"হিন্দু রাষ্ট্র কাকে বলে?"
কোনো বিজেপি সমর্থককে এই প্রশ্ন করা হলে অবধারিত ভাবে সে উত্তর দেবে - গুজরাট। সংঘিদের ভাষায় "হিন্দু রাষ্ট্র গুজরাট।" নিন্দুকদের ভাষায় "হিন্দুত্বের ল্যাবরেটরি গুজরাট।" গুজরাটের সমস্ত কিছুতে ধর্ম। হাজার হাজার মন্দির। প্রতি অলিতে গলিতে ধর্মনাম ধর্মগান লেগেই রয়েছে সারা বছর। সেখানে মুসলমানরা একঘরে। ২০০২ এর পর থেকে ভয় সিঁটিয়ে থাকে তারা। ২২ বছর একটানা হিন্দুত্বের শাসন। সংঘ পরিবারের বিরুদ্ধে খোলাখুলি গলার আওয়াজ তোলা বারণ। নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে গেলে সেখানে সিবিআইয়ের জাজ পর্যন্ত খুন হয়ে যায়। পুঁজিপতিদের কাছে মডেল গুজরাট। সেখানে কোনো শ্রমিককে ইউনিয়ন করতে দেওয়া হয় না। বন্ধ বা স্ট্রাইক নেই। হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ সেখানে প্রতি বছর। তার জন্য সাধারণ মানুষের কত লাভ হলো সেই প্রশ্ন তোলাও গুজরাটে অপরাধ। আম্বানি আদানিদের জায়গীর হলো গুজরাট। ২২ বছরের একটানা শাসনে সেখানকার সমস্ত ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ করেছে হিন্দুত্ব। স্কুলের পাঠক্রম থেকে শুরু করে ইতিহাসের গবেষণা - সর্ব ক্ষেত্রে হিন্দুত্বের প্রভাব। সংঘের হাজার হাজার স্কুল। একটা গোটা প্রজন্ম তৈরি হয়েছে যাদেরকে সংঘের মতাদর্শ গেলানো হয়েছে। রাজনীতি বিজ্ঞানের গবেষকরা বলেন যে সংঘ কোনো নতুন নীতি নেওয়ার আগে তার পরীক্ষা করে নেয় গুজরাটে। গুজরাট মডেল।
এই গুজরাট থেকেই জয়যাত্রা শুরু করেছিলেন হিন্দু হৃদয় সম্রাট নরেন্দ্র মোদি। সারা ভারতকে গুজরাট বানাবেন - এই আশায় হিন্দুত্ববাদের সমর্থকরা তাকে ভোট দিয়েছিলেন। বিজেপির সভাপতিও ওই রাজ্য থেকেই। অমিত শাহ যে প্রবাদপ্রতিম পার্টি মেশিনারি তৈরি করেছে তার হাতেখড়িও গুজরাটে। নিজের হাতের তালুর চেয়েও গুজরাটের পার্টি সংগঠনকে ভালোভাবে চেনে অমিত শাহ। ভোটের আগে সমস্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, একাধিক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজেদের কাজ কম্ম ফেলে পড়েছিলেন গুজরাটে। পার্লামেন্টের শীতকালীন অধিবেশন স্থগিত রয়েছে গুজরাটের জন্য। যে রাজ্যের টানা চারবারের মুখ্যমন্ত্রী দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন সেই রাজ্যে তো এমনিতেই ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার কথা, সব কিছু বাদ দিয়ে শুধু গুজরাটি সেন্টিমেন্টের জন্য জিতে যাওয়ার কথা। তবুও কোনো ঝুঁকি নেননি প্রধানমন্ত্রী। কেন্দ্র এবং রাজ্যে তারা ক্ষমতায়, বিরোধীরা দাঁড়াবে কী ভাবে সেখানে? ২০১২-তে, যখন কংগ্রেসের সূর্য মধ্যগগনে, যখন একের পর এক নির্বাচন হারতে হারতে বিজেপি হাতে গোনা তিন চারটে রাজ্যে সীমাবদ্ধ, সেই তখনও গুজরাটে ১১৫-টা আসন জিতে নরেন্দ্র মোদি প্রমান করে দেন যে তিনিই একা কুম্ভ। সেইখানে ২০১৭-তে নির্বাচনের ফল তো পুনর্নির্ধারিত হওয়া উচিত।
কিন্তু কী হলো?
সেই হিন্দুত্বের পুণ্যভূমিতে কোনো মতে তরী পাড়ে লাগলো। মাত্র ৭ টি আসনের বহুমত। গত বিধানসভার থেকে ১৬ টি আসন কম। ভোট বেড়েছে ১ শতাংশ, কিন্তু কংগ্রেসের ভোট বেড়েছে ৪ শতাংশ। আর লোকসভার তুলনায় বিজেপির ভোট কমেছে ১০ শতাংশেরও বেশি। বিহার নির্বাচনে নীতিশ কুমারের সঙ্গ হারিয়েও এত শতাংশ ভোট কমেনি বিজেপির। ৮-টি আসনে বিজেপি জিতেছে ১৮০০ ভোট বা তার কম ভোটের ব্যবধানে। কয়েকটি ৫০০ এরও কম ব্যবধানে। এই অসনগুলোয় মোট ৪৫০০ ভোট বিজেপির থেকে কংগ্রেসে ঘুরে গেলেই কংগ্রেস সরকার গড়ত। মাত্র ৪৫০০। একবার ভাবুন। একটা বড় বিয়েবাড়িতেও ওর চেয়ে বেশি মানুষ নিমন্ত্রিত থাকেন। বিভিন্ন পোল সার্ভে বলছে কংগ্রেসের ভোট সবচেয়ে বেশি অল্পবয়সীদের মধ্যে। সেই অল্পবয়সীরা যাদেরকে ২০১৪-তে বিজেপির প্রধান নির্বাচনী সম্পদ বলা হয়েছিল। হিন্দুত্বের কেন্দ্রতে হিন্দুত্ব এরকম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে কয়েক মাস আগেও কেউ ভেবেছিলেন? যে মডেলে গোটা দেশকে গড়ে তোলার কথা বলে মোদিজি প্রধানমন্ত্রী হলেন সেই মডেলই হাতছাড়া হতে পারে এরকম ভেবেছিলেন? যাঁরা তাদের দলের প্রধান সম্পদ ছিল, সেই যুবক যুবতীরা বিরোধীদের সব থেকে বড় সম্পদ হয়ে উঠবে কেউ ভেবেছিলেন?
হিন্দু রাষ্ট্রের প্রধান পীঠস্থান হলো সোমনাথ। যেখানে সোমনাথ মন্দির, যে সোমনাথ মন্দিরে ভিসিটর বুকে সই করার খবর রটিয়ে রাহুল গান্ধীকে অহিন্দু বলে রটনা করেছিল বিজেপি। সেই সোমনাথে কংগ্রেস ২০ হাজারের বেশি ভোটে জিতেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন