সময়ও নাথুরাম এই বিষয়ে তার আহত অনুভূতির কথা উল্লেখ করেছিলেন।" [সূত্রঃ ৮]

এইবারে আসা যাক আসল বিষযে, হত্যাকান্ডের মোটিভ। কেন সেদিন বিকেলে খুন হতে হয়েছিল ওই বৃদ্ধকে। তিনি কি অপরাধ করেছিলেন। 

খুনের একটু আগে পিছিয়ে যাওয়া যাক। ১৫ই আগস্ট, ১৯৪৭ সাল। গোটা দেশ এর বড় অংশ  স্বাধীনতার আনন্দে মাতোয়ারা। ওই বৃদ্ধের "সবচেয়ে বড় শিষ্য" তখন ক্ষমতার গদিতে বসার আনন্দে তাঁর অন্য সঙ্গী সাথীদের নিয়ে দিল্লির আলো উজ্জ্বল সেন্ট্রাল হলে "নিয়তির সাথে অভিসার" এর গল্প শোনাচ্ছেন দেশ তথা বিশ্বকে তখন দাঙ্গা বিধস্ত কলকাতার বেলেঘাটায় ওই বৃদ্ধ অনশন করছেন, চরকা কাটছেন। প্রতিবাদে। হিন্দু-মুসলিম, তাঁর প্রিয় সন্তানদের মারামারি খুনোখুনির প্রতিবাদে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত এক সৈনিক।

কলকাতা শান্ত হলে তিনি যাবেন দাঙ্গা বিধস্ত পাঞ্জাবে এমনটাই তাঁর ইচ্ছে। তাঁর সাধের জওহরলাল, প্যাটেলদের অনেক কাজ। দেশ চালাতে হবে। তাই তিনিই যাবেন বৃদ্ধ অশক্ত শরীর নিয়ে। কারণ তিনি জানেন যে এখনও ভারতের জীবিত সবচেয়ে বড় মাস লিডার তিনিই। ওসব জহর, প্যাটেল কিস্যু নয়। লর্ড মাউন্টব্যাটেন জানতেন এই সৈনিক একাই একটা সৈন্যদল। তিনি লিখেছেন, "মাই ডিয়ার গান্ধীজি, পাঞ্জাবে আমাদের হাতে আছে ৫৫,০০০ সেনা আর বিশাল মাপের রায়ওটিং। এদিকে বাংলায় আছে একজন মানুষ দিয়ে গড়া সৈন্যদল আর সেখানে কোনও রায়ওটিং নেই" [সূত্রঃ ৯]

'ওয়ান ম্যান আর্মি' সেই বৃদ্ধ তাঁর প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেন নি। তার জন্য তাঁর বহু অনশন দীর্ন অশক্ত শরীর দায়ী নয়। দায়ী অন্যকিছু। ৭ই সেপ্টেম্বর পাঞ্জাব যাবেন বলে দিল্লি রওয়ানা হলেও দিল্লিতে আটকে গেলেন। একদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দলে দলে আগত শিখ আর হিন্দু রিফিউজিদের ক্রোধের আগুনে তখন পুড়তে শুরু করেছে দিল্লির মুসলিম মহল্লা। বৃদ্ধ অনশনে বসলেন। আর অন্য দিকে "বাম" নেহেরু বনাম "দক্ষিণ" প্যাটেল এর প্যাঁচ কষাকষি। দ্বিতীয় জন গান্ধীর ইচ্ছে মেনে নিয়ে প্রথম ক্যাবিনেটে উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ মেনে নিলেও মনে মনে মানেন নি। 

পাকিস্তানের প্রতি জঙ্গি মনোভাব হোক আর কংগ্রেস পার্টি প্রেসিডেন্ট পদে দক্ষিণপন্থী পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডনকে দাঁড় করানো হোক, গান্ধীর তথাকথিত ডান হাত আর বাঁ হাত তখন ক্ষমতার অলিন্দে লড়াই করা দুই প্রতিপক্ষ। বৃদ্ধ আবার অনশনে। [সূত্রঃ ১০]

দেশের অবস্থা শোচনীয়। বৃদ্ধ একা হয়ে গেছেন। নিঃসঙ্গ। প্রিয় শিষ্যরা না পারছে তাকে ফেলতে না পারছে গিলতে। গডসে আপ্তে "নিখুঁত" পিস্তল জোগাড়ে ব্যস্ত। 

বৃদ্ধের মনে পড়ে যাচ্ছে তাঁর আরেক অনুচর এর কথা। নিখোঁজ। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী মৃত। বৃদ্ধের ভাষায় "নেতাজি ওয়াজ লাইক এ সন টু মি"। বৃদ্ধের মনে পড়ে যাচ্ছে তার আশীর্বাদ চেয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রভিনসিয়াল ভারত সরকার ঘোষণার এবং "দিল্লি চলো" আদেশ ঘোষণার প্রাক্কালে নেতাজির সেই ডাক, 
"ভারতের স্বাধীনতা র শেষ মহারণ শুরু হয়ে গেছে। জাতির জনক, ভারতের মুক্তির এই পবিত্র যুদ্ধের জন্য আমরা আপনার আশির্বাদ ও শুভেচ্ছা চাইছি।" [সূত্র ১১] 

আজাদ হিন্দ ফৌজ এর বন্দী সেনানীদের সাথে আলাপ আলোচনার পর বৃদ্ধের নিজস্ব বিশ্লেষণ একটু দেখে নেওয়া যাক,  "যদিও আইএনএ তাঁদের আশু লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, তাঁদের জমার খাতায় গর্ব করার মতো অনেক কিছু আছে। তার মধ্যে মহত্তম হ'ল এক পতাকার তলে ভারতের সব ধরণের ধর্ম, সম্প্ৰদায়, জাতির মানুষকে একজোট করা, তাদের মধ্যে একতা ও সংহতির এক উদ্দীপনা প্রবিষ্ট করা যার মধ্যে সকল প্রকার সাম্প্রদায়িক ভাবনা বর্জিত হয়েছে" [সূত্রঃ ১২]

১২ই সেপ্টেম্বর, আরএসএসের প্রধান গুরু গোলওয়ালকর এর সাথে গান্ধীজি র বৈঠক হল, গান্ধীজি  তাঁকে দাঙ্গা থামানোর অনুরোধ করলেন এবং সোজাসুজি বললেন যে সঙ্ঘের হাত রক্তে মাখা, গোলওয়ালকর উচ্চ সুরে তা অস্বীকার করলেন। [সূত্র ১৩]। বৃদ্ধ বোঝেন নি যে সেইদিনই তাঁর মৃত্যু পরোয়ানায় সই হয়ে গেল। আশাবাদী বৃদ্ধ নিজের জীবনের পরোয়া না করে ১৬ সেপ্টেম্বর তারিখে গেলেন দিল্লির ভাঙি কলোনিতে অবস্থিত আরএসএসের শাখায় তাঁর শান্তির বাণী প্রচার করতে। 

সুধী পাঠক এতক্ষনে নিশ্চয়ই খুঁজে পেয়েছেন সেই হত্যাকারীর মোটিভ। নিঃসঙ্গ অশক্ত ওই বৃদ্ধ বেঁচে থাকতে ভারতের মাটিতে সাম্প্রদায়িক হানাহানির সংস্কৃতি কিছুতেই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। বৃদ্ধ ব্যাগড়া দেবেনই। আর দেশের লোক ওই "বোকা বুড়ো" এর কথায় এখনও নেচে ওঠে, বৃদ্ধ অনশন শুরু করলে তাদের সেন্টিমেন্ট এর বন্যা বয়ে যায়। অতএব মরতে হবেই বৃদ্ধ আপদকে। তাতে অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। কেউ তাকে মূর্তি বানিয়ে ফুর্তি চালিয়ে যাবে, আর কেউ ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখবে সাম্প্রদায়িক ঘেন্না ছড়িয়ে। 

সুধী পাঠক, ক্ষমা করবেন, বৃদ্ধের জন্মদিনে তাঁর আর পাঁচজন ভক্তের মতো "রামধুন" শুনবো না, কারণ আমরা তাঁর ভক্ত নই। আমরা বরং শুনবো সেই গান যা এক হরিজন বস্তিতে তাঁকে শুনিয়েছিলেন গানটির সুরকার আজাদ হিন্দ ফৌজ এর ক্যাপ্টেন রাম সিং। বেহালার ছড় সুর তুলছে "কদম কদম বাড়ায়ে যা"। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে শহীদ ওয়ান ম্যান আর্মির সম্মানে ফৌজের গান চাই। স্যালুট। গডসে বনাম গান্ধীর এই যুদ্ধে আমরা গান্ধীর পক্ষে। 

সূত্র১: পাইওনিয়ার, ২২শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩
সূত্র ২: প্রেস নোট, ২রা অক্টোবর, ১৯৪৩
সূত্র ৩: প্রেস নোট, ৭ই মে, ১৯৪৪
সূত্র ৪: চার্জশিট গান্ধী মার্ডার কেস
সূত্র ৫: মনোহর মালগাঁওকর, দি মেন হু কিল্ড গান্ধী
সূত্র ৬: জাস্টিস জি ডি খোসলা, দি মার্ডার অফ মহাত্মা
সূত্র ৭: সাভারকার এর বিবৃতি, ২০শে নভেম্বর, ১৯৪৮
সূত্র ৮: ইনামদার, আত্মকথা
সূত্র ৯: রাজমোহন গান্ধী, মোহনদাস, এ ট্রু স্টোরি অফ এ ম্যান, হিজ পিপল এন্ড এন এম্পায়ার
সূত্র ১০: অমিত কাপুর, দি এজ অফ এওকেনিং
সূত্র ১১: আজাদ হিন্দ রেডিও 'র : ৬'ই জুলাই ১৯৪৪, রেঙ্গুন ব্রডকাস্ট
সূত্র ১২: হরিজন পত্রিকা, ১৪-০৪-১৯৪৬ সংখ্যা।
সূত্র ১৩: দিনেন্দ্র ঝা, গোলয়ালকর - দ্যা মিথ বিহাইন্ড দ্যা ম্যান।

বৃহস্পতিবার, ২ অক্টোবর, ২০২৫

যদি তোর ডাক শুনে কেউ ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত




সেবাগ্রামে থাকার সময় গান্ধীজি সময় পেলেই লম্বা হাঁটা লাগাতেন। ১৯৩৯ এর ডিসেম্বর আশ্রম থেকে বেড়িয়ে গান্ধীজি দেখলেন  হাতে পুঁটুলি নিয়ে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি এগিয়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করলেন। গান্ধীজি চিনতে পারলেন, শাস্ত্রীজি। গান্ধীজির মুখে একটা চিন্তার ছায়া পড়লো। শাস্ত্রীজি সেটা লক্ষ করেই বললেন, "আপনার কাছে যে চিঠি পাঠিয়েছিলাম তার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করা উচিত ছিল আমার। কিন্তু নিজেকে আটকাতে পারলাম না। হরিদ্বারে বসে নিজের হাতে কাটা সুতো আপনার হাতে তুলে দিতে এসেছি। আমি আশ্রমের ভেতরে যাবো না, এই গাছতলায় শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দেবো  সকালে চলে যাবো"। কে এই শাস্ত্রীজি, কেনই বা তিনি আশ্রমে না ঢুকেই চলে যেতে চাইছেন এটা জানতে গেলে আমাদের একটু ফিরে যেতে হবে।

গান্ধীজি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরে আসেন এবং তার সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। উনি ও অন্য নেতারা গ্রেপ্তার হন, পুনের ইয়েরওয়ারা জেলে পাঠানো হয়। জেলে থাকার সময়, গান্ধীজি জেলসুপার ভান্ডারী সাহেবের কাছে দত্তাত্রেয় পারচুরে শাস্ত্রী নামের সহবন্দী সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন। উনি ভান্ডারী কে অনুরোধ করেন খোঁজ নিতে যে কোথায় শাস্ত্রীজিকে আটকে রাখা আছে, ভান্ডারী কে বলেন " যদি উনি আমার সংগে একসাথে থাকেন তাহলে আমরা একে অন্যকে সংগ দিতে দিতে পারি, আলাপ আলোচনা করে সময় কাটাতে পারি।

ভান্ডারী তার উত্তরে বলেন, " শাস্ত্রীজির কুষ্ঠ আছে বলে তাকে জেলের অন্য সেকশনে রাখা হয়েছে।" এটা শুনে গান্ধীজি স্তম্ভিত হয়ে যান। শাস্ত্রীজি একজন পড়াশোনা করা শিক্ষিত, পন্ডিত মানুষ যার বেদ সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান। এরপরে গাঁধীজি শাস্ত্রীকে একটি চিঠি লেখেন মন খারাপ না করতে এবং অনুরোধ জানান চিঠিপত্র এর মাধ্যমে যোগাযোগ বজায় রাখতে, কোনো প্রয়োজন এ সাহায্য চাইতে।

শাস্ত্রীজি তার উত্তরে লেখেন, " যদি সম্ভব হয় তাহলে কিছু তুলোর ব্যবস্থা করবেন যাতে আমি আমার ক্ষত গুলি পরিস্কার রাখতে পারি; আর যদি কিছু বই এর ব্যবস্থা করা যায়। চিঠি পাওয়ার পরে মহাদেব দেশাই যখন গাঁধীজি কে দেখতে আসেন জেলে, তখন গাঁন্ধীজির নির্দেশে দেশাই ওইসব ব্যাবস্থা করেন ও শাস্ত্রীজিকে খবর পাঠান যে "শরীর আমাদের অসুস্থ হতে পারে কিন্তু চৈতন্য আমাদের জাগিয়ে রাখবে।" গান্ধীজীর এই চিঠি "মৃত সঞ্জীবনী এর মতো কাজ করে শাস্ত্রীজির জন্য এবং তিনি গাঁধীজির এই কথাতে বিপুলভাবে উজ্জীবিত হন।
 
কোনোও সময়ে গাঁধীজি জেলে অনশন করতেন। তাঁর জীবন যখন একটা সুতোয় ঝুলছে, সেই সময়ে সরকার সমঝোতা করেছে।  কে গাঁধীজিকে অনশন ভঙ্গ এর সময় প্রথম ফলের রস খাওয়াবে সে প্রশ্ন উঠে এসেছে। বাপু চেয়েছিলেন শাস্ত্রীজি এই কাজের ভার নিক। সরকার বাহাদুর মেনে নেওয়ার পরে সেটাই হয়। শাস্ত্রী এগিয়ে আসেন।। জেলার ভাণ্ডারী সাহেব এই দৃশ্য দেখে নিজের চোখের জল আটকাতে পারেন নি।

কুষ্ঠরোগীর প্রতি গান্ধীজির এই মনোভাবের শুরু কিন্ত অনেক আগে। দক্ষিণ আফ্রিকায়, নাটাল এ এক জনসভায় বক্তব্য রাখছিলেন গাঁধীজি। হটাৎ খেয়াল করলেন দূরে একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে একদল লোক খুব মন দিয়ে তাঁর কথা শুনছে। হাত নেড়ে কাছে এসে ভিড়ের সাথে মিশে যাওয়ার জন্য ডাকলেও তারা সাড়া দিল না। 

গাঁন্ধীজি ওদের দিকে এগিয়ে এলেন ব্যাপারটা বোঝার জন্য। এগিয়ে আসা মাত্রই ওদের একজন চেঁচিয়ে উঠলো, "গান্ধীভাই আমাদের কাছে আসবেন না।। আমরা লেপার, কুষ্ঠরুগী।" এসব শোনার পরেও গান্ধী এগিয়ে এলেন, কথা বললেন ওদের সাথে।কয়েকজনের হাতের আঙ্গুল খসে গেছে তো কারুর পায়ের আঙ্গুল। কারুর ভুরুর লোম উঠে গেছে। ওরা কে কি চিকিৎসার সুযোগ পায়, গান্ধী জানতে চাইলেন। উত্তর শুনে স্তম্ভিত, স্তব্ধ।

ওদের কথায়, " কোনো ডাক্তার আমাদের চিকিৎসা করতে চায় না; আমরাই যে যার নিজের চিকিৎসা করি নিমপাতার রস দিয়ে।" যখন জানতে চাওয়া হল যে ওই রসে কোনো উপকার হচ্ছে কি না, তখন সবারই উত্তর না, ওরা কেবল ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে। 

ঠিক ওই মুহূর্তে গান্ধীজি ঠিক করলেন যে ওই মানুষগুলির জন্য ওনাকে কিছু করতেই হবে। উনি ওদের বাড়িতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে চলে গেলেন কিন্তু দিনের বেলায় কারুর সাহস হল না তার বাড়ি গিয়ে দরজায় কড়া নাড়ার। গান্ধীজি যখন রাতে ঘুমোতে যাচ্ছেন তখন ওরা গিয়ে উপস্থিত। ওদের ডেকে নিলেন ভেতরে। ওদের ঘা পরিষ্কার করে দিলেন, কিছু খাবার দাবার বের করে খাওয়ালেন, আর ওদের জীবন কাহিনী শুনলেন, কিভাবে ওরা গ্রামের বাইরে একটা খণ্ডহরে বাসা করে থাকে আর বাঁচার চেষ্টা করে। 

ওদের জলের অভাব, নাগাল পায় না, তাই বরুনদেব যখন কৃপা করে মুখ তুলে চান তখন ওরা সেই বারিধারাতে স্নান করে। তা না হলে ওরা ওদের সেই ছেঁড়াখোঁড়া জামাকাপড় ই না কেচে দিনের পর দিন পড়ে থাকে কারণ স্নান করার বা কাপড় কাচার জল থেকে ওরা বঞ্চিত। গ্রামের আনন্দ-অনুষ্ঠানের উচ্ছিষ্ট দিয়েই পেট ভরাতে হয়। জীবন কাহিনী বর্ণনা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে লোকগুলি বিদায় নিতে চায়। গান্ধীজি বিদায়ের সময় বলেন যে তিনি ওদের জন্য কিছু করতে চান। করেওছিলেন,  পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা, ওষুধপত্র এর ব্যবস্থা।

সেবাগ্রামের সেই দিনটাতে ফেরত যাই আমরা। 
এই সেই শাস্ত্রীজি। গাঁধীজি  দক্ষিণ ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবক ভেলাধুনকে নির্দেশ দেন শাস্ত্রীজির জন্য একটি নতুন ধুতি ও বেনিয়ান আনতে। পরের দিন যথানিয়মে প্রার্থনা সভায় মিলিত হলেন সব আশ্রমিকরা। যেখানে গাঁধীজি ঘোষণা করেন, "আজ আমাদের মধ্যে বেদ ও অন্যান্য বিষয়ে পারঙ্গম একজন পন্ডিত মানুষ শাস্ত্রীজি আমাদের মধ্যে উপস্থিত। উনি কুষ্ঠ রোগ এ ভুগছেন। আপনারা কি ওনাকে সমর্থন করবেন  ও ওনাকে এই আশ্রমে থাকতে দেবেন ? " 

চারদিকে তখন সূচ পতনের নীরবতা। আশ্রমিকদের অনুৎসাহিত মনোবাসনা বুঝে গাঁধীজি আবেদন রাখলেন, " যদি আপনাদের বিবেক অনুমোদন দেয় তাহলেই আপনারা সম্মতি দেবেন।" গান্ধীজীর কথায় সেদিন কাজ হয়েছিল। মানুষ তার কথায় ভরসা রেখেছিল। শাস্ত্রীজি আশ্রমেই থেকে যান। আশ্রমের পূর্বদিকে তার জন্য একটি কুটির তৈরি হয়। গান্ধীজি প্রতিদিন সময় পেলে নিজের হাতে তার সেবা করতেন, ক্ষতস্থান ধুয়ে দিতেন, জামাকাপড় পড়িয়ে দিতেন।  তার সাথে সংস্কৃত কাব্য আবৃত্তি করতেন। ডাঃ জীবরাজ মেহেতা এর দেওয়া ওষুধ সেবনের পরে শাস্ত্রীজির উন্নতি দেখে গাঁধীজি খুবই সন্তুষ্ট হন। কাছেই দত্তপুরে ওয়ার্ধায় মনোহর দেওয়ান কুষ্ঠ পুনর্বাসন কেন্দ্র খোলেন। শাস্ত্রীজি সেখানে স্থানান্তরিত হ'ন ও আমৃত্যু সেখানেই থেকে যান। গান্ধীজি এই মনোহর দেওয়ান কে "প্রকৃত মহাত্মা" খেতাবে সম্ভাষিত করেন। 

কুষ্ঠরোগ নিয়ে গান্ধীজির এই অবদানের দুটি বৈশিষ্ট্য আছে। (এক) এটি কোনো বিচ্ছিন্ন লোক দেখানো ঘটনা নয়। এর ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। আগ্রহী পাঠক-পাঠিকার জন্য একটি সংক্ষিপ্ত কালানুক্রম দেওয়া হল। ( দুই) গান্ধীজির এই সেবার মনোভাবের সাথে আগাগোড়া বিজ্ঞান জড়িয়ে ছিল। দেশ বিদেশের বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে সাধারণ স্বাস্থ্যকর্মী যারা কুষ্ঠরোগ নির্মূল করার অভিযানে জড়িত তারা অনেকেই নিয়মিতভাবে ওয়ার্ধা সেবাগ্রামে এসেছেন গান্ধীজির সাথে আলাপ আলোচনা পরামর্শ করেছেন। উনি আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে কিভাবে এই রোগ দূর করা যায় তাতে উৎসাহী ছিলেন। 

ভারতবর্ষ তথা বিশ্বে বহু রাজনীতিবিদ জন্মেছেন বা জন্ম নেবেন। কিন্তু একটি রোগের জন্য একজন রাজনীতিবিদ এর এমন অবদান এর দৃষ্টান্ত সম্ভবত আর নেই। আমাদের দুর্ভাগ্য যে গান্ধীবাদী রাজনীতির অনুসারীরাও এই বিষয়ে গান্ধীজির অবদান নিয়ে বিস্মৃতপ্রায়, গান্ধিবিরোধীদের কথা তো বাদই দিলাম। আমরা যে রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী হই না কেন, একটা অসুখ ঘিরে কুসংস্কার এর বিরুদ্ধে একজন মানুষের প্রায় একক লড়াইকে,  একটা সামাজিক আন্দোলনের স্রষ্টাকে সেলাম জানাতে বাধ্য। আজ ওঁর জন্মদিনে জনস্বাস্থ্যের এক সামান্য কর্মী হিসেবে শ্রদ্ধার্ঘ্য সেই মানুষটিকে যার প্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীত এর নাম, "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে"।

সংক্ষিপ্ত কালানুক্রম:
১৮৯৪-৯৫: ডারবান: রাস্তায় গান্ধীজির সাথে কুষ্ঠরোগীর সাক্ষাৎ।
১৮৯৭: ডারবান: নিজের বাড়িতে গান্ধীজি কুষ্ঠরোগীর পরিচর্যা করলেন।
১৯০৫: দক্ষিণ আফ্রিকা: ভারতে কাজ করতে গিয়ে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়েছেন এমন একজন মিশনারিকে নিয়ে গান্ধীজি একটি ছোট প্রবন্ধ লিখলেন।
১৯১৩-১৪: পুনে: সান্ধ্য ভ্রমণে বেরিয়ে গান্ধীজি একজন কুষ্ঠরোগীকে উদ্ধার করলেন।
১৯১৩-১৫: মাদ্রাজ: একজন কুষ্ঠরোগী যিনি বিশিষ্ট রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন তার ক্ষতস্থান গান্ধীজি নিজের কাপড় দিয়ে মুছে দিলেন।
১৯১৭: চম্পারণ: বিখ্যাত চম্পারণ যাত্রার সময় গান্ধীজি একজন কুষ্ঠরোগীকে সঙ্গে করে  পৌঁছে দিলেন গন্তব্যে।
১৯২৫: কটক: ১৯শে আগস্ট, গান্ধীজি কটক কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন।
১৯২৫: পুরুলিয়া: ১২ই সেপ্টেম্বর গান্ধীজি পুরুলিয়া কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন।
১৯২৭: কটক: ২১শে ডিসেম্বর গান্ধীজি কটক কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন। তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ওয়ার্ড ছেড়ে চলে আসার আগে কয়েকজনের সাথে মেলালেন হাত।
১৯২৯: আলমোড়া: কাঁসাই, বাগেশ্বর এর কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন গান্ধীজি।
১৯৪৪: সেবাগ্রাম: কস্তুরবা ট্রাস্ট গঠিত হ'ল। কুষ্ঠরোগ নিয়ে কর্মসূচি ওই ট্রাস্টের অন্যতম লক্ষ্য।
১৯৪৪: সেবাগ্রাম:  গান্ধীজি দত্তপুর কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন ও তার কর্ণধার মনোহর দেওয়ানকে "প্রকৃত মহাত্মা" বলে আখ্যা দিলেন।
১৯৪৫: সেবাগ্রাম: ৯ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ব বিখ্যাত কুষ্ঠ বিশেষজ্ঞ ডঃ ককরেন এসে দেখা করলেন গান্ধীজির সাথে।
১৯৪৬: মাদ্রাজ: ৪ঠা ফেব্রুয়ারি চেনগেলপুট উইলিংডন কুষ্ঠ হাসপাতালে রুগীদের সাথে দেখা করলেন গান্ধীজি।
১৯৪৭: ১২ই জানুয়ারি গান্ধীজি হরিজন পত্রিকায় কলম ধরলেন সিন্ধ প্রদেশের কুষ্ঠরোগীদের বাধ্যতামূলক বন্ধ্যাকরণ নিয়ে উত্থাপিত বিল কে ধিক্কার জানিয়ে।
১৯৪৭: নোয়াখালী:  ৫ই ফেব্রুয়ারি তার প্রার্থনা শেষে সভায় গান্ধীজি কুষ্ঠরোগী ও অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের বিশেষ প্রতিনিধিত্ব এর কথা উল্লেখ করলেন।
১৯৪৭: কলকাতা: ৪ঠা সেপ্টেম্বর গান্ধীজি দেখতে গেলেন গোবরা মানসিক হাসপাতাল, বললেন যে এদের দুর্দশা কুষ্ঠরোগীদের চেয়েও খারাপ।
১৯৪৭: দিল্লি: ২৩শে ও ২৪শে অকটবর পরপর দু'দিন প্রার্থনা শেষের সভায় গান্ধীজি কুষ্ঠরোগের উল্লেখ করলেন। বার্তা পাঠালেন সারা ভারত কুষ্ঠরোগ কর্মী সম্মেলনে।
১৯৫৪: ৩০শে জানুয়ারি অর্থাৎ গান্ধী হত্যার দিনটিকে সারা ভারত জুড়ে কুষ্ঠ-বিরোধী দিবস হিসেবে পালন শুরু।

মহালয়া চণ্ডীপাঠ ~ শঙ্খ দে



১৯৭৬ এর 'দেবী দুর্গতিহারিনী'তে উত্তম কুমার আর চিরাচরিত ভদ্রবাবু ছাড়াও বাঙালি কিন্তু মহালয়ার সকালে অন্য একজনের কণ্ঠেও চণ্ডীপাঠ শুনেছে।
নাহ্ এটা না জানায় আপনার বাঙালিয়ানা ক্ষুন্ন হবেনা, কারণ তথ্যটা খুব কম মানুষই জানে।
হ্যাঁ, এবার নামটা বলি 'নাজির আহমেদ'। কি? চমকালেন?!

হ্যাঁ, ঠিকই পড়লেন, যেখানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্র উচ্চারণ নিয়েই অনেক মানুষের আপত্তি ছিল সেখানে ভারতের স্বাধীনতার আগের শেষ পাঁচ বছর একটানা আকাশবাণীর সদর থেকে গোটা বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল একজন শুধু অব্রাহ্মণ না, একজন অহিন্দুর কণ্ঠ। দেশ ভাগ না হলে হয় তো আজও সেটাই শুনতাম আমরা।

আসলে ঘটনাটা ঘটে খুবই আশ্চর্যভাবে, ১৯৪২ এর মহালয়ার ভোরে স্টুডিওতে আসতে দেররি করছেন ভদ্রবাবু, এদিকে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে.. অতঃকিম্?
তরুণ বাচিক শিল্পী নাজির এসে প্রস্তাব দিল, "আমি স্কুলে থাকতে সংস্কৃতে পাকা ছিলাম, ম্যাট্রিকে লেটার মার্কসও আছে, অনুমতি দিলে চেষ্টা করে দেখতে পারি।"
কোনো রাস্তা না পেয়ে পঙ্কজ মল্লিক বললেন, "বেশ তবে করো যদি পারো।"
কিছু পরে স্টুডিওতে এসে হাজির বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, স্তোত্র উচ্চারণ শুনে তিনিও মুগ্ধ হয়ে বললেন, "নাজিরই করুক না, বেশ করছে তো।"

অদ্ভুতভাবে পরের বছরও একই ঘটনা, ভদ্রবাবু বলেন, "আহাঃ পঙ্কজদা, নাজির উঠতি শিল্পী, আমরা বুড়োরা আর কতদিন করবো? এরপর থেকে ওইই করুক না। গলা তো ছেলের খাসা।"

এরপর থেকে ১৯৪৬ এর শরৎ পর্যন্ত এই দায়ভার সামলে গেছেন এই মুসলমান ছেলেটাই। 
মাঝে একটা বেশ বড়ো বদল ঘটে গিয়েছিল অবশ্য, কিন্তু তার খোঁজও কেউ রাখে না। ১৯৪৪-৪৫ এর মধ্যে কতৃপক্ষের সাথে মনোমালিন্যের জন্য দ্বায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান পঙ্কজ মল্লিক, তার জায়গায় আসেন উঠতি শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। প্রথম বছর একই সুরে কোনোকিছু না পাল্টে একই ভাবে অনুষ্ঠান হলেও দ্বিতীয় বছরে অন্যরকম কিছু করতে গিয়ে জনগণের মধ্যে তা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ১৯৪৬ এ পঙ্কজ বাবু ফিরে এলে আবার পুরোনো মেজাজে ফেরে মহিষাসুরমর্দিনী।

কিন্তু ভাগ্যের ফের, ১৯৪৭ এর দেশভাগ। নাজির আহমেদ ফিরলেন নিজের মাটিতে। ঢাকা রেডিওতে যোগ দেন তিনি এবং আবার পুরোনো জায়গায় ফিরতেই হয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে।

তবে শুধু বাচিক শিল্পীর কথা কেন, যন্ত্র শিল্পীরা কেন বাদ যাবেন?

সারেঙ্গী নিয়ে বসতেন মুন্সী, চেলো নিয়ে তারই ভাই আলী আর হারমোনিয়ামে মোহাম্মদ। এরা তিনজন তো হিন্দু নয়ই উপরন্তু বাঙালিও নন। মাতৃ ভাষা উর্দু। আর সেই জন্যই ওদের করে ফেলা কিছু ভুলে আমাদের মহালয়ার সকাল অন্য মাত্রা পায়। কি সেই ভুল?

রিহার্সাল শুরুর আগে সবাইকে বোঝানো হয় বাংলা পাঠ চলাকালীন তারা আবহ বাজাবেন কিন্তু সংস্কৃত স্তোত্র উচ্চারণ করার সময় তা থেমে যাবে, কিন্তু ওরা বোঝেননি ভাষা সমস্যায়। বীরেন বাবু ভাষা পাল্টে বাংলা থেকে সংস্কৃততে চলে গেলেও ওঁরা বুঝতে না পেরে বাজাতেই থাকে, সবাই দেখতেও থাকে যে কোনরকম প্রস্তুতি ছাড়াই তিনজন বাজিয়ে চলেছেন আর অদ্ভুত ভাবে তা মিলেও যাচ্ছে ভাষ্যের সাথে।
শুধু ওদের এই ভুলটার জন্যই পঙ্কজকুমার মল্লিক এর মতো আত্মপ্রত্যয়ী মানুষও নিজের পরিকল্পনা থেকে বেরিয়ে এসে সংস্কৃত স্তোত্র উচ্চারনের মাঝেও যন্ত্রানুষঙ্গ যোগ করেন। এ প্রসঙ্গে পরে তিনি বলেছিলেন, "সেদিন মুন্সীদের কান্ডটা আমার চোখ আরও বেশি খুলে দিল হে। আরও বেশি করে স্পষ্ট হল যে সঙ্গীতের কাছে, সুরের কাছে ভাষাটা কোনো ব্যারিয়রই নয়।"

এসবের বাইরেও এই অনুষ্ঠানের অন্যতম একটি গান 'শান্তি দিলে ভরি'র সুরকার কিন্তু হিন্দু নন, মোল্লার ছেলে উস্তাদ সাগীরউদ্দিন খাঁ।

এবার বুঝছেন পঙ্কজ মল্লিকের ওই কথাটা কত বড় সত্যি ?

"উৎসবের আবার বামুন-কায়েত কি? যে ভাষায় নজরুল ইসলাম কীর্তন থেকে শ্যামাসঙ্গীত সব লেখেন সেই ভাষায় কোনো জাতপাত টানবেন না।"