শনিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

মাঝেরহাট ব্রিজ ও নীল-সাদা ধ্বংসস্তূপ ~ কাজল মল্লিক



সম্প্রতি মাঝেরহাট ব্রিজের ভেঙে পড়া বাস্তবের ট্র্যাজেডির পাশাপাশি গুরুত্ত্বপূর্ণ প্রতীকী মূল্য বহন করে | কয়েক বছর ধরে যে একের পর এক সেতু ও উড়ালপুল ভেঙে পড়ছে, এবং ব্রিজের তলা দিয়ে বা ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় শহরবাসীর যে হঠাৎ করে সেসব কথা মনে পরে যাচ্ছে ও সে প্রযুক্তির কিছু না বুঝেও অসহায়ভাবে ব্রিজের শরীরের দিকে তাকাচ্ছে এ যাত্রা বেঁচে যাবে কিনা বোঝার জন্য এই ব্যাপারটা এই সময়ের একটি যুগচিহ্ন মাত্র, একটি শক্তিশালী যুগচিহ্ন | 

বস্তুতঃ, রাজ্যের বর্তমান শাসনব্যবস্থায় প্রায় সবকিছুই ভেঙে পড়েছে | অন্য সবকিছু ভেঙে পড়ার দৃশ্য যদিও ব্রিজের মতো অতটা নাটকীয় ও ট্র্যাজেডি অতটা অকস্মাৎ ও তাৎক্ষণিক নয়, সেসব ভেঙে পড়া অনেক ক্ষেত্রেই উপড়ে আনার চেষ্টা করছে আরো অনেক গভীর শিকড়, তাদের অভিঘাত আরো অনেক গভীরে নিহিত |

এই সরকার আসার পরে প্রথমেই যেটা ভেঙে পড়েছে সেটা গণতন্ত্র | গণতন্ত্র শব্দটা বড়, তাই একটু ভেঙে বোঝা দরকার | একদিকে গেছে সরকার ও তার প্রধানকে প্রশ্ন করার অধিকার | খবরে আসা কিছু উদাহরণ সবারই মনে আছে, ডাক্তার শ্যামাপদ গড়াই দিয়ে শুরু, তারপর সারের দাম বাড়ছে কেন জিগেস করে কৃষক শিলাদিত্য, পার্ক স্ট্রিটকাণ্ডে কিছু একটা অপরাধ হয়েছে বলে মনে হয় শুধু এইটুকু বলার জন্য পুলিশ অফিসার দময়ন্তী সেন, রাস্তাঘাটে নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে প্রশ্ন করে প্রেসিডেন্সির ওই ছাত্রী, ডেঙ্গু-কে অজানা জ্বর লিখতে না চেয়ে ডাক্তার অরুণাচল দত্তচৌধুরী, ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি | এছাড়া খবরের বাইরে থাকা অসংখ্য ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত যেখানে বিরোধী রাজনীতি করার "অপরাধে" হুমকি প্রলোভন আক্রমণ ও মিথ্যা মামলার সামনে পড়তে হচ্ছে অসংখ্য রাজ্যবাসীকে |

গণতন্ত্র ভেঙে পড়ার আরেকটি সহজবোধ্য দিক হচ্ছে নির্বাচন উঠে যাওয়া | কোথাও কোথাও সরাসরি, যেমন ইস্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় অফিসের বিভিন্ন কমিটি ইত্যাদি | নির্বাচন উঠিয়ে দাও বা অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে দাও আর ততদিন দলীয় লুটের রাজত্ব বজায় রাখো | আর বড় নির্বাচনগুলো, বিধানসভা পৌরসভা পঞ্চায়েত, যেগুলো আক্ষরিকভাবে উঠিয়ে দেওয়া মুশকিল, সেগুলো কার্যত উঠিয়ে দাও | প্রথমে ভয় দেখাও যাতে লোকে বিরোধীদলের প্রার্থী হতে না চায়, তাতে যাদের বাগে আনা যাবেনা তাদের দলীয় কর্মী তথা গুন্ডা দিয়ে মনোনয়ন জমা দিতে বাধা দাও (পুলিশ ঠুঁটো জগন্নাথ, সুতরাং কিছু বলবে না বা গুন্ডাদেরই সাহায্য করবে), তাতেও না হলে ভয় দেখিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহার করাও | এরপর তো নির্বাচনের দিন তাণ্ডব আছেই - হাতে বালা গলায় মালা কোমরে বন্দুক মুখে শাসানি নিয়ে নেতা থেকে ক্যাডার সবাই নেমে পড়বে | আর যাদের নামার কথা অর্থাৎ পুলিশ তাদের দেখা যাবেনা! এরপর নির্বাচন কমিশনকে নালিশ জানালে তারা সাকুল্যে আড়াইখানা বুথে পুনর্নির্বাচন করবে যেগুলোয় আবার সেরকম গোলমাল হয়নি! আর যেহেতু বড় দেশ, তাই এই সবকিছুর পরও কতিপয় বিরোধী প্রার্থী জিতবে | তাদের জন্য শেষ অস্ত্রটি ছাড়া হবে - যারা এতো বাধাবিপত্তি পেরিয়ে ঝুঁকি নিয়ে এই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ভোটে জিতলো, কোনো এক আশ্চর্য কারণে তারা ভোটের দু-চারদিন পরেই "উন্নয়নে" মুগ্ধ হয়ে দল পাল্টে তৃণমূলে যোগ দেবে !

দ্বিতীয় যেটা এই সরকারের আমলে উঠে গেছে সেটা প্রশাসন | আগের অংশেই পরিষ্কার, ভোটের সময় বা অন্য যেকোনো সময়, তৃণমূলের গুন্ডারা যাই করুক, পুলিশ কিছু বলবেনা, এটাই দস্তুর | অন্যান্য "স্বাধীন" কমিশন ফমিশন যা আছে - নির্বাচন মানবাধিকার মহিলা ইত্যাদি - যাদের আদতে সরকার বেআইনি বেপরোয়া কিছু করছে কিনা এটাই দেখার কাজ, সেখানে সব পেটোয়া লোক বসানো আছে, তারা সব দেখেশুনে বলবে কিছু হয়নি |

এরপর যেটা ভেঙে পড়েছে সেটার গুরুত্ত্ব আরও অনেক ব্যাপক, শিকড় অনেক গভীরে | সেটা মূল্যবোধ | আমাদের সমাজে আর যাই হোক কিছু সাধারণ মূল্যবোধ টিকে ছিল, যেমন চুরি করা খারাপ, লোক ঠকানো খারাপ, মিথ্যে কথা বলা খারাপ ইত্যাদি | তৃণমূলের কল্যাণে এখন সেসব উঠে গেছে | তাই ক্যামেরার সামনে ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পরেও নেতারা – ডাক্তার অধ্যাপক থেকে ডকের মাফিয়া – হাসতে হাসতে ঘুরে বেড়াচ্ছে | প্রথমে বললো ভিডিও জাল, তারপর সেটা পরীক্ষা করে ঠিক প্রমাণ হওয়ায় বললো টাকা নিয়েছি ঠিকই, কিন্তু ও অনুদান, তারপর কিছু বলাও ছেড়ে দিলো, কারণ এই জমানায় ওসবে কিছু এসে যায়না | সারদা রোজ ভ্যালির টাকা কোথায় গেলো সে তদন্ত তো চলছে চলবে, পুলিশ প্রমাণ নষ্ট করতে সাহায্য করবে, বিজেপি নিজের স্বার্থে তৃণমূলকে হাতে রাখতে তদন্ত শেষ করতে দেবেনা, আর তার মধ্যে প্রান্তিক সর্বস্বান্ত মানুষের মিছিল বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যাবে | আর "ইস্ট জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের" "ডক্টরেট"-এর হাত ধরে যে যাত্রার শুরু, সেখানে প্রতি পদে মিথ্যা বলাটাকে তো আর কোনো অন্যায় বলা যায়না | চুরি করা, লোক ঠকানো, মিথ্যে বলা এসব যে আগে ছিল না তা নয়, কিন্তু অপরাধীরা আগে অন্তত ধরা পড়লে বুক ফুলিয়ে ঘুরতো না, লজ্জায় মুখে অন্তত একটা কাপড় ঢাকা দিতো, এখন এই সমস্ত অপরাধীরাই – পাড়ার গুন্ডা চোর ডাকাত – ক্ষমতায়, সেই কাপড়টা উঠে গেছে, কারণ সাধারণ মূল্যবোধ ভেঙে গেছে | এই মূল্যবোধ ভেঙে যাওয়ার আরও অনেক দিক আছে, কয়েকটা কিঞ্চিৎ সূক্ষ্ম, যেমন নির্লজ্জ আত্মপ্রচার, ইত্যাদি | দিকে দিকে অনুপ্রেরণার হোর্ডিং আর ছবি, এমনকি রবীন্দ্র সদন  নন্দনের সামনেও বিশাল ফলক, নবরূপে চত্বরের উন্মোচন করলেন মুখ্যমন্ত্রী, ইত্যাদি আরো অসংখ্য উদাহরণ | এই পাগলের মতো আত্মপ্রচারে মনের যা ক্ষতি আর দৃশ্যের যা দূষণ হয়, সেটা বোঝা শাসকদলের নেতানেত্রীদের মানসিক ক্ষমতার অনেক যোজন ওপর দিয়ে যায়, বলাই বাহুল্য, কিন্তু প্রতিদিন ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় রাজ্যবাসীকে | সৌভাগ্যবশতঃ আর সব গেলেও অন্তত হিউমার-নামক বস্তুটি এখনো বাঙালিকে ছেড়ে যায়নি, তাই এই সব ব্যাপার নিয়ে সামান্য কৌতুক রচনাই বাঙালির বাঁচার উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যদিও সে-ব্যাপারে হিসেবে সামান্য গোলমাল হলে অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রর হালও হতে পারে! উদাহরণ আরো অসংখ্য দেওয়া যায়, তালিকা দিতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে, তার প্রয়োজন নেই, বুদ্ধিমান পাঠক বুঝে নেবেন |

আমাদের চোখের সামনেই ভেঙে পড়লো আমাদের রুচি, জ্ঞান ও নান্দনিকতার বিচার | এটা মূল্যবোধের সঙ্গেও যুক্ত | যে যার পছন্দ মতো গান শুনবে, বই পড়বে, সেটা আরেকজনের পছন্দ হোক বা না হোক, এটা চিরকালই ছিল | কিন্তু ভুল তথ্য, ভুল ও কদর্য ভাষা-ব্যবহার, বাছাই-করা রদ্দি সংস্কৃতির এমন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মহোৎসব আগে কখনো হয়েছে বলে মনে হয় না (সিদ্ধার্থ রায়ের আমল দেখিনি তবে শুনেছি সেও এক ভয়ঙ্কর সময় ছিল, যাঁরা দেখেছেন তাঁরা বলতে পারবেন বর্তমান সময়ের সঙ্গে কতটা  তুলনীয়) | ডহরবাবু দিয়ে শুরু, তারপর তো তালিকা দিয়ে শেষ করা যাবে না, সঙ্গে আবার সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে বহুল প্রচারিত সব কবিতাও আছে | যেন অশিক্ষা অজ্ঞানতা অপসংস্কৃতির একটা মহোৎসব চলছে | যে কোনো জিনিসে উৎকর্ষের জন্য যে পরিশ্রম করতে হয়, এই সাধারণ মূল্যবোধটাই ধাক্কা খেয়েছে | প্রায় এই জায়গায় পৌঁছেছে বাংলার সংস্কৃতি যেন সরকারের নেতা নেত্রীরা বলতে চাইছেন জানার থেকে না-জানা ভালো, বোঝার থেকে না-বোঝা ভালো, ঠিক ভাষার থেকে ভুল ভাষা এমন কি খিস্তি-গালাগালিও ভালো, ইত্যাদি | যতক্ষণ ভয় দেখিয়ে, মিথ্যা প্রচার করে, গুন্ডা লেলিয়ে ভোটে জেতা যাবে ততক্ষণ এটাই চলবে | ইতিহাসে লিখে রাখার মতো তলানিতে এসে পৌঁছেছি আমরা!

ক্ষমতার লোভে একেবারে দায়িত্ত্ব নিয়ে ভাঙার চেষ্টা হচ্ছে রাজ্যের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি | তোষণের নির্লজ্জ ও হাস্যকর সব পদক্ষেপ করা হচ্ছে, সিদ্দিকুল্লা থেকে ইদ্রিস আলী - মৌলবাদীদের সচেতনভাবে ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে, ভারতের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তিন তালাক তুলে দেওয়ার প্রতিবাদ করা হয়েছে সম্ভবত একমাত্র তৃণমূল নেতাদের থেকে | আবার মাঝে মাঝে উল্টোপক্ষর জন্য হনুমান জয়ন্তী, ব্রাহ্মণ ভোজন ইত্যাদি | পুরো পরিবেশটার মধ্যে ধর্ম ও ধর্মচিহ্নের দৃষ্টিকটু বাড়াবাড়ি ও উস্কানি | এই রাস্তায় তৃণমূলের দোসর জুটেছে বিজেপি, কখনো তৃণমূল আগুন জালে বিজেপি হাওয়া দেয়, কখনো উল্টোটা | মানুষের বিরুদ্ধে অমার্জনীয় অপরাধ করে চলেছে নিজেদের ক্ষমতার দৌড় আরেকটু দীর্ঘায়িত করার স্বার্থে |

এই যখন অবস্থা, যে দেশে গণতন্ত্র ভেঙে পড়েছে, প্রশাসন ভেঙে পড়েছে, মূল্যবোধ ও রুচি ভেঙে পড়েছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নড়বড় করছে, যে দেশে জোরে চেঁচিয়ে মিথ্যা বলে দিনকে রাত ও তিলকে তাল করাটাই দস্তুর, যে দেশে এমনকি পুলিশ অফিসারের অপরাধকে অপরাধ বলা বা ডাক্তারের ডেঙ্গুকে ডেঙ্গু বলার অধিকারটাও ভেঙে পড়েছে, সে-দেশে একটা সেতু ভেঙে পড়াটা আর বেশি কী? যেকোনো সভ্য সমাজে চুরির ফলে, অবহেলায় একটা উড়ালপুল ভেঙে এতো ক্ষয়ক্ষতি একটা জাতীয় লজ্জার কারণ হতো, সরকার ও নেতাদের দীর্ঘদিন জবাবদিহি করতে হতো, কিন্তু আজকের বাংলায় এটা একটা প্রতীকমাত্র, সমাজের যা কিছু গুরুত্ত্বপূর্ণ সব ভেঙে পড়ার একটা প্রতীক | আমরা এখন একটা ধংসস্তূপের তলাতেই বাস করছি, নীল সাদা রং করা একটা ধংসস্তূপ, আর সেই ধ্বংসস্তূপের ওপরে দাঁড়িয়ে নৃত্য করছে কিছু রাজনৈতিক ভূত |

---------------------------------------------

স্বেচ্ছাচারী, অত্যাচারী, দুর্নীতিগ্রস্ত শাসককূল ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়েই চেয়েছে গল্পটা এখানেই শেষ হোক, কারণ তাদের কোনো নৈতিকতাবোধ বা জনদরদ নেই | তারা আরো চুরি করে আরো মানুষ মেরে আইনের চোখ এড়িয়ে দীর্ঘজীবন লাভ করতে চায়, কেউ কেউ হয়তো অমরও হতে চায়! কিন্তু এখানেই ইতিহাসের মজা, গল্পটা কখনোই এখানে শেষ হয় নি ! এবং এক্ষেত্রেও হবে না | যতজনকে রাষ্ট্র মারতে চাইবে, ধরতে চাইবে তাদের একটা অংশ প্রতিবাদের নিশানে রূপান্তরিত হবে | অম্বিকেশ মহাপাত্র বা কানহাইয়া কুমাররা একা নয়, তাদের পেছনে মিছিল আছে | জনতা এমনিতে হাড়হাভাতে, রাজনৈতিক গুন্ডারা দেখে ভাবে টোকা দিলেই পরে যাবে, পরে যায়ও অনেকদিন | তারপর যেদিন রুখে দাঁড়ায় সেদিন কেষ্ট হাকিম মদন মেয়র থেকে শুরু করে কোনো দাদা দিদি পার পায় না, সে তার ছাতি ছাপ্পান্ন ইঞ্চি হোক, আর ডিগ্রি ইস্ট জর্জিয়ার হোক | এখানেও সেদিন এলো বলে !

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন