বৃহস্পতিবার, ২ এপ্রিল, ২০০৯

রঞ্জিত এবং ~ শময়িতা

সম্পাদক সমীপেষু,

এই লেখাটি ছাপানোর জণ্য অনুরোধ রইল।

ভারতের ফিল্ম ইতিহাসের অন্যতম সাড়া জাগানো ছবি ‘শোলে’ তে ভীরু, অর্থাৎ ধর্মেন্দ্র, গ্রামের জলের ট্যাঙ্কে উঠে আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছিল এবং ততক্ষণ পর্যন্ত সেই হুমকি চালিয়ে যায় যতক্ষণ না পর্যন্ত বাসন্তী, অর্থাৎ হেমা মালিনী তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়। সে দৃশ্য আমাদের সকলেরই মনে আছে। কিন্তু যেটা রহস্য সেটা হল শিলিগুড়ির রঞ্জিত সিংহর সেরকমই কোনো ইচ্ছে ছিল কিনা। গোটা ৩০ টি ঘন্টা তিনি শিলিগুড়ির ১২০ ফিট উঁচু ইলেক্ট্রিসিটি টাওয়ারের ওপর বসে থাকলেন। বিদ্যুত পর্ষদ ২৪ টি ঘন্টা বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয় যেন তার কোনো ক্ষতি না হয়। শিলিগুড়ির বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে গোটা একটা দিন অন্ধকার থাকে মাননীয় রঞ্জিত বাবুর এই উদ্ভট মতিভ্রমের জন্য।

আমরা এখনো জানিনা রঞ্জিত বাবু কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী কিনা। ধরে নেওয়া যেতেই পারে যে এই কাজ তিনি নিজের দায়িত্বেই করেছেন। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। রঞ্জিত বাবু যদি রাজনীতি করতেন তবে তিনি কোন দলের সমর্থক হতেন?

প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা। ডেরেক ও ব্রায়েন হয়েতো এক ন্যানো সেকেন্ডের (কোনো দ্যর্থকতার উদ্দেশ্য ছিল না) মধ্যেই এই ক্যুইজটির উত্তর দিয়ে দেবেন। অবশ্যই তার নিজের দল। তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়া আর কোন দল ১২০ ফিট উচ্চতা থেকে ঝাঁপ দেওয়ার (হুমকি) কথা ভাবতে পারে? তা সেক্ষেত্রে সাড়া পশ্চিম বাংলার মানুষ যতই অন্ধকারে ডুবে থাকুক না কেন। রজ্ঞিত মানসিকতার সাথে কি আশ্চর্য মিল।

আর সেটাই তৃণমূল কংগ্রেসের যাবতীয় শক্তির উৎস। রঞ্জিত সুলভ মানসিকতা। ভারতবর্ষ গনতান্ত্রিক দেশ। ফলে যে কোনো মানুষ যা ইচ্ছে তাই করতে পারে; হ্যাঁ, যা ইচ্ছে তাই। কেউ যদি মনে করে যে সে তার জীবন নিয়ে বিতশ্রদ্ধ তাহলে হে একটা গোটা শহর কে অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখে ইলেক্ট্রিসিটি টাওয়ারে উঠে বসে থাকতে পারে। তাতে তার কোনো শাস্তি হয় না। উপরন্তু, দমকল বাহিনীর অফিসাররা তার সামনে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করবেন যেন সে নেমে আসে।

একই রকম ভাবে কোনো রাজনৈতিক দল দিনের পর দিন একঘরে হতে হতে এবং জনগনের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থেকে বিতশ্রদ্ধ হয়ে সেই ‘জনগনের স্বার্থে’ যা খুশী তাই করতে পারে। এমনকি যে রাজ্যের বেকার সংখ্যা লক্ষাধিক, কোনো পার্টি চাইলেই সেই রাজ্য থেকেও দেশের প্রথিতযশা শিল্পপতি কে বিতাড়িত করে সেই রাজ্যের শিল্পায়ন কে স্তব্ধ করার চেষ্টা করতে পারে। কোনো দলের কেবলমাত্র গনতান্ত্রিক অধিকারের জ়োরে ১৫ দিন জুড়ে দেশের একটি ব্যস্ততম জাতীয় সড়ক আটকে রেখে লক্ষ লক্ষ মানুষ কে দুর্ভোগ এ ফেলতে পারে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই কোনো বলপ্রয়োগ করা যাবে না। তাহলেই মুখ্যমন্ত্রী ‘নরখাদক’, ‘হিটলার’ অথবা ‘নরেন্দ্র মোদী’ বলে রব উঠবে। বরঞ্চ মুখ্যমন্ত্রী কে করজোড়ে অগ্নিমাতা কে অনুরোধ করতে হবে যেন তিনি আলোচনায় বসেন। রঞ্জিত আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছিল। আমরা নিশ্চই ভুলিনি যে আমাদের এই অগ্নিমাতাও বেশ কয়েক বছর আগে ঠিক এমন ভাবেই আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। প্রকাশ্য দিবালোকে, মাঝরাস্তায়, নিজের শাড়ি গলাতে পেঁচিয়ে। যদিও আদতে দুটি ঘটনাই সাধারণ মানুষের কাছে হাস্যকর, তবুও, এই অদ্ভুত আচরণের জন্য দুর্ভোগ পোহাতে হয়ে সাধারণ মানুষকেই।

অদ্ভুত ভাবে এই একই বৈশিষ্ট লক্ষ্য করা যায় মহারাষ্ট্রের নেতা রাজ ঠাকরের মধ্যেও। যদি তিনি মনে করেন যে মারাঠি রা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তাহলেই তিনি মহারাষ্ট্রের কোনো বিহারী বস্তি তে আগুন লাগিয়ে দিতে পারেন। অথবা, অন্য রাজ্য থেকে আসা মানুষদের দুর্ভোগে ফেলতে পারেন, কিংবা বিহারী ছাত্রদের বিহারী হওয়ার অপরাধে খুন করতে পারেন ‘মারাঠা আস্মিতা’ র নামে। যদিও মহারাষ্ট্রের সরকারি দপ্তরে মারাঠা কর্মচারী রা শতকরা ৮০%, তবুও রাজ ঠাকরে যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন। এবং নিশ্চিতভাবেই কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহন করবে না যাতে তার ‘মারাঠা অস্মিতা’ জারী রাখার কাজ কিছুমাত্র ব্যহত হয়।

এবং কি আশ্চর্য মিল মমতা ব্যানার্জী এবং রাজ ঠাকরের মধ্যে। রাজ্যের প্রথম সারির বুদ্ধিজীবী রা সবসময়েই এদের সমর্থনে গলা ফাটান। ঠিক যেমন মমতা ব্যানার্জী সমর্থন পেয়েছিলেন শুভপ্রসন্ন (বিখ্যাত বায়স-শিল্পী), শাঁওলী মিত্র (অভিনেত্রী), অপর্ণা সেন (চিত্র পরিচালক ও অভিনেত্রী), সুনন্দ সান্যাল (তাঁর সুতীক্ষ্ণ গালিগালাজ বাদে তিনি বিখ্যাত আরেকটি কারনে, তিনি পুরো আন্দোলনে মমতা ব্যানার্জী বাদে একমাত্র পিএইচডি), রাজ ঠাকরেও ঠিক তেমনি সমর্থন পেয়েছেন দেশের অন্যতম খ্যাতনামা লেখিকা শোভা দের কাছ থেকে।

সমীকরণটা খুবই সহজ। কোনো একটি আন্দোলন শুরু কর। তারপর তাতে ‘মারাঠা আস্মিতা’ বা ‘কৃষি জমি বাঁচাও’ ধরনের একটা নাম দিয়ে দাও। এতে নিশ্চিত ভাবেই বেশ কিছু ‘self proclaimed’ বুদ্ধিজ়ীবীদের সমর্থন পাওয়া যাবে। সুতরাং সরকারের ওপর আরো চাপ সৃষ্টি করা যাবে এবং সরকারও কিছু করতে সাহস পাবে না। অতএব যা ইচ্ছে তাই করা সম্ভব হবে।

একই ছবি বিমল গুরুং এর ক্ষেত্রেও। যত কম ই জনসংখ্যা হোক না কেন, তিনি চান পৃথক রাজ্য, গোর্খাল্যান্ড। সেই দাবী তে তিনি পাহাড়ী অঞ্চলের সমস্ত সরকারী পরিষেবা বন্ধ করে দিতে পারেন। গাড়ীর নম্বর প্লেট বদলে ‘WB’ র জায়গাতে ‘GL’ লিখতে বাধ্য করাতে পারেন। সেই অঞ্চলের মানুষের পোশাকের ওপর বিধি জারী করতে পারেন। সরকারী বিদ্যুৎ যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার এবং অপচয় করতে পারেন। কিন্তু সরকার কোনো ভাবেই তাকে কিছু বলতে পারবে না। বললেই ‘এ সরকার ফ্যাসিস্ত সরকার’ ধ্বনি উঠবে।

এবং মাওবাদীরা! আমাদের বিপ্লবী সহযোদ্ধাগন। যদি তারা মনে করে যে এখনই প্রত্যন্ত গ্রামে উন্নয়নের প্রয়োজন নেই তাহলেই তারা একটি মেডিকেল ভ্যান উড়িয়ে দিতে পারে এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের খুন করতে পারে। সরকার এক্ষেত্রেও কিছু বলতে পারবে না। বললেই তো সরকার বুর্জোয়া ও প্রতিক্রিয়াশীল।

শেষ এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, জাভেদ খাঁন। কোনো মুসলমান যুবকের হিন্দু মেয়েকে বিবাহ অন্যায় এটা ভেবে নেওয়ার গনতান্ত্রিক অধিকার তার আছে। এবং সেই কারনে সেই যুবককে দিনের পর দিন হুমকি দেওয়ার অধিকারও তার আছে। তার পরে সেই যুবক আত্মহত্যা করলে সরকারের বিরুদ্ধে যুবকের পরিবারের ওপর ছাপ সৃষ্টি করার অভিযোগে মিছিলে পা মেলান তিনি। এবং তারপরে সেই যুবকের সুইসাইড নোটে জাভেদ খাঁন কে অভিযুক্ত করা হলে প্রশাসন নিশ্চয় তাকে গ্রেপ্তার করতে পারে না। কেন? আহা, এটাই যে এদেশের গনতন্ত্র। এটাই মমতা অথবা রাজ, শুভপ্রসন্ন অথবা জাভেদ খাঁনের গনতন্ত্র।

আপনি কি আমার আপনার গনতন্ত্রের কথা ভাবছেন?...আপনি কি পাগল হলেন নাকি?

খবর এসেছে রঞ্জিতকে শেষ পর্যন্ত নামানো গেছে। যাক, ৪০ ঘন্টা পর যদি তার হুঁশ এসে থাকে তাহলে ভালই। সব ভাল যার শেষ ভাল।

শুধু একটা ছোট্ট প্রশ্ন। রঞ্জিত যদি সত্যিই তৃণমুল সমর্থক হতেন তাহলে কি তাকে এত সহজে নামানো যেত? ডেরেক ভাই এর কাছে এই উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।

ধন্যবাদ সহ
শময়িতা চক্রবর্তী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন