বুধবার, ২৮ মার্চ, ২০১৮

রানীগঞ্জ ~ প্রদীপ চক্রবর্তী

      

গত চব্বিশ  ঘন্টা আমার গত কুড়ি বছরেরও বেশি সময়ের  লেখালিখির অভিজ্ঞতাকে ম্লান করে দিয়েছে | আমি ভাবলে অবাক হই , এই অর্থহীন  লেখালিখি কার জন্য ?  লিখে কি হয় ?

আমি সেই ব্যক্তি ,সেই সাধারণের  একজন , জনারণ্যে মিশে থাকা হাস্যকর শান্তিপ্রিয়  সেই , যে যাবতীয় বাহ্যিক  সামাজিক উত্তেজনা  থেকে নিজেকে এক পাশে সরিয়ে  রেখে ,এক কাল্পনিক ভারতবর্ষ  ও বর্তমানের পশ্চিমবঙ্গে  বাস করে , ভাবে , শান্তিপ্রিয় এক মানবিক  স্বর্গরাজ্যে  আছি | এই চূড়ান্ত মূর্খের স্বর্গে  বাস করতে করতে , কখনো মনে হয় নি , অশনি সংকেতের  বারুদ  যে কোনো সময় আমার পায়ের নিচে নিরাপত্তাহীনতার  মাটিকে  টলিয়ে দিতে পারে এক মুহূর্ত্বে....| 

আমি রানিগঞ্জের স্টেশনের কাছাকাছি একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে পড়াই | আমি জানতাম , রঘুপতি  রাঘব  ,একজন ব্রহ্মজ্ঞানী  ছিলেন | আমি জানি না , বাল্মীকির রামায়ণে কোথায় রাজা রাম , অস্ত্র পুজোর কথা বলেছেন ? বাঙালি রাম কে ভালোবেসেছে  কৃত্তিবাস ওঝার  চোখ দিয়ে , বাঙালির মতো করে | সে কখন যেন রামায়ণ    পাঁচালির মধ্যে দিয়ে ,রাম ,হনুমানকে  দেখেছে নিজের পরিবারের একজন প্রিয় মুখ হিসেবে | সে রাম কে নিয়ে দ্বিধা বিভক্ত  হয়েছেন , আধুনিক মধুসূদনের  চোখ দিয়ে ,সে মেঘনাদ  বধ কাব্য পড়তে পড়তে জোর তর্ক জুড়েছে  | সে ,অসম্মান  করে নি , রাবন ও মেঘনাদকে  | তার মান্যতার  ছিল   স্বাধীনতা , তার সংস্কৃতি তাকে বাঙালি -  হিন্ধু  করে নি শুধু , তাকে করেছে বিশ্ব  মানবিক | পরমত সহিষ্ণু  , উদার  | কিন্তু সব হিসেবে গুলিয়ে যাচ্ছে , বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের  কতিপয় রাজনৈতিক ব্যাক্ত্বিত্বের  উস্কানি  মূলক ইন্ধন জোগানোর  পরিকল্পিত কার্যকলাপে  | 

কাল যখন স্কুল থেকে বেরোলাম  ,একটু আগে , কারণ আজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শুরু ,তাই |, ততক্ষন মিডিয়া জানিয়ে দিয়েছে আপনাদের অনেক কিছু | কিন্তু ট্রেন ধরার জন্য স্টেশনে  আসার আগে দেখলাম ,উন্মুক্ত  তরোয়াল  ,কৃপাণ  , লাঠি ,নানারকম অস্ত্র হাতে ,স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় ছুটে আসছে একদল উন্মত্ত  যুবক  |, চোখের সামনেই  দেখলাম , হাতের বোমা কি ভাবে ইঁটের টুকরোর  মতো আঘাত করতে পারে বন্ধ দোকানের  দরজায় | দাউ  দাউ করে দোকানের পর দোকানে আগুন লাগানো  হচ্ছে | বহু দোকানে চলছে অবাধ  লুট | আমাদের জোর করে স্টেশন এ ঢুকিয়ে প্রচুর পুলিশ  ও   কম্ব্যাক্ট ফোর্স  পাহারা  দিচ্ছে | মাঝে মাঝেই রে রে করে তেড়ে আসছে ,স্টেশন এ ঢুকতে  চাইছে  , একদল উন্মত্ত , জয় শ্রী রাম বলা মানুষ ,....আর পুলিশ বাঁধা দিয়ে যাচ্ছে | চারদিকে পোড়া বারুদের  গন্ধ | টায়ার  জ্বলে যাচ্ছে দাউ দাউ |

আজ ,আবার যখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা নিতে যাচ্ছি , হিল  বস্তির  কাছাকাছি , একটি মেয়েদের উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে , একশো চুয়াল্লিশ  ধারা চলছে , তবুও তার মধ্যে লাঠিসোঠা  নিয়ে পথ আটকালো  একদল | আমাদের গাড়িকে  ঘিরে জিজ্ঞেস  করলো ,আমরা হিন্দু  না মুসলিম | হঠাৎ ,কাকতলীয়  ভাবে , একজন ওই ভিড়ের মধ্যে চিনতে পেরে বললো , মাস্টার লোগ... ছোর দো ....

স্কুলে ,ক্লাসে  পৌঁছে দেখছি , টেনশন  এ , ছাত্রীরা  আকুল ভাবে কেঁদে  যাচ্ছে ভয়ে  | তাদের থামানো  যাচ্ছে না | তাদের একটাই প্রশ্ন , তাদের বাবা মা দাদা ,যারা তাদের নিয়ে এসেছেন , তারা নিরাপদে  আছেন কি না ? অনেক  বুঝিয়ে তাদের থামানো হলো | পরীক্ষার  শেষে আকুল অভিভাবকদের  চোখ মুখে উৎকণ্ঠিত  , গাঢ় আতঙ্কের  ছাপ | কালকেই  উচ্চপদস্থ  একজন পুলিশ আধিকারিকের  হাত ছিন্নভিন্ন হয়েছে বোমের  আঘাতে | নিহত  হয়েছে , রক্ত ঝরেছে  মানুষের ,প্রচুর | আর আজ স্কুল জুড়ে  পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ  | কম্ব্যাক্ট ফোর্স ভর্তি |,  মনে হচ্ছে ,এ কি আমার চেনা রানীগঞ্জ না কাশ্মীর  ?..

গোটাশহর জুড়ে অলিখিত বন্ধ  | পুড়ে যাওয়া অজস্র দোকান , বন্ধ গৃহস্তের  জানলা দরজা | মানুষের মুখে একরাশ  আতঙ্কের ছাপ | যেন একদিনের এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক | চেনা শহর , চেনা মানুষ ,চেনা মুখগুলো বড্ড অচেনা যে ....

একসুদূর প্রসারী  চক্রান্ত শুরু হয়েছে গোটা বাংলা জুড়ে | অশুভ  বুদ্ধির  কেউ কেউ কী চাইছে , বাঙালি সংস্কৃতির ওপর , বাঙালি  হিন্দুদের ওপর অন্য বলয়ের হিন্দুদের দিয়ে আগ্রাসী মেরুকরণের দাঙ্গা বা ধর্মীয় কোনো দাঙ্গা ?  রামমন্দির  বাবরি  মসজিদ  , গোধরা  কাণ্ডের  ক্ষত আমরাও  বয়ে বেড়াচ্ছি  প্রচন্ড ভাবে আজো |যদি কেউ ভাবেন ,যার হচ্ছে হোক ,আমি তো ঠিক ই আছি |, ভুল ভাবছেন  | পাশের  বাড়িতে আগুন লাগলে ,আপনার বাড়িটিও  কিন্তু নিরাপদ নয় |

কোনো, অনুষ্ঠান উৎসব নয় | প্রায় সাত দশক দেশ স্বাধীন , অথচ ,এই দেশের সমস্ত মানুষ আজো ন্যূনতম  খাবার ,পোশাক ,বাসস্থান শিক্ষা  পায় না | হাজার প্রকল্পের ভিড়ে ,  ক্ষুধার্থ মানুষ প্রচন্ড কাঁদছে  | রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এই সমস্যার  গোড়ায়  গিয়ে সমাধান  না করা | এই সমস্যা  জিইয়ে রাখা , তাতেই ভোট  কেন্দ্রিক রাজনীতির  ফায়দা  |
আসুন, আজ আমরা যাবতীয় ধর্মের উর্ধে উঠে ,হাতে হাত রাখি | সমস্ত মানুষকে নিয়ে আসি একটা ভালোবাসার দৃঢ  ছাতার নিচে |, যে যেখানেই  থাকি , শহর গ্রাম মফস্বল  প্রত্যন্ত এলাকায় পাড়ায়  চলুন  ,যে যেরকম  ভাবে পারি , ভালোবেসে মানুষের হাতে হাত রাখি | 

আজ থেকে  পাঁচশো  বছর আগে , সব চেয়ে বড়ো মানবিক রাজনীতি বা বিপ্লব করেছিলেন , ভালোবাসার অস্ত্র দিয়ে দুকূল  প্লাবিত  করে , যবন হরিদাস  কে বুকে নিয়ে ,শ্রী চৈতন্য  মহাপ্রভু  |,  নানক  , বুদ্ধ  ,  তুকারাম  , কনফুসিয়াস  , দাদূ ,  হজরত মোহম্মদ, যীশু  , রামকৃষ্ণ  কেউ কখনো মানবিক ভালোবাসার বাইরে মানুষকে কখনো শিক্ষা  দেন নি .....
মানুষ বড়ো কাঁদছে , মানুষের পাশে দাঁড়ানো  আজ খুব দরকার | এবং অবশ্যই বাঙালি হিসেবে আমি গর্বিত আমার সাহিত্য আমার সংস্কৃতির জন্য | এর ভিত যথেষ্ট মজবুত | একে ভাঙার ক্ষমতা কোনোদিন কোনো বিজাতীয়  শক্তির ছিল না ...... আজো নেই |




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন