আপনাদের একটি গল্প শোনাই। গত তিন দিন ধরে বিভিন্ন লোকের সাথে কথা বলে, খবর নিয়ে, অনেকুগুলো বিন্দুর মধ্যে লাইন টেনে গল্পটা তৈরি করেছি। আসলে তৈরি করেছি বলা ভুল, আসলে এই গল্পটা খালি অপেক্ষা করছিলো কখন কেউ তাকে একজায়গায় একসাথে লিখে ফেলবে।
পুরো বসিরহাট মহকুমা অঞ্চলেই দীর্ঘদিন ধরে জামাতের চাষ হচ্ছে । বিশেষ করে শেষ দশ বছর।পরিকল্পিত ভাবে বাংলাদেশ থেকে জামাতিরা এসে গ্রামে গ্রামে মিটিং করে যায়। ওয়াজ করে যায়। সেই ওয়াজের কিছু কিছু ভিডিও আপনারা ইন্টারনেটেও দেখতে পান। গোটা বারাসাত বসিরহাট দেগঙা অঞ্চলে শেষ ৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে ভরে ভরে জামাতি পাব্লিক এসেছে হাসিনার সরকারের তাড়া খেয়ে, তার সাথে এসেছে জামাতি আইডিওলজি, সৌদি ফান্ডিং আর বেসরকারি মাদ্রাসা। তৃণমুলের আগের এমপি হাজি নুরুল আর এখনকার এমপি ঈদ্রীশ আলি সরাসরি ঘোষিতভাবে জামাতের সাহায্যে প্রচার করে, তার বদলে জামাতকে নিজেদের অঞ্চলে ফ্রী হ্যান্ড দেয় যা ইচ্ছে করবার জন্যে। সারদার টাকা ববির হাত দিয়ে জামাতের কাছে যায়, বিনিময় ওরা বাংলাদেশি জামাতিদের ভোট এবং তার ওপর প্রভাব এনশিওর করে।
এবার আসরে নামলো বিজেপি / আর এস এস/ সংঘ পরিবার। বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দুদের মধ্যে তাদের সংগঠন অনেকদিন ধরেই ছিলো, তারা এবার অঞ্চলে প্রচার করতে শুরু করলো, যে হিন্দুরা আজ এই আগ্রাসনের সামনে বিপন্ন, যার ফলে উপনির্বাচনে জিতলো শমীক।
আশার কথা, অঞ্চলের স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যেও ধীরে ধীরে এই জামাতি মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি হলো। জামাতিদের প্রথম টার্গেট হলো স্থানীয় মাজহার এবং তাদের পীরেরা, কারন তাদের ধর্মীয় মতবাদে ইসলামে এগুলো শিরক। এই দ্বন্দ্ব গত কয়েক বছরে এই অঞ্চলে আরও শক্তিশালী হয়েছে।
২০১৬ র বিধানসভা নির্বাচনে এইখানকার তিনটে বিধানসভা কেন্দ্রের দুটো জিতলো জোটের প্রার্থীরা (একজন কংগ্রেস একজন সিপিএম) এবং একটি জিতলো তৃণমুল। তৃণমুল দেখলো যে ঈদ্রীশ আলির মতন 'ধর্মপ্রান' নেতা বা জামাতিদের দিয়েও এখানকার মুসলিম ভোট কনসোলিডেট করা যাচ্ছে না, তারা রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে বিবেচনা করে ভোট দিচ্ছে, ধর্মীয় না।
বাদুড়িয়ায় রবিবার থেকে ঝামেলার সূত্রপাত। একটি খবরের কাগজে স্থানীয় বিজেপি নেতার ইন্ধনে ভুয়ো খবর ছাপানো নিয়ে, যে ঈদের দিন নাকি পাকিস্তানের পতাকা ওড়ানো হয়েছে। এবার আসরে নামলো হিন্দু সংহতি। হিন্দু সংহতির নাম শুনেছেন তো? এদের নেতা তপন ঘোষ। তিনি ভোটের আগে ঘোষনা করে মমতাকে ভোট দিতে আবেদন জানান, তিনি মমতার সরকারকে দশে সাত দেন, তিনি অঞ্চলে অঞ্চলে তৃণমুলের লোকেদেরকে বলেন হিন্দু সংহতিতে যোগ দিতে, কারন 'আমরা আপনাদের এবং দিদিরই পক্ষে'। তা শৌভিক সরকার নামক একটি ১৭ বছরের তরুন, যে আবার এই হিন্দু সংহতির সাথে যুক্ত, সে ফেসবুকে একটি নোংরা ছবি পোস্ট করলো। এ নিয়ে অঞ্চলের স্থানীয় কিছু মুসলিম বিক্ষোভ দেখানো শুরু করলো। শৌভিক গ্রেপ্তার হলো।
এরপরেই গল্পের আসল মজা। স্থানীয় লোকজন জানাচ্ছেন, যারা বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন, থানা ঘেরাও করেছিলেন, তাদেরকে পুলিশ ডিসপার্স করে দেয়। তারপরেই বাইরে থেকে কিছু অচেনা লোক আসে, যারা হিন্দিতে কথা বলছিলো, তারাই পুলিশের গাড়িতে আগুন লাগানো এবং ভাংচুর শুরু করে। (নিচে নিউজ ১৮ এর ভিডিও রিপোর্ট দেখুন)
এর পরে হঠাত করে অঞ্চলে কে বা কারা গুজব ছড়াতে থাকে। শোনা যায় বসিরহাটে নাকি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছে। পবিত্র কোরানের ওপর নাকি প্রস্রাব করা হয়েছে। এবার ঝামেলা ছড়াতে থাকে। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে দলবল নিয়ে কিছু মানুষ বেরিয়ে পড়ে ভাংচুর, অবরোধ শুরু করে, অনেক দোকান আর বাড়িতে আগুন লাগানো হয়। শৌভিকের বাড়িও বাদ যায় না। স্থানীয় বহু হিন্দু-মুসলিম যুবক যুবতী এমনকি বেশ কিছু মসজিদের ইমাম শান্তিরক্ষার জন্যে রাস্তায় নামে, কিন্তু প্রথম কয়েক ঘন্টা তাদের চেষ্টায় কোন কাজ হয়না। খেয়াল রাখবেন, এর মধ্যে মাত্র ২৪ ঘন্টা অতিবাহিত হয়েছে। এই গোটা সময়টায় পুলিশ প্রশাসন ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসেছিলো। এর মধ্যে রাজ্যপাল আর মমতার ফোনে বচসা হয়। মমতা প্রেস কনফারেন্স করে ফেলেন, যেখানে তিনি বলেন - 'আপনাদের আমি অনেক প্রটেকশন দিয়েছি, আর দেবো না'। (নিচে নিউজ রিপোর্ট দেখুন) স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে, এখানে মমতা 'আপনাদের' বলতে কাদের কথা বুঝিয়েছেন? দাঙ্গাবাজরা? জামাতি ধর্মগুরুরা? নাকি সাধারন মুসলমানরা? এবার আস্তে আস্তে পুলিশ সক্রিয় হয়। স্থানীয় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সংগঠিত হয়। ফুরফুরা শরীফের ইব্রাহিম সিদ্দিকি, বসিরহাটের পীরজাদা, অল বেংগল ইমামস এসোশিয়েশনের চেয়ারম্যান, সবাই বিবৃতি দিয়ে দাঙ্গাবাজদের নিন্দা করেন আর শান্তির আবেদন জানান। তৃণমুলের এমপি ঈদ্রিশ আলি বোধহয় সারাদিন ঘুমোচ্ছিলেন। তৃণমুলের এম এল এ দীপেন্দু বিশ্বাস জার্মানিতে ফুটবল দেখতে গেছেন। তাই তার অঞ্চল বসিরহাট দক্ষিনে মাঠে নেমেছেন বসিরহাট উত্তরের সিপিএমের এমএলএ রফিকুল ইসলাম। ওদিকে ঝামেলার দিন সারাদিন বিজেপির দিলীপ ঘোষ আর বাবুল সুপ্রিয় ট্যুইটারে নিজেদের মধ্যে তরজা করে গেছেন কে রাজনীতিতে নতুন তাই নিয়ে। এখন ওনারা আর হিন্দু সংহতি মাঠে নেমেছেন, হিন্দুদের 'প্রতিশোধ' নিতে আহ্বান জানিয়ে।
তাহলে যা দাড়ালো, এই অঞ্চলে এতদিন জামাত আর হিন্দু সংহতি চাষ করিয়েও সাধারন হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয় ভিত্তিতে ভোট ভাগাভাগি করা যাচ্ছিলো না। তাই এই ৪৮ ঘন্টার স্ক্রীপ্টটার খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো। হিন্দুদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ ঢুকিয়ে তাদের ভোট বিজেপির দিকে ঠেলবার চেষ্টা। বিজেপির বৃদ্ধির সম্ভাবনার জুজু দেখিয়ে মুসলমানদের ভোট তৃণমুলের দিকে টানবার চেষ্টা হলো। বিরোধী ভোট সুন্দর করে ভাগ করে দেওয়া গেলো। যেই ঝামেলা স্রেফ পুলিশ দিয়ে প্রথম এক ঘন্টায় থামিয়ে দেওয়া যেতো, রাজ্য প্রশাসনকে ছুটিতে পাঠিয়ে তাকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে এই আকার দেওয়া হলো। সাথে যোগ করা হলো রাজ্যপালের সাথে তরজা, রাষ্ট্রপতি শাসন আর কেন্দ্রীয় বাহিনীর মশলা। নাগপুর আর কালিঘাটের যৌথ ফরমুলায় ল্যাবরেটরিতে তৈরি হলো এই বিষ।
এই ঘটনা থেকে যাদের ক্ষীর খাওয়ার তারা খেয়ে নিয়েছে। পড়ে রইলাম আমি আর আপনি। আমাদের মধ্যে আরেকটু অবিশ্বাস বাড়লো। এবার আমরা একে অপরকে আরও বাঁকা চোখে দেখবো। ভয় পাবো। আরও অচেনা হবো। জিএসটি, নারদা, ভাঙরের লড়াই আপাতত সবাই ভুলে গেছে।
মিশন সাকসেসফুল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন