শুক্রবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২২

পয়লা বৈশাখের অঙ্ক ~ অমিতাভ প্রামাণিক

শুভ নববর্ষ ১৪২৯। 

প্রসঙ্গত বলা যাক, ১৪২৯ একটা মৌলিক সংখ্যা। আজ থেকে দু'বছর আগের সালটাও মৌলিক ছিল, আজ থেকে চার বছর পরের সালটাও মৌলিক হবে। 

এই সালটা আমরা যেভাবে লিখি, অর্থাৎ ১, ৪, ২, ৯ পাশাপাশি বসিয়ে (এ আর এমন কী!), এই রীতি ছ'-সাতশো বছর আগেও ইওরোপে অজানা ছিল, আমেরিকা মহাদেশের তো অস্তিত্বই অজানা ছিল প্রায়। রোমানরা ১৪২৯ লিখত এইভাবে - MCDXXIX. 

এইভাবে দুটো সংখ্যা যোগ করাই দায়, গুণ-ভাগ-বর্গমূল-গসাগু-লসাগু তো অনেক দূরের কথা। অথচ তারা নাকি সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের আবিষ্কারক! চোর কি আর গাছে ফলে! 

যাক সে কথা। ভারতীয় পঞ্জিকা সূর্যসিদ্ধান্তমতে সূর্য আকাশের প্রেক্ষাপটে যেদিন মেষরাশিতে প্রবেশ করে, সেদিন থেকেই নতুন বছর শুরু, সেটাই পয়লা বৈশাখ আমাদের। মেষ ছেড়ে যেদিন বৃষতে প্রবেশ করবে সূর্য, আসবে দ্বিতীয় মাস জ্যৈষ্ঠ। দক্ষিণ ভারতে কিছু রাজ্যে যুগাদি ও গুডি পড়োয়া নামে বর্ষবরণ শুরু হয় এর ঠিক আগের অমাবস্যাশেষে, চান্দ্রসৌরমতে।

গুচ্ছ-গুচ্ছ রিফর্মের শেষে গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার এখন দুনিয়ার মানুষ অনুসরণ করে, তার নববর্ষ পয়লা জানুয়ারি। পয়লা জানুয়ারির বৈশিষ্ট্য কী, সেদিন জাগতিক কোন্ ব্যাপারটা ঘটে? কিছুই না। পুরো আরবিট্রেরি দিন একটা। 

গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার আর সূর্যসিদ্ধান্ত অনুযায়ী বছরের দৈর্ঘ্য সমান নয়, কুড়ি মিনিটের পার্থক্য আছে (এই কারণেই গ্রেগোরিয়ান নিয়ম অনুসরণ করে বাংলাদেশে গতকাল নববর্ষ পালিত হয়েছে)। এর কারণ আহ্নিক ও বার্ষিক গতি ছাড়াও পৃথিবীর তৃতীয় গতি, যার নাম অয়নচলন (লাট্টু ঘোরালে যেমন তার মাথাটা ঘোরে, যার ইংরাজি নাম প্রিসিশন)। অয়নচলন বিষয়ে ভারতীয় গণিতজ্ঞরা আদৌ অজ্ঞ ছিলেন না, তাঁরা ঠিক করে নিয়েছিলেন আকাশের রাশিমণ্ডলের একটাতে (এক্ষেত্রে মেষ) প্রবেশের সময় থেকে পরবর্তী প্রবেশের সময়কালই এক বছর। গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডারে তেমন নয়, এক ইকুইনক্স (ইক্যুয়াল নাইট, যে দিন দিনরাত্রি সমান) থেকে পরবর্তী ইক্যুইভ্যালেন্ট ইকুইনক্সের মধ্যবর্তী সময় হচ্ছে এক বছর। কিন্তু তাতে বছরের প্রথম দিনটা একেবারে আরবিট্রেরি, কেননা এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ইস্টারের দিন ফিক্স করা (যা যিশুর রেজারেকশন-সংক্রান্ত, ধর্মীয় ও আধুনিক বিজ্ঞানমতে গাঁজাখুরি; এবং সেই উদ্দেশ্যও অসফল, কেননা ইস্টারের তারিখ ফিক্সড হয় না)। 

অনেককে লিখতে দেখি, সূর্যসিদ্ধান্তের গণনা ভুল ইত্যাদি, গ্রেগোরিয়ান কারেক্ট। সেটা সত্যি না। তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে এই গ্রেগোরি কে, তিনি কীভাবে ঠিকটা জানলেন, তার ইতিহাস দেখতে গেলে দেখা যাবে, এটা টোকা জিনিস এবং যাঁদের জ্ঞানলব্ধ বস্তু থেকে টোকা, তাঁরা কেরালার 'আর্যভট গণিতবিদ্যালয়'-এর সদস্য ছিলেন। কেরালার সঙ্গমগ্রামের আচার্য মাধব এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। জ্যেষ্ঠদেব, নীলকণ্ঠ, শঙ্কর ইত্যাদি নামের শিষ্যবৃন্দ সেই বিদ্যালয়ের গৌরব বৃদ্ধি করেছিলেন। ১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দে ভাস্কো ডা গামার কালিকটে আগমন ও তার পরবর্তী উদ্ভূত স্থানীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার হয় সম্ভবত এই বিদ্যালয়, যদিও গ্রেগোরিয়ান রিফর্ম তার অনেক পরের ঘটনা। ততদিনে প্রাচ্যদেশের জ্ঞান চুরি করার জন্যে বহুস্থানে গজিয়ে গেছে বহু গির্জা, স্থাপিত হয়েছে বহু মিশন। 

সে সব গল্প অন্যদিন হবে। আজ বছরের প্রথম দিন। আপনারা সবাই ভালো থাকবেন। নতুন বছর সকলের জন্যে আনন্দময় হোক, খুশির হোক, সুখের হোক - এই প্রার্থনা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন