শনিবার, ৮ জুলাই, ২০২৩

পঞ্চায়েত নির্বাচন ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত


একটা সময় ছিল যখন শহরবাসী বাঙালির বেশিভাগের একটা দেশের বাড়ি থাকতো, সপ্তাহান্তে না হোক, বছরে অন্তত দুবার বাঙালি তার সেই দেশের বাড়ি ফিরে যেত। গ্রামের সাথে শহরের বাঙালির দেখা সাক্ষাৎ হত। ষাট এর দশকেও বাঙালির উপন্যাস চলচ্চিত্র, কবিতায় নাটকে একটা গ্রাম বাংলা থাকতো।


এর পরে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই শহররায়ন হল। বাঙালি মধ্যবিত্ত মেট্রোপলিটন মননে গ্রাম বাংলার জায়গা সংকুচিত হতে থাকলো। শিল্পী হিসেবে নবান্নের ধানের গন্ধের সাথে রাত দেড়টায় মাচায় উঠে, "ভালো আছো বাংলা?" বলে ইকো চেম্বার নিয়ে চিৎকার করা ছাড়া আর কিছু বাকি থাকলো না। গ্রাম নিয়ে যাবতীয় খবরাখবর এর উৎস হয়ে পড়ে থাকলো লক্ষ্মীকান্তপুর বা ক্যানিং লোকাল থেকে আগত গৃহকর্মীদের সাথে গৃহিণীর অলস বিশ্রম্ভালাপ। টেলিগ্রাফ বা স্টেটসম্যানের পাতা ওলটানোর ফাঁকে গৃহকর্তার কানে যাওয়া সেই আলাপের ছেঁড়া টুকরো। গ্রাম বাংলা কেবল ফিরে আসে মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুমে পঞ্চায়েত ভোটের সময়। সত্তরের দশকের শেষ থেকে আশির দশকের শুরুতে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে অশোক মিত্র, বিনয় চৌধুরীর নেতৃত্বে গ্রাম বাংলায় ঘটে যাওয়া পঞ্চায়েত নামক নিঃশব্দ বিপ্লব নিয়ে মধ্যবিত্ত শহুরে বাঙালি উদাসীন থেকেছে, বড়জোর গ্রাম থেকে আগত অপ্রাপ্তবয়স্ক গৃহ পরিচারিকার সরবরাহে ঘাটতি পড়ায় কিঞ্চিৎ বিরক্ত বোধ করেছে।

বার্কলে থেকে প্রণব বর্ধন একের পর এক গবেষণাপত্রে সংসদীয় বামপন্থীদের এই বিকেন্দ্রিকরণের মহত্তম এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে উচ্ছাসিত হলেও শিক্ষিত বাঙালির তাতে বিশেষ হেলদোল দেখা যায় নি। জ্যোতি বাবু ও তাঁর সহযোগীরা অতি দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি যে ফান্ড ফাংশন ফাংশানারির বিকেন্দ্রীকরণের তাদের এই প্রচেষ্টা ভবিষ্যতে জন্ম দেবে এক ফ্র্যাঙ্কনস্টাইনের। পঞ্চায়েত এর এই মধু ভান্ডারের স্বাদ পেতে মরিয়া হয়ে বাংলার বুকে এমন মুষল পর্ব দেখবে গোটা ভারত যে যদু বংশও লজ্জা পাবে। গণতন্ত্রের এই ধর্ষণ বোধ করি হিটলারকেও লজ্জিত করতো। বাংলার বুদ্ধিজীবী মহল জানে যে না তারা না কোনো পার্টির প্রথম সারির নেতা নেত্রী, কারুর গায়েই আঁচটি পরবে না এই গ্রামের নির্বাচনে। নির্বাচনের দিন ঘোষণা থেকে নির্বাচনের দিন, বড়জোর হপ্তা দুয়েক বাংলা জুড়ে একটা উন্মত্ততা চলবে, যেটা নজর আন্দাজ করলেই হল। এর পরেই জাতীয় বা আন্তর্জাতিক রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে হারিয়ে যাবে রহিম শেখ বা রামা কৈবর্ত নামক শহীদদের কাহিনী। টিভির চ্যানেলে চ্যানেলের সান্ধ্য আসরে কেচ্ছা কাহিনীর অভাব হবে না।

বিবেক খুব কুটকুট করলে সোশ্যাল মিডিয়াতে একবেলার জন্য পবিত্র ঘৃনা উগড়ে দিলেই হবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম পাশাপাশি বসবাস করা পরিবার গুলোর মধ্যে যে ঘৃণার রাজনীতির চাষ অনায়াসে অক্লেশে মানুষকে লাশ বানিয়ে ফেলছে, গ্রামীণ পল্লী সমাজে আমদানি করছে সন্দেহ অবিশ্বাস এর বাতাবরণ, ধ্বংস করে দিচ্ছে গরীব খেটে খাওয়া মানুষের ঐক্য, তাদের একে অন্যকে দাঁড় করাচ্ছে মুখোমুখি সংঘর্ষের আঙিনায় সে নিয়ে বাংলার বুদ্ধিজীবি সমাজের বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই। আগ্নেয়গিরির শিখরে বসে নাগরিক বাঙালি বুদ্ধিজীবী পিকনিক করছে, বুঝতে পারছে না পঁচাত্তর হাজার গ্রাম বাঁচলে তবেই বাঁচবে বাংলা। বুঝতে পারছে না বাংলার সর্বনাশ হচ্ছে, হয়ে গেছে। 

"আমরা যে গাছটিকে কৃষ্ণচূড়া গাছ ভেবেছিলাম
যার উদ্দেশ্যে ধ্রূপদী বিন্যাসে কয়েক অনুচ্ছেদ প্রশস্তি লিখেছিলাম
গতকাল বলাই বাবু বললেন, 'ঐটি বাঁদরলাঠি গাছ'।
অ্যালসেশিয়ান ভেবে যে সারমেয় শাবকটিকে
আমরা তিন মাস বক্‌লস পরিয়ে মাংস খাওয়ালাম
ক্রমশ তার খেঁকিভাব প্রকট হয়ে উঠছে।
আমরা টের পাইনি
আমাদের ঝরণা কলম কবে ডট্‌ পেন হয়ে গেছে
আমাদের বড়বাবু কবে হেড অ্যসিস্ট্যান্ট হয়ে গেছেন
আমাদের বাবা কবে বাপি হয়ে গেছেন।
আমরা বুঝতে পারিনি
আমাদের কবে সর্বনাশ হয়ে গেছে।"

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন