বৃহস্পতিবার, ১ অক্টোবর, ২০২০

যোগীর রাজ্যে নিম্ন বর্ণের মানুষ ~ সুশোভন পাত্র

- মর্নিং ওয়াকে কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকা উত্তরপ্রদেশের দাদা বললেন 'যোগীর রাজ্যে মেজরিটি লোকজন ভালোই আছে। দলিতরা বরং সরকারের দেওয়া চাল-ডাল ফ্রিতে নিয়ে অন্ন ধ্বংস করছে। রেপ-টেপ তো চলতা রেহেগা ভাই। আসলি মুদ্দা হ্যা ৩৭০ কো হাটানা অউর এনআরসি লে আনা।' 
 
- কলেজে, গণিতে স্নাতকোত্তর বিভাগের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট বন্ধু ফোনে বলল 'মেয়েদের সাবধানে চলাফেরা করাই ভালো। পোশাক আর আচার-আচরণে শালীনতা বজায় রাখাই ভালো। আফটার অল, মেয়ে তো। তাই না?'    

- সাড়ে সাত বছরের বিহুর ৯টার আগে ঘুম ভাঙ্গে না। ব্যতিক্রম মহালয়া। বিহু কে জিজ্ঞাসা করলাম, মহালয়া দেখে কি কি শিখলি? অনেক খুচরো কথার নির্যাস টেনে বলল 'জানো মেসো, কালো মানে বদ লোক, কালো মানে মহিষাসুর। ফর্সা মানে মা দুর্গা। ফর্সা মানে ভালো।' 

- কেরালার হাতির মৃত্যুতে বিহ্বল হয়ে পাড়া মাথায় তোলা আমার দুঃসম্পর্কের আত্মীয় গত তিনদিন হোয়াটস-অ্যাপ গ্রুপে নিখোঁজ। দলিত কিশোরীর ধর্ষণ, খুন কিম্বা রাতের অন্ধকারে তাঁর পরিবারের অসম্মতি তে, অনুপস্থিতি তে পুলিশ লেলিয়ে লাশের লেলিহান শিখা, আমার দুঃসম্পর্কের আত্মীয়র ভাবাবেগে বিন্দুমাত্র আঘাত করতে পারেনি। কথায় বলে মরা হাতির দাম লাখ টাকা। মরা দলিতের মেয়ের দাম কত? 
নিজেদের প্রতিদিনের জীবন অনুশীলনীর ল্যান্ডস্কেপে ছড়িয়ে থাকা এরকম বিন্দু গুলো কে যুক্ত করলেই দেখবেন ধর্ষণের কিম্বা ধর্ষণের প্রতিবাদে প্রিভিলেজড ক্লাসের সিলেক্টিভ উদাসীনতার ব্যাকগ্রাউন্ডে নকশাটা আসলে সমাজে রুবারু হয়ে থাকা শ্রেণী বৈষম্যের, নকশাটা জাত-বর্ণ বিদ্বেষের, নকশাটা পুরুষতান্ত্রিকতার এবং অবশ্যই সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার। 
যারা ভাবছেন, যে দেশে প্রতি ১৫ মিনিটে কেউ না কেউ ধর্ষিতা হচ্ছেন সেখানে উত্তরপ্রদেশের কিশোরীর ধর্ষণ নিয়ে দেশ তোলপাড় করা আসলে, বিরোধীদের চক্রান্ত, দলিত সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিতে দেশদ্রোহীদের রাজনৈতিক নখরামি কিম্বা মোদী কে বদনাম করার অন্তঃ-রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র; তারা হালকা পাশ ফিরে শুয়ে পড়ার আগে জেনে রাখুন, ভারতে গত ১০ বছরে মহিলাদের ধর্ষণের আশঙ্কা বেড়েছে ৪৪%। প্রতিদিন দলিত মহিলা ধর্ষিত হচ্ছেন গড়ে ১০জন আর ২০১৪-২০১৮-র উত্তরপ্রদেশে দলিতদের উপর অত্যাচারের  ঘটনা বেড়েছে ৪৭%। 
যদি ভাবেন নিছক পরিসংখ্যান, তাহলে কষ্ট করে সামান্য কটা গুগল সার্চ করুন। দেখবেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন "ঘরে মেয়ে জন্মালে বাগানে ৫টি গাছ লাগান। পরে গাছ বিক্রি করে মেয়ের বিয়ে দেবেন।" মন দিয়ে যোগী আদিত্যনাথের কথা শুনুন। বলছেন "মহিলাদের স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার যোগ্যতাই নেই।" আর সঙ্ঘ পরিবার হোতা মোহন ভাগবতের নিদান? "পুরুষরা উপার্জন করবে। মহিলাদের ঘরের কাজ করবে। এটাই সমাজের নিয়ম।" 
এখন আপনার যদি এই মন্তব্য গুলো নেহাত সাদামাটা লাগে তাহলে বলুন তো, মেয়ে জন্মালেই গাছ কেন লাগাতে হবে? মেয়েদের বিয়ের সঙ্গে কি পয়সার কোন বিশেষ সম্পর্ক আছে? না, প্রধানমন্ত্রী হালফিলে জিও ছেড়ে পণ প্রথার ব্র্যান্ড অ্যাম্বেসেডার হয়েছেন? বলুন তো, মেয়েরা কেন স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবেন না? বাইরে গিয়ে উপার্জন করতে পারবেন না? কল্পনা চাউলা, ভেলেনটিনা তেরেসকোভা, গীতা গোপীনাথন কিম্বা হিমা দাসদের কর্মদক্ষতা বা উপার্জন করার ক্ষমতা চামচা সম্বিত পাত্রদের থেকেও কম নাকি? তাই আপনি হয়ত তাসের দেশের নিয়মমতে ধর্ষণের বিরোধিতা করলেন, কিন্তু এই মন্তব্য গুলির সংশ্লেষে মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইলেন তাহলে বুঝতে হবে, you are not part of the solution, you are part of the problem.
কারণ আপনার সাদা মনে কাদা না থাকলেও মোদী-যোগী-মোহন ভাগবতদের আদর্শগত বাপ-ঠাকুরদাদের ছিল। আর ছিল বলেই সঙ্ঘ-পরিবারের ব্রেন-চাইল্ড হিন্দুরাষ্ট্রের ব্লু-প্রিন্ট লিখতে বসে দ্বিতীয় সরসঙ্ঘ চালক গোলওয়ালকার লিখেছিলেন "শঙ্কর প্রজনন পদ্ধতিতে, প্রভূত লাভ হতে পারে মনুষ্য প্রজাতির। কেরলে নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ পরিবারের প্রথম সন্তান সব সময় নিম্নবর্ণের মেয়ের সাথে বিবাহ করবে এবং সন্তানের জন্ম দেবে। এইসব সন্তানেরা নাম্বুদিরি বামুনদের গুণাবলী তাদের পিতার থেকে পাবে। কেরলের যে কোনও জাতের যে কোনও বিবাহিত মহিলার প্রথম সন্তান নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণজাত হতে হবে। তার বিবাহ অন্য যার সাথেই হোক, সেই মহিলার প্রথম সন্তানটি যেন নাম্বুদিরি বামুনদের ঔরসজাত হয়।" 
আপনি মনুস্মৃতি খুলুন। চ্যাপ্টার ১, শ্লোক ৯.৩। লেখা আছে, "একজন মহিলা, কখনই স্বাধীন হতে পারেন না। তাকে বিয়ের আগে পিতা, বিয়ের পর স্বামী এবং বৃদ্ধ বয়সে পুত্রর উপর নির্ভরশীল হতেই হবে।" শ্লোক ৮.৩৬৫-তে বলছে, কোনও 'নিম্ন বর্ণের' মহিলা যদি 'উচ্চ বর্ণের' পুরুষের সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করলে তা শাস্তি যোগ্য অপরাধ নয়। কিন্তু উল্টোটা হলে মেয়েটির কঠোরতম শাস্তির জন্য প্রস্তুত থাকা উচিৎ। রামচরিতমানস বলছে, মহিলারা স্বাধীন হলে 'নষ্ট' হতে বাধ্য কিম্বা পাত্রের জাতের থেকে কনের জাত নিচু হলে, সেটা 'বিপরীত বিবাহ', অতএব হিন্দু ধর্মে 'অবৈধ'। এখন এগুলো যদি আপনার 'উচ্চবর্ণের' পুরুষদের 'নিম্নবর্ণের' মেয়েদের ভোগ্যপণ্য হিসেবে ব্যবহার করার লাইসেন্স না মনে হয় তাহলে বুঝতে হবে, you are not part of the solution, you are part of the problem.
তাই নেটফ্লিক্সে আর্টিকেল 15 কিম্বা অ্যামাজন প্রাইমে পাতাললোক -মির্জাপুরের ওয়েব সিরিজ দেখে, নিজেকে উত্তর আধুনিক ভেবে ফুটেজ খাওয়ার আগে একটিবার ভাবুন, কোন ঢং-র রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হচ্ছে এসব ডার্ক থ্রিলারের চিত্রনাট্য? কেনই বা এই প্রতিটি ডার্ক থ্রিলারের পটভূমি কেবলমাত্র গোবলয়ের রাজ্যগুলি? ধর্মের আর রাজনীতির কোন ককটেলে উত্তরপ্রদেশ-রাজস্থান-হরিয়ানার মত রাজ্যগুলিতে দিনের পর দিন পুষ্ট হচ্ছে জাতপাতের ভিত্তি?  
ভাবুন কারণ বাংলা বাঁচাতে লড়তে হবে। যে বাংলা রবীন্দ্রনাথের, যে বাংলা নজরুলের। যে বাংলা লালনের, যে বাংলা মাইকেলের। যে বাংলা র‍্যাডক্লিফের টানা লাইনে রক্তাক্ত হয়েছে কিন্তু ধর্মান্ধতার সঙ্গে এক ইঞ্চি আপোষ করেনি। যে বাংলা জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে কিন্তু অস্পৃশ্যতার কানাগলিতে কখনও পথ হারায়নি। রামমোহনের যে বাংলার সতীদাহ রুখতে জানে। বিদ্যাসাগরের  যে বাংলা বিধবাবিবাহের নবজাগরণে দুনিয়া কে পথ দেখাতে পারে।  
যোগী-মোদীরা জানুক, এই বাংলা ঠিক যতটা সর্ষে ইলিশের, ঠিক ততটাই ধামসা মাদলের। এই বাংলা সাজে দুর্গাপূজার অঞ্জলিতে, এই বাংলা চেনে ভাদু পরবে লেগে থাকা সোঁদা মাটির গন্ধটাকে। এই বাংলা হক যতটা হেমরাজ তামাঙ্গদের ঠিক ততটাই হক আছে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গিদেরও। গোবলয়ের মামদোবাজরা জাত-ধর্মের রাজনীতি চাষ করতে এলে মুখে ঝাঁটার বাড়ি মারুন। আর আপনার চারপাশের জাত-ধর্মে বিচার করা অবিকল মানুষের মত দেখতে জন্তুগুলো কে মানসিক রোগী ভেবে ঘেন্না করুন, করুণা করুন। পারলে, চিড়িয়াখানাতে চালান করুন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন