বৃহস্পতিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

ভারতী ঘোষ ~ সুশোভন পাত্র

ম্যাডাম ভারতী ঘোষ, আপনার সালকু সরেন কে মনে পড়ে ?
জানেন ম্যাডাম, লালগড়ের জঙ্গলে সালকু'র লাশটা যখন পাওয়া গেলো তখন গলায় ছ-খানা টাঙ্গির কোপ। শরীরের চামড়া পচে গলে যাচ্ছে, পোকাতে কুরে খাচ্ছে সারা দেহ, চারিদিকে দুর্গন্ধ। অথচ মাওবাদী'দের ফতোয়ায়, বৃদ্ধা বিধবা মা'র শত অনুরোধেও, মৃতদেহ সৎকারে সাহস করছে না ধরমপুর গ্রামের কেউ! সালকুর অপরাধ? সি.পি.আই(এম) মধ্যমকুমারি শাখার পার্টি সদস্য ছিল সালকু ¹। 
সেদিন সালকু'র নৃশংস খুনের 'মাস্টারমাইন্ড' সুচিত্রা মাহাতো'র আত্মসমর্পণের চিত্রনাট্য লিখেছিলেন আপনিই, শ্রীমতী ভারতী ঘোষ। মহাকরণের অলিন্দে পৌঁছে দিয়ে সরকারী প্যাকেজ নিশ্চিত করেছিলেন আপনিই, শ্রীমতী ভারতী ঘোষ। আদালতে বেকসুর খালাসের জন্য নিখুঁত বয়ান সাজিয়েছিলেন আপনিই, শ্রীমতী ভারতী ঘোষ। আজ সুচিত্রা মাহাতো'র পয়সা হয়েছে, গাড়ি হয়েছে, তৃণমূল নেতা প্রবীর গড়াই'র সাথে বিয়েও হয়েছে। কিন্তু সেদিন বুড়িশোলের জঙ্গলে কিষানজীর মৃত্যুর পর পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে সুচিত্রা মাহাতো পালাল কি ভাবে -সেই প্রশ্নের হিসেব হয়নি। পেটে গুলি বিদ্ধ সুচিত্রা মাহাতোর চিকিৎসা হল কোথায় -সেই প্রশ্নের ফয়সালা হয়নি। পার্শ্ববর্তী গ্রামে চিরুনি তল্লাশি'তেও সুচিত্রা মাহাতো পুলিশের র‍্যাডারে ধরা পড়ল না কেন -সেই প্রশ্নের সমাধান হয়নি ² ³ । । অবশ্য তাতে কি? নিখুঁত স্ক্রিপ্ট, নিবিড় সম্পাদনার উপঢৌকনে এক লহমায় রুমাল থেকে বেড়াল হয়ে গিয়েছিলেন আপনি। দু-দুটো জেলার পুলিশ সুপার, 'কমেন্ডেবেল সার্ভিস'র মেডেল -বকলমে জঙ্গলমহলের বেতাজ সম্রাজ্ঞী ⁴ ।  তামাম বাংলা সাক্ষী রেখে জঙ্গলমহলে শুরু  হয়েছিল তৃণমূল এবং প্রশাসনের মিথোজীবিতার নতুন অধ্যায়। যে অন্যোন্যজীবিত্বে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন 'জঙ্গলমহলের মা' ⁵। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন 'বনদেবী' ⁶ । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন 'বাংলার মার্গারেট থ্যাচার' ⁷। 
ম্যাডাম ভারতী ঘোষ, আপনার সুশান্ত ঘোষ কে মনে পড়ে ? 
জানেন ম্যাডাম, সুশান্ত ঘোষের পৈতৃক ভিটে বেনেচাপড়ার দাসেরবাঁধ খালের কান ঘেঁষে উদ্ধার হয়েছিল 'কঙ্কাল'। দশ বছর মাটির নিচে পোঁতা মৃতদেহ পচে গলে কঙ্কাল হয়ে গেলেও, অক্ষত রয়ে গিয়েছিলো একটি কঙ্কালের, একটি অন্তর্বাস। আর সেই অন্তর্বাস দেখেই কেশপুরের শ্যামল আচার্য সনাক্ত করে ফেললেন তাঁর বাবা অজয় আচার্য'র দেহাবশেষ -২০০২'র ২২শে সেপ্টেম্বর কেশপুরে 'নিহত' তৃণমূল কর্মী'দের একজন। ব্যাস, শ্যামল আচার্যের এফ.আই.আর-এ সওয়ার হয়ে পুনরুজ্জীবিত হল আদালতে রায় দান হয়ে যাওয়া পুরনো মামালার। 'অভিযুক্ত সুশান্ত ঘোষ' কে 'খুনি সুশান্ত ঘোষ' প্রমাণে সি.আই.ডি হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের নামে শুরু হল প্রবল মানসিক অত্যাচার ⁸ । 
আচ্ছা ম্যাডাম, আপনি জানতেন না এই শ্যামল আচার্য আসলে আইনের ভাষায় দাগী আসামী? আপনি জানতেন না এই শ্যামল আচার্যর বাড়িতেই যৌথবাহিনী উদ্ধার করেছিল বে-আইনি কার্তুজ? আপনি জানতেন না এই শ্যামল আচার্যই মাওবাদীদের অস্ত্র সরবরাহের ঘটনায় জেল খেটেছিল⁹ ? 
জানতেন। আর জানতেন বলেই, আজ সাত বছর পরেও, সি.আই.ডি 'কঙ্কাল কাণ্ডে'র ডি.এন.এ টেস্টের রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনতে পারেনি, অভিযোগের প্রামাণ্য নথি আদালতে জমা দিতে পারেনি, পুলিশ চার্জশিট গঠন করতে পারেনি, আর তাই হাজার চেষ্টা করেও সুশান্ত ঘোষ কে জেলে আটকে রাখা যায়নি ¹⁰ । যায়নি, কারণ ইতিহাস সাক্ষী সেদিনের 'কেশপুর সিপিএম'র শেষপুর'র নেপথ্য কাহিনীর। ২৩শে সেপ্টেম্বর ২০০২ আনন্দবাজার পত্রিকা আজও বয়ে বেড়াচ্ছে যে ইতিহাস  -''রবিবার ভোর ৪টের থেকে কেশপুর ব্লকের তিনদিক থেকে প্রায় ৬০ জনের একটি দল গ্রামে ঢোকে। একদল ঢোকে শালবনীর আমনপুর ও সাতশোল দিয়ে। দ্বিতীয় দলটি ঢোকে বেলামমহারাজপুর, গোরুরবাগা হয়ে এবং তৃতীয় দলটি ডেবরার কাছে কংসাবতী নদী পেরিয়ে সরিষাখোলা হয়ে। শালবনীর দিকে আড়াবাড়ির জঙ্গল দিয়ে ঢুকে আক্রমণকারীরা সাতশোল গ্রামে ব্যাপক মারধর করে। ওই গ্রামের সিপিএম সমর্থক নেপাল ঘোষ, ভক্তি ঘোষ ও চিত্তরঞ্জন বেজের উপর অত্যাচার চালায়। পুলিশ সরিষাখোলা থেকে ১৭ জন তৃণমূল সমর্থক'দের গ্রেপ্তার করেছে। তাদের কাছে ৯টি মাসকেট, ১২১টি তাজা কার্তুজ, দুটি বোমা, ১১টি চকলেট বোমা ও কয়েকটি কালো পোশাক পাওয়া গিয়েছে।" 
ভারতী ঘোষ আপনি বলতে পারেন, এই ব্যাপক পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে অজয় আচার্যরা কেশপুরে ঠিক কি করছিলেন? ভোররাতে কালো পোশাকে মুখ ঢাকা  ছিল কি উদ্দেশ্যে ? ভারতী ঘোষ আপনি বলতে পারেন, ২২শে সেপ্টেম্বর ভোররাত অবধি দাসেরবাঁধের মাটি কেটে তৃণমূল কর্মী'দের লাশ পুঁতেছিলেন যে সুশান্ত ঘোষ তাঁকে ২৩শে সেপ্টেম্বর সকালেই মহাকরণে পাওয়া গেলো কি করে ¹¹? 
ম্যাডাম ভারতী ঘোষ, আজকে যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আপনার পিছনে সি.আই.ডি লেলিয়ে দিয়েছেন, আজকে যখন আপনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে 'মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার' অভিযোগ করছেন, আজকের যখন আপনার ফ্ল্যাটে বে-আইনি মদ উদ্ধার হচ্ছে, আজকে যখন আপনার আর্থিক অসঙ্গতির কেস-ডাইরি লেখা হচ্ছে, তখন একবার আয়নার সামনে দাঁড়ান ¹² । দেখবেন, সময়ের নাব্যতায় হিসেবের যে বৃত্তটা আজ সম্পূর্ণ হচ্ছে তাতে, সেদিন বামপন্থী'দের বিরুদ্ধে উইচ-হান্টের নায়িকা ভারতী ঘোষ একটু একটু করে হেরে যাচ্ছে। আর বেমালুম জিতে যাচ্ছে সালকু সরেনরা। জিতে যাচ্ছেন সুশান্ত ঘোষরা।  
ম্যাডাম, আপনাকে জানিয়ে রাখি, সালকুর পরিবার আজও লালঝাণ্ডার রাজনীতি করে। সালকু'র মা ছিতামণি সরেন আজও ইনকিলাবি মিছিলে হাঁটে। লালগড়ের পার্টি অফিসে আজও এক টুকোর লালপতাকা সালকুর রক্ত গায়ে মেখে পতপত করে ওড়ে। 
জেরা চলাকালীন আপনার বাধ্য সি.আই.ডি অফিসার সেদিন সুশান্ত ঘোষ কে জিজ্ঞেস করেছিলেন – "আপনার কি কোনও অসুবিধা হচ্ছে? আপনি কেমন আছেন?" সুশান্ত ঘোষ বলেছিলেন, "আমরা কমিউনিস্টরা যেকোনো পরিস্থিতির জন্যই তৈরি থাকি। চিন্তা করবেন না, আমি ভালো আছি"। ম্যাডাম ভারতী ঘোষ, আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি, সুশান্ত ঘোষ আজও ভালো আছেন। সুশান্ত ঘোষ আজও মাথা উঁচিয়ে বাঁচেন। সুশান্ত ঘোষ আজও বুকচিতিয়েই লড়াই করেন। 
আপনি বরং বলুন ম্যাডাম, মালকিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জিঘাংসায় সলতে পাকিয়ে বামপন্থী'দের ঘরে যে আগুন আপনি সেদিন লাগিয়েছিলেন, আজকে যখন সেই আগুনেই আপনার নিজের হাত পুড়ছে তখন "আপনার কি কোনও অসুবিধা হচ্ছে?" আপনি বরং বলুন ম্যাডাম, আজকে সেই আগুনেই যখন আপনি নিজেই ছেঁকা খাচ্ছেন তখন "আপনি কেমন আছেন?"












**  ২০০২'র আনন্দবাজারের  ওয়েব সংস্করণ রিডেবেল ফরম্যাটে নেই। তাই আনন্দ বাজার কে কোট করে গনশক্তির একটি নিবন্ধের লিঙ্ক  দেওয়া হল।    



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন