শুক্রবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

বং ~ সুশোভন পাত্র

- হু ওয়াজ নজরুল মামমাম?
- সাচ অ্যা শেম তাতাই! ইউ ডোন্ট ইভেন নো নজরুল তাতাই? হি ওয়াজে গ্রেট বেঙ্গলি পোয়েট, রাইটার অ্যান্ড মিউজিসিয়ান। উই অল রেড হিস পোয়েম ইন আওয়ার চাইল্ডহুড।
দিল্লী মেট্রো তে আড়ি পেতে শোনা এই কথোপকথনের মত, গত পাঁচ বছরে আরও গণ্ডা খানেক উদাহরণে ঋদ্ধ হয়ে নিশ্চিত হয়েছি যে, দিল্লীর কনটেম্পোরারি বাঙালি বাপ-মা'রা কদাচিৎ ব্যতিক্রম ছাড়া আর ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলেন না। আজকাল তো শুনছি কলকাতাতেও বলেন না।
গ্লোবালাইজেশনের দুনিয়ায় ক্লাস টু'র বাচ্চা'দের ইংরেজিতে ঢেকুর তোলাটাও নাকি আবশ্যিক। আমরা নেহাতই ওল্ড ফ্যাশানড তাই ক্লাস এইটে প্যাসিভ ভয়েস কে অ্যাক্টিভ করলে ইংরেজি মাস্টার ভালোবেসে একটা চুইনগাম চিবোতে দিতেন। আবেশের বন্ধুদের ইন্টার্ভিউ দেখতে গিয়ে খেয়াল করলাম, কি ঝরঝরে ইংরেজি। কি কেতাদুরস্ত উচ্চারণভঙ্গি। মুখ ফসকেও একটা বাংলা বেরল না। এরা আমার-আপনার মত সাদামাটা বাঙালি নয়, এরা 'বং'। কলোনিয়াল কালচারের সম্পৃক্ততায় মাতৃভাষা কে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলার প্রবল চেষ্টা এই 'বং জেনারেশনে'র ট্রেন্ডিং ফ্যাশন। আর অযথা আমেরিকান এসেন্টে ইংরেজি বলাটা এলিটিজম।

যে ধরনের এলিটিজম আপনি ধরবো ধরবো করবেন কিন্তু ধরতে পারবেন না সেটা 'সোশ্যাল স্ট্যাটাস'। যেমন ধরুন, আইফোন সেভেন। কিম্বা ধরুন, মহারাষ্ট্রের বিজেপি বিধায়কের বৌ'কে জন্মদিনে গিফট করা ৩.৫ কোটির ল্যাম্বোরগিনির গাড়ি। আবার যে ধরনের এলিটিজম আপনার কষ্টকল্পনা'তেও বিলাসিতা সেটা হল 'গ্ল্যামার'। যেমন ধরুন, ফিতুর সিনেমায় চিনার পাতার রঙে ক্যাটরিনা কাইফের চুল রাঙিয়ে দিতে ৫৫ লাখের বাজেট। কিম্বা বিরাট কোহলির প্রতিদিনের ১০ লক্ষ টাকার প্যাকেজ। এই 'সোশ্যাল স্ট্যাটাস' আর 'গ্ল্যামার'র ককটেল যদি সময় মত বগল দাবা করতে পারেন তাহলে আপনি 'সেলিব্রেটি'। আর এদেশের সেলিব্রেটি সত্ত্বা হল দায়িত্ব-কর্তব্য, আইন-প্রশাসন -সবকিছু ফাঁকি দেবার এলিটিজম।   

সংসদের দু-কক্ষ মিলিয়ে সাংসদ'দের উপস্থিতির গড় ৮০.৫%। আর সেলিব্রেটি সাংসদ'দের কিরণ খের ছাড়া বাকি সবার উপস্থিত ৭৫%'র কম। গত চার বছরে অভিনেত্রী রেখার রাজ্যসভায় উপস্থিতি ৫%। বিতর্কে অংশগ্রহণ শূন্য। প্রশ্ন উত্থাপনও শূন্য। এম.এল.এ ফাটাকেষ্টর রুপালি পর্দায় ডায়লগ বাজি করে সততার রুশ বিপ্লব নামিয়ে ফেলা মিঠুন চক্রবর্তীর উপস্থিতি ১০%। কেন্ট আরও'র বিজ্ঞাপনে গোটা দেশের মানুষকে বিশুদ্ধ জল সরবরাহকারী হেমা মালিনীর উপস্থিতি ৩৭%।

'ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান' নিয়ে দেব লোকসভাতে বাংলায় মুখ খুলেছেন ঐ একবারই। আর তাতেই ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি রোমন্থনের সাব-অলট্রানিসমের আবেগে ধুয়ে গেছে তাঁর মুখে লেগে থাকা লোকসভায় মাত্র ৯% উপস্থিতি'র চুনকালি। সংসদে এনারা সাবডিসাইজড ক্যান্টিনে খাবার খেতে আর শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে হাই তুলতে মোট দুবার মুখ খুললেও, আমাদের ট্যাক্সের টাকা চটকে, মাসের শেষে সাংসদ হবার সমস্ত সুযোগ সুবিধা উদরস্থ করতে কোন কসুরই করেন না। আসলে এদেশে সেলিব্রেটি'দের সাংসদ হওয়া তে কোন দায়বদ্ধতা নেই। আছে একধরনের এলিটিজম। সংসদীয় এলিটিজম। 

'ভারতরত্ন' লতা মঙ্গেশকার ২০০১'এ মুম্বাইয়ের পেদ্দার রোডে তাঁর বিলাসবহুল বাড়ির উল্টো দিকে একটি ফ্লাইওভারের নির্মাণ পরিকল্পনার তীব্র বিরোধিতা করে প্রয়োজনে দেশ ছেড়ে পাকাপাকি দুবাইয়ের বাসিন্দা হবার হুমকি দেন। তড়িঘড়ি ফ্লাইওভার নির্মাণ পরিকল্পনার স্থগিতাদেশ ঘোষণা করে মুম্বাই মিউনিসিপালিটি কর্পোরেশন। আজ অবধি আর শুরু হয়নি সে নির্মাণ। আরেক 'ভারতরত্ন'শচীন তেন্ডুলকার ২০০৩'এ ডন ব্র্যাডম্যানের ২৯'টি সেঞ্চুরির রেকর্ড টপকে মাইকেল শুম্যাখার উপহার ইটালিয়ান ফেরারী স্পোর্টস কারের ১.১৩ কোটি টাকা আমদানি শুল্ক ছাড় দেবার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করেন। ২০১১'তে বান্দ্রার ৮০ কোটির অট্টালিকায় আইন বহিৰ্ভূত নির্মাণের অভিযোগ ওঠে লিটিল-মাস্টারের বিরুদ্ধে। কিছুদিন আগেও মুসৌরি তে DRDO'র নো-কন্সট্রাকশন জোনে বিজনেস পার্টনার সঞ্জয় নারঙ্গর বিরুদ্ধে যে বে-আইনি নির্মাণের অভিযোগ উঠেছিলো, শচীন নিজে মনোহর পারিকরের সাথে দেখা করে তার মধ্যস্থতা করেন। আসলে এদেশের ম্যাচো ম্যানরা থাম্পস আপের বোতলে তুফানি চুমুক দিয়ে হরিণ মেরে, ফুটপাতে গাড়ি চালান। রাতের অন্ধকারে, মানুষ মেরে, প্রধানমন্ত্রীর সাথে নিঃসংকোচে ঘুড়ি ওড়ান। আর এদেশের মুন্নাভাই'রা ঘরে বে-আইনি অস্ত্র রাখার গুরুতর অপরাধ অভিযুক্ত হয়েও বরাদ্দ মেয়াদের আগেই জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। এলিটিজম কি আর শুধু মোকাম্বো'র রেস্টুরেন্টে? এলিটিজম তো এদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। 

মোকাম্বো'র ঘটনার প্রায় সমান্তরালেই পালিত হল 'ওনাম'। পৌরাণিক বিশ্বাসে মালায়ালি দলিত রাজা মহাবলীর রাজত্বে নাকি সবার ছিল সমানাধিকার, সব প্রজারা ছিলেন বেজায় খুশি। মহাবলীর প্রতিপত্তিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে, ছলে বলে কৌশলে তাঁকে পরাস্ত করে, তাঁকে নরকে পাঠিয়ে দেন বামনা অবতারে মর্ত্যে অবতীর্ণ বিষ্ণু। গোটা কেরালা যখন ওনাম উপলক্ষে এই মহাবলীর পুনরাবির্ভাব উদযাপনে ব্যস্ত, তখন বামনা অবতারের কল্পিত চিত্র টুইটারে পোস্ট করে 'বামনা জয়ন্তী' পালন করলেন বিজেপি প্রেসিডেন্ট অমিত শাহ।  রাজনীতি ও ধর্মের সংমিশ্রণে শ্যামলা বর্ণের দলিত রাজার উপর গোরা ব্রাহ্মণ্যবাদের এলিটিজম।

আসলে এলিটিজম আমাদের রক্তে। সোশ্যাল মিডিয়া ঝড় তুলে আমার ভেতরের এলিটিজমের ভিসুভিয়াস'টাকে যদি চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া যেত, তো বেশ হত। জোমেটো তে রেটিং দিয়ে যদি দেশের সব এলিটিজম এক লহমায় ঝেড়ে ফেলা যেত, তো বেশ হত। কিন্তু কি করবেন বলুন, দিনের শেষে আমরাও তো 'ভদ্রলোক'। আমরা সকালবেলা আনন্দবাজার পড়ি। সন্ধ্যে বেলা অফিস ফেরত মায়ের বাতের ব্যথার ওষুধ কিনি। ফোর্ড আইকনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে পরের দিনের ভাতের থালাতে পালং শাকের অপেক্ষা করি। তাই প্রাণহীন মোকাম্বো'ও এলিটিজম প্র্যাকটিস করে। তাই প্রাণহীন মোকাম্বোর স্টাফ হাউসের এলিটিজম নিশ্চিত করে। কারণ আমরাই এলিটিজম কে ধাওয়া করি। আমরাই এলিটিজম আগলে রাখি। আমরাই মনের মণিকোঠায় এলিটিজমের আকাঙ্ক্ষা কে সযত্নে লালন পালন করি ...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন