সোমবার, ২৪ জুন, ২০১৯

বিপ্লবী গণেশ ঘোষ ~ অরিজিৎ গুহ

কলকাতার কুখ্যাত পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট। প্রচুর স্বদেশী আন্দোলনের বিপ্লবীদের হত্যা এবং তাঁদের ওপর বীভৎস অত্যাচারের এক মূর্ত প্রতীক। এই চার্লস টেগার্টের ওপর ১৯৩০ সালে ডালহৌসি স্কোয়ারে আক্রমণ চালাল বিপ্লবীদের একটি গোষ্ঠী। তার গাড়িতে বোমা নিক্ষেপ করা হল। অত্যাচারী পুলিশ কমিশনার হলেও যে গুণটা তাঁর ছিল, সেটা হচ্ছে মস্ত ডাকাবুকো ছিলেন উনি। এর আগেও বহুবার তাঁর ওপর আক্রমণ হয়েছে, কিন্তু কোনোবারই ভয় পেয়ে নিজের দায়িত্ব হতে সরে আসেন নি। ওড়িশার বালাসোরে বাঘা যতীনের গ্রুপের সাথে সরাসরি অ্যাকশন করেছেন। 
  ডালহৌসি স্কোয়ারে তাঁর গাড়িতে বোমা নিক্ষেপ করার পরও তিনি প্রাণে বেঁচে যান এবং যে বোমা ছুড়েছিল সেই তরুণ বিপ্লবী অনুজা সেনকে গুলি করতে সক্ষম হন। ধাওয়া করে ধরে ফেলা হয় আরেক তরুণ বিপ্লবী দীনেশ মজুমদারকে। এরপরই সারা কলকাতা জুড়ে শুরু হয় ধরপাকড়। মহামান্য ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ কমিশনারের গাড়িতে বোমা মারার অপরাধ কম অপরাধ নয়। সেই সূত্রেই গ্রেপ্তার হন মেডিকাল কলেজের ডাক্তার নারায়ণ রায়। তাঁর কাছ থেকে পাওয়া গেল বোমা তৈরি করার মশলা, বোমা বানানোর নক্সা। ক্যালকাটা বম্ব কেসে গ্রেপ্তার হলেন ডক্টর নারায়ণ রায়। প্রথমে আলিপুর জেলে এরপর সেখান থেকে পাঠানো হল বোম্বের যারবেদা জেলে। সেখান থেকে কয়েক বছর পর আবার নিয়ে আসা হল আলিপুর জেলে। এবার আরো বড় প্রোমোশন দিয়ে পাঠানো হবে আন্দামানের সেলুলার জেলে। তারই প্রস্তুতি হিসেবে ১৯৩৩ সালে দ্বিতীয়বার স্থানান্তরিত করা হল আলিপুর জেলে। বোম্বের যারবেদা জেলে নারায়ণ রায়কে রাখা হয়েছিল এক নির্জন কক্ষে। সেখানেই সারাদিন ধরে পড়াশোনা করতেন। সেখানেই শেষ করলেন মার্ক্সের ক্যাপিটাল আর লেনিন রচনাসমগ্র। এরপর যখন আলিপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হল তখন যে কদিন ছিলেন সেই কদিনের মধ্যেই জেলে তৈরি করে ফেললেন মার্ক্সিস্ট স্টাডি গ্রুপ। ইতিমধ্যে সেখানে নিয়ে আসা হয়েছে হাজারিবাগ জেল থেকে সতীশ পাকড়াশী আর বোম্বের রত্নগিরি জেল থেকে নিরঞ্জন সেনকে। এই দুজনকেও পাঠানো হবে আন্দামানের সেলুলার জেলে। আলিপুর জেলে বসেই তিনজনে মিলে ঠিক করে ফেললেন আন্দামানে প্রচুর মার্ক্সিস্ট সাহিত্য নিয়ে যাওয়া হবে। সেরকম ব্যবস্থা করেই দু ট্রাঙ্ক ভর্তি বই নিয়ে তিনজনে মিলে চড়ে বসলেন আন্দামানগামী জাহাজে।
    সেলুলার জেলে এসে ছোট্ট একটা গ্রুপ নিয়ে নারায়ণ রায়রা তৈরি করলেন মার্ক্সিস্ট স্টাডি সার্কেল। প্রতিদিন নিয়ম করে সেখানে বিপ্লবী তৈরি করার পাঠচক্র বসতে থাকল। আস্তে আস্তে সেই গ্রুও বড় হতে শুরু করল। তাঁরা নিজেরা একটা হাতে লেখা পত্রিকাও বের করলেন। স্টাডি সার্কেলের অধ্যক্ষ হয়ে উঠলেন নারায়ণ রায়।
    সেলুলার জেলে আসার পর থেকেই নারায়ণ রায় দেখতেন দু তিনজনের একটা ছোট্ট গ্রুপ তারা নিজেদের মতই থাকত। খুব একটা নারায়ণ রায়দের কাছে ঘেঁষত না। ওদের মধ্যে একটা লম্বা কালো মত ছেলে নারায়ণ রায়কে আকৃষ্ট করল। দূর থেকে ছেলেটা ওদের স্টাডি সার্কেলকে লক্ষ্য করত, কিন্তু কখনো কাছে আসত না। ওদের আসলে নিজেদের অন্য মত ছিল। ওই গ্রুপের বক্তব্য ছিল মসি চালনার থেকে অসি চালনাই আসল কাজ। অর্থাৎ পড়াশোনা করার থেকে হাতে তরোয়াল তুলে নেওয়াটাই সঠিক পদক্ষেপ। নারায়ণ রায় বুঝতে পেরেছিলেন ছেলেটি কঞ্চি নয়। শক্ত বাঁশ। কঞ্চিকে সহজে নোয়ানো যায়। বাঁশকে নোয়ানো সহজ নয়, কিন্তু একবার নোয়াতে পারলে শক্তিশালি অস্ত্র তৈরি হবে।
   এই ঘটনার আগে একটু পূর্বকথন রয়েছে। ব্রিটিশ সরকারকে জোরদার ধাক্কা দেওয়ার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম শহরে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে একদল বিপ্লবীর চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুন্ঠন ইতিহাসের এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। ব্রিটিশ সামরিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মত পরিস্থিতি যে একদল অকুতোভয় বিপ্লবী সৃষ্টি করতে পারে সেটা ভারতবাসী জেনে গেছে। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন এক নতুন আদর্শের জন্ম দিয়েছে। যদিও সেই অপারেশনের প্রত্যেকেই ধরা পড়েছে এবং বিচারে সবাইকে সেলুলার জেলে কারাবন্দী করা হয়েছে নারায়ণ রায়রা জেলে এসে পৌঁছানোর বছর খানেক আগেই। চট্টগ্রামের সেই গ্রুপটাই নিজেদের আলাদা করে রাখত বাকিদের থেকে। তারা তখনো চট্টগ্রামের ধাঁচে বৃহৎ পরিকল্পনা রচনা করতে সচেষ্ট ছিলেন। যদিও তাদের মধ্যে রণধীর দাশগুপ্ত ও আনন্দ গুপ্ত ইতিমধ্যেই স্টাডি সার্কেলে নাম লিখিয়েছিলেন। 
   সেই কালো লম্বা মত ছেলেটা অবশ্য মাঝেমাঝে নারায়ণ রায়দের স্টাডি সার্কেলের ছেলেদের সাথে রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা করত। কখনো কখনো ঐক্যমতে পৌঁছাত, কখনো বা আবার তাদের মতের সাথে বিরুদ্ধমত প্রকাশ করত। আস্তে আস্তে স্টাডি সার্কেলের গ্রুপের সাথে বন্ধুত্ব বাড়তে লাগল। ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করল নারায়ণ রায়েরও। ইতিমধ্যে কলকাতার আলিপুর জেল থেকে গোপনে আব্দুল হালিম যোগাযোগ করতে সমর্থ হয়েছেন সেলুলার জেলের নারায়ণ রায় সতীশ পাকড়াশীদের সাথে। আব্দুল হালিম তখন কলকাতা জেলার ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। গাড়োয়ান আর মেথরদের ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিয়ে জেলে গেছেন। আব্দুল হালিম ওঁদের সাথে যোগাযোগ করে জানালেন এবার সরাসরি আন্দামান জেলে কমিউনিস্ট পার্টির প্রচারের কাজ করতে হবে। কারণ সারা দেশজুড়ে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে জোয়ার এসেছে। পার্টি এই সুযোগকে কাজে লাগাতে চাইছে। এর জন্য জেলে তৈরি হল কমিউনিস্ট কনসলিডেশন। নারায়ণ রায় সরাসরি ছেলেটিকে বললেন কমিউনিস্ট কনসলিডেশনে জয়েন করতে। 
   দু বার ভাবে নি সেই ছেলেটি কমিউনিস্ট গ্রুপে জয়েন করতে। কারণ আর আগেই চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের সেনানীরা প্রায় প্রত্যেকেই নারায়ণ রায়দের সংস্পর্শে এসে কমিউনিস্ট হয়ে গেছে। বাকি ছিল তাদের কমান্ডার ইন চিফই একমাত্র। নারায়ণ রায়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সেলুলার জেলেই কমিউনিস্ট পার্টিতে হাতেখড়ি হল সেই লম্বা কালো মত ছেলেটির। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের কমান্ডার ইন চিফ গণেশ ঘোষের।
   ১৯৩৭-৩৮ এ প্রবল জনবিক্ষোভের চাপে আন্দামানে বন্দী সব বিপ্লবীদের দেশে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হল ব্রিটিশ সরকার। গণেশ ঘোষকে প্রথমে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে পরে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয়। ৪৬ সালের ভয়ঙ্কর দাঙ্গার পরপরই মুক্তি পান গণেশ ঘোষ। ডেকার্স লেনের কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে সংবর্ধনা দেওয়া হল তাঁকে। সেদিনই তিনি ঘোষণা করলেন তিনি পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে কাজ করতে চান। 
    ৪৮ এ পার্টি যখন বে আইনি ঘোষিত হল তখন গণেশ ঘোষকে চলে যেতে হল আন্ডারগ্রাউন্ডে। সেই সময়ে যারা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন তাঁদের কথানুযায়ী চট্টগ্রাম বিপ্লবের একফোঁটা আভিজাত্যবোধ তাঁর মধ্যে ছিল না। মনে রাখতে হবে দেশ তখন সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে। যারা ব্রিটিশ পুলিশ দ্বারা একদিনের জন্যও জেলবন্দী হয়েছে তারাও তখন সমাজের চোখে হিরো। সেই জায়গায় চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের কমান্ডার ইন চিফকে মানুষ মাথায় করে রাখত। সারা জীবন কংগ্রেস সরকারের দয়া দাক্ষিণ্যে আরামের জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু সেই জীবন না বেছে তিনি বেছে নিয়েছিলেন চিরাচরিত বিপ্লবী জীবন। পার্টির নির্দেশে ঘুরেছেন জেলায় জেলায়। আন্দামানের বন্দী হিসেবে যখন ভারত সরকার তাঁকে পেনশন আর স্বাধীনতা সংগ্রামীর তাম্রপত্র দিতে চান, ভারত সরকারকে বিনয়ের সাথে উনি জানান, 'আমার পেনশন আর সরকারী স্বীকৃতির দরকার নেই। আমার পার্টি সিপিআই(এম) ই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমাকে দেখবে।'

গনেশ ঘোষকে গণেশ ঘোষ করার পিছনে যেমন মাস্টারদা রয়েছেন, ঠিক তেমনই ডাক্তার নারায়ণ রায়দের মত শিক্ষকরাও রয়েছেন। নারায়ণ রায়ের গল্প আবার পরে কোন একদিন বলা যাবে নাহয়।

ঠিক দুদিন আগে ২২শে জুন চলে গেল এই মহান বিপ্লবীর জন্মদিন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন