শুক্রবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৯

অশনিসংকেত ~ প্রসূন আচার্য্য

প্রিয় বন্ধুরা, 
মনে হয় আপনারা এখনো শোভন-বৈশাখী আর কাশ্মীরে 370 ধারা তুলে দেওয়া নিয়েই পড়ে আছেন। শোভনের আধ-বোলে মমতা-মা এর সমালোচনা, রং-মিলন্তি পোশাক, বৈশাখীর প্রসাধন করা মুখ, হাতে আটটি আংটি, আর ওরা কি একসঙ্গেই থাকে ? এই আলোচনায় বাঙালি মশগুল। একটু পিছিয়ে কিন্তু দ্বিতীয় আলোচনার বিষয়বস্তু কাশ্মীর। যাই বলো গুরু, মোদী আর অমিত শাহ বাপ কা বেটা। পাকিস্তানকে দেখিয়ে দিল। জঙ্গিদের ঘরে ঢুকিয়ে দিল। যাক এত দিনে শ্যামাপ্রসাদের আত্মা শান্তি পেল। আর তৃতীয় আলোচনার বিষয়? দিদিকে বলো। প্রশান্ত কিশোর। 2021 আর ক'মাস?

পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি এবার একটু চোখ তুলে তাকান। তৃণমূলের কিছু নেতা বা কর্মীর দুর্নীতি, সুবোধ থেকে শ্রীজাতদের নব্য-দলদাস হওয়া, মমতার অন্ধ ভাইপো স্নেহের থেকে অনেক বড় বিপদ আজ আমাদের দোর গোড়ায়। আমরা এক ভয়ংকর আর্থিক মন্দার মধ্যে দ্রুত প্রবেশ করেছি। কোনও বাংলা বড় সংবাদমাধ্যম এ কথা বলছে না। ভয়। দিল্লির বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যাবে। ঠিক যেমন দিদির পুলিশ রাতের অন্ধকারে আলো নিভিয়ে মহিলা পার্শ্বশিক্ষিকাদের উপর মধ্যযুগীয় কায়দায় লাঠিপেটা করে তাঁদের ব্লাউজ ছিঁড়ে দিলেও মিডিয়া চুপ করে থাকে, ঠিক তেমনি।  আমি প্রথম শ্রেণীর মিডিয়ায় চাকরি করেও বলছি, শাসকের কাছে এমন নতজানু মিডিয়া আমি 31 বছর সাংবাদিকতা জীবনে কোনোদিন দেখিনি। অবশ্য সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও একই ছবি।

বিশ্বাস করুন, মোদী-শাহ- নির্মলা সীতারামন তিনজনেই জানেন, সরকারের হাতে টাকা নেই। আজই স্টেট ব্যাংক বলেছে, এটিএম কার্ড বন্ধ করে দেবে। নতুন এপ্স নিয়ে আসবে। কেন ? আসল কারণ, লোকজনের ব্যাংক থেকে টাকা তোলা বন্ধ করতে। অবস্থা কতটা খারাপ একটা উদাহরণ দিই। আপনার হকের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা সরকারের কাছে থাকে। প্রতি বছর 1 এপ্রিল সুদের টাকা জমা হয়। এ বছর হয়নি। নাকি সার্ভার খারাপ। আরে ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় 6 মাসে সার্ভার ঠিক হলো না? গত বছরও একই যুক্তি ছিল। পিএফের টাকা সরকার ধার নেয়। বিভিন্ন খাতে খাটায়। তারপর সুদ সমেত ফেতৎ দেয়। এটাই নিয়ম। এই বছর আজও গত বছরের টাকা ফেরত দেয়নি। দিলে খাতা কলমে এক লাখ কোটি টাকা শুধু সুদ দিতে হবে। সরকারের কাছে সেই টাকা নেই। জিএসটি থেকে আয় হলে দেবে। 

আপনারা ভাসা ভাসা জানেন বিএসএনএল এর অবস্থা খারাপ। জানেন কি, শুধু কলকাতায় যাঁরা লাইন-ম্যান হিসেবে কাজ করেন, সেই 4800 কর্মচারী গত জানুয়ারির পর কোনো বেতন বা টাকা পায়নি। সাত মাস ধরে কী করে তাঁদের পরিবার চলছে তাঁরাই জানেন। অনাহারে অসুস্থ হয়ে ইতিমধ্যে 7 জন মারা গেছেন। কলকাতায় এই মুহূর্তে 25 হাজার ল্যান্ড লাইন খারাপ। দিন দিন সংখ্যা বাড়ছে। কাজ করার লোক নেই। ভাবছেন জিও তো ব্রড ব্যান্ড নিয়ে আসছে। চিন্তা কি! এই মুহূর্তে বিএসএনএল এর জন্য সরকারকে দিতে হবে মাত্র 14 হাজার কোটি টাকা। তাহলেই 1 লাখ 75 হাজার কর্মী সেইসঙ্গে ঠিকাদার ও শ্রমিক মিলে 5 লাখ পরিবার বাঁচবে। মাত্র 14 হাজার কোটি কেন বললাম ? রিলায়েন্স এর ব্যাংকের কাছে ধার প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা! সিংহভাগ জি ওর জন্য। বুঝছেন ব্যাপার টা? এয়ারটেল এর ধার এক লাখ কোটির ওপর।

লোকের হাতে টাকা নেই। ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে না। এই মুহূর্তে দেশের 30 টি বড় শহরে 12 লাখ 80 হাজার তৈরি ফ্ল্যাট পড়ে আছে। কেনার লোক নেই। শুধু কলকাতায় 20 হাজারের উপর ফ্ল্যাট অবিক্রিত।

গাড়ি বিক্রি এতই কমে গেছে নয়ডার মারুতি গাড়ির কারখানা থেকে শুরু করে জামসেদপুরের টাটা মোটর এর উৎপাদন ক'দিনের জন্য বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কর্মী ছাঁটাই শুরু হচ্ছে। একই অবস্থা বাজাজ এবং হিরো কোম্পানির। কয়েকশো গাড়ির শোরুম ঝাঁপ ফেলে ব্যাংকে জানিয়ে দিয়েছে, আমরা আর এখন টাকা শোধ করতে পারব না। কম্পিউটার এর জন্য অনুসঙ্গ বানানো কোম্পানি mosar বিয়ার এর মালিক আজই দেনার দায়ে গ্রেফতার হয়েছে। ভিডিওকন আগেই বন্ধ। মালিক বেনুগোপাল ধুত আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, হাজার কোটি টাকা ব্যাংকের দেনা তার পক্ষে শোধ করা সম্ভব নয়। বেশ কিছু সিমেন্ট কারখানা বন্ধ। ঝাড়খণ্ডের জয় বালাজি স্টিল কোম্পানি দু দিন হল উৎপাদন বন্ধ করেছে। কারণ ইস্পাত এর বাজার নেই। টাটা স্টিল ও ওই পথ নিতে পারে। গত দুই মাসে শুধু ঝাড়খণ্ড এ বেকার হয়েছে 3 লাখ শ্রমিক। লোকের হাতে টাকা না থাকায় বা থাকলেও খরচ করতে ভয় পাওয়ার ফলে হোটেলে খাওয়া কমেছে। সাবান থেকে বিস্কুট সব কিছুর বিক্রি কমছে। অর্থাৎ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের আয়ের যে অন্যতম উৎস GST সেখানেই বিপুল ঘাটতি দেখা দিতে চলেছে। কী ভাবে এই অবস্থা সামাল দেবে মোদী এন্ড কোং তা জানেন না। 

আজই কাপড় কলের মালিকরা কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়েছেন, বস্ত্র শিল্পের অবস্থা খুব খারাপ। বাজার নেই। কাপড় কলের মধ্যে তিনভাগের একভাগ এই বছরই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। লোকসান করায় মিল মালিকরা ব্যাংকের টাকা শোধ করতে পারছে না। ওদের হিসেবেই তুলো চাষিদের নিয়ে কয়েক কোটি মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে খেয়ে পরে বাঁচে। তাঁদের ভবিষ্যৎ কী কেউ জানে না। বিদেশে রফতানিও কমেছে দ্রুত। তার থেকেও বড় কথা ক মাস বাদেই নতুন তুলো উঠবে। তার বাজার মূল্য 80 হাজার কোটি টাকা। বিক্রির বাজার না থাকলে মিল মালিকরা তা কিনবে কেন? কিংবা আরও সস্তায় কিনবে। ফলে তুলো চাষিদের আত্মহত্যা আরও বাড়বে। এই বছরই আবার ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানার ভোট। রাজনৈতিক দল গুলো তার জন্যে টাকা তুলবে! 

গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো কাশ্মীর। সেখানে কাশ্মীরি জনগণের মৌলিক অধিকার বন্দুকের বেয়নেট এর জোরে কেড়ে নিতে প্রায় 6 লাখ সেনা নিয়োগ করতে হয়েছে। তার বিপুল খরচ। কোনো যুদ্ধের থেকে খুব কম নয়। তা কিন্তু জোগাতে হবে। কারণ কাশ্মীর আগ্নেয়গিরির মত ফুটছে। ফ্যাসিস্টদের পরিয়ে দেওয়া কাজলে আমরা এতটাই অন্ধ, তা দেখতে পাচ্ছি না। আর মোদী-ভক্ত দালাল মিডিয়া দেখাচ্ছে, সব স্বাভাবিক।

পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে একটাই পথ সরকারি সম্পত্তি বিক্রি। লাভের মুখ দেখা বেঙ্গল কেমিক্যাল থেকে অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি সব বিক্রি করে দাও। রেলের টিকেট বিক্রি থেকে IRCTC সব বেসরকারি হাতে তুলে দাও। আরে কিনবে কে? পরিষেবা দেবে কে ? তা জানি না। তিন বার দরপত্র হাঁকার পর  আজ অব্দি কেউ air India কিনলো না!

প্রতিবাদ করলেই UAPA  আছে। আপনাকে দেশদ্রোহী বলে দেগে দেওয়া হবে। কংগ্রেস কার্যত ভোকাট্টা। দুর্নীতিগ্রস্থ বিরোধীদের জন্যে  ED, CBI, IT আছে। তারাও মুখ বুঁজে আছে। অন্য ধান্দা করছে।

এ রাজ্যে আমাদের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য মমতা আছেন। যিনি গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত বিরোধী পক্ষ মানেন না। আট বছর ধরে মানুষ তাই দেখছেন। সিপিএম, কংগ্রেস এতদিন তাই বলছিল। এখন মুকুল থেকে শোভন, তাঁর তৈরি সাধের তৃণমূলের একদা ডান ও বাম হাত আজ বিজেপিতে গিয়ে একই কথা বলছেন। আর আছে কাট মানি। আর আছে দিদিকে বলো। 

বাঙালি, চোখ বন্ধ করে থাকলে কিন্তু প্রলয় বন্ধ হবে না।

প্রসূন আচার্য। সাংবাদিক ও সমাজকর্মী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন