দ্বারভাঙ্গার রাজপ্রাসাদে সেদিন ভিড় উপচে পড়ছে।তিল ধারনের আর জায়গা নেই।গণ্যমান্য বিশিষ্ট অতিথিরা সবাই নিজের নিজের আসনে আসন গ্রহণ করে অপেক্ষা করছেন মেহফিলের।রাজা সাহেব এক নতুন চমক দিতে চলেছেন সবার সামনে।কদিন আগে থেকেই এই জন্য রাজসভায় সাজো সাজো রব।আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।সেজে উঠেছে সভা। কলকাতা থেকে নতুন বাঈজি নিয়ে এসেছেন রাজা লক্ষমেশ্বর সিং।সেই বাঈজির গলার মিঠাস আর নাচের ছন্দ নাকি পাগল আর মাতোয়ারা করে দেয় তামাম ইন্সানকে।সবাই অধীর আগ্রহে সেই বাঈজির অপেক্ষা করে যাচ্ছেন।
রাজা লক্ষ্মমেশ্বর সিং জি প্রবেশ করলেন সভার মধ্যে।মুহুর্তের হইচই যেন স্তব্ধ হয়ে গেল।সবাই আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানালেন রাজা সাহেবকে।রাজা সাহেবের ব্যক্তিত্বে সবাই মুগ্ধ হয়ে থাকেন।আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এই রাজা তাদের পূর্বপুরুষদের থেকে চিন্তায় ভাবনায় অনেক এগিয়ে।সেই লক্ষমেশ্বর সিং যখন কলকাতার বাঈজিকে নিয়ে এসেছেন, তখন সেই বাঈজিকে তো অসামান্য হতেই হবে।
এরপর সভার মধ্যে প্রবেশ করলেন সেই বাঈজি।নাচ আর গান শুরু করবে কি! বাঈজির অসাধারণ রূপেই মুগ্ধ হয়ে গেল প্রত্যেকে।রূপ যেন ফেটে পড়ছে।আর রূপ হবে নাই বা কেন! বাঈজির শরীরে তো আর ভারতীয় রক্ত নয়, বইছে ইউরোপিয়ান রক্ত।বাবা আর্মেনিয়ান ইহুদি উইলিয়াম রবার্ট ইয়োওয়ার্ড আর মা জন্মসূত্রে ভারতীয় ভিক্টোরিয়া হেমিংস।তাদেরই সন্তান অ্যাঞ্জেলিনা পাকেচক্রে হয়ে পড়েছেন তাওয়াইফ।তবে নাচ আর গানের ক্ষেত্রে অ্যাঞ্জেলিনার মায়ের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি।নিজে যেহেতু নাচ আর গানের পেশায় যুক্ত ছিলেন।
গান শুরু করলেন কলকাতার বাঈজি।তন্ময় হয়ে গেল রাজসভা।গানের প্রতিটা মোচড় যেন বুকে এসে বিঁধছে। রাজা নিজেও মুগ্ধ।ডুবে গেলেন সুরের গভীরে।খেয়ালই নেই কখন একটার পর একটা গান গেয়ে চলেছে তাওয়াইফ।অবশেষে ঘোর ভাঙল গান শেষ হওয়ার পর।হাততালি দিতেও ভুলে গেছিলেন রাজা লক্ষমেশ্বর সিং জি।গান শেষ হওয়ার পর রাজা ঘোষণা করলেন 'আজ থেকে আমার রাজ্যের রাজসভার সঙ্গীতবিদ হিসেবে নিযুক্ত করা হল এনাকে'।
মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে সেই সময়ের সব থেকে শক্তিশালী দেশীয় রাজ্য দ্বারভাঙ্গার সভার সঙ্গীতবিদ হিসেবে নিযুক্ত হলেন অ্যাঞ্জেলিনা উর্ফ গওহর জান।বাবা মায়ের বিচ্ছেদের পর মা ভিক্টোরিয়া হেমিংস বিয়ে করেন খুর্শেদকে এবং নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম গ্রহণ করেন মালেক জান আর মেয়ে অ্যাঞ্জেলিনার নাম হয় গওহর জান।
আজ থেকে ১৪৫ বছর আগে ১৮৭৩ সালের ২৬ শে জুন উত্তর প্রদেশের আজমগড়ে জন্ম গওহর জানের।গ্রামোফোন কোম্পনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে যার গান রেকর্ড করে।রাগ যোগিয়া গেয়েছিলেন তার প্রথম রেকর্ডে।এরপর প্রায় ৬০০ খানা রেকর্ড বের হয় তার।আজ থেকে ১০০ বছর আগেই গওহর জান সেই সময়ে হয়েছিলেন কোটিপতি।অথচ শেষ জীবনে প্রায় কপর্দকশূন্য হয়ে কাটাতে হয়েছিল মহিশূরের রাজপ্রাসাদে।ওখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।আজ তার জন্মের ১৪৫ তম বছরে গুগলও তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে গুগল ডুডল এ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন