শনিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২৩

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ~ অহনা বিশ্বাস

আজ মহামহিম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্মদিনে তাঁকে অনন্ত শ্রদ্ধা জানাই। আজ এই উপমহাদেশের সকল মেয়েদের, বিশেষত নবপর্দায় শোভিত মেয়েদের তাঁকে বড় প্রয়োজন।

তাঁর 'অবরোধবাসিনী' (1931) বইটি থেকে খানিক উদ্ধৃত করলাম। যদি কারুর ইচ্ছা হয় তো পড়বেন। 

'প্রায় ৪০/৪৫ বৎসর পূর্ব্বের ঘটনা-কয়েক ঘর বঙ্গীয় সম্ভ্রান্ত জমীদারের মাতা, মাসী, পিসী, কন্যা ইত্যাদি একত্রে হজ করিতে যাইতেছিলেন। তাঁহারা সংখ্যায় ২০/২৫ জন ছিলেন। তাঁহারা কলিকাতায় রেলওয়ে ষ্টেশন পৌঁছিলে পর সঙ্গের পুরুষ প্রভুগণ কার্য্যোপলক্ষে অন্যত্র গিয়াছিলেন। বেগম সাহেবাদিগকে একজন বিশ্বস্ত আত্মীয় পুরুষের হেফাজতে রাখা হয়। সে ভদ্রলোকটীকে লোকে হাজী সাহেব বলিত, আমরাও তাহাই বলিব। হাজী সাহেব বেগম সাহেবাদের ওয়েটিং রুমে বসাইতে সাহস পাইলেন না। তাঁহারা উপদেশ মতে বিবি সাহেবারা প্রত্যেক মোটা মোটা কাপড়ের বোরকা পরিয়া ষ্টেশনের প্লাটফরমে উবু হইয়া (Squat) বসিলেন; হাজী সাহেব মস্ত একটা মোটা ভারী শতরঞ্জি তাঁহাদের উপর ঢাকিয়া দিলেন। তদবস্থায় বেচারীগণ এক একটা বোচকা বা বস্তার মত দেখাইতেছিলেন। তাঁহাদিগকে ঐরূপে ঢাকিয়া রাখিয়া হাজী সাহেব এক কোণে দাঁড়াইয়া খাড়া পাহারা দিতেছিলেন। একমাত্র আল্লাহ জানেন, হজযাত্রী বিবিগণ ঐ অবস্থায় কয় ঘণ্টা অপেক্ষা করিতেছিলেন-আর ইহা কেবল আল্লাহতালারই মহিমা যে তাঁহারা দম আটকাইয়া মরেন নাই।

ট্রেণ আসিবার সময় জনৈক ইংরাজ কর্ম্মচারীটী ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে হাজী সাহেবকে বলিলেন, "মুন্সি! তোমারা আসবাব হিয়াসে হাটা লো। আভি ট্রেণ আবেগা-প্লাটফরম পর খালি আদামি রহেগা-আসবাব নেহি রহেগা।" হাজী সাহেব যোড়হস্তে বলিলেন, "হুজুর, ঐ সব আসবাব নাহি-আওরত হায়।" কর্ম্মচারিটী পুনরায় একটা "বস্তায়" জুতার ঠোকর মারিয়া বলিলেন, "হা, হা-এই সব আসবাব হাটা লো।" বিবিরা পর্দ্দার অনুরোধে জুতার গুতা খাইয়াও টু শব্দটী করেন নাই।'
******

'আমরা বহু কাল হইতে অবরোধ থাকিয়া থাকিয়া অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছি সুতরাং অবরোধের বিরুদ্ধে বলিবার আমাদের-বিশেষতঃ আমার কিছুই নাই। মেছোণীকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে, "পচা মাছের দুর্গন্ধ ভাল না মন্দ?"-সে কি উত্তর দিবে?

এস্থলে আমাদের ব্যক্তিগত কয়েকটি ঘটনার বর্ণনা পাঠিকা ভগিনীদেরকে উপহার দিব-আশা করি, তাঁহাদের ভাল লাগিবে।

এস্থলে বলিয়া রাখা আবশ্যক যে গোটা ভারতবর্ষে কুলবালাদের অবরোধ কেবল পুরুষের বিরুদ্ধে নহে, মেয়েমানুষদের বিরুদ্ধেও। অবিবাহিতা বালিকাদিগকে অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া এবং বাড়ীর চাকরাণী ব্যতীত অপর কোন স্ত্রীলোকে দেখিতে পায় না।

বিবাহিতা নারীগণও বাজীকর-ভানুমতী ইত্যাদি তামাসাওয়ালী স্ত্রীলোকদের বিরুদ্ধে পর্দ্দা করিয়া থাকেন। যিনি যত বেশী পর্দ্দা করিয়া গৃহকোণে যত বেশী পেঁচকের মত লুকাইয়া থাকিতে পারেন, তিনিই তত বেশী শরীফ।

শহরবাসিনী বিবিরাও মিশনারী মেমদের দেখিলে ছুটাছুটি করিয়া পলায়ন করেন। মেম ত মেম-সাড়ী পরিহিতা খ্রীষ্টান বা বাঙ্গালী স্ত্রীলোক দেখিলেও তাঁহারা কামরায় গিয়া অর্গল বন্ধ করেন।'
******

'কবির ভাষায় বলিতে ইচ্ছা করেঃ

"কাব্য উপন্যাস নহে, এ মম জীবন,
নাট্যশালা নহে, ইহা প্রকৃত ভবন!"

প্রায় তিন বৎসরের ঘটনা, আমাদের প্রথম মোটর বাস প্রস্তুত হইল। পূর্ব্বদিন আমাদের স্কুলের জনৈকা শিয়িত্রী, মেম সাহেবা মিস্ত্রীখানায় গিয়া বাস দেখিয়া আসিয়া সংবাদ দিলেন যে, মোটর ভয়ানক অন্ধকার···"না বাবা! আমি কখনও মোটরে যা'ব না।" বাস আসিয়া পৌঁছিলে দেখা গেল,—বাসের পশ্চাতের দ্বারের উপর সামান্য একটু জাল আছে এবং সম্মুখ দিকে ও উপরে একটু জাল আছে। এই তিন ইঞ্চি চওড়া ও দেড় ফুট লম্বা জাল দুই টুকরা না থাকিলে বাসখানাকে সম্পূর্ণ "এয়ার টাইট" বলা যাইতে পারিত।

প্রথম দিন ছাত্রীদের নূতন মোটরে বাড়ী পৌঁছান হইল। চাকরাণী ফিরিয়া আসিয়া সংবাদ দিল-গাড়ী বড্ড গরম হয়,—মেয়েরা বাড়ী যাইবার পথে অস্থির হইয়াছিল। কেহ কেহ বমি করিযাছিল। ছোট মেয়েরা অন্ধকারে ভয় পাইয়া কাঁদিয়াছিল।

দ্বিতীয় দিন ছাত্রী আনাইবার জন্য মোটর পাঠাইবার সময় উপরোক্তা মেম সাহেবা মোটরের দ্বারের খড়খড়িটা নামাইয়া দিয়া একটা রঙীন কাপড়ের পর্দ্দা ঝুলাইয়া দিলেন। তথাপি ছাত্রীগণ স্কুলে আসিলে দেখা গেল,—দুই তিন জন অজ্ঞান হইয়াছে, দুই চারিজনে বমি করিয়াছে, কয়েক জনের মাথা ধরিয়াছে, ইত্যাদি। অপরাহ্নে মেম সাহেবা বাসের দুই পাশের দুইটী কড়খড়ি নামাইয়া দুই খণ্ড কাপড়ের পর্দ্দা দিলেন। এইরূপে তাহাদের বাড়ী পাঠাইয়া দেওয়া গেল।

সেই দিন সন্ধ্যায় আমার এক পুরাতন বন্ধু মিসেস মুখার্জ্জি আমার সহিত দেখা করিতে আসিলেন। স্কুলের বিবিধ উন্নতির সংবাদে আনন্দ প্রকাশ করিয়া বলিলেন,—"আপনাদের মোটরবাস ত বেশ সুন্দর হয়েছে। প্রথমে রাস্তায় দেখে আমি মনে করেছি যে আলমারী যাচ্ছে না কি-চারিদিকে একেবারে বন্ধ, তাই বড় আলমারী বলে ভ্রম হয়! আমার ভাইপো এসে বলেল, "ও পিসীমা! দেখ, সে Moving Black Hole (চলন্ত অন্ধকূপ) যাচ্ছে।" তাই ত, ওর ভিতর মেয়েরা বসে কি করে?"

তৃতীয় দিন অপরাহ্নে চারি পাঁচ জন ছাত্রীর মাতা দেখা করিতে আসিয়া বলিলেন, "আপকা মোটর ত খোদা কা পানাহ! আপ লাড়কীয়োঁ কো জীতে জী ক্ববর মে ভয় রহি হয়ঁ।" আমি নিতান্ত অসহায়ভাবে বলিলাম, "কি করি, এরূপ না হইলে ত আপনারাই বলিতেন, "বেপর্দ্দা গাড়ী।" তাঁহারা অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, 'তব কেয়া আপন জান মারকে পর্দ্দা করেঙ্গী? কালসে হামারী লাড়কীয়াঁ স্ড়্গুল নেহী আয়েঙ্গী।" সে দিনও দুই তিনটী বালিকা অজ্ঞান হইয়াছিল। প্রত্যেক বাড়ী হইতে চাকরাণীর মারফতে ফরিয়াদ আসিয়াছিল যে, তাহার আর মোটর বাসে আসিবে না।

সন্ধ্যার পর চারিখানা ঠিকানারহিত ডাকের চিঠি পাইলাম। ইংরাজী চিঠির লেখক স্বাক্ষর করিয়াছেন, "Muslim Brotherhood" বাকী তিনখানা উর্দ্দু ছিল-দুইখানা বেনামী আর চতুর্থখানায় পাঁচজনের স্বাক্ষর ছিল। সকল পত্রেরই বিষয় একই-সকলেই দয়া করিয়া আমাদের স্কুলের কল্যাণ কামনায় লিখিয়াছেন যে, মোটরের দুই পার্শ্বে যে পর্দ্দা দেওয়া হইয়াছে, তাহা বাতাসে উড়িয়া গাড়ী বে-পর্দ্দা করে। যদি আগামীকল্য পর্য্যন্ত মোটরে ভাল পর্দ্দার ব্যবস্থা না করা যায়, তবে তাঁহারা তাতোধিক দয়া করিয়া "খবিছ" "পলীদ" প্রভৃতি উর্দ্দু দৈনিক পত্রিকায় স্কুলের কুৎসা রটনা করিবেন এবং দেখিয়া লইবেন, এরূপ বে-পর্দ্দা গাড়ীতে কি করিয়া মেয়েরা আসে।

এ তো ভারী বিপদ,—
"না ধরিলে রাজা বধে,—ধরিলে ভুজঙ্গ!"

রাজার আদেশে এমন করিয়া আর কেহ বোধ হয় জীবন্ত সাপ ধরে নাই! অবরোধ-বন্দিনীদের পক্ষে বলিতে ইচ্ছা করিল,—

"কেন আসিলাম হায়! এ পোড়া সংসারে,
কেন জন্ম লভিলাম পর্দ্দা-নশীন ঘরে!"

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন