শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

বিষয়- সাগু ~ কৌশিক মজুমদার


জনমেজয় কহিলেন, হে মহর্ষে! আপনি কহিলেন যে, কলিযুগে সাগু নামে এক প্রকার মনুষ্যেরা পৃথিবীতে আবির্ভূত হইবেন। তাঁহারা কি প্রকার মনুষ্য হইবেন এবং পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া কি কার্য্য করিবেন, তাহা শুনিতে বড় কৌতূহল জন্মিতেছে। আপনি অনুগ্রহ করিয়া সবিস্তারে বর্ণন করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে নরবর! আমি সেই বিচিত্রবুদ্ধি; ফেসবুককুশলী সাগু তথা সাহিত্য গুন্ডাগণকে আখ্যাত করিব, আপনি শ্রবণ করুন। আমি সেই চস্‌মাঅলঙ্কৃত, উদরচরিত্র, দেড় ব্যাটারি, অপভাষী, কুৎসাপ্রিয় সাগুদিগের চরিত্র কীর্ত্তিত করিতেছি, আপনি শ্রবণ করুন। হে রাজন্, যাঁহারা বিচিত্রস্তাবকাবৃত, সর্বদা খরগহস্ত, বিশ্বজ্ঞানী, এবং মহাপাদুক, তাঁহারাই সাগু। যাঁহারা কুবাক্যে অজেয়, কুভাষাপারদর্শী, মাতৃভাষার বানানে অপটু, তাঁহারাই সাগু। মহারাজ! এমন অনেক মহাবুদ্ধিসম্পন্ন বাবু জন্মিবেন যে, তাঁহারা ঘুটুবাজি ব্যাতীত অন্য কাজে অসমর্থ হইবেন। যাঁহাদিগের দশেন্দ্রিয় অপ্রকৃতিস্থ, অতএব অপরিশুদ্ধ, যাঁহাদিগের কেবল রসনেন্দ্রিয় লেখকবিশেষনিষ্ঠীবনে পবিত্র, তাঁহারাই সাগু। যাঁহাদিগের মস্তক বুদ্ধিহীন শুষ্ক গোময়ের ন্যায় হইলেও কুবাক্যে সক্ষম; হস্ত দুর্ব্বল হইলেও কি বোর্ড ধারণে এবং ভারচুয়াল বিপ্লবে সুপটু; চর্ম্ম কোমল হইলেও পরদ্রব্যবিশেষের প্রহারসহিষ্ণু; যাঁহাদিগের ইন্দ্রিয়মাত্রেরই ঐরূপ প্রশংসা করা যাইতে পারে, তাঁহারাই সাগু। যাঁহারা বিনা উদ্দেশ্যে দল বাঁধিয়া কলহ করিবেন, কলহের জন্য স্ক্রিনসট দিবেন, স্ক্রিনসটের জন্য  ইনবক্স করিবেন, ইনবক্সের জন্য গায়ে পড়িয়া আলাপ জমাইবেন, তাঁহারাই সাগু।
মহারাজ! সাগু শব্দ নানার্থ হইবে। যাঁহারা কলিযুগে ফেসবুকাভিষিক্ত হইয়া, মেম্বার নামে খ্যাত হইবেন, তাঁহাদিগের নিকট "সাগু" অর্থে সাহিত্য গ্রুপের অ্যাডমিন  বুঝাইবে। নির্বোধদের নিকটে "সাগু" শব্দে অপেক্ষাকৃত জ্ঞানী বুঝাইবে। লেখকের নিকট "সাগু" অর্থে আপদ বুঝাইবে। এ সকল হইতে পৃথক্, কেবল সাগুজন্মনির্ব্বাহাভিলাষী কতকগুলিন মনুষ্য জন্মিবেন। আমি কেবল তাঁহাদিগেরই গুণকীর্ত্তন করিতেছি। যিনি বিপরীতার্থ করিবেন, তাঁহার এই মহাভারত শ্রবণ নিষ্ফল হইবে। তিনি লেখকজন্ম গ্রহণ করিয়া সাগুদিগের ভক্ষ্য হইবেন।
হে নরাধিপ! বাবুগণ দ্বিতীয় অগস্ত্যের ন্যায় গ্রুপরূপী মেম্বারদের শোষণ করিবেন, কি বোর্ড ইঁহাদিগের গণ্ডূষ। কিছু লেখক প্রকাশক ইঁহাদিগের আজ্ঞাবহ হইবেন-"বই উদ্বোধন" এবং "ফিতাকাটা" নামক দুইটি অভিনব বিষয় আশ্রয় করিয়া রাত্রি দিন ইঁহাদিগের গ্রুপে ছবি লাগাইতে থাকিবেন। ইঁহাদিগের যেমন মুখে অগ্নি, তেমন জঠরেও অগ্নি জ্বলিবেন। এবং গেট্টু নাম দিয়া পেটোয়া মেম্বার লইয়া তৃতীয় প্রহর পর্য্যন্ত ইঁহাদিগের রথস্থ যুগল প্রদীপে জ্বলিবেন। আলোচিত সঙ্গীতে এবং কাব্যেও অগ্নিদেব থাকিবেন। তথায় তিনি "মডার্ন" এবং "পোস্ট মডার্ন" রূপে পরিণত হইবেন। ফেবুবাসীদের মতে ইঁহাদিগের কপালেও অগ্নিদেব বিরাজ করিবেন। যেকোন লেখককেই ইঁহারা নস্যাৎ করিবেন-ভদ্রতা করিয়া সেই দুর্দ্দর্ষ কার্য্যর নাম রাখিবেন, "রিভিউ"। কেবল বিনা পয়সায় বই দেওয়া লেখক ও প্রকাশকদিগকে ইঁহারা পূজা করিবেন। সেই মন্দিরের নাম হইবে "অ্যাডভেঙ্চার"।
হে নরশ্রেষ্ঠ! যিনি কাব্যরসাদিতে বঞ্চিত, সঙ্গীতে দগ্ধ কোকিলাহারী, যাঁহার পাণ্ডিত্য শৈশবাভ্যস্ত ফেবুগত, যিনি আপনাকে অনন্তজ্ঞানী বিবেচনা করিবেন, তিনিই সাগু। যিনি কাব্যের বা সাহিত্যের   কিছুই বুঝিবেন না, অথচ কাব্যপাঠে এবং সমালোচনায় প্রবৃত্ত, যিনি বারযোষিতের চীৎকার মাত্রকেই সঙ্গীত বিবেচনা করিবেন, যিনি আপনাকে অভ্রান্ত বলিয়া জানিবেন, তিনিই সাগু। যিনি রূপে কার্ত্তিকেয়ের কনিষ্ঠ, গুণে নির্গুণ পদার্থ, কর্ম্মে জড় ভরত, এবং বাক্যে সরস্বতী, তিনিই সাগু। যিনি অন্য গ্রুপ দখলের জন্য কলহ করিবেন, বন্ধুর ইনবক্স পাইয়া পায়ে পা লাগাইবেন, গ্রুপের স্থাপককে বাহির করিয়া দিতে সচেষ্ট হইবেন এবং না পারিলে চোখের জল মুছিয়া নতুন গ্রুপ খুলিবে, তিনিই সাগু। যাঁহার গমন অনাহুত সভায় এবং আহার প্যাকেটের সিঙারা, তিনিই সাগু। যিনি মহাদেবের তুল্য তান্ডবপ্রিয়, ব্রহ্মার তুল্য চতুরানন, এবং বিষ্ণুর তুল্য লীলা-পটু, তিনিই সাগু। হে কুরুকুলভূষণ! বিষ্ণুর সহিত এই বাবুদিগের বিশেষ সাদৃশ্য হইবে। বিষ্ণুর ন্যায় ইঁহারাও দিবারাত্র ফেবুতে অনন্তঅনলাইন হইবেন। বিষ্ণুর ন্যায় ইঁহাদিগেরও দশ অবতার-যথা, কেরাণী, মাষ্টার, প্রকাশক, রিভিউয়ার, ফেবুলেখক, উকিল, আই টি, পা চাটা, সম্বাদপত্রসম্পাদক এবং নিষ্কর্ম্মা। বিষ্ণুর ন্যায় ইঁহারা সকল অবতারেই অমিতবলপরাক্রম লেখকগণকে বধ করিবেন। 
মহারাজ! পুনশ্চ শ্রবণ করুন। যাঁহার বাক্য মনোমধ্যে এক, কথনে দশ, লিখনে শত এবং কলহে সহস্র তিনিই সাগু। যাঁহার বল হস্তে একগুণ, মুখে দশগুণ, পৃষ্ঠে শতগুণ এবং লেখনকালে অদৃশ্য, তিনিই সাগু। যাঁহার বুদ্ধি বাল্যে পুস্তকমধ্যে, যৌবনে বোতলমধ্যে, বার্দ্ধক্যে গৃহিণীর অঞ্চলে, তিনিই সাগু। যাঁহার ইষ্টদেবতা নিজ স্বয়ং, গুরু অন্য অ্যাডমিন, বেদ  ফেবু এবং তীর্থ "জীবনানন্দ সভাঘর" তিনিই সাগু।  যাঁহার যত্ন কেবল পরিচ্ছদে, তৎপরতা কেবল উমেদারিতে, ভক্তি কেবল কলহে, এবং রাগ কেবল সদ্‌গ্রন্থের উপর, নিঃসন্দেহে তিনিই সাগু।
হে নরনাথ! আমি যাঁহাদিগের কথা বলিলাম, তাঁহাদিগের মনে মনে বিশ্বাস জন্মিবে যে, আমরা তাম্বূল চর্ব্বণ করিয়া উপাধান অবলম্বন করিয়া সভা সমিতিতে গিয়া, দ্বৈভাষিকী কথা কহিয়া, এবং লেখকদের গুষ্টি উদ্ধার করিয়া বাংলা সাহিত্য পুনরুদ্ধার করিব।
জনমেজয় কহিলেন, হে মুনিপুঙ্গব!সাগুদিগের জয় হউক, আপনি অন্য প্রসঙ্গ আরম্ভ করুন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন