বৃহস্পতিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২০

বিষ্ণুপুর মল্লভূম ~ অরিজিৎ গুহ

শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বাংলায় যে দেড়শ বছরের মাৎসান্যায় চলেছিল তার অবসান হয় গৌড়ে পাল বংশের প্রথম রাজা গোপালের সিংহাসন লাভের পর। অরাজকতার শেষ হয়ে প্রায় পুরো উত্তর ভারত আর পূর্ব ভারত জুড়ে এক শক্তিশালি রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হয় গোপালের হাত ধরে। তবে এই মাৎসান্যায়ের সুবাদে তৎকালীন বাংলার বেশ কিছু অঞ্চলে কিছু আঞ্চলিক রাজার উত্থান ঘটে। বেশিরভাগই ছিল স্থানীয় উপজাতি গোষ্ঠির নেতা যারা পরে নিজেদের রাজা বলে ঘোষণা করেন।
    ৬৯৪ খৃষ্টাব্দে এরকমই এক উপজাতি নেতা 'আদি মল্ল' মল্লভূম অঞ্চলের অর্থাৎ এখনকার বাকুঁড়া বিষ্ণুপুর অঞ্চলের রাজা হয়ে ওঠেন। মূলত জঙ্গলে ঘেরা অঞ্চল এবং সেখানকার মল জাতিদের থেকে মল্লভূম নামটি এসেছে বলে মনে করা হয়ে থাকে। আরেকটি মতে সংস্কৃতে মল্ল মানে যোদ্ধা বা যারা খালি হাতে যুদ্ধ করে। সেই মল্লযোদ্ধাদের থেকেই মল্ল নামটি এসেছে বলেও অনেকে মনে করে থাকেন। অর্থাৎ মল্ল রাজারা কোনো মল্লযোদ্ধার বংশধর বলে মনে করা হয়।
    বিষ্ণুপুর অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধার জন্য বাংলা তথা ভারতের নানা রাজনৈতিক উথালপাথাল সত্ত্বেও জঙ্গলে ঘেরা এই অঞ্চলে মল্লরাজারা মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই শাসন করে গেছেন। খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে ব্রিটিশ শাসন অব্দি মল্লরাজাদের সুদীর্ঘ সময়কাল। মল্ল রাজা হাম্বির মল্ল বা বীর হাম্বির মল্লের সময় থেকে বিষ্ণুপুরের স্থাপত্য ও শিল্প সংস্কৃতির উত্থান বলা যেতে পারে। তিনি ছিলেন আকবরের সমসাময়িক। তাঁর সময়েই তৈরি হয় বিষ্ণুপুরের প্রসিদ্ধ রাসমঞ্চ।
 
    ১৬০০ খৃষ্টাব্দে তৈরি এই রাসমঞ্চের স্থাপত্যে মিশরীয় ইসলামিক আর বাংলার নিজস্ব স্থাপত্য রীতির পরিচয় পাওয়া যায়। মূল মঞ্চের একদম ওপরের অংশ পিরামিডাকৃতি। এখানে মিশরীয় স্থাপত্য রীতির ছাপ রয়েছে। এরপরের অংশ বাংলার কুঁড়েঘরের স্থাপত্যের অনুকরণে আর একদম নিচের অংশের যে আর্চ বা খিলান রয়েছে তা ইসলামিক স্থাপত্য রীতি অনুযায়ী। প্রসঙ্গত হাম্বির মল্ল বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করে মল্লভূমে বৈষ্ণব ধর্মের প্রসার ঘটান। মদন মোহনের উপাসনা তিনিই প্রচলন করেন মল্লভূমে। সেখান থেকেই মল্লভূমের নাম বিষ্ণুপুর হয়েছে। বিষ্ণুর পুর অর্থাৎ ঘর। রাস উৎসবে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি এই রাসমঞ্চে নিয়ে আসা হত। সেখানে একশ আটটি কুঠুরিতে একশ আট রকমের মূর্তি থাকত।  সামনের খোলা প্রান্তরে অর্থাৎ নাটমন্দিরে ঢোল বাজিয়ে কীর্তন করত কীর্তনীয়ার দল। সারা মল্লভূম রাস উৎসবে তখন কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা আর জনতার ঢল এসে মিশত এই রাসমঞ্চে।

     হাম্বির মল্লের সময় থেকে মল্লভূম পরিণত হচ্ছে বিষ্ণুপুরে। স্থাপত্যের কীর্তি তৈরি হচ্ছে তাঁর সময় থেকে আগেই বলেছি, তবে রঘুনাথ সিংহের রাজত্বকালে (১৬২৬-১৬৫৬) বিষ্ণুপুরের ইতিহাসে স্বর্ণালী সময় বলা যেতে পারে। মুর্শিদাবাদের নবাব রঘুনাথ সিংহকে সিংহ উপাধি দেন। প্রথম মল্ল রাজা হিসেবে তিনি এই উপাধি লাভ করেন। কথিত আছে বিষ্ণুপুর সেই সময়ে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা পরিচিত শহর ছিল। এমনকি ইন্দ্রের প্রাসাদকেও নাকি বিষ্ণুপুর হার মানাত।
    তাঁর সময়কালে বিষ্ণুপুর স্থাপত্যের দিক থেকে সর্বাপেক্ষা পরিচিতি লাভ করে। আজকের বিষ্ণুপুরের যে কটি মন্দির দেখা যায় তার বেশিরভাগই তাঁর সময়ে তৈরি।

    গোকুলচাঁদ মন্দির জয়পুরের গোকুলনগর গ্রামে ১৬৪৩ খৃষ্টাব্দে স্থাপিত হয় মহারাজ রঘুনাথ সিংহের আমলে। এই পঞ্চরত্ন মন্দিরটি বাঁকুড়া জেলার সব থেকে বড় প্রস্তর নির্মিত মন্দির।
   ওই একই বছরেই রঘুনাথ সিংহ শ্যামরায় মন্দির স্থাপন করেন। প্রতিটি মন্দিরের মত এই মন্দিরেও রামায়ন মহাভার‍তের বিভিন্ন দৃশ্য খোদাই করা রয়েছে টেরাকোটার ফলকে। তবে এখানে একটি খুব ইন্টারেস্টিং জিনিস রয়েছে। রঘুনাথ সিংহ খুবই জনপ্রিয় রাজা ছিলেন। তাঁর সাথে এমনকি মুঘল রাজপরিবারেরও বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। শাহজাহান সেই সময়ে মুঘল বাদশাহ। শ্যামরাই মন্দিরের নানান রকম টেরাকোটার ফলকের মধ্যে একটা ফলকে পাওয়া যায় যেখানে একজন উষ্ণীষ পরিহিত রাজা বাঁ হাতে বাজপাখি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। শাহজাহানের পোষা বাজপাখি ছিল সবাই জানে। মনে করা হয় রঘুনাথ সিংহ শাহজাহানের প্রতি অনুরাগ বশত ওই ফলকটি খোদাই করান। অর্থাৎ শ্যামরায়ের মন্দিরগাত্রে রামায়ন মহাভার‍তের বিভিন্ন ফলকের সাথে শাহজাহানকে চিত্রিত করা ফলকও পাওয়া যায়।

   ১৬৫৫ সালে তৈরি জোড় বাংলা স্থাপত্য রীতিতে তৈরি কেষ্ট রাই মন্দির এক বিশেষ স্থাপত্য রীতির পরিচয় রাখে। জোড় বাংলা মন্দিরের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি দুটি চালার সমাহারে তৈরি হয়। একটা অংশ দালান হিসেবে আরেকটা অংশটি মন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অধিকতর স্থায়িত্বের জন্য দুটি দোচালা পাশাপাশি জোড়া থাকে। কালনার সিদ্ধেশ্বরী কালিমন্দির গড়পঞ্চকোটের জোড় বাংলা মন্দির হুগলির গুপ্তিপাড়ার শ্রীচৈতন্য মন্দির জোড় বাংলা মন্দিরের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এটিও রঘুনাথ সিংহ দেব এর রাজত্বকালে তৈরি।

     মহারাজ দুর্জন সিংহ দেবের আমলে তৈরি মদনমোহন মন্দির একটি একচালা মন্দির। এই মন্দিরে মদনমোহনের যে মূর্তি আছে কথিত রয়েছে সেই মূর্তি নাকি চৈতন্য মহাপ্রভু দর্শন করে গেছিলেন। সেই মূর্তি তখন ছিল কোনো এক গ্রামে। মূর্তির এতই খ্যাতি ছিল যার জন্য চৈতন্যদেবও ছুটে আসেন সেই টানে। এরপর মহারাজা দুর্জন সিংহ দেব সেই মূর্তি এনে স্থাপন করেন মদনমোহন মন্দিরে।
    রঘুজি ভোঁসলের সেনাপতি ভাস্কর রাও এর নেতৃত্বে মারাঠা বর্গীরা যখন আক্রমণ করে বিষ্ণুপুর তখন তৎকালীন মল্ল রাজা গোপাল সিংহ দেব শরনাপন্ন হন মদনমোহনের। প্রত্যেক প্রজাকে নির্দেশ দেন দুর্গের মধ্যে মদনমোহনের নাম করার জন্য। কথিত আছে সেই মদনমোহনের কৃপাতেই ভাস্কর রাও আর দুর্গ প্রাকার ভেদ করতে পারেন নি। কয়েকদিনের মধ্যেই বর্গীরা বিষ্ণুপুর ছেড়ে চলে যায়। যাই হোক, সেবার আসলে মুর্শিদাবাদের নবাব আলিবর্দি খাঁ বীর বিক্রমে লড়াই করে বাংলা থেকে বর্গী আক্রমণ প্রতিহত করেন। সেই কারণেই বিষ্ণুপুরও রক্ষা পায় বর্গী আক্রমণের হাত থেকে।
   ১৮২০ সালে এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে আদি মন্দিরটি ভেঙে যাওয়ার পরে বর্তমান মন্দিরটি তৈরি করা হয়।
শেষ মল্লরাজা কালিপদ সিংহ ঠাকুর ১৯৮৩ সালে মারা যাওয়ার পর থেকে আর কেউ রাজা উপাধি পান নি। তবে রাজবংশ এখনো রয়েছে। তারা থাকেন বিষ্ণুপুরের প্রাচীন দুর্গা মন্দিরের পিছনের এক বাড়িতে। পুজোর দেখাশোনা এখনো তাঁরাই করে থাকেন। রাজা বা রাজত্ব না থাকলেও ঐতিহ্য পরম্পরা সবই থেকে গেছে এখনো। পুজোর শুরু হয় দলমাদল কামান থেকে তোপধ্বনি দিয়ে। এটাই এই পুজোর ঐতিহ্য।

Escape Thrill এর সৌজন্যে আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল জয়পুরের জঙ্গল। সেখান থেকেই একটু এগিয়ে গোকুলনগর গ্রামে গোকুলচাঁদ মন্দির। এরপর দিন বিষ্ণুপুরের মন্দির দেখে সোজা চলে যাওয়া মুকুটমনিপুর।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন