সোমবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

এই রে, এখন কি করি! ~ প্যাডম্যান নিয়ে ম্যাডম্যানের লেখা

"এই রে, এখন কি করি!
নাসিরুদ্দিন আর তাঁর গিন্নি একদিন বাড়ি ফিরে এসে দেখে চোর এসে বাড়ি তছনছ করে দিয়ে গেছে। গিন্নি তো রেগে আগুন। বললে 'এ তোমার দোষ। সদর দরজায় তালা দাওনি, তাই এই দশা।'
পড়শিরাও সেই একই সুর ধরলে। একজন বললে, 'জানলাগুলোও তো ভাল করে বন্ধ করেনি দেখছি।'
আরেকজন বললে, 'চোর আসতে পারে সেটা আগেই বোঝা উচিৎ ছিল।'
আরেকজন বললে, 'দরজার তালাগুলোও পরীক্ষা করে দেখা উচিৎ।'
'কী আপদ।' বললে নাসিরুদ্দিন, 'তোমারা দেখছি শুধু আমার পিছনেই লাগতে শুরু করলে।'
'দোষ তো তোমারই মোল্লাসাহেব', পড়শিরা বললে।
'বটে?' বললে নাসিরুদ্দিন, 'আর চোরের বুঝি দোষ নেই?'
মোল্লা নাসিরুদ্দিনের দোষ আর মহিলাদের পিরিয়ডের সময় চাপিয়ে দেওয়া ধর্মীয় আনুশাসন দেখে একইরকম মনে হয়। চোরের দোষ দেখতেই পায় না – ধর্মের আনুশাসন যারা চাপিয়ে দিয়েছে তাদের পাব কোথায়। শিখ ধর্ম ব্যতিরেকে, মোটামুটি সবকটি Institutional religion এ এই অনুশাসন দেখা যায়। গুরু নানক রক্তকে impure মনে করতেন না, মনে করতেন না যে পিরিয়ড চলাকালীন মহিলারা অপবিত্র, তাই গুরুদুয়ারাতে এইসময় আসতেও কোন বাধা নেই। Guru Granth Sahib (p.1013) বলছে "By coming together of mother and father are we created, by union of the mother's blood and the father's semen is the body made. To the Lord is the creature devoted, when hanging head downwards in the womb; He whom he contemplates, for him provides." । শিখ Padwomanরা এই দিক থেকে অন্তত স্বাধীন।
প্রাচীন বৌদ্ধধর্মে এই ধরণের অনুশাসনকে প্রশ্রয় দেয়নি, তাদের কাছে প্রধান ছিল "`inner washing' (M.I,39), i.e. developing a mind of love, kindness and honesty, and free from greed, hatred and delusion"। কিন্তু কালক্রমে সেই, ধর্মের পবিত্রতার মধ্যেও ঢুকেছে অপবিত্রতা। Thailand এ এইসময় মহিলাদের স্তুপা পরিক্রমণ নিষিদ্ধ হয়েছে। বার্মাতেও এইসময় পবিত্র বুদ্ধ মূর্তির সামনে যাওয়া বারন।
ইসলাম ধর্মে কোরানে এর উল্লেখ আছে, তবে এর ব্যাখ্যা অনেকরকম হতে পারে, মনে হয় তিনি এইসময় যৌনমিলনের বারন বলতে চেয়েছেন। কোরাম বলছে "It is harm, so keep away from wives during menstruation. And do not approach them until they are pure. And when they have purified themselves, then come to them from where Allah has ordained for you. Indeed, Allah loves those who are constantly repentant and loves those who purify themselves [2:222] - Quran"। জানা যায় মোহম্মদ তাঁর বিবির এইসময় তাঁর কোলে মাথা রেখে কোরান পড়েছেন, মসজিদে নামাজ পড়ার সময় তাঁর বিবিকে মাদুর বিছিয়ে দিতে বলেছেন – ধরা যায় মসজিদে যাওয়া বারন করেন নি। কিন্তু যা হয়, পরবর্তীকালে মহিলাদের অবজ্ঞা করে এসেছে অনুশাসন। সবচেয়ে মজার কথা বা দুঃখের কথা এই যে, এই সাধারণ জৈবিক প্রক্রিয়াকে পাপ বলে তকমা দেওয়া হয়েছে – এর পিছনে অন্য ধর্মের কোন প্রভাব আছে কিনা তা অনুসন্ধান করার যথেষ্ট অবকাশ আছে।
ইহুদি ধর্মে "Juwish code of law, Halakha" এর বিশদ নিয়মকানুন বলে দিয়েছে। The Book of Laviticus, Hebrew Bible এ 15.19-15.33 এই সংক্রান্ত অনেককিছু থেকে কিছু উল্লেখ্য "15.19 "Whenever a woman has her menstrual period, she will be ceremonially unclean for seven days. Anyone who touches her during that time will be unclean until evening. 20 Anything on which the woman lies or sits during the time of her period will be unclean. 21 If any of you touch her bed, you must wash your clothes and bathe yourself in water, and you will remain unclean until evening. 22 If you touch any object she has sat on, you must wash your clothes and bathe yourself in water, and you will remain unclean until evening……….. 29 On the eighth day she must bring two turtledoves or two young pigeons and present them to the priest at the entrance of the Tabernacle. 30 The priest will offer one for a sin offering and the other for a burnt offering. Through this process, the priest will purify her before the LORD for the ceremonial impurity caused by her bleeding. 31 "This is how you will guard the people of Israel from ceremonial uncleanness. Otherwise they would die, for their impurity would defile my Tabernacle that stands among them…….33 or a woman during her menstrual period. It applies to any man or woman who has a bodily discharge, and to a man who has sexual intercourse with a woman who is ceremonially unclean."। এর মধ্যে 29, 30, 31 পড়লে যে কোন ধর্মীয় স্থানের সামনে, মুক্তির পথে কিছুটা এগিয়ে দেবার জন্য, নানাবিধ পূজার দ্রব্যসামগ্রী সাজিয়ে বসে থাকা দোকানের চিত্রটা চোখের সামনে ভেষে উঠা, বা পরপারে যাত্রার জন্য গরুর লেজ ধরে ধরে দাড়িয়ে থাকা মনে আসা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এইসময় সেই মহিলাদের ছায়া মাড়ানোও যেন পাপ, অশুচি। নেপালে এবং আরো অনেক জায়গায় "menstrual hut" দেখা যায়, নেপালের সর্বোচ্চ আদালত এর বিরুদ্ধে রায়প্রদান করেও সমাজের এই stigma কতটা দূর করতে পেড়েছে জানা নেই। প্রগতিশীল ভাবনাচিন্তার মানুষজন বলবে এর থেকে বেরিয়ে আসায় তো মানুষের কাজ, কিন্তু এর ইতিহাস অনেক প্রাচীন – ধর্মের আধ্ম্যাতিকতা ব্যতিরেকে জাগতিক আচার প্রধান ধর্মের যুগে (ritual over spiritual) – এর থেকে বেরিয়ে আসতে অনেক অনেক সময়ের অপেক্ষা।
এই প্রসঙ্গে হিন্দু ধর্মের আনুশাসন সর্বজনবিদিত। মন্দিরের সামনে লিখিত বা অলিখিত নিয়মের লিখনের রঙ বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও বা কন্যাশ্রী কালেও বিন্দুমাত্র ফিকে হয়না। এদের কেউ এই অনুশাসনের নামে নারীদের উপর পুরুষের আধিপত্য কায়েম, রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রথিত বহুযুগের করাল গ্রাস থেকে মুক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়না। মনু-স্মৃতির দুটি শ্লোক খুবই প্রাসঙ্গিক। ūrdhvaṃ nābheryāni khāni tāni medhyāni sarvaśaḥ | yānyadhastānyamedhyāni dehāccaiva malāścyutāḥ || 5.130 || - The cavities that are above the navel are all pure; those that are below it are impure; as, also are all excretions dropped from the body.—(5.130). আর একটা vasā śukramasṛgmajjāmūtraviḍghrāṇakarṇaviṭ | śleśmāśru dūṣikā svedo dvādaśaite nṛṇāṃ malāḥ || 133 || - Fat, man, blood, marrow, urine, ordure, nasal excretion, ear-wax, phlegm, tears, rheum of the eyes and perspiration,—these twelve are the 'excretions' of human beings.—( 133). তার মানে নাভির উপর থেকে যা কিছু নিঃসৃত হয় তাতে দোষের কিছু নেই। তাই যদি হয় তাহলে মুখ থেকে নিঃসৃত লালা পূজার আগে প্রসাদের থালাতে পড়লে দোষের কিছু নেই। অনেকেই বলবে যে এটা স্বাস্থ্যবিজ্ঞানসম্মত নয়, তাই থালা ধুয়ে নিতে হবে। তাই যদি হয় তাহলে মহিলারা এইসময় স্বাস্থ্যবিজ্ঞানসম্মত জিনিষ ব্যবহার করে মন্দিরে প্রবেশ করলে দোষ কোথায়, অশুচিতা কোথায় – আসল শুচিতা তো মনে। সব দোষ কি মোল্লা নাসিরুদ্দিনের!
খ্রিস্টধর্ম জন্মের আদিকাল থেকে নারীকে খুব একটা সন্মানের চোখে দেখেনি। Original Sin, The Fall এর জন্য নারীদের দায়ী করে। Eve কে এক সাপ প্রলুব্ধ করেছিল জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেতে। কেন সাপকে দেখান হোল? – সাপ মাতৃজাতির প্রতীক, ক্রমবিবর্তিত জন্ম-মৃত্যু প্রতীক। "The serpent represents immortal energy and consciousness engaged in the field of time, constantly throwing off death and being born again"। একবার Bill Moyers, J. Campbell কে প্রশ্ন করেছিলেন যে, আর কোন mythology তে নারীদের এতখানি পাপী হিসাবে দেখানোর নজির আছে কিনা। J. Campbell তার বক্তব্যে বলছেন "No, I don't know of it elsewhere. The idea in the biblical tradition of the Fall is that nature as we know it is corrupt, sex in itself is corrupt, and the female as the epitome of sex is a corrupter. Why was the knowledge of good and evil forbidden to Adam and Eve? Without that knowledge, we'd all be a bunch of babies still in Eden, without any participation in life. Woman brings life into the world. Eve is the mother of this temporal world. Formerly you had a dreamtime paradise there in the Garden of Eden -- no time, no birth, no death -- no life. The serpent, who dies and is resurrected, shedding its skin and renewing its life, is the lord of the central tree, where time and eternity come together."। সাপই জীবন দান করেছে, যেমন মায়েরা জীবন দান করে। তাহলে আবার নাসিরুদ্দিনের মত বলতে হয়, বটে, সব দোষ কেবল আমার। সাপ যেমন পুরোন ত্বক পরিত্যাগ করে নতুন ত্বক ধারণ করে – রুপক অর্থে মৃত্যু সেখান থেকে আবার পুনর্জন্ম – চন্দ্রের অমাবস্যা-শুক্লপক্ষ-পূর্ণিমা-কৃষ্ণপক্ষ ক্রমবিবর্তন চক্রও তার প্রতীক বহন করে।
এবার আরো একটু পিছিয়ে প্রায় 27000-20000 BCE সময় পাথরের দেওয়ালে আঁকা, সউথ-ওয়েস্ট ফ্রান্সে একশ বছর আগে আবিষ্কৃত, Venus of Laussel ছবির কথা মনে করা যাক।সুধী পাঠকগণ বিবরণের ঘাটতি মেটানোর জন্য Internet search করে ছবিটি দেখে নিতে পারেন। একটি নগ্ন নারী মূর্তি, তার ডান হাত কাঁধের সমান উচ্চতায় উঠে আছে, সেই হাতে ধরে আছে একটি বাইসনের শিং – তাতে ১৩টি দাগ উল্লম্বভাবে আঁকা। তার বাম হাত ঈষৎ স্ফীত পেটের উপর রাখা। এই ১৩টি দাগের দুটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। চন্দ্রের অমাবস্যা-শুক্লপক্ষ-পূর্ণিমা-কৃষ্ণপক্ষ ক্রমবিবর্তন চক্রে প্রথম চন্দ্রকণা থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত সময় লাগে ১৩ দিন, আবার কেউ কেউ বলেন এক বছরে চন্দ্র ১৩ বার আবর্তন করে। বাংলা প্রবাদ বাক্য '১২ মাসে ১৩ পার্বণ'-এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ আমার জানা নেই, তবে একবছরে মহিলাদের ১৩ বার (365/28 = 13) পিরিয়ড সম্পূর্ণ হয়, এটা সর্বজনবিদিত। অমাবস্যা থেকে পূর্ণিমা আবার অমাবস্যা – জন্ম-মৃত্যুর চক্রবত পরিবর্তন। 1.Menstrual phase (From day 1 to 5), 2.Follicular phase (From day 1 to 13), 3.Ovulation phase (Day 14), 4.Luteal phase (From day 15 to 28) মহিলাদের menstrual cycle চন্দ্রে সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এইসময় কত সম্ভাব্য প্রানের জন্ম নেয়, আবার মৃত্যু হয়, আবার জন্ম নেয় – চক্রাকারে ঘূর্ণায়মান। সুতরাং এর মধ্যে না আছে কোন দোষ, না আছে কোন পাপ, না আছে কোন আশুচী। আগেকার মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে সবসময় সংযোগ স্থাপন করত। মানুষ যত সভ্য হয়েছে, ধর্ম যত Institutional Form নিয়েছে প্রকৃতি সঙ্গে যোগাযোগ থেকে আমরা তত বিচ্ছিন্ন হয়েছি, তত আমাদের মধ্যে ঢুকেছে ধর্মীয় আনুশাসন, সামাজিক বিধিনিষেধ। তাই আমরা শুধুই মোল্লা নাসিরুদ্দিনের দোষ দেখি। Psychoanalyst J. L. Hendorson মনে করেন "the menstrual cycle may actually be from a woman's point of view, since it has the power to awaken the deepest sense of obedience to life's creative power over her."
সাম্প্রতিককালে Padman ছবি মুক্তি পেয়েছে, আর সাথেসাথে শুরু হয়েছে চাপানোতর। Federal Censor Board (FCB) এর সদস্য ঈসাক আহমেদ বলেছেন "we can't allow our film distributor to import film which is against our tradition and culture". জানা নেইTradition এর সময়কাল কতদূর সময় পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। 'বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও', বা কন্যাশ্রী বা এই ধরণের অন্য প্রকল্প সত্যিই বেটিকে বাঁচার মত করে বাঁচাতে পারবে তো, কন্যা শ্রীমতি হতে পারবে তো, নাকি অন্য যূপকাষ্ঠে তাদের বলী চলতেই থাকবে। নাকি মহিলাদের 'এই রে, এখন কি করি!' বলে দুশ্চিন্তা করতেই হবে। কলকাতা এয়ারপোর্টে সম্প্রতি Sanitary Pad dispensary booth চালু হয়েছে, তাহলে যে কোন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সামনে কেন থাকবে না! ভগবানের কৃপায় তাদের আয় তো কম নয়। 1996, Boston Marathon, Uta Pippig, প্রথম স্থানাধিকারী, যখন দৌড় শেষ করে তখন menstrual cramp, কিন্তু তারপরেও বিভিন্ন কথা তাকে শুনতে হয়। আমরা সবসময় ভুলে যায় "পশ্চাতে রেখেছ যারে, সে তোমায় পশ্চাতে টানিছে", এর সঙ্গে সঙ্গে সামগ্রিক বিষয় আনুসন্ধানের জন্য পশ্চাতে অগসরের প্রয়োজন আছে বোধহয়। পাপ-পুণ্য, শুচী-অশুচী, শুদ্ধ-অশুদ্ধ না ভেবে জন্ম-মৃত্যুর ক্রম আবর্তন ভাবতে ক্ষতি কিসের, কার ক্ষতি। 'এই রে, এখন কি করি!' – এই tradition নিয়ে। কি আর করি – সুমন চ্যাটুজ্জের মত বলি "সূর্য ডোবার সময় হলে, পশ্চিমে নয় পূবের দিকে, মুখ ফিরিয়ে ভাবব আমি, কোন দেশে রাত হচ্ছে ফিকে"।"

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন