সোমবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৯

মাইকেল ও উৎপল ~ অরিজিৎ গুহ

ম্যাডান থিয়েটার ও নিউ থিয়েটার্সের বহু ও নির্বাক সবাক সিনেমার বিখ্যাত পরিচালক ছিলেন মধু বসু। বিংশ শতাব্দীর তিনের দশকে হিমাংশু রায়ের সাথে জার্মানি গিয়ে বিখ্যাত এমেলকা স্টুডিওতে ক্যামেরার কাজ শিখে দেশে ফিরে এসে বহু নির্বাক ও হিন্দি ও বাংলা দ্বিভাষিক সবাক ছবি পরিচালনা করেছিলেন। বিখ্যাত আলিবাবা সিনেমার পরিচালক ছিলেন উনি। মর্জিনার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তাঁর স্ত্রী সাধনা বসু। এছাড়াও তাঁর নিজের ব্যালের গ্রুপ ছিল 'ক্যালকাটা আর্ট প্লেয়ার্স। ক্যালকাটা আর্ট প্লেয়ার্সই প্রথম ক্ষিরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের আলিবাবা মঞ্চস্থ করে, পরে সেটাই সিনেমা হিসেবে পরিচালনা করেন মধু বসু। 
    মধু বসুর অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন বিখ্যাত কবি সুধীন দত্ত। সুধীন দত্তের ভাঁড়ারে প্রচুর বই ছিল। তাঁর বাবা ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক হীরেন দত্ত। লাইব্রেরির অধিকাংশ বই পিতার সূত্রেই পাওয়া। একদিন মধু বসু সুধীন দত্তের রাসেল স্ট্রীটের ফ্ল্যাটে গিয়ে আড্ডা মারছেন, কথায় কথায় সুধীন দত্ত বলে উঠলেন, মধু তুমি মাইকেলের জীবনী পড়েছ? মধু বসু বললেন পুরো জীবনী পড়া হয় নি, অল্প কিছু কিছু জানি। তখন সুধীন দত্ত নিজের লাইব্রেরি থেকে মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনীর ওপর দুটো বই নিয়ে এসে মধু বসুকে পড়তে দিলেন। বন্ধুদের মধ্যে বই এর আদান প্রদান হয়েই থাকে। 
   বাড়িতে এসে বই পড়া শুরু করলেন। যতই পড়তে থাকেন ততই চমকিত হতে থাকেন। এত নাটকীয় সঙ্ঘাত মূলক জীবনী আর কারো নেই। মনের মধ্যে মাইকেলের জীবনীর চিত্ররূপ দেওয়ার ইচ্ছে জেগে উঠল। পুরো পড়ার পর মাইকেলের জীবনীর চিত্রনাট্যের খসরা লিখতে শুরু করে দিলেন। 
    হাতে সেই সময়ে কোনো কাজ নেই। মাইকেলের জীবনীর জন্য প্রোডিউসারের খোঁজ করতে লাগলেন। কদিনের মধ্যেই প্রোডিউসার পাওয়া গেল। বাংলা ছবি নরেশ মিত্র'র পরিচালনায় 'স্বয়ংসিদ্ধা' তখন খুব হিট করেছিল। সেই ছবির প্রযোজক মণি গুহ মধু বসুকে দিয়ে ছবি করাতে চান। মধু বসু বললেন গল্প একটা আছে, তার চিত্রনাট্যের খসরাও তৈরি আছে, একবার শুনে নিন। মণি গুহ শুনে বললেন, 'সবই ঠিক আছে, কিন্তু জীবনী কি আমাদের দেশে লোকে নেবে?' মধু বসু বললেন 'দেখাই যাক না'।
   শুরু হয়ে গেল মাইকেল ছবির নির্মাণের কাজ। সাল ১৯৪৯। চিত্রনাট্যের খসরা থেকে সম্পূর্ণ চিত্রনাট্য লিখতে হবে। কবি বিমল ঘোষকে ঠিক করা হল চিত্রনাট্য লেখার জন্য। মাইকেলের বাবার ভূমিকায় অহীন্দ্র চৌধুরি এবং মায়ের ভূমিকার সাড়ে চুয়াত্তর খ্যাত মলিনা দেবীকে মনোনিত করা হল। স্ত্রী হেনরিয়েটার ভূমিকায় ঊষা বলে নতুন একটি মেয়েকে নেওয়া হল। বিদ্যাসাগরের ভূমিকায় অবিনাশ দাস, রেভারেন্ড কে এম ব্যানার্জির ভূমিকায় হরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরি নামে দুজন নতুন শিল্পীকে নেওয়া হল। আস্তে আস্তে রঙ্গলাল, গৌর বসাক, রাজনারায়ন বসু, কালীপ্রসন্ন সিংহ প্রভৃতির জন্যও অভিনেতা অভিনেত্রী পাওয়া গেল, কিন্তু পাওয়া গেল না মাইকেলকে। অনেক খোঁজাখুঁজি করা হল, কিন্তু কাউকেই পছন্দ হয় না। সেট ডিজাইন করা হয়ে গেছে, ক্যালকাটা মুভিটোনে শুটিং হবে তার জন্য স্টুডিওর ডেটও নেওয়া হয়ে গেছে, অথচ মাইকেলকে পাওয়া যাচ্ছে না। শেষমেশ প্রযোজক মণি গুহ মধু বসুকে বললেন, মধু বাবু, কাউকেই যখন পাওয়া যাচ্ছে না তখন একবার শিশির বাবুকে বললে হয় না?'
মধু বসু অবাক হয়ে তাকালেন মণি গুহ'র দিকে। বললেন, 'কি বলছেন! শিশির ভাদুড়ি এই বয়সে এসে করবেন মাইকেলে অভিনয়? আমি মাইকেলকে দেখাব হিন্দু স্কুলের ছাত্র, শিশির বাবুকে কিভাবে ওই ভূমিকায় মানাবে? মঞ্চে যা মানায় সিনেমায় তা মানায় না। আমি এখনো হাল ছাড়ি নি, ঠিক পেয়ে যাব কাউকে না কাউকে।'
    এর কদিন বাদে একটি ছেলে দেখা করতে এল মধু বসুর সাথে। ছেলেটির নাম জ্যোতি সেন। ইচ্ছে মাইকেলে কোনো একটা ভূমিকায় অভিনয় করার। জ্যোতি সেনের সাথে আরেকটি ছেলে এসে দাঁড়িয়েছিল মধু বসুর সামনে। ছেলেটির চোখমুখ, ব্যক্তিত্ব, চলাফেরা সহজেই আকৃষ্ট করল মধু বসুকে। ছেলেটি মধু বসুকে নমষ্কার করে পরিষ্কার ইংরিজিতে বলে উঠল মাফ করবেন মিঃ বোস, আমি আপনার খুব বড় একজন ভক্ত। সেন যখন বলল আপনার কাছে আসছে তখন আমি আপনার সাথে আলাপ করার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমি নিজেও অভিনয় করি থিয়েটারে, তবে সে সবই ইংরিজি থিয়েটার। মূলত শেক্সপিয়ারের নাটকই করে থাকি।
   মধু বসু কথা বলার সাথে সাথে আকৃষ্ট হচ্ছিলেন বেশি বেশি করে। ইংরিজির উচ্চারণ এত স্পষ্ট যা সাধারণত কোনও বাঙালি ছেলেদের মধ্যে পাওয়া যায় না। কথায় কথায় আরো জানা গেল ছেলেটি সম্প্রতি কলেজ ছেড়ে স্টেটসম্যান পত্রিকার এডিটোরিয়ালে জয়েন করেছে। মধু বসু জিজ্ঞাসা করলেন তুমি বাঙালির ছেলে অথচ ইংরিজিতে কথা বলো? বাংলা যা কয়েকটা বলছ তাও ভাঙা ভাঙা, জড়তা রয়েছে তার মধ্যে। ছেলেটি তখন বলল কলেজে যখন ছিলাম তখন আমার বন্ধুবান্ধব সবাই ছিল অবাঙালি। ওদের সাথেই মঞ্চে নাটক করেছি মূলত ইংরিজি নাটক আর কলেজ থেকে বেরিয়েও ওদের সাথেই রয়েছি। তাই বাংলাটা আমার ঠিক বলা হয়ে ওঠে না। ছেলেটি তার নিজের ইচ্ছেপ্রকাশ করে জানাল যে মঞ্চে অভিনয় করলেও তার একবার সিনেমার পর্দায় অভিনয় করার ইচ্ছে রয়েছে। সে নিজেকে পরীক্ষা করে দেখতে চায় তার মধ্যে ক্যামেরা কনসাসনেস আছে কিনা।
   মধু বসু বুঝলেন, হলে একে দিয়েই হবে। ছেলেটির নাক চোখ মুখের ঔজ্জ্বল্য আর ইংরিজি উচ্চারণ যা তাতে ছেলেটি মাইকেলের ভূমিকায় একদম যেন পার্ফেক্ট। কিন্তু একটাই খটকা। ছেলেটির বাংলা উচ্চারণ। তাও মধু বসু তাকে বললেন পরদিন আসতে।
     পরদিন আসার পর মধু বসু তাকে বললেন, 'তোমাকে আমি মাইকেলের ভূমিকা দিতে চাই।' ছেলেটি অবাক হয়ে বলল কিন্তু শুটিং তো আর মাত্র পনেরো দিন বাদে শুরু হবে! এর মাঝে সংলাপ যা বেশিরভাগই অমিত্রাক্ষর ছন্দে তা কি আমি পারব? মধু বসু বললেন আমার ওপর ছেড়ে দাও ব্যাপারটা। তুমি শুধু অভিনয়ের ওপর জোর দাও।
   এরপর থেকে শুরু হল রিহার্সাল। দৈনিক ৫-৬ ঘন্টা ধরে চলত রিহার্সাল। স্টেটসম্যানের অফিস ছুটি হওয়ার পর বিকেল ৫ টা থেকে শুরু করে কোনো কোনোদিন রাত বারোটা একটাও বেজে যেত রিহার্সাল করতে গিয়ে। শুটিং শুরু হওয়ার দু একদিন আগেই ছেলেটি পুরোপুরি তুলে নিল মাইকেলের সংলাপ অমিত্রাক্ষর ছন্দ সহ।
  শুটিং শুরু হওয়ার পর ছেলেটিকে পরীক্ষা করার জন্য মধু বসু তার প্রথম দিনের শুটিং ফেললেন তখনকার দিনের নামকরা অভিনেত্রী মলিনা দেবীর সাথে যিনি মাইকেলে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করছিলেন। অবাক হয়ে মধু বসু লক্ষ্য করলেন নামকরা অভিনেত্রীর উলটোদিকে দাপটের সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করে গেল ছেলেটি। সেটের সবাই নবাগতকে দেখে তার অভিনয় দেখে খুবই খুশি। 
   এরপরে কোনো একদিন শুটিং এ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। মাইকেল জ্বরে পড়ে আছেন আর জ্বরের ঘোরে উত্তেজিতভাবে আবৃত্তি করে চলেছেন, স্ত্রী হেনরিয়েটা মাইকেলের ঘাড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সংলাপ বলছেন। একটা বড় দৃশ্য যেখানে মাইকেল জ্বরের ঘোরে কথা বলে যাবেন। দৃশ্যের শুটিং করতে গিয়ে দেখলেন সেট আলো সব রেডি, ক্যামেরাম্যান ক্যামেরা নিয়েও তৈরি, কিন্তু মাইকেলকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। খোঁজ খোঁজ শুরু হল, মেক আপ রুম, ক্যান্টিন, বাথরুম কোথাও নেই। শেষে অন্য একটা ফ্লোরের এক কোণায় পাওয়া গেল সে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে রয়েছে। মিধু বসু তার কাছে গিয়ে বললেন, কি ব্যাপার? এখানে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছ? তোমার শরীর খারাপ নাকি? তাহলে শুটিং প্যাক আপ করে দিচ্ছি। ছেলেটি তখন তাড়াতাড়ি খাট ছেড়ে উঠে বলল, না না, আসলে জ্বরের ঘোরের দৃশ্যের শুটিং তো, তাই একটু মুডে আসার চেষ্টা করছিলাম।
   মধু বসু স্বগোতক্তি করলেন, শুটিং এর বাকি সবাই যখন হাসি ঠাট্টায় মেতে রয়েছে, তখন কাজের প্রতি কতটা নিষ্ঠা থাকলে নিজের চরিত্রের মধ্যে সব সময় ডুবে থাকা যায় তা একে দেখে শিখতে পারে সবাই। সেদিন থেকেই উনি বুঝে গেছিলেন ছেলেটি একদিন বিরাট বড় শিল্পী হবে।
    মাইকেল যথারীতি রিলিজ করল। দর্শকদের মন জিতে নিল মাইকেলের ভূমিকায় প্রথমবার সিনেমায় অভিনয় করা উৎপল দত্ত।

     নিজেকে উনি বলতেন আমি শিল্পী নই, প্রোপাগান্ডিস্ট। কিন্তু প্রোপাগান্ডিস্ট হওয়ার জন্যও শিল্পকে গভীরভাবে আত্তীকরণ করতে হয়। শিল্পের মধ্যে থাকতে হয়। যেটা উনি পেরেছিলেন। ১৯ শে আগস্ট তাঁর ছাব্বিশ তম প্রয়াণ বার্ষিকী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন