বুধবার, ৫ জুন, ২০১৯

কমরেড কৃষ্ণা দেশাই ~ অরিজিৎ গুহ

আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে আজকের দিনে অধুনা মুম্বাই তৎকালীন বোম্বের প্যারেলে ঝেপে বৃষ্টি নেমেছিল। সকাল থেকে বৃষ্টি হওয়ার পর রাতের দিকে একটু ধরেছিল। তাও ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়েই চলেছিল। দেশাই জি কাজ সেরে বাড়ি ফিরে সবে রাতের খাবার খেতে বসবেন সেই সময়ে ডেকে উঠল প্রকাশ। খুব জরুরী দরকার আছে নাকি। স্ত্রী কে 'একটু আসছি' বলে প্রকাশের সাথে বেরিয়ে হাজির হলেন খোলা মাঠের সামনে মিলের গিরনি কামগর ইউনিয়ন অফিসের সামনে। খোলা মাঠের সামনে তখনো হাল্কা ঝিরিঝিরি করে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। চারিদিকটা ঢেকে রয়েছে অন্ধকারের চাদরে। হয়ত লোডশেডিং হয়েছে। মাঠের একদিকে রাস্তা, সেই রাস্তার ধারেই রাইস মিলের ইউনিয়ন অফিস। ইউনিয়ন অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে দেশাই জি'র সাথে তখন পরেরদিনের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রোগ্রাম নিয়ে আলোচনা করছিল প্রকাশ আর কার্ণিক। হঠাৎ একজন মানসিক প্রতিবন্ধী লোক দেশাই জি কে বলল আপনাকে কিছু মজদুর ডাকছে ওই দিকটায়। বলে রাস্তার উল্টোদিকে দেখিয়ে দিল। দেশাই জি একটু অবাক হলেন। ওরা এখানে আসছে না কেন! প্রকাশকে বললেন, দেখো তো একটু কে ডাকছে। প্রকাশ এগিয়ে যেতে দেখল কয়েকজন অল্পবয়সী যুবক একটা গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রকাশ একটু দূর থেকেই হাক দিল কৌন হ্যায়? উলটো দিক থেকে জবাব এলো 'জয় ভারত'। প্রকাশ আরেকটু এগোতেই দেখতে পেল কয়েকজনের জামার নিচে গুপ্তি লোকানো। প্রমাদ গুণল প্রকাশ পাটকার। এর আগে ৬৭ র ইলেকশনের সময়ে দেশাই জি'র ওপর আক্রমণ হয়েছিল এই ছোরা নিয়েই। কোনোরকমে মাথার ওপর ব্রিফকেস উঁচিয়ে প্রাণে বেঁচেছিলেন সেবার। স্ত্রী পরিবারকে তারপর অনেকদিন রত্নাগিরির গ্রামের বাড়িতে রেখে এসেছিলেন। এবারও খবর আছে ওঁর ওপর আক্রমণ হতে পারে। চিৎকার করে দেশাই জি'কে সতর্ক করতেই ধারালো অস্ত্রের আঘাত নেমে এলো প্রকাশের ওপর। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল প্রকাশ। দৌড়ে ধাওয়া করল এরপর দেশাই জি কে। দেশাই জি ততক্ষণে দৌড়াতে শুরু করেছেন। কিন্তু পারলেন না। ধরা পড়ে গেলেন আততায়ীদের হাতে।কুপিয়ে কুপিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হল ট্রেড ইউনিয়ন নেতা বোম্বের প্যারেলের নির্বাচিত বিধায়ক কৃষ্ণ দেশাই কে। খুন করে রাইস মিলের গিরনি কামগর ইউনিয়নের অফিস জ্বালিয়ে দেওয়া হল।  উল্লাসে মেতে উঠল যুবকের দল। অনেক টাকার কন্ট্র‍্যাক্ট ছিল যে! 

   মিলের ভোঁ বাজার সাথে সাথে লাইন দিয়ে বেরিয়ে আসছে মজদুররা। হাতে তাদের সেদিনই পাওয়া হপ্তার টাকা। ইউনিয়নের সাথে চুক্তিতে মিল মালিক বাধ্য হয়েছে হপ্তা বাড়াতে। তা নাহলেই স্ট্রাইক ডেকে বসত মজদুররা। খুব সমস্যা মিল মালিকদের। বোম্বের খানিদানি মিল মালিক ব্যবসাদাররা তাও সমঝে চলে ইউনিয়নবাজিকে, কিন্তু গুজরাটি বানিয়ারা কিছুতেই মানতে পারে না। বেওসা করতে এসে এইসব ইউনিয়নবাজি ফাজির মত ফালতু বাত নিয়ে সবার সরদর্দ হয়ে রয়েছে। কিছু করাও যাচ্ছে না। আগে যেখানে মুনাফা হত এত্তো এত্তো সেখানে এখন মুনাফার কত অংশ যে মজদুর পেমেন্টে চলে যাচ্ছে তার ঠিক নেই। মেঘাজি লোখান্ডে আর জ্যোতিরাও ফুলে যে বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নের বিজ পুতে গেছে মহারাষ্ট্রের বুকে সেই মহান আদর্শ সম্বল করে লাল ঝাণ্ডাওয়ালারা শ্রমিকদের হকের দাবী তুলেছে, শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, আট ঘন্টার বেশি কাজ করানো যাবে না, বেশি কাজ করালে দিতে হবে ওভারটাইম, হপ্তার মাইনে হপ্তাতেই দিতে হবে, মাসিক মাইনে দিতে হবে মাসের পনেরো তারিখের মধ্যে এইসব নানা দাবী নিয়ে মুখর। বিভিন্ন ফ্যাকরা তুলে মিলে স্ট্রাইক ডাকছে, ম্যানেজারদের ঘেরাও করছে ঝাণ্ডাওয়ালারা। মালিকরা সব পার্টির কাছে ঘুরে এসেছে এই ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। কাংগ্রেস পার্টি বলে দিয়েছে যা করার মিল মালিকরা করুক, পার্টি ওদের সাথে আছে। লাল ঝাণ্ডাওয়ালাদের শেষ করতে যা যা লাগে সব সাহায্য করবে পার্টি। কিন্তু নিজেরা এগিয়ে এসে কিছু করবে না। তবে হ্যাঁ, ভরোসা দিয়েছে একমাত্র বালাসাহেব জি। উনি বলে দিয়েছেন ওনার ছেলেদের দিয়ে সব কটা মজদুর লিডারকে টাইট দিয়ে দেবেন। 'কমিউনিস্টদের শেষ করার একটাও সুযোগ ছাড়া যাবে না'। কিন্তু এর জন্য খরচা আছে। বেশ ভালো পয়সা লাগবে এর জন্য। মিল মালিকরা ভেবে দেখল পয়সা তো এমনিই বেরিয়ে যাচ্ছে কত, যদি ইউনিয়নবাজি থেকে মুক্তি মিলবে তো আরো পয়সা খরচ করা যাবে। তাতে কি আছে। ভরোসা পেয়েছে মিল মালিকরা। বালাসাহেব জি'র বক্তব্যে, মারাঠি ও হিন্দু অস্মিতার গর্বে একের পর এক মারাঠি যুবক ভর্তি হচ্ছে বালাসাহেবের দলে। ইতিমধ্যে একটা আর্মি বানিয়ে ফেলেছে বালাসাহেব জি। নাম দিয়েছে শিব সৈনিক। দলের নাম শিব সেনা। 

    শুরু হল একের পর এক নেতাদের গুম করা। কাউকে ভয় দেখিয়ে, কাউকে একেবারে হাপিস করে, কাউকে ব্ল্যাকমেল করে চলল বালাসাহেব জি'র অপারেশন। প্যারেল ছিল সেই সময়ের লাল ঝাণ্ডার শক্তিশালী কেন্দ্র। সিপিআই এর স্ট্রংহোল্ড। পারোলের বিধায়কের ওপর টার্গেট করা হল। জানা ছিল কৃষ্ণ দেশাইকে সরিয়ে দিতে পারলে মজিদুরদের কোমর ভেঙে দেওয়া যাবে। ৬৭'র নির্বাচনী প্রচারে আক্রমণ করা হল একবার। কোনোমতে প্রাণে বাঁচলেন। নির্বাচনে জিতে আরো বেশি বেশি করে মজদুর আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেন। একের পর এক মিল মালিকদের বাধ্য করলেন মজদুরদের সাথে সম্মানজনক শর্তে চুক্তি করতে। এরপরই ৭০ সালে ফাইনাল আঘাত নেমে এলো। কুপিয়ে কুপিয়ে যখন বিধায়ক জি'কে খুন করা হচ্ছে তার আগেই ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন প্রায় শেষের মুখে পুরো মহারাষ্ট্র জুড়ে। মালিকদের চোখে হিরো হয়ে উঠলেন বালাসাহেব ঠাকরে। মহারাষ্ট্রের মত জায়গায় যার প্রাদেশিক রাজধানীর সাথে জড়িয়ে আছে নৌ বিদ্রোহের মত ঐতিহ্য সেখানে ট্রেড ইউনিয়ন মজদুর ঐক্য শক্তিশালী যে হবেই সেটা জানা কথাই ছিল। শ্রমিকদের হকের দাবী মেরে কেউ নিজদের পেট ভরাবে এটা অন্তত বি টি রণদিভে অহল্যা রঙ্গনেকারের রাজ্যে ভাবা যায় নি। কিন্তু বর্বর আক্রমণ, খুনের রাজনীতিকে পরাস্ত না করতে পারার ফল হাতে নাতে দিতে হয়েছে মজদুরদের। বোম্বের সেই সব মিলগুলোতে পরে উঠেছে মল, উঠেছে হাইরাইজ বিল্ডিং। মিলওয়ালারা সমস্ত কিছু বিক্রিবাট্টা করে নিজের পকেট ভরে চলে গেছে অন্য ব্যবসায়ে। কেঁদে মরেছে শ্রমিকরা। কারণ ওদের হয়ে বলার জন্য তখন কেউ আর নেই।

    কৃষ্ণ দেশাইকে খুন করার পিছনে প্রচ্ছন্ন মদত ছিল কংগ্রেসেরও। শারদ পাওয়ার তখন কংগ্রেসে। পরে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী। ইতিমধ্যেই তার মালিকানায় রয়েছে প্রচুর সুগার মিল আখের ক্ষেত আরো অন্য অন্য ব্যবসা। তার ব্যবসারও ক্ষতি হচ্ছিল ওই ঝাণ্ডাওয়ালাদের জন্য। তাই তারও দরকার হয়ে পড়েছিল কমিউনিস্ট নিধন করার। বালাসাহেব ঠাকরে যখন কমিউনিস্ট ট্রেড ইউনিয়ানিস্টদের খতম করছেন তখন তিনি ইতিহাসের চাকা ঘোরার কথা বুঝতে পারেন নি। ১৯৭০ সালের ৫'ই জুন কৃষ্ণ দেশাইকে খুন করার পরে আজাদ ময়দানে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন লাল ঝাণ্ডাওয়ালাদের সব জায়গা থেকে শেষ করতে হবে। মুছে দিতে হবে নাম ও নিশান। we must not miss a single opportunity to massacre communists. পঞ্চাশ বছর পরে বালাসাহেবের নাতি আদিত্য ঠাকরে সেই আজাদ ময়দানেই সেই লাল ঝাণ্ডাওয়ালাদের কৃষক লং মার্চে সমবেদনা জানাতে বাধ্য হচ্ছে। আমি জানি কৃষকরা অনেক দূর থেকে পায়ে হেটে এসেছে। আমি ওদের দাবীর প্রতি সহানুভূতিশীল। 
   ১৯৭০ সালের ৫'ই জুন কৃষ্ণ দেশাই এর হত্যার সাথে সাথে বামপন্থীদের শেষ করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ফিনিক্স পাখির গল্প হয়ত বালাসাহেবরা জানতেন না। আজাদ ময়দানেই কিষান লং মার্চ থেকে জন্ম হয়েছিল ফিনিক্স পাখির। আদিত্য ঠাকরে চেয়ে চেয়ে দেখেছিল সেই ফিনিক্স পাখির জন্মকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন