সোমবার, ৮ আগস্ট, ২০২২

এসএসকেএমে মেরুদণ্ডের জন্ম (একটি কল্প-গল্প) ~ ডাঃ অরুণাচল দত্ত চৌধুরী

ল্যাবরেটরির নামটা ভজঘট। সলিড সায়েন্টিফিক কাইনেটিকস অফ মিউটেশন সংক্ষেপে এসএসকেএম।  

আসলে কাজ হয় জেনেটিকস আর ইভোলিউশন নিয়ে। রাষ্ট্রীয় কাজ। অতীব গোপন, বলাই বাহুল্য।  ল্যাবে আজকে প্রবল উত্তেজনা। কাগজে একটা খবর বেরিয়েছে। তাই নিয়েই সিনিয়ার সায়েন্টিস্ট মহীতোষ মহলানবিশের নামে গুরুতর অভিযোগ। 

এমনিতে এই ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত নেবার যে বৈজ্ঞানিক প্রথা সারা বিশ্বে চালু আছে সেইটিই চালু। কিন্তু সে সবই মলিকিউলার লেভেলে। প্রোটিন কার্বোহাইড্রেট ফ্যাট মিনারেল নিয়ে জটিল কাজ কারবার। কখনও কমপিউটার সিমুলেশনে রেজাল্ট দেখে আন্দাজ করার চেষ্টা করা হয় অনাগত ভবিষ্যতে কী ধরণের পরিবর্তন আসতে চলেছে। সাধারণের পক্ষে একপ্রকার অবোধ্যই। সেই সব কাজ জাতির কী কাজে লাগে কেউই জানে না।

ইভোলিউশন মানে বিবর্তন সবাই জানে একটি ধীর প্রক্রিয়া। শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে যায় খুব ছোট পরিবর্তন আসতেও। কাজেই সরাসরি বিবর্তন চাক্ষুষ করা এই ল্যাবের তো বটেই সবাইরই সাধ্যাতীত। তবু কখনও জিন পালটে নতুন প্রজাতি তৈরি করার চেষ্টাও করা হয় অবশ্যি।

বিজ্ঞানী মহীতোষ আবার কবি টাইপের। এই ল্যাবের সর্বাধিনায়ক ডঃ সর্বজ্ঞ এই কবিতার ইস্যুতে ওর ওপর একটু বিরক্তও বটে। ব্যাপার তত সিরিয়াস কিছু না। আসলেই আবেগ সামলাতে না পেরে ওর কবিতা ছাপতে পাঠায় বিভিন্ন ম্যাগাজিনে। সেই আপদগুলি ছাপাও হয়। ডঃ সর্বজ্ঞর ধারণা সেই সব কবিতা ডিকোড করে বিদেশি প্রতিদ্বন্দ্বীরা এই ল্যাবের গোপন সাফল্যগুলি জেনে যাচ্ছে। অথচ এখানে গবেষণার শর্তই হল, কিছুতেই এখানের খবর বাইরের কারওর সঙ্গে শেয়ার করা যাবে না। 

এই না মানে সর্ব অর্থেই না। এখানের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পরও না। এই মর্মে চুক্তিপত্র সই করতে হয়েছে সব রিসার্চারকেই। গতমাসেই তিনি মহীতোষকে তাঁর ঘরে, যেটিকে লোকে আড়ালে টর্চার চেম্বার বলে, ডাকিয়ে এনেছিলেন। 
– তোমাকে আজকেই শো কজ্ নোটিশ ধরাব।
নিরীহ মহীতোষ কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করেছিল,
– কেন স্যার? 

সর্বজ্ঞ গম্ভীর ভাবে বিজ্ঞান কথাঞ্জলি নামের ওঁচা লিটল ম্যাগাজিনটা তার দিকে এগিয়ে দিলেন। 
– এই কবিতাটা তুমি কেন লিখেছ? 

মহীতোষ গলা বাড়িয়ে দেখে নিয়ে ঢোঁক গিলল। একটা নির্দোষ লিমেরিক। স্যার এটারও খোঁজ পেয়ে গেছেন? বড়ই আপশোষের কথা। 

লিমেরিকটা হল,
লঙ্কা গাছের কোষে মুরগির জিন দিয়ে ঠেসে
নিরামিষ ফলে পাই, মাংসের স্বাদ অবশেষে।
চিলি চিকেনের ভোজ
জুটছে এখন রোজ।
খবরটা গোপনীয়, এক্ষুনি দিচ্ছি না প্রেসে। 

জলদগম্ভীর গলায় বস জিজ্ঞেস করলেন,
– আমাদের এই ল্যাবটা কি খেয়াল খুশির জায়গা? এই ভাবে তুমি ল্যাবের গোপন খবর কবিতাপত্রিকা দিয়ে বাইরে আউট করছ? তুমি জানো, কেনটাকি চিকেন কিম্বা ম্যাকডোনাল্ড আরও কতজন এই রকম আবিষ্কারের জন্য ওঁৎ পেতে বসে আছে? তোমার মাথায় আইডিয়া এসেছে ভালো কথা। সেটা পাবলিশ করার সাহস তোমার হয় কী করে? 

– কিন্তু স্যার এই আইডিয়াটা তো…
– কোনও এক্সপেরিমেন্টেই এখন অবধি ইমপ্লিমেন্টেড হয়নি। এই তো বলবে? কিন্তু এই আইডিয়াটা তোমার মাথায় এসেছে কাজেই এটা ল্যাবের সম্পত্তি, বুঝেছ?
বাধ্য ছাত্রের মত ঘাড় নাড়ে মহীতোষ 

আজ আবার মহীতোষের ডাক পড়েছে টর্চার চেম্বারে।
– তুমি আবারও সেই কাজ করেছ? খবর পাচারের সেই জঘন্য কাজ?
ঘাড় নেড়ে প্রতিবাদ করে মহীতোষ। 

– না হে, ঘাড় নাড়লেই হবে না। ওই যে আগের মাসে কবিতাটার শেষ লাইনে লিখেছিলে  "খবরটা গোপনীয়, এক্ষুনি দিচ্ছি না প্রেসে" লিখেছ তাতেই তো বোঝা যাচ্ছে তোমার ইয়ে কী বলে প্রেস মানে সাংবাদিকদের সঙ্গে দহরম মহরম মানে চেনা জানা মানে গোপন যোগাযোগ মানে… 

মানের সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে ক্লান্ত হয়ে হাঁপাতে থাকেন ডঃ সর্বজ্ঞ।

ততক্ষণে তাঁর হাতে উঠে এসেছে আজকের আনন্দ বার্তা কাগজ।
সেইটি টেবিলের ওপর বিছিয়ে তার হেড লাইনে হাত রাখেন তিনি। প্রশ্ন করেন,
–এটা কী? কে এদের খবর দিল তুমি ছাড়া?

মহীতোষ ঘুম থেকে উঠতে দেরি করে তড়িঘড়ি চলে এসেছে। পড়তে হয় নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়। 
পড়েনি। তাই পিছিয়ে পড়েছে। 

আনন্দবার্তা আঠারো পয়েন্টে হেড লাইনে লিখেছে,

অবশেষে বিবর্তনের নতুন দিশা। এসএসকেএমের পরীক্ষাগারে বিশেষ তাপে ও চাপে কিছু কেঁচোর শরীরে শিরদাঁড়ার আভাস দেখা দিয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন