মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৩

ভ্রাতৃদ্বিতীয়া ~ অমিতাভ প্রামাণিক


বিবস্বতমুনির পুত্র নরকরাজ যমদেবের বোন যমুনা। বিয়ের পর যমুনা ভাই যমরাজকে নেমন্তন্ন করলেও নরকে পাপীতাপীদের নিয়ে হাজারটা কাজে ব্যস্ত থাকায় যম বোনের শ্বশুরবাড়ি আসার সময় পায়না। অবশেষে কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়ায় যম চিত্রগুপ্তকে চার্জ বুঝিয়ে কোনোরকমে একদিন ছুটি নিয়ে যমুনার বাড়ি গেল। যমুনা তো ভাইকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। নিজের হাতে ভাইয়ের কপালে সুগন্ধী চন্দনের ফোঁটা দিলো, রান্না করে ভাইকে খাওয়ালো ভালোমন্দ এটাসেটা। যমের অরুচি গেল কেটে। যমরাজ অত্যন্ত খুশি হয়ে ভুঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে যমুনাকে বলল, বল, কী বর চাই তোর? যমুনা বলল, বরই যদি দিস দাদা, এমন বর দে যেন আজকের দিনে যে ভাই বোনের হাতে ফোঁটা নেবে সে কোনদিন নরকদর্শন করবে না, সে অমর হবে, তার হবে অখণ্ড পরমায়ু। 

বোনের যত্ন-আত্তি পেয়ে আর পেটপুরে খেয়ে যমরাজ খুশিই ছিল। বললো, তথাস্তু।

এই তো, গল্পটা? এ রকম আরো আছে, একাধিক। নরকাসুরকে বধ করে কৃষ্ণ ফিরে গেল দ্বারকায়, সেখানে ক্লান্ত কৃষ্ণকে বোন সুভদ্রা প্রদীপ জ্বালিয়ে ওয়েলকাম করলো, পিঁড়ি পেতে খেতে দিল মণ্ডা-মিঠাই। ভাই যেন পুনর্জন্ম পেল, হয়ে গেল দ্বিজ, তাই শুরু হল ভাই-দ্বিজ, অপভ্রংশে ভাইদুজ।

পাতালরাজ দানবীর বলির তপস্যায় খুশি হয়ে ভগবান বামদেব বিষ্ণুরূপে তার গৃহে এসে বর দিতে চাইলে বলি বললেন, ভগবন্‌, আপনি এখানেই দ্বারপাল হিসাবে থাকুন, যাতে আসতে যেতে আপনার দেখা পাই। বিষ্ণুর রাজী না হয়ে উপায় ছিল না। এদিকে লক্ষ্মী পড়েছেন ফ্যাসাদে, ঘরের মানুষের দেখা নেই। নারদের মুখে খবর পেয়ে লক্ষ্মী গরীর ভিখারিনী সেজে শাড়ি ছিঁড়ে গিঁট মেরে অজন্তা হাওয়াই ফটফট করতে করতে বলির কাছে গিয়ে ভিক্ষে চাইল। কপালে ফোঁটা দিয়ে বলল, আমার ভাই নেই, তুমি আমার ভাই। দানবীর বলির দানের অহঙ্কার, বললো, বোনটি আমার, তোর যা চাই তাই পাবি। লক্ষ্মী বলল, আমার কর্তাকে আটকে রেখেছ, প্লীজ ছেড়ে দাও। ব্যাস, বলির হাওয়া নিকলে গেল।

মহামতি চাণক্য এই নিয়ে পরে শোলোক বেঁধেছেন – অতিদর্পে হতা লঙ্কা অতিমানে চ কৌরবাঃ। অতিদানে বলির্বদ্ধঃ সর্বমত্যন্তম্‌ গর্হিতম্‌। মানে বলে দিতে চাইলে নিশ্চয় বলবে, বেশি বেশি কোরনা!

রাজা নন্দীবর্ধন বহুদিন ভাইকে না দেখে মনোকষ্টে ভুগছে। ভাই মহাবীর তপস্যায় নির্বাণলাভ করে জৈনধর্ম প্রচার করে বেড়াচ্ছে। নন্দীবর্ধনের কষ্ট লাঘবের জন্যে বোন সুদর্শনা কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়ায় ভায়ের বাড়ি এসে তার সেবা করতে লাগল। 

তারপর সেই গল্পটা! অনেক আগে জঙ্গলের ধারে এক বাড়িতে থাকত এক পরিবার। দিদির যখন বিয়ে হয়ে যায়, ভাই তখন খুব ছোট। বড় হয়ে দিদির মুখ মনেও পড়ে না তার। অন্যদের দেখে মাকে জিজ্ঞেস করে, মা, আমারও তো দিদি আছে তুমি বলো, সে কেন আসে না? মা বলে, ওরে, তার যে শ্বশুরবাড়ি অনেক দূর, পরে পড়ে জঙ্গল, খরস্রোতা নদী, সে কী করে আসবে বল? 

ছেলেটা বলল, আমি দিদির শ্বশুরবাড়ি যাব। মা যত বিপদের কথা বলে, নাছোড়োবান্দা ছেলের তত জেদ বেড়ে যায়। শেষে মা পুজো-আচ্চা করে মাথায় চুমো টুমো খেয়ে যেতে দিল ছেলেকে।

জঙ্গলের পথে হাঁটছে ছেলে, ধেয়ে এল সাপ। ছেলে বলল, জানো, আমি আমার দিদির কাছে যাচ্ছি, কতদিন তাকে দেখিনি, এখন আমাকে কেটো না, প্লীজ, ফেরার পথে যা খুশি কোরো। সাপ বলল, ঠিক আছে। ছুটে এল বাঘ, তাকেও একই কথা বলল সে। পাহাড় শুরু করল তার ওপর পাথর ফেলতে, সে মিনতি করল, এখন আমায় মেরো না দয়া করে। ওরা মেনে নিল।

নদী পার হতে গিয়ে দেখে প্রবল স্রোত, ভেসে যাবার উপক্রম। নদীর কাছেও সে চাইল তাকে যেন অনওয়ার্ড জার্নিতে ডুবিয়ে দেওয়া না হয়। নদী তাকে ডলফিন-টলফিন দিয়ে পার করে দিল।

ভাইকে পেয়ে তো দিদির আনন্দের শেষ নেই। খাওয়া-দাওয়া ফোঁটা-টোঁটা তো হলই, কত গল্পগুজব, খুনসুটি, কত কী! অনেক দিন সেখানে থেকে ফেরার যখন সময় হল, দিদি বলল, আবার আসিস ভাই। ভাই বলল, জানিস দিদি, আমাদের আর দেখা হবে না। আসার সময় যা যা কাণ্ড হয়েছিল, সব দিদিকে বলল সে।

দিদি বলল, কী, আমার ভাইকে মেরে ফেলবে এরা? রসো, মজা দ্যাখাচ্ছি। সেও পোঁটলা নিয়ে রেডি হয়ে গেল, বলল, চ' আমিও তোর সাথে যাব।

নদীকে খুশি করতে পুজো দিল সে, নদী ছেড়ে দিল। বাঘ হালুম করে তেড়ে আসতেই পোঁটলা খুলে তার দিকে ছুঁড়ে দিল রান্না করা মাংসের চাঁপ-রেজালা-দোপিঁয়াজা। বাঘ তাই খেয়ে ফুটে গেল। সাপকে দুধকলা দিয়ে আর পাহাড়কে সোনা-রূপো ঘুষ দিয়ে বশ করে ফেলল সে। ভাইয়ের সব অনিষ্ট দূর হয়ে গেল।

এই গল্পটা আরো বড়, কিন্তু সেসব থাক। মূল কথা এটাই। ভাইদের মঙ্গলের জন্যে বোন বা দিদিরা পারে না, হেন কাজ নেই।

আজ সেই পরম মঙ্গলময় দিন। আজ কাকডাকা ভোরে বোনেরা ঘুম থেকে উঠে ঘাসের ডগা থেকে শিশিরকণা সংগ্রহ করে তাই দিয়ে চন্দন বেঁটে ভাইয়ের জন্যে বাঁ হাতের অনামিকায় তুলে নেয় যে ফোঁটা, প্রদীপ জ্বালিয়ে মাথায় ধানদূর্বা দিয়ে মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে দিয়ে সেই ফোঁটা এঁকে দেয় ভায়ের কপালে, তার তুল্য পবিত্র অনুষ্ঠান জগতসংসারে নেই। 

ভ্রাতস্তব ললাটে হি দদামি তিলকং শুভ। অতঃপরং যমদ্বারে ময়া দত্তং হি কন্টকম্। ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।

এরপর ভাইকে ভূরিভোজ করানো। ভ্রাতস্তবাগ্রজাতাহং (বয়সে ছোট অর্থাৎ অনুজ হলে ভ্রাতস্তবানুজাতাহং) ভুক্ষ্ব ভক্তমিদং শুভম। প্রীতয়ে যমরাজস্য যমুনায়া বিশেষতঃ। আর ভাইয়ের কাজ বসে বসে সেগুলো সাঁটানো। তত্র যম পূজা দিকমঙ্গ্ ভগিনী হস্তাদ্ ভোজনং প্রধানং কর্ম।

আজ রাতের আকাশে শুক্লা দ্বিতীয়ার প্রায়-অদৃশ্য একফালি চাঁদ। কিন্তু এর কাছে ভাই-বোনের মধুর-সম্পর্কজনিত অপর তিথি রাখীপূর্ণিমার পূর্ণচাঁদও যেন ম্লান মনে হয়। 

দিদিরা, আমার প্রণাম নিও। বোনেরা, অনেক ভালবাসা। ঘরের দেয়ালে একটা এক্সট্রা ফোঁটা কেটে রেখ তোমরা আমার জন্যে। মিষ্টির প্লেট আর গিফ্‌ট্‌ কি ক্যুরিয়ারে পাঠাবে?

ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। ৫ই নভেম্বর ২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন