বুধবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২০

নিলামের নোবেল ~ অর্ক রাজপন্ডিত

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ধরা যাক আমার আর আপনার দেখা হল। বিভূতিভূষণ বলছেন তিনিই আমাকে বা আপনাকে নিয়ে যাবেন ফুলকিয়া বইহার বা লবটুলিয়ার দেশে।

'আরণ্যক'র সত্যচরণ বন পাহাড়ের দেশে দেশে যেভাবে চিনেছিলেন সেভাবেই বিভূতিভূষণ আমাদের চিনিয়ে দেবেন কুশি নদীর ধারের সেই সুবিশাল প্রান্তর, গাছগাছালি, পরিচিত-অপরিচিত অদ্ভুত সব লতাপাতা, বিচিত্র পাখির সমাবেশ, বন্য প্রাণীর আনাগোনা, জ্যোৎস্নাশোভিত রাত্রির রহস্যময়তা। দেখা হয়ে যাবে যুগলপ্রসাদ, দোবরু পান্না বা রাজকন্যা ভানুমতীর সঙ্গেও!

কিন্তু আমি বা আপনি, দুজনের মধ্যে মাত্র একজনই সঙ্গী হতে পারবো বিভূতিভূষণের, টাইমমেশিনে চড়ে এক ছুটে যেতে পারবো লবটুলিয়া।

কে যাবেন? কে সঙ্গী হবেন বিভূতিভূষণের? আমি আর আপনি বিভূতিভূষণের সঙ্গে আশ্চর্য সফরে সঙ্গী হওয়ার জন্য বাজি ধরলাম। নিলামে হাঁকলাম আমি, এই সফরের গুরুত্ব, মূল্য আমার কাছে ভীষণ দামি। এক কোটি টাকা অবধি খরচ করে ফেলতে পারি নিমেষে এমন স্বপ্নমাখা সফরের জন্য। আপনিও দমবার পাত্র নন, আপনি বলে ফেললেন দেড় কোটি টাকা অবধি আপনিও খরচ করতে পারেন। আমি বললাম দু কোটি, আপনি বললেন তিন কোটি। আমি আর পেরে উঠলাম না! আপনিই জিতলেন।

এর পরে আবার একদিন আমার আপনার দেখা হল। আমি আর আপনি বাজি ধরলাম, দেখি তো কার মানিব্যাগে টাকা বেশি আছে, দুজনের মিলিয়ে মোট কত টাকা আছে। এটা একটু জটিল হল। কারণ আপনার মানি ব্যাগে কত টাকা আছে আমি জানি না তেমনই আমার মানি ব্যাগে কত টাকা আছে আপনি জানেন না। আমরা দুজনেই উৎসাহী হলাম দেখি তো শেষ পর্যন্ত কার মানি ব্যাগে টাকা বেশি আছে আর দুজনের মোট কত টাকা আছে।

অর্থনীতিবিদরা বিভূতিভূষণের সঙ্গে আরণ্যকের দেশ দেখতে চেয়ে আমার আপনার দর হাঁকাকে বলবেন 'পার্সোনাল ভ্যালু অফ অকশন'। ব্যক্তিগত মূল্যের নিলাম। আমার দোবরু পান্নার দেশ দেখার জন্য নিজস্ব অনুভূতি আছে, আমার মত করে তার মূল্য রয়েছে, তেমনি আপনারও আরণ্যকের সফরে যাওয়ার জন্য আপনার নিজস্ব অনুভূতি আছে তার জন্য যত দূর পর্যন্ত টাকা খরচ করা যায় তার সাধ আছে। প্রশ্ন হল কার অনুভূতি টাকার নিরিখে জিতবে।

আমার আপনার ওয়ালেটে টাকা নিয়ে দর হাঁকাকে অর্থনীতিবিদরা বলবেন 'কমন ভ্যালু অফ অকশন'। অভিন্ন মূল্যের নিলাম। কিন্তু দুজনেই ধাঁধায় আছি কার ম্যানি ব্যাগে কত টাকা।

নিলাম পদ্ধতি তাই সব ক্ষেত্রেই সহজ নয় বরং জটিল। যবে থেকে বাজার তবে থেকেই প্রায় নিলাম। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রীক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস লিখেছিলেন ব্যাবিলনের পুরুষরা আকর্ষক স্ত্রী বেছে নেওয়ার জন্য কিভাবে নিলামে অংশ নিতেন, বলাই বাহুল্য প্রাচীণ সেই নিলামও ছিল পিতৃতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত।

১৯৯৬ সালে 'অকশন থিওরি'র জন্য অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছিলেন ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম ভিকরি। তাঁর নিলাম তত্ত্ব অর্থনীতির দুনিয়াকে চমকে দিলেও অর্থনীতিবিদদের জন্য সুস্পষ্ট দিকনির্দেশ ছিল না জটিল নিলাম প্রক্রিয়াকে কিভাবে সুবিন্যস্ত করা যায়।

জটিল নিলাম প্রক্রিয়াকে সুবিন্যস্তভাবে বাস্তবের মিশেলে হাজির করার জন্য এই বছরে অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দুই মার্কিন অর্থনীতিবিদ রবার্ট উইলসন এবং তাঁর ছাত্র পল মিলগ্রম।

'অকশন থিওরি'  শুধু তত্ত্বের মোড়কের বাইরে এসে গত প্রায় তিন দশক ধরে নয়া উদারবাদ তাকে ব্যবহার করছে দেশে দেশে জাতীয় সম্পদ নিলামে চড়িয়ে বিক্রি বাট্টার জন্য। নদী, খনিজ, পাহাড়, কারখানা সবই নিলামে চড়িয়ে বিক্রি। নয়া উদারবাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদের বেসরকারিকরণ অভিযানে তাই 'অকশন থিওরি' শুধু থিওরি হয়ে থাকলেই চলবে না বিক্রিবাট্টা সুগম সহজ করার পথে তাকে কার্যকরি হাতিয়ার হয়ে উঠতে হবে।

রবার্ট উইলিয়াম হচ্ছেন সেই 'প্র্যাক্টিকাল ডিজাইন অফ অকশন থিওরি'র কার্যত বেতাজ বাদশা।

১৯৯০ সালে মার্কিন দেশের সরকার এই দুই অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম আর মিলগ্রমের শরণাপন্ন হন সেদেশের 'রেডিও স্পেকট্রাম' নিলামে চড়াতে। খুবই জটিল ছিল সেই প্রক্রিয়া। বিভিন্ন চাহিদা অনুয়ায়ী নিলাম। ধরা যাক 'ক' টিভি কোম্পানি 'এক্স' ব্যান্ডের স্পেকট্রাম নেবে বা 'ওয়াই' ব্যান্ডের স্পেকট্রাম নেবে বা দুটোই নেবে। আবার 'খ' টিভি কোম্পানির আবদার তারা শুধু মার্কিন দেশের উত্তরে রাজ্যগুলিতে তাদের চ্যানেল দেখাবে কিন্তু দক্ষিণের রাজ্যগুলির স্পেকট্রামও তাদের চাই। এই বহুবিধ সমাহারের নিলাম প্রক্রিয়াকে কিভাবে সহজ করা যায় তার বাস্তব ধারণাই দিয়েছেন এবারের নোবেল জয়ী দুই অর্থনীতিবিদ।

মনে রাখতে হবে যে বছরে নোবেল কমিটি  'অকশন থিওরি'র জন্য অর্থনীতিতে নোবেল দিচ্ছে সেই বছরই সারা দুনিয়া মহামারিতে আক্রান্ত। দুনিয়া জুড়ে অনাহার আর মৃত্যু। হাত ধরাধরি করা মাড়ী আর মড়ক।

সেই বছরেই নোবেল কমিটি অর্থনীতিতে নোবেল দিচ্ছে নিলাম চড়ানোর জন্য! কিভাবে দেশে দেশে সরকারগুলি নিও লিবারেল প্রেসক্রিপশন মেনে সহজে নিলাম চড়াতে পারে দেশের জাতীয় সম্পদ।

সুইডিশ একাডেমির নোবেল কমিটির ও শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি আছে।

 আকাশছোঁয়া বৈষম্য আর তার সমাধান নিয়ে কাজ করে যাওয়া ফরাসী অর্থনীতিবিদ থমাস পিকেট্টি যে কোনদিনই নোবেল পাবেন না তা জানা কথাই, তিনি ঘোষিত বামপন্থী।

কানাঘুঁষো ছিল যে এই মহামারির বছরে অন্তত বৈষম্য নিয়ে কাজ করা,  শ্রমশক্তির উপর বৈষম্যের প্রভাব নিয়ে কাজ করা কেউ অন্তত নোবেল পাবেন অর্থনীতিতে। নাহ! পাননি।

নিলাম তো আমরা জানি। জানে জানে দেশে দেশে মার খাওয়া মানুষ। চিলিতে আর্জেন্টিনায় গুয়াতেমালায় তুরস্কে গ্রীস থেকে আমাদের ভারতে কিভাবে নয়া উদারবাদ নিলাম চড়ায় দেশের জাতীয় সম্পদ।

আমরা দেখেছি। কিভাবে মহামারিকে সামনে রেখে মুনাফাখোর দের দেশ লোটার সুযোগ দিয়েছে মোদী সরকার। মহামারির মধ্যেই নিলামে চড়ছে কয়লা খাদান। অর্ডন্যান্স কারখানা। বিপিসিএল থেকে কনকর।

'অকশন থিওরি'র নামে বেসরকারিকরণ অভিযানের অ্যান্টিথিসিস হচ্ছে 'রেসিস্ট্যান্স'। 'প্র্যাকটিকাল ডিজাইন অফ অকশন'কে রুখে দিতে পারে দেশের নদী পাহাড় প্রতিরক্ষা খনি বাঁচাতে চাওয়া সাচ্চা দেশপ্রেমিক জনগণের যৌথ প্রত্যক্ষ প্রতিরোধ।

যেভাবে কয়লা ব্লক নিলামে চড়ানোর বিরুদ্ধে তির ধুনক নিয়ে ধর্মঘটে ছিল ছত্তিশগড় থেকে ঝাড়খন্ডের জংলা মহল। যেভাবে প্রতিরক্ষায় নিলাম চড়ানোর বিরুদ্ধে অনির্দিষ্টকালিন ধর্মঘটে ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসে সরকার। যেভাবে ব্রিজ অ্যান্ড রুফ কারখানাকে ঘিরে রাখে শ্রমিকরা নিলাম চড়ানোর বিরুদ্ধে। নিলাম চড়িয়ে বিক্রিবাট্টার বিরুদ্ধে যেভাবে লড়ছে আমাদের দুর্গাপুর এএসপি।

'অকশন থিওরি' বাস্তবে বিক্রিবাট্টার দুনিয়ায় জিতে গেলে এই আশ্বিনেও ফুলকিয়া বইহার থেকে, লবটুলিয়ার চাঁদের আলো মাখা জ্যোৎস্নামাখা মাটি থেকে নদী থেকে মাটির নিচে খনিজ বুকে করে রাখা মালভূমি থেকে উচ্ছেদ হবেন আজকের যুগলপ্রসাদ, ধাতুরিয়া, দোবরু পান্না আর ভানুমতীরা।

অকশনওয়ালাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বনপথ থেকে আলপথ থেকে জাতীয় সড়কে যুগলপ্রসাদ, ধাতুরিয়া, দোবরু পান্না আর ভানুমতীদের সঙ্গে হাতে হাত রাখা থাক আমার আর আপনার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন