রবিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৯

এক যে ছিল ফেরিওয়ালা ~ শ্যমলেন্দু সিনহা

তখন সবে গ্রাজুয়েট হয়েছি। না না রেজাল্ট বেরোয় নি তখনো। সে কালে অনেকদেরী করে বেরোতো রেজাল্ট। কিন্তু আমার তো অত দেরী করার উপায় নেই। তখনই আমার তিন বছরের পুরোনো প্রেমটা পেকে গেছে ফোঁড়ার মত। টনটনে ব্যাথা। যে কোনো দিন একটু অসতর্ক হলেই ফেটে যাবে ব্যথার চূড়োটা। মানে সানাই বাজিয়ে কোনো গোঁফ ওয়ালা দামড়া সেরে ফেলবে ফুলশয্যা আমার ফোঁড়ার, না না প্রেমিকার সাথে। যে কোনো একটা চাকরী চাই তখন।
যাতে ওই রহস্যময়ী, বাড়ীতে বলতে পারে আর একটু অপেক্ষা করতে চাই আমরা। বেকার প্রেমিক অনেকটা তখনকার দিনে, আজকালকার দিনের এইচ আই ভি পজিটিভের মত। কোনো চারিত্রিক দোষ নাও থাকতে পারে, তবে মেয়ের বাবার চোখে, কোনো রকম সন্দেহেরই উর্দ্ধে নয়। ওই পেঁয়াজ খাওয়া থেকে শুরু করে, আর কি....। একটা ৫০০ টাকার চাকরী করলেও, লড়াকু, সভ্য, ভদ্র, আর কিছু না হোক, ধর্মের ষাড় তো নয়। এইসব সাতপাঁচ ভেবেই পরীক্ষা দিয়েই খুঁজছিলাম কিছু। তখনই এক পাড়ার জেঠামশাই বললেন, সেলসের কাজ করবি? ওঁনাদের কলকাতায় একটা চালু ওষুধের দোকান ছিল। বললেন মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ এর কাজ। এক সেকেন্ডেরও কম সময়েই দিলাম উত্তর, করবো।

সব্যসাচী সেদিন ওর ডাক্তারী জীবনের প্রথম দিকের কথা লিখেছে। পড়তে পঢতেই মনে পড়ে গেল আমার চাকরী জীবনের প্রথম দিকের এই গল্পটা। ওরটা ভদ্রসভ্য গ্ল্যামারাস ডাক্তারী, আর আমারটা ডাক্তারদের সাধাসাধি করে তাঁদের দিয়ে ওষুধ বিক্রি করতে চাওয়া, এক নবীন ফেরিওয়ালার গল্প। হোকগে তা লজ্জার রঙে লাল। অপমানের ব্যথায় নীল। ঘামে আর বৃষ্টিতে ভেজা এক যুবকের গল্প। জীবনের রানওয়েতে উড়ানের মৃদুগতির যাত্রাশুরু। তবুও বলতেই হবে, পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, আজকের আমার বুকের গভীরে লুকিয়ে আছে, সদ্য কৈশোর পেরোনো প্রেমিক ফেরিওয়ালাটাও। লাজুক, মুখচোরা মফস্বলের একটা ছেলের রাত্রির অন্ধকারের গল্প। থ্যাঙ্ক ইউ সব্য, আমার নিদ্রাবেলাকে জাগিয়ে দেওয়ার জন্য।
পরেরদিনই চলে গেলাম কলকাতা, জেঠামশাই এর ওষুধের দোকানে। ওখান থেকে বাগরী মার্কেটের গলির গলি, তস্য গলির শেষে একটা ঘরে। বাগরী মার্কেটের ওই বাড়ীটায় যাদের যাতায়াত আছে তাঁরা জানেন, ওটা লক্ষ্ণৌ এর ভুলভুলাইয়ার ছোটভাই এটা। এই বাড়ীর একটা ঘরেই ওষুধের কোম্পানী। দুটো তাঁদের ওষুধ। কাশির আর হজমের। সিরাপ। কোনো ট্রেনিং নেই। মালিক বসেই ছিলেন ঘরে। আর আমার মত কিছু ধর্মের ষাড় না হতে চাওয়া ছেলে। কে জানে ওদেরও একটা ভয় আছে নাকি, অন্য লোকের দুঃস্বপ্নের ফুলশয্যার! তা দেখলাম মালিক খুব অমায়িক লোক। বললেন দেখুন দুটো ওষুধ আমরা বানাই। বাঙ্গালীর প্রিয় রোগ কাশির আর হজমের গন্ডোগোলের। ডাক্তারদের একদম জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। ওরা কাশী আর হজম নিয়ে মোটা মোটা বই পড়েছে। আপনার কাজ ওষুধ বেচা। সোজাসুজি বেচা না। ডাক্তার আপনার ওষুধের নাম প্রেসক্রিপশনে লিখবে, রোগী দোকানে গিয়ে আমাদের ওষুধ কিনবে। আমার লাভ হবে। আপনি মাইনে পাবেন। আপনার কাজ প্রথম কদিন এলাকায় ঘুরে ঘুরে ডাক্তারের নাম যোগাড় করা, যাদের বেশী রুগী। তারপর দেখা সেই রুগীরা কোন দোকান থেকে ওষুধ কেনে। সেই ওষুধের দোকানে আমাদের ওষুধ রাখতে হবে। ডাক্তার লিখলে দোকানদারের বাপও আমাদের ওষুধ রাখবে। আমাদের করণীয় নাকি খুব সহজ!!! ডাক্তারকে দিয়ে আমার ওষুধটা প্রেসক্রাইব করানো। নিজেকে প্রেমিক হিসেবে প্রমাণ দেওয়ার জন্য এটুকু তো করতেই হবে।

তবে এটুকু যে কেমন কাজ, টের পেলাম ধীরে ধীরে। বুঝলাম জীবনটা শালা কেবল মান্না দের গান আর সুনীল গাঙ্গুলীর কবিতা না। এই দুটো প্রিয় লোক আমার পরম শত্রু হয়ে দাঁড়ালো। এই দুটো লোকের জন্যই আমার জঘন্য রেজাল্ট। এঁদের জন্যই আমি এঁচোড়ে পাকা। এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি?  মাঝখানে নদীরূপী জীবনে, হাবুডুবু খায় কেরিয়ার। ডাক্তাররা কত পড়াশুনো করে ডাক্তারীতে চান্স পেয়েছে। তারপর রুগী তাঁদের পয়সা দিয়ে দেখায়। ভালো ওষুধ দিয়ে তাড়াতাড়ি সুস্থ করাই তাঁদের কাজ।গতকাল গজানো "জগাছা ফার্মাসিউটিকালস" এর কাশির আর হজমের ওষুধ তাঁরা প্রেসক্রিপশনে লিখবে কেনো? এটা তাঁদের ক্যারিয়ারের প্রশ্ন। রোগীর স্বাস্থ্যের প্রশ্ন। তিনি তো সবসময় ভালো কোম্পানির পরীক্ষীত ওষুধটাই খেতে বলবেন রোগীকে। তবে, এসব তো অনেক পরের কথা। প্রথম দিন ভারী চামড়ার ব্যাগটা নিয়ে বেড়িয়েছি সকালে। ধোপদুরস্ত জামা কাপড় পরে। আর দেখতেও তখন এমন জলহস্তীর মত ছিলাম না। কিন্তু আমার ঠাঁটবাট দেখে কোনো শালা জানতেই পারেনি, আমার মাইনে কেবল আড়াইশো টাকা। কোনো যাতায়াত ভাড়া নেই। চকচকে ব্যাগটাই দেখছে সবাই। কাচের বোতলে ভরা কাশির আর হজমের সিরাপের বোতলের ভারে আমার কাঁধ যে ব্যথা করে রাতে জানেই না কেউ। আমি খান্নার মোড় থেকে হেঁটে শিয়ালদা, বেলেঘাটা ঘুরে ফিরে আসি, ফ্যানহীন মেঝের পাতলা বিছানায় শুই জানেই না কেউ। রিক্সাওয়ালা আর ঠেলাওয়ালাদের পাশে বসে বড়রাস্তার ধারে একটা ছোট ঘরে বসে আমি চারটে রুটি খাই আাচার দিয়ে, একটাকায়। আমার উপার্জনের ডিনার। সকালে চিড়ে আর চিনি জল দিয়ে মেখে খাই। দুপুরে চারটাকায় ভাত ডাল তরকারী। রাত্তিরে শুই পরেশনাথের মন্দিরের পাশে  অনুকুল ঠাকুরের মন্দির আছে, পাঁচতলা বাড়ী। তার উপরের তলার একটা হলঘরে। সাত আটজন পাশাপাশি । বিনাপয়সায় থাকা। এক ভক্তদাদা খুঁজে দিয়েছিল ডেরা। তবে বিশ্বাস করুন আমি একটুও মহান সাজার জন্য বলিনি এসব। আদতে এগুলো যে কোনো কষ্ট বা জীবনযুদ্ধ জানতামই না। আমার খালি মনে হ'ত ভালো কিছু চাকরী পাওয়ার আগের দিনগুলোও বেকার থাকা যাবে না। আর মফস্বলের বাড়ী থেকে রোজ দুবেলা এসে তো ফেরিওয়ালার কাজ করা যায় না। একটা কথা মনে পড়ে কেবল। প্রথম পূজোয় এক মাসের মাইনের কিছু বেশীটাকা বোনাস পেয়েছিলাম প্রথম বছর। একটা মায়ের জন্য শাড়ী আর একটা প্রেমিকার। মায়ের শাড়ীটাও প্রেমিকাই দিল পছন্দ করে। ১৭০ টাকা দাম। নিজেরটা ১৬০ টাকা। আর ভাইয়ের একটা জামার কাপড়। সব টাকা শেষ। এত ভালো পুজোর বাজার আর করিনি জীবনে। আজ প্রায় চল্লিশ বছর পেরিয়ে শুনি বউয়ের মুখে, অত ভালো শাড়ী নাকি আর সে পায়নি কখনো। আজ জানি আমি টাকা কত কিছু পারে। আজ এও জানি আমি টাকা সবকিছু পারেনা কখনো।

গুমোট গরমে ঘুম ভেঙ্গে যায় কোনো কোনো দিন মাঝরাতে। আমার শত্রুর কবিতা মনে পড়ে যায়। যার পাগলামীতে আমর লেখাপড়াই হ'ল না ভালো। সেই সুনীল গাঙ্গুলীর কবিতা। 

"নীরা তুমি অমন সুন্দর মুখে তিনশো জানলা
খুলে হেসেছিলে, দিগন্তের মত কালো বাঁকা টিপ,
চোখে কাজল ছিল কি? না ছিল না
বাসস্টপে তিনমিনিট, অথচ তোমায় কাল স্বপ্নে বহুক্ষণ...."

মাঝরাতে বৃষ্টি নামতো কোনো কোনো দিন, বৃষ্টির ছাঁটে ঘুম ভেঙ্গে যেত বারোয়ারী ঘরে। খানিক গুজগুজ ফিসফাস নড়াচড়া সেরে আমার এপাশ ওপাশের প্রতিবেশীরা আবার ঘুমাতো। আমার চোখের নীচে জলন্ত বৃষ্টির ফোঁটা আমায় ঘুমাতে দিত না। বহুদূরে থাকা একজনের জন্য মনে আসত..... মনে পড়তো কয়েকটা লাইন, 

"তুমি ভয় পেয়ো না, তুমি ঘুমোও, আমি বহুদূরে আছি
আমার ভয়ঙ্কর হাত তোমাকে ছোঁবে না, এই মধ্যরাত্রে
আমার অসম্ভব জেগে ওঠা, উষ্ণতা, তীব্র আকাঙ্খা ও
চাপা আর্তরব তোমাকে ভয় দেখাবে না,
আমার সম্পূর্ণ আবেগ
শুধু মোমবাতির আলোর মত ভদ্র হীম,
শব্দ ও অক্ষরের কবিতায়
তোমার শিয়রের কাছে যাবে।  '

একদিন গেছি, এক ডাক্তারের চেম্বারে, খুব ভীড়, বসে আছি তো বসেই আছি, খিদেও পেয়েছে বেজায়। আমার আবার ছোটবেলা থেকেই খিদে পেলে অভিমানী হয়ে যাই। সে যাক, অবশেষে ডাক্তারবাবুর ঘরে গেলাম। অসীম অবজ্ঞায় আমার সিরাপ দুটো দেখলেন। আমি বললাম যদি কয়েকটা প্রেসক্রাইব করেন ভালো হয়। রেগে গেলেন। বললেন কেন লিখবো? আপনার এই এক্সপেকটোরেন্টার দাম ছ'টাকা পঞ্চাশ। বেনাড্রিলের দাম ছটাকা। নামী কোম্পানিরটা না লিখে আপনারটা কেন লিখবো? এখানে ভিজিট দিয়ে যারা দেখাতে আসে আমি তাদের নামী কোম্পানীর ওষুধই প্রেসক্রাইব করবো। আমার বোধহয় খিদেতে মাথার ঠিক ছিল না। বললাম স্যার আপনারা প্রেসক্রাইব করেই তো বেনাড্রিলকে বা তাঁর কোম্পানীকে বিখ্যাত করেছেন। কে জানে ওনারও বোধহয় খিদে পেয়েছিল। মুখঝামটা দিয়ে বের করে দিলেন ঘর থেকে। কত ধাক্কা যে খেয়েছি সে সময়। মনখারাপ হ'ত। শনিবারে বাগড়ী মার্কেটে মালিকের সাথে মিটিং। মাখন মাখানো পাউরুটি, কলা, আর মিষ্টি ছিল বাঁধা টিফিন। আর সাথে মালিকের হুল ফোটানো কথা। আমরা সব অকর্মণ্য, ফাঁকিবাজ ইত্যাদি। সব টিফিন বিস্বাদ হয়ে যেত।

কিছু ডাক্তার খুব ভালো ব্যবহার করতেন। বাড়ীর গল্প করতেন সময় থাকলে। আর এই একবছরের কিছু বেশী সময় ধরে যা শিখেছিলাম, তা অমূল্য। ফেরিওয়ালা হওয়ার মত বিশ্ববিদ্যালয় আর নেই। আপনি অপমানিত হচ্ছেন, ধাক্কা খাচ্ছেন, আবার আশায় বুক বেঁধে, আপনার পশরার বোঝাটাকে ক্লান্ত কাঁধে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, পথ হাঁটছেন। সব ব্যথা বুকে চেপে পরের দোকানদারের কাছে গিয়ে হাসিমুখে দাঁড়াচ্ছেন। এটা যে কি থ্রিলিং, কি চ্যালেঞ্জিং, বোঝানো অসম্ভব। নিজের ভাঙ্গাচোরা টুকরোগুলোকে জোড়া লাগিয়ে এগিয়ে যাওয়া। আজ মনে হয় ফিরিই তো করছি আমরা সবাই। বুকে পিঠে বাঁধা অদৃশ্য পিটারা। হয়ত জ্ঞানের, অথবা প্রতিভার, খুব দামী পশরা হয় যদি। কেবল কিছু মানুষের ঝুড়িটা দেখা যায়, এটাই তফাত। 

আর এই যে বারবার নিজেকে মেলে ধরা ক্রেতার সামনে সোজাসুজি। এক শিক্ষা দিয়ে যায় জীবনের। নিরহংকার হও, নত হও, হেরেও যাও বারবার যদি, হেরো হোয়ো না। হয়ত এর পরের মানুষ, অথবা তার পরের মানুষ, কিম্বা নিশ্চিত তার পরের মানুষটা তোমায় খুশীর খবর দেবে। আলো আছে, নিশ্চই আছে, সুড়ঙ্গের শেষে।

আজ বহুবছর বাদে, আমার টেবিলের ওপারে ওরা এসে বসে। ঘামে বা বৃষ্টিতে ভেজা নবীন যুবক। ওরা বেচতে বেড়িয়েছে। অফিসের নানা দরকারী জিনিস। আমি ওদের চোখে, ভাষায়, ওদের ক্লান্তিতে, হতাশায়, শুকনো হাসিতে,  অবিরাম হেঁটে চলা পায়ের ব্যথায় আর বোঝাটানা কাঁধের ব্যথায়, আমাকেই খুঁজে পাই। যদি কিনতে নাও পারি কিছু, জলের বোতল আর চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে, ছু্ঁতে চাই ওদের লড়াই। ওদেরও বুকের গভীরে হয়ত জেগে আছে নিজস্ব 'নীরা'রা ।

ওদের ফিরে যাওয়া শরীরের দিকে চেয়ে অস্ফুটে বলি। প্রতিটা পদক্ষেপে তোরা অজান্তেই পেরোচ্ছিস অন্ধকার। আলোটা আসছে এগিয়ে ধীরে আর নিশ্চিতভাবে। আজকের এই ব্যথা এই অপমান, তোদের হৃদয়ে বাঁচবে, কোহিনূর হয়ে, সারাজীবন ধরে।

তারপর ভালোবাসার এই মায়াবী পৃথিবীতে, বহুবছর বাদে, পাশে বসে তার, বলিস শেষ পংক্তি দুটো,

"নীরা শুধু তোমার কাছে এসেই বুঝি
সময় আজো থেমে আছে"


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন