বাসটা লেট করে সর্বনাশ করে দিলো সৌরভের। মাঝরাত্তির ছুঁই ছুঁই সময়ে মনসাপোতা বাসস্টপে নামালো, তখন পথঘাট শুনশান। সব দোকানে ঝাঁপ পড়ে গেছে। অবশ্য দোকান বলতে তো দুটো চা দোকান, একখানা মনিহারি কাম মুদি,
একটা পাইসহোটেল আর একটা নাপিতের দোকান।দিনের বেলায় রাস্তার ধারে আনাজপাতি বসে। এটাকেই এখানকার লোক মার্কেট বলে।
মনসাপোতার নাম জানি কেউ শোনোনি। বর্ধমান থেকে বাঁকুড়ার দিকে যেতে গেলে এক মিনিটের জন্য বাস থামে এখানে। কোনোকালে নাকি কেউ মাটি খুঁড়ে মা মনসার মূর্তি পেয়েছিলো, সেই জন্য এই নাম। সে মায়ের মন্দির এখন পোড়ো, মা মনসার চেলাচামুন্ডাদের বাস, ওই যে গো, রাত্তিরে যাদের লতা বলতে হয়।
এই পান্ডববর্জিত জায়গায় সখ করে যে আসেনি , বলাই বাহুল্য।গ্রামটির নামও মনসাপোতা, এখানে নেমে লোকে ওই একটা জায়গাতেই যায় সাধারনত, যদিও আশেপাশে ছোটোখাটো আরো কয়েকটা গাঁ আছে। সৌরভের প্রিয়তম পুরুষ ও নারীটি এই গাঁয়েই বাস করেন, মানে তার দাদা আর নাম্মা। দাদা পঁচাশি পেরিয়ে আজও সটান, নাম্মা আটাত্তরে একটু সুগারে কাবু হলেও,দিব্যি সচল আছেন।গ্রামের বাড়ি ছেড়ে থাকেননা, তবে দেখাশোনার দু তিনজন আছে। দিন কয়েক আগে নাতিকে অনেকদিন দেখেন নি বলে মোবাইলে করা অভিমানহেতু চমক দিতে আজকে সৌরভের মনসাপোতা অভিযান। কিন্তু আটটায় পৌঁছনোর বাস যে ঝুলিয়ে এরকম সাড়ে দশটা করবে, বোঝেনি ও। অন্যসময় হলে তবু ভ্যানগাড়ি থাকে একটা দুটো।কিন্তু এখন....
এখনকার কথা মনে করেই শিরদাঁড়া বেয়ে হিম নামলো সৌরভের। গত ছয়মাসে পাঁচজন খুন হয়েছে এই অঞ্চলে,
সকলেই গভীর রাতে। খুব সম্ভব লোকাল কোনো ডাকাতের গ্যাং। সৌরভ শুনেছে রাত্রে সবাই দল বেঁধে চলা ফেরা করে। খুব বোকার মতো কাজ হয়েছে এই সময়ে একলা এসে পড়ে।
কি করবে এখন? হেঁটে গেলে পাক্কা পয়তাল্লিশ মিনিট, তার বেশির ভাগটাই আলো নেই। একশো দিনের কাজের দৌলতে খানাখন্দ নেই ঠিকই, কিন্তু দুধারে ঝোপ, ওখানে ওত পেতে কেউ বসে থাকলে বোঝার উপায় নেই।
ক্রিং ক্রিং! রিকশার বেলের শব্দটা যেন জমাট অন্ধকার চিরে আছড়ে পড়লো সৌরভের কানে। অন্ধকার ফুঁড়ে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ধরা দিলো একটু বাদেই। সৌরভকে দেখে একগাল হেসে জিজ্ঞেস করলো চালক, ' যাবেন?'। এ লাইনের রিকশা সব ওই মনসাপোতার আশেপাশেই যায়, সুতরাং কোথায় জানার খুব একটা দরকার নেই।
চালকটি সৌরভেরই বয়েসী হবে। হাঁফ ছেড়ে রিকশায় উঠে পড়তে বললো, ' বাঁচালেন! একা একা ফিরতে হবে ভেবে খুব চিন্তায় ছিলাম'
' আমিও তাই রে ভাই। দুজন হলে একটু ভরসা পাওয়া যায়। নাম কি তোমার?'
' আজ্ঞে, রানা। আপনি মনসাপোতাতেই নামবেন তো? আমারও ঘর ওদিকপানেই।'।
' হ্যাঁ, সেনবাড়ি চেনো? ওখানেই যাবো। না চিনলে কাছাকাছি এলে চিনিয়ে দিতে পারি'
' আজ্ঞে খুব চিনি। কদিন আগেই সেনদাদুকে নিয়ে হাটে গেছিলাম তো । আপনি ওবাড়ির ছেলে ?'
' একদম। সম্বিত সেন আমার দাদু। '
বলতে বলতে ওরা আলোর বৃত্ত পেরিয়ে অন্ধকারের আয়ত্ত্বে চলে এসেছে। চাঁদের আলোয় দেখতে খুব অসুবিধে নেই, তবে গা ছমছম ভাবটা এড়ানো মুশকিল। সুবিধা এটাই, রানার রিকশাতে আলো রয়েছে, গ্রামদেশে প্রায়শই টর্চ দিয়ে এ কান্ডটা করা হয়। গোরুর গাড়ির হেডলাইট মোটেই হাসির বস্তু না, রীতিমতো বাস্তব।
ভটভট .. ভটভট.. হঠাৎই দূর থেকে আরেকটা আলো রিকশার ওপরে। একটা মোটরসাইকেল। অনেকটা পেছন থেকে এলেও, পাশ দিয়ে হুট করে বেরিয়ে যাওয়ার কথা।
কিন্তু এখানে কিছু গণ্ডগোল দেখা যাচ্ছে। কেউ যেন অসম্ভব ধীরে রিকশাটার পেছন পেছন আসছে। রাস্তার বাঁক এলে আলো সরে যাচ্ছে, কিন্তু তারপরই আবার। রিকশার সাথে মোটামুটি সত্তর আশি ফুট দূরত্ত্বে চলেছে বাইকটা। দু চারবার ঘুরে দেখার চেষ্টা করেছে সৌরভ আরোহীকে। আবছা হেলমেট পরা অবয়ব, তার বেশি কিছু দৃশ্যমন নয়।এসব দিকে দিনের বেলাতেই হেলমেটের বালাই থাকে না! তবে কি..?
রানা চাপাস্বরে বলে, 'বাবু ভালো বুঝছি না। নির্ঘাত কোনো মতলবে আছে ওই বাইকটা।'
'কি করা যায় বলো তো? থেমে দেখবো কাছে আসে কিনা?'
'না বাবু, আমরা যা ভাবছি তা ঠিক হলে ওর কাছে হাতিয়ার থাকবে। সামনেই বটতলার মাঠ। ওখান থেকে একটা শর্ট কাট করা যাবে। ও রাস্তাটা সবাই জানেনা।'
'কিন্তু, এটা যদি সেই খুনীটাই হবে, ও এখনো এগিয়ে আসছে না কেন? '
'বোধহয় দুজন আছি বলে। কিংবা সামনে কোনো স্যাঙাৎ আছে ওর। ধরে বসুন বাবু।'
বটতলার মাঠের সামনে গোত্তা খেয়ে রানা রিকশাটাকে আচমকা পাশের পাতলা জঙ্গলে ঢুকিয়ে দিলো। বাঁক থাকায় বাইকটা তখনও এসে পৌঁছায় নি। এখানে পথ এবড়োখেবড়ো, মাঝে মাঝেই গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে গাছের ছুটকো ডাল। রানা প্রাণপণ চালাচ্ছে, অঘটনের আশঙ্কা মানুষের জোর বাড়িয়ে দেয়।একটু নিশ্চিন্তের শ্বাস ফেলছিলো সৌরভ,
বাইকটাকে ছাড়িয়ে, হঠাৎই তার মনে তিরের মতো এক সন্দেহ বিঁধে গেলো।
ব্যাপারটা প্ল্যান নয়তো? রানা আর ওই বাইক, একই গ্যাংয়ের অংশ নয় তো? হঠাৎ রিকশার উদয়, ভাড়া নিয়ে দর না কষেই রাজী হওয়া, আর তার পরেই বাইক, যেটা আবার ঠিক পেছন পেছন, সবই কি কাকতালীয়? মূল রাস্তা থেকে এখন সে সরে এসেছে, এখানে কেটে ফেললেও টের পেতে লোকের এক দুদিন লাগবে।
বলতে বলতে একটা ঝাঁকুনি খেয়ে রিকশাটা দাঁড়ালো। হিসহিসে গলায় রানা বললো, 'চেন পড়ে গেছে। অন্ধকারে একটু সময় লাগবে বাবু।' হেডলাইট বনা টর্চ নিয়ে সে উবু হয়ে বসে পড়লো। টর্চের আধাআলো পড়ে রানার মুখটা কেমন ভয়ানক দেখাচ্ছিলো, গালের কাটা দাগ, চোয়াড়ে মুখে না কাটা দাড়ি, পুরু নিচেক ঠোঁট সৌরভের মনে একটা চেনা চেনা ছবির কথা তুলে আনছিলো। কোথায় দেখেছে, কোথায় দেখেছে..
বিদ্যুৎচমকের মতো মনে পড়লো, ক'মাস আগেই এই মুখ সে দেখেছে আনন্দবাজারের প্রথম পৃষ্ঠায়। রঞ্জিত! সাতটা খুন, গোটা পনেরো ডাকাতি। তিনটে পুলিশকে জখম করে আদালতের থেকে ফেরার, সেটাও ওই ছয়মাস আগেই। দাড়ি বাদ দিলে অবিকল সেই মুখ। হিম বয়ে যায় সৌরভের বুকে ।এই ভয়ঙ্কর অপরাধীর সামনে তো ও নস্যি। এমন সময় আবার .. ভট ভট ভট ভট.. দূরে সেই বাইক। ওদের ওপর আলো পড়তেই দাঁডিয়ে পড়লো দূরত্ব রেখে।
তক্ষুণি রানা অথবা রঞ্জিত চেন ঠিক করে উঠে প্যাডেলে উদ্দাম চাপ দিলো। শুরুর আগে একবার সৌরভের দিকে তাকালো, সেই তাকানোয় আর যাই থাক, আন্তরিকতা ছিলো না। রিকশা চলছে, পেছনে বাইক, আর একটু বাদেই নির্ঘাত ঝাঁপিয়ে পড়বে দুজনে সৌরভের ওপর। অদূরে একচিলতে আলো, কিছু লোকের নড়াচড়া, সৌরভকে ওরা নিয়ে আসছে ডাকাতদের বধ্যভূমিতে.. মা বাবা দাদু নাম্মা....
দুম করে রিকশাটা মনসাপোতার প্রথম বাড়িটা পেরোলো। রানা রিকশাটা থামিয়ে বললো ' দাঁড়ান দেখি, বাইকটার সাথে বোঝাপড়া করে নিই।' কটা বাড়ি পেরোলেই সেনবাড়ি, চেনা জায়গায় ফিরে এসেছে সৌরভ। দেখতে দেখতে পাশে এসে দাঁড়ালো বাইকটা। হেলমেট খুলে ফেললো মাঝবয়েসী লোকটা। একগাল হেসে বললো, 'কি ভয়ই পেয়েছিলাম! এত রাত্রে রিকশা, ভাবলাম আপনারা নির্ঘাত ওই খুনীর দল, পেরোতে গেলেই কোনোভাবে ঝাঁপাবেন।'রানা খিকখিক করে হেসে বললো, ' আমি তো ভাবছিলাম এই বাবু আর আপনি ষড় করে আমাকে মারবেন, আজ নিঘঘাত গেছি।'
সৌরভ হাসলো শুধু। সে কি ভাবছিলো সেটা আর খোলসা করলো না। এখন তার দাদু নাম্মার সাথে দেখা করার তাড়া।
পুঃ: গল্পের রিকশাওয়ালাটিকে দলিত, সৌরভকে হিন্দু এবং বাইকচালককে মুসলিম ভাবলে আমাদের দেশের গল্পটা পেয়ে যাবেন হয়তো। খুনী কিন্তু এখনো অধরা...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন