রবিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২

দীপান্বিতা জানা ~ আর্কাদি গাইদার

একদম প্রথম যখন রাজনীতি নিয়ে ভাবতে শিখেছি, - মানে চটকদার টপিক বা ট্রেন্ড হিসেবে না -  জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন হিসেবে, সেই সময়ে বাংলায় সন্ধিকাল - সিঙুর, নন্দীগ্রামের একের পর এক ঘটনার ঘনঘটা। পুলিশের গুলি, চাষের জমি - প্রতিনিয়ত হেডলাইন হাতুড়ি মারছে মগজে, আর সেই সময়েই অল্প অল্প করে সরকারবিরোধী বামদলের লোকজন, তৃতীয় ধারার লোকজন, এদের সাথে সখ্যতা তৈরি হচ্ছে, এদের রাজনৈতিক বক্তব্য আকৃষ্ট করছে, এনারাও মাঝেমধ্যে অনলাইন অফলাইন 'সিটিং' দিচ্ছেন।

এমনই একদিন একটি ছবি বেরোয় আবপ'তে, একটি মৃতদেহের ছবি। এর আগেও বহুবার দুদিকেরই অনেক ঘটনার ছবি বা খবর বেরিয়েছে, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীকে ধর্ষণ করে জ্যান্ত কবর দেওয়া, দুধওয়ালা কে পুলিশের চর ঘোষণা করে গুলি করা, কিন্তু সেসব মনে সেরকম দাগ কাটেনি, গণঅভ্যুত্থানের বাস্তব চিত্র হিসেবে হয়তো অবচেতনে নিজেই নিজের কাছে এর জন্যে সম্মতির নির্মাণ করে ফেলেছিলাম। 
কিন্তু এই ছবিটিতে তা হয়নি। কেন জানি না, কিন্তু এই ছবিটি খুব গভীরভাবে মনে দাগ কেটেছিলো। আজকাল সচেতন লোকজন যাকে বলে 'ট্রিগার' করা। 

দীপান্বিতা জানা নামক নন্দীগ্রামের সীতানন্দ কলেজের ভূগোলের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। এসএফআই করবার অপরাধে তাকে ধর্ষণ করে খুন করে হলদি নদীর ধারে তার দেহ ফেলে রাখা হয়েছে। আবপ'র পাতায় সেই দেহেরই পেছন থেকে তোলা ছবি। হঠাত এই ছবিটিই এত বিচলিত করেছিলো কেন জানিনা, কিন্তু এই নিয়ে সেই সময়ের রাজনৈতিক পরিসরে বারবার প্রশ্ন করতে শুরু করলাম, তর্ক শুরু করলাম। আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই হয়তো এরকম মাইলফলকের মতন ঘটনা আসে, যা জীবনের দিকনির্ণয় করে দেয়। দীপান্বিতা জানার মৃতদেহের জাস্টিফিকেশনে ঘুরেফিরে আমায় একটি কথাই বলা হয়েছিলো- কোল্যাটারাল ড্যামেজ হিসেবে ধরতে হবে। তো এই দুটো শব্দ - কোল্যাটারাল ড্যামেজ - আমার বাদবাকি জীবনের  রাজনীতির দিকনির্ণয় করে দেয়।

সেই তখন যারা আমায় কোল্যাটারাল ড্যামেজ বুঝিয়েছিলেন, সেই পরিসরের রাজনীতির ধারক ও বাহকরাও অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছেন। তারাও পরিবর্তনের স্রোতে এখনকার বিপ্লবী, ফ্যাসিবাদ-বিরোধী নাগরিক নেতা, সোশ্যাল মিডিয়ার নারীবাদী থিওরিটিশিয়ান, অন্যধারার প্রকাশক, ওয়েবজাইনের কর্ণধার হিসেবে আমাদের মধ্যে থেকে গেছেন। মাঝেমধ্যে দীপান্বিতা জানার সংগঠনকে পেট্রোনাইজিং জ্ঞান দেওয়া বিশ্লেষণমূলক থিসিস, বক্তব্য তারা বিভিন্ন জায়গায় রেখে থাকেন। 

দীপান্বিতা জানা - ২২ আগস্ট, ২০১০ সংবাদপত্রে দেখা যেই অচেনা মেয়েটির মৃতদেহের ছবি  আজও ২০ বছর পরে আমার মাথায় হানা দেয় - অথচ আমি তার মুখই জানি না। তার দেহের ছবি তোলা পেছন থেকে, তার অন্য কোন ছবি নেটে নেই, কোথাও নেই। এসএফআই'র সেন্ট্রাল কমিটি ওয়েবসাইটে শহীদদের তালিকার মধ্যে লিস্টে একজায়গায় তার নাম আছে। এইটুকুই। আমি কোনদিনও জানতে পারবো না দীপান্বিতার মুখটা কিরকম দেখতে। 

সাধারণত আজকাল এধরনের লেখা লিখলে বা ছবি দিলে সাথে নাকি লিখতে হয় - T/W বা Trigger  Warning. কিন্তু সচেতন ভাবেই এসব শব্দ এড়িয়ে চলছি - ওই কোল্যাটারাল ড্যামেজ শেখানো রাজনীতির ব্যক্তিবর্গ আসলে এই শব্দগুলোকে  কার্ড হিসেবে ব্যবহার করে করে অপবিত্র করে ফেলেছে। যেমন করেছে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শব্দকে - নারীবিদ্বেষ, কাঠামোগত হিংসে, পুরুষতান্ত্রিকতা, আধিপত্য - এগুলোকে নিয়ে ওনারা সুবিধেমতন নিঃশব্দ হয়ে আর সুবিধেমতন লেবেলিং আর তর্কের কার্ড হিসেবে ব্যবহার করে এই শব্দগুলোর রাজনীতিকে অপবিত্র করেছেন। দীপান্বিতার নামটা ভুলতে না দেওয়ার যে লড়াই - সেই ইনসাফের পাশাপাশি এই শব্দগুলোর রাজনীতিকেও এদের সুবিধেবাদী হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াইটাও লড়তে হবে। 

আগামী ২০ তারিখ ছাত্র-যুবদের ইনসাফ সভা ভিক্টোরিয়া হাউজের সামনে। পুরনোদের অনেকেরই হয়তো দীপান্বিতার নাম মনে নেই, নতুনদের জানারই কথা নয়। ইনসাফ সভায় যারা যাবেন, এবং লড়াইয়ের রসদ জোগাড় করবেন, তাদেরই কাছে অনেকের সাথে দীপান্বিতার নামটাও যাতে জানানো যায়, মনে পড়ানো যায়, তাই এই লেখা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন