লোকসভা নির্বাচনে , সি পি আই এম বেশ কিছু কম আসন পেয়েছে এবার। সারদেশে মোট প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা তে খুব একটা কম পায়নি সি পি আই এম, এমনকি পশ্চিমবঙ্গে আসন সংখ্যা মাত্র ১৪ হলেও মোট ভোট সংখ্যাতে মাত্র ৪% মত কম হয়েছে। নানা কারণ খুঁজে বার করা হচ্ছে। আর একটা অংশ মনেই করছে আর কি ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় এসেই গেছে। একটা হতাশার বাতাবরণ বাম সমর্থকদের মধ্যে। এর মধ্যে একটা মত হল, সরকার চালানোর মত কাজের জন্য তো সি পি আই এম তৈরি হয় নি। তার কাজ তো বিপ্লব করা। তা হলে সরকার না চালাতে পারলে কি আর এসে যায়। যা কিছু রোগ সি পি আই এম এ দেখা যাচ্ছে সবই তো এসেছে সরকার চালাতে গিয়ে, তা হলে সরকার না চালাতে হলে সব সম্যসার সমাধান হয়ে যাবে। আর জঙ্গলে বসে মাও সে তুং এর নাম করে একদল মানু(!) দিনের পর দিন সি পি আই এম কে হত্যা করছে, আর দাবী করছে তারা বিপ্লবী, সি পি আই এম আর বিপ্লবী দল নয় কারণ তারা সরকার পরিচালনা করে।
২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসবে কি না সেটা সময় বলবে। এখনো অনেক সময় বাকি। এখনও অনেক জল গড়ানো বাকি গঙ্গা দিয়ে। ২০০৬ সালে কোন সি পি আই এম সমর্থক ভাবে নি বামফ্রন্ট ২৩৫ টা আসন পাবে আর মেদিনীপুরে সাংবাদিকদের দুই আঙুলে ভি দেখানো দিদিমিণি মাত্র ৩০ টা আসন পাবে। কিন্তু সরকারে থাকলে বিপ্লবী চরিত্র চলে যায়, নানা রোগ দেখা দেয় অতএব বিপ্লবী থাকা ভাল , তাতে সরকারে না থাকলেই ভাল এই চিন্তা যাদের মধ্যে আসছে তাই নিয়ে আজ কিছু কথা।
সত্যিই তো ৩২ বছর একটা রাজ্যে সরকার চালানো সি পি আই এম কি বিপ্লবী ? আসলে বিপ্লবী শব্দটা শুনলেই মনের মধ্যে ভেসে ওঠে কিউবা কিম্বা বলিভিয়ার জঙ্গলে এক মুখ দাড়ি মুখে কাধে বন্দুক হাতে চে গুয়েভরা, না হলে লালফৌজ এর সামনে লং মার্চ করা মাও সে তুং। কোথায় একটা বিপ্লবী ভাব তা না ৩২ বছর ধরে রাইট্রাস বিল্ডিং এ বসে সরকার চালানো না হলে বিগ্রেডের মাঠে জনসমাবেশে ভাষন ।সরকার চালাতে গেলে কি বিপ্লবী হওয়া যায়? প্রশ্ন গুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া স্বাভাবিক।
সরকার পরিচালনা করা কি বিপ্লবী কাজ ? সি পি আই এম তার কর্মসূচীর অংশ হিসাবে এই কাজ পরিচালনা করছে। সি পি আই এম তার পার্টি কর্মসূচীতে পরিষ্কার করে ব্যাখা করেছে কি ভাবে তারা ভারতবর্ষে বিপ্লব করতে চায়, আসুন দেখি সেই কথা গুলি।
আমাদের দেশ ভারতবর্ষের রাষ্ট্রচরিত্র বিশ্লেষন করতে গিয়ে সি পি আই এম তার কর্মসূচীর ৫.১ ধারাতে বলেছে “ বর্তমান ভারত রাষ্ট্র বুর্জোয়াদের ও জমিদারদের শ্রেনীগত শাসনের যন্ত্র এর নেতৃত্বে আছে বৃহৎ বুর্জোয়ারা – ধনতান্ত্রিক বিকাশ সাধনের উদ্দেশ্যে যারা ক্রমেই বেশি বেশি করে ফিন্সাস মূলধনের সঙ্গে সহযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে। দেশের জীবনে রাষ্ট্রের ভূমিকা ও কর্যাবলী এই শ্রেনী চরিত্রের দ্বারাই নির্ধারিত হয়ে থাকে।”
সি পি আই এম কমিউনিষ্ট পার্টি হিসাবে তার চরম লক্ষ্য কমিউনিজিম এই কথা সোচ্চারে ঘোষণা করে , তার পাশাপাশি সে মনে করে এই লক্ষ্যে যেতে হলে সমাজতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক বিপ্লব অসমাপ্ত তাই তাকে শেষ না করে এক লাফে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে পৌচ্ছান সম্ভব নয়। আমাদের দেশে বিভিন্ন তথাকথিত বিপ্লবী দল রাষ্ট্রের শ্রেনীচরিত্র ও বিপ্লবের স্তর নির্বাচন এই দুটি ক্ষেত্রে চরম ভুল করে।
লেনিন বিপ্লবের দুটি স্তরের কথা বলেছিলেন। কিন্তু মহান নভেম্বর বিপ্লবের পর উপনিবেশ ও আধা উপনিবেশ এর মুক্তির সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে দেখা গেল এই সমস্ত উপনিবেশের বুর্জোয়ারা গনতান্ত্রিক বিপ্লব অসমাপ্ত রেখে মাঝপথে সামাজ্যবাদের সঙ্গে আপস করে নিজেদের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে। তাই এই অসমাপ্ত গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কাজ শ্রমিকশ্রেনীকেই সমাপ্ত করতে হয়। আমাদের দেশে ঠিক এই ঘটনা ঘটেছে। প্রথম স্তরে ভারতবর্ষে সামাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ( আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন) সাধারণ যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্ব যেহেতু কমিউনিষ্ট পার্টি দিতে পারে নি , এই দেশে শাসকশ্রেনী আপস করেছে,গণতান্ত্রিক বিপ্লব শেষ করে নি । তাই বিপ্লবের দ্বিতীয় স্তর হিসাবে আগে গণতান্ত্রিক বিপ্লব শেষ করতে হবে। তার পর তৃতীয় স্তর হিসাবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করতে হবে।
যেহেতু শ্রমিকশ্রেনীর পার্টি হিসাবে সি পি আই এম এই গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবে কিন্তু একা শ্রমিকশ্রেনী এই বিপ্লব করতে পারে না, তাই তৈরি করতে হবে জণগনতান্ত্রিক মোর্চা ।এই মোর্চার মূল মিত্র হবে কৃষি মজুর ও গরিব কৃষক, বিশ্বস্ত মিত্র হবে মধ্যবিত্ত শ্রেনী ও মাঝারী কৃষক, দোদুল্যমান মিত্র হবে ধনী কৃষক ও অবৃহৎ পূঁজিপতি। এই জণগনতান্ত্রিক বিপ্লবের ( শ্রমিকশ্রেনীর নেতৃত্ব জণগনতান্ত্রিক মোর্চা নিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লব) প্রধান কাজ হবে সামান্ততন্ত্র বিরোধী , সামাজ্যবাদ বিরোধী এবং বৃহৎ পূঁজিপতি বিরোধী।
সুতরাং এই বিপ্লবের কাজ হল সকল প্রকার জমিদারদের সমস্ত জমি বিনা ক্ষতিপূরনে কেড়ে নিয়ে তা কৃষকদের মধ্যে বন্টন করা, সমস্ত রকম সামাজ্যবাদী ও বৃহৎ পুঁজির শোষণ বন্ধ করার জন্য তাদের পুঁজি বাজেয়াপ্ত করা।
জণগনতান্ত্রিক বিপ্লব সমাধা করার জন্য জণগনতান্ত্রিক মোর্চা গঠন একটি জটিল কাজ। এই সংগ্রাম একটি দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া , এই কাজ পরিচালনা করতে গিয়ে যদি কোন রাজ্যে বা কেন্দ্রে ( কেন্দ্র শব্দটি সময়োপযোগী পার্টি কর্মসূচীতে ৭.১৭নং ধারা তে নতুন করে সংযোজন) সরকার পরিচালনার সুযোগ আসে তবে সেই সুযোগ গ্রহন করার কথাও সি পি আই এম কর্মসূচীতে লিখিত ভাবে রেখেছে।
কিন্তু কেন, কেন বিপ্লবীরা একটি বুর্জোয়া পার্লামেন্টে অংশগ্রহন করবে? সি পি আই এম এর কর্মসূচীতে যা আছে তার আগে দেখে নি একবার এই প্রসঙ্গে কমরেড লেনিন কি বলেছেন। তৃতীয় আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় অধিবেশন চলার সময় অষ্ট্রিয়ার কমিউনিষ্ট পার্টি তাদের দেশের পার্লামেন্ট বয়কট করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। লেনিন তাঁদের ভুল সংশোধন করে চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে লেনিন লিখেছিলেন :
“ বুর্জোয়া পার্লামেন্টকে ভেঙে দেবার শক্তির অভাব যতদিন আমাদের থাকবে ততদিন এই পার্লামেন্টের বিরুদ্ধেই আমাদের কাজ করতে হবে বাইরে থেকে এবং ভিতর থেকে। শ্রমিকদের প্রতারিত করার জন্য বুর্জোয়ারা যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক হাতিয়ার ব্যবহার করছে সেই হাতিয়ার সম্পর্কে মেহনতী জনগনের বেশ উল্লেখযোগ্য অংশের যতোদিন পর্যন্ত আস্থা থাকবে ততোদিন পর্যন্ত এই প্রতারণাকে ব্যাখা করতে হবে সেই প্ল্যাটফরম থেকেই ….. '' ( লেনিন রচনাবলী ৩১ খন্ড, পৃষ্ঠা ২৬৮ ) ।
তৃতীয় আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় অধিবেশনে পার্লামেন্টারি সংগ্রামে অংশগ্রহন করাকে যাঁরা সময়ের অপচয় বলে মনে করেন তাঁদের বিরুদ্ধে খুব কড়াভাবে লেনিন বলেন “ পার্লামেন্টারি সংগ্রামে অংশগ্রহন করাটা আদৌ সময়ের অপচয় নয়। সমাজের সবশ্রেনীই পার্লামেন্টের কাজ কর্মে আগ্রহশীল। পার্লামেন্টেই শ্রেনীস্বার্থ ও শ্রেনীবিরোধ প্রতিফলিত হয় বলেই সব শ্রেনীই পার্লামেন্টারি সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে। এক আঘাতে পুঁজিবাদের উচ্ছেদ করার জন্য সর্বত্র এবং অবিলম্বে একটা চূড়ান্ত সাধারণ ধর্মঘট বাস্তবায়িত করা সম্ভব হত তা হলে ইতি মধ্যেই বহু দেশেই এই বিপ্লব ঘটানো যেতো। কিন্তু ঘটনা যা তাই আমাদের বিশ্লেষন করতে হবে এবং পার্লামেন্ট হচ্ছে শ্রেনী সংগ্রামেরই একটি ক্ষেত্র বিশেষ।” (লেনিন রচনাবলী ৩১ খন্ড, পৃষ্ঠা ২৫৫-২৫৬ )
এইবার আসুন দেখি সি পি আই এম তাদের কর্মসূচীতে যা লিখেছে “ দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির চাহিদা অনুসারে পার্টিকে নানান ধরনের অন্তর্বতীকালীন স্লোগান স্পষ্টতই হাজির করতে হবে। বর্তমান শাসকশ্রেনীগুলিকে ক্ষমতাচ্যুত করে শ্রমিক কৃষকের দৃঢ় মৈত্রীর উপরে প্রতিষ্ঠিত এক নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট ও সরকার স্থাপনের কর্তব্যকে জণগনের সামনে অবিচল রেখেও যদি তেমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যে, জণগনের সমস্যাবলী প্রশমনের এক কর্মসূচীতে অঙ্গীকারবদ্ধ কোন সরকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ আছে, তা হলে পার্টি সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে ও বর্তমান সীমাবদ্ধতার মধ্যে জনগনকে রিলিফ দেওয়ার এবং বিকল্প নীতি গুলি তুলে ধরার ও প্রয়োগ করার চেষ্টা করবে । এই ধরনের সরকার গঠনের ফলে শ্রমজীবী জণগনের বৈপ্লবিক আন্দোলন শক্তিশালী হবে, জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠনের প্রক্রিয়াকে তা সাহায্য করবে। অবশ্য এই ধরনের সরকারগুলি দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্যসাবলীর মৌলিক সমাধান কোন ভাবেই করবে না। তাই পার্টি সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতি অনুযায়ী রাজ্যগুলি অথবা কেন্দ্রে এই ধরনের সরকার গঠনের সুযোগ গ্রহণ করেও বুর্জোয়া -জমিদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান রাষ্ট্র ও সরকারের অপসারনের আবশ্যকতা সম্পর্কে ব্যাপকতম জণসাধারণকে শিক্ষিত করতে থাকবে এবং এর দ্বারা গণ – আন্দোলনকে শক্তিশালী করবে '' ( সময়োপযোগী পার্টি কর্মসূচীতে ৭.১৭নং ধারা)
এই বিশ্লেষনের উপর দাঁড়িয়ে সি পি আই এম সরকারে অংশগ্রহন করে। এই মুহুর্তে জঙ্গলে নয়, রাইফেল কাধে লংমার্চে নয় , পঞ্চায়েতে ,পৌরসভাতে , রাইট্রাস বিল্ডিং এ মানুষ কে রিলিফ দেওয়ার কাজ যারা করছেন এবং সেই কাজ করতে গিয়ে মানুষের কাছে এই ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কথাও তারা তুলে ধরছেন( সব সময় সঠিক ভাবে না হলেও)। কারণ এই ব্যবস্থা মানুষের মৌলিক সম্যসাবলীর সমাধান করতে পারে না। তবুও পশ্চিমবঙ্গের তথা ভারতবর্ষের মানুষের চেতনায় এই পার্লামেন্টিয় গণতন্ত্র সম্পর্কে এখনো ভরসা আছে। ফলে দেশের মানুষের চেতনা যে স্তরে থাকে তাকে বাদ দিয়ে কোন বিপ্লবী দল তার কর্মকান্ড চালাতে পারে না। জণগনতান্ত্রিক বিপ্লবের মোর্চা গঠনের কাজ করতে করতে এবং এই পার্লামেন্টিয় ব্যবস্থার অসারতা প্রমান করতে প্রকৃত বিপ্লবী পার্টিকে তাই পার্লামেন্টিয় কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করতে হয়। তাই এই কাজে যারা অংশগ্রহন করছেন , তাঁরা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে চলার কাজ করে চলেছেন।
তবে পার্লামেন্ট সমন্ধে মোহ সৃষ্টি করা নয় , যেখানে সম্ভব সেখানে পার্লামেন্ট কে ব্যবহার করতে হবে শ্রমিকশ্রেনীর সংগ্রামকে শক্তিশালী করার কাজে, পার্লামেন্টারি কাজকে মূল আন্দোলনের নীচে স্থান দিয়ে তাকে সংগ্রামের সহায়ক হিসবে ব্যবহার করতে হবে, তা না করলে মারাত্বক ভুল হবে। লেনিনের কথায় “ কোন অবস্থায়ই পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা ও কাজকে এবং বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সমস্ত স্বাধীনতাকে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা চলবে না। সেগুলিকে প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবী শ্রেনী সংগ্রামের উপজাত হিসাবে দেখতে হবে” ( লেনিন সিলেকটেড ওয়ার্কস, ১০ খন্ড, পৃষ্ঠা ৪৫)
তাই বিপ্লবী কমিউনিষ্ট পার্টি সংসদীয় পথে যায় না, বা সরকারে অংশগ্রহন করলে পার্টি আর বিপ্লবী থাকে না এই ধারনা একেবারেই সঠিক নয়। বিপ্লবী কাজে যেমন ভুল ভ্রান্তি থাকে, তাকে যেমন মতার্দশের উপর দাঁড়িয়ে ঠিক করতে হয় তেমনি সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে যদি পার্টিতে ভুল চিন্তা অনুপ্রবেশ ঘটে তবে মতার্দশের উপর দাঁড়িয়েই তাকে সঠিক করতে হবে, সরকারে যোগদান থেকে বিরত থেকে নয়।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার “ প্রসঙ্গ সময়োপযোগী পার্টি কর্মসূচি “ ….......সুধাংশু দাশগুপ্ত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন