বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

আমার পূজো - পারমিতা ব্যানার্জী

জানলার বাইরের নিম গাছটার  পাতার ফাঁক দিয়ে যে নরম রোদ টা আমার ঘরের প্রান্ত থেকে প্রান্ত খেলে বেড়াচ্ছে সেটা আমার খুব চেনা, এই রোদটা প্রথম জানান দেয় পুজো আসছে আমার ছোটবেলায় "পুজো আসছে " এই দুটো শব্দের অর্থ একটু অন্যরকমপুজো আসা মানে বাবার  বাড়ি ফেরা বাবা তখন চাকরিসূত্রে ভূপালে আর আমরা দুই বোন  মা এর সাথে কলকাতায় তখন এইরকম একটা নরম রোদের সাথে বাবার চিঠি আসতপুজোয় বাবার বাড়ি ফেরার চিঠি আর সেই এক টুকরো কাগজ যেন মনের মধ্যে আনন্দের একটা ফড়িং উড়িয়ে দিত বাবা আসা মানেই তো দূপুর জুড়ে দেশ বিদেশের গল্প শোনা নোয়াস আর্ক ,মোজেস এর সমুদ্র ভাগ,চাঁদের পাহাড় এর শংকর,জুলেভার্নের টাইম মেশিনের সাথে প্রথম পরিচয় আমার এই এক একটা দুপুরেইগল্পের পাশাপাশি থাকত নতুন নতুন ধাঁধার এক একটা ধাঁধার জন্য সময় ধার্য থাকত একটা দূপুর বিকেল হলেই উত্তর দিতে হত আর না পারলে বাবা বলে দেবেবাবা যদিও বা আমার না পারার লজ্জায় মুখ ভার দেখে আরো একটু চেষ্টার সুযোগ দিত কিন্তু আমার এক নম্বরের পাজি দিদিটা ঠিক উত্তর বলে দিয়ে জিভ ভেঙিয়ে পালাতো সেটা তো হতে দেওয়া যায়না তাই গল্প শোনার ফাঁকে ধাঁধাটা নিয়েও ভাবতে হত অবশ্য দিদি বা বাবা কাউকেই খুব একটা উত্তর বলে দেওয়ার সুযোগ দিতাম না আমি

"পৃথিবীটাকারবশ"-"পৃথিবী টাকার বশ",তিন অক্ষরের নাম -প্রথম অক্ষর বাদ দিলে গায়েতে পরি ,দ্বিতীয় অক্ষর বাদ দিলে জীবনের শেষ তরী,তৃতীয় অক্ষর বাদ দিলে কামড় খেয়ে মরি -বলত কী? ভাবতে হবেনা বলে দিচ্ছি  -"মশারি"এমন কত শত ধাঁধা আমার বাবার কাছে শেখা ,পুজোর ছুটি শেষ হতেই যেগুলো বন্ধুদের বলে ধাঁধাগিরির বাহবা নেওয়া গল্প আর ধাঁধা ছাড়া আর একটা কাজ বাবা ছাড়া হতই না অষ্টমীর জামা কেনা অষ্টমীর জামা মানে পুজোর সেরা জামাটা সেটা সব সময় বাবার সাথে গিয়েই কেনা হতসব দোকান ঘুরে আমার সব চেয়ে পছন্দের জামাটা বাবা আমাকে কিনে দিতজামা কিনে বাড়ি ফেরার পর মা প্রতিবার জামার রঙ ,সাইজ ,কাপড় ,দাম নিয়ে কিছু না কিছু খুঁত বার করতইআর আমরা আগে থেকেই মা কি কি খুঁত বার করতে পারে সেটা ভেবে রাখতামবাবা বলত মার মত খুঁতখুঁতে মানুষ আর হয়না ,বাবা নাকি এমন কিছু কোনদিন কেনেইনি যার কোনো খুঁত মা খুঁজে পায়নি

অফিস যাবার পথে আকাশের দিকে চোখ পরতেই দেখলাম অসংখ্য সাদা মেঘের ভেলাবাবা আমাকে শিখিয়ে ছিল ওই মেঘেদের মধ্যে থেকে হাতি, ঘোড়া,খরগোশ ,ভাল্লুক খুঁজে বার করা মিশনের মাঠে বসে বাবা মেঘেদের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করত "বলতো খরগোশ টা কোন দিকে "ওহ সে যেন পরীক্ষার প্রশ্নের চেয়েও কঠিনমেঘ গুলো তো স্থির নয়,এক মিনিট দেরী হলেই খরগোশ টা অন্য কিছু হয়ে যাবে ,তাই চোখের পলকে সারা আকাশ তোলপাড় করে খরগোশ টা খুঁজে বার করতে হতো ,আর খুঁজে পাবার পর বাবার চোখের সেই দীপ্তি যেটা বলে দিত "এই না হলে আমার মেয়ে" সেটা ছিল সব পুরষ্কারের সেরা

বাবার চিঠি আসতো মহালয়ার আগের দিন আর বাবা আসতো পঞ্চমীর দিন ভোরে মাঝের এই কটা দিন যেন কাটতেই চাইতনা আর পঞ্চমীর দিন তো সূর্য কে যেন রাহু গ্রাস করতএমনিতে কোনকালেই আমি ভোরে উঠতে পারিনা কিন্তু ওই একটা দিন কাউকে ডাকতে হতনাভোর হওয়ার অনেক আগে থেকেই জানলার ফাঁকটায় চোখ রাখতাম আলোর অপেক্ষায়একটা আলোর রেখা জানলার এপার ওপার হলেই মশারি ডিঙিয়ে দরজা খুলে সোজা ঘরের বাইরে আমাদের বাড়ির পেছন দিকে পাঁচিলের একটা ভাঙ্গা অংশ দিয়ে গলির মুখটা দেখা যেত সেখানেই প্রথম বাবার আসা টা দেখতে পেতাম আর যেই না দেখা ছুট্টে বারান্দা পেরিয়ে তুলসী মঞ্চ পেরিয়ে গেট খুলে বাইরে একবার  তো এভাবেই ছুটতে গিয়ে তুলসী মঞ্চের সামনে পা পিছলে গিয়ে সোজা নাকটা গিয়ে ঠেকলো মঞ্চের গায়ে আর অমনি দরদরিয়ে রক্ত ,বাবার আসাটা আর দেখা হলনা ,বাবা হাত থেকে সুটকেস রাখার আগেই ডাক্তার এলো ঘরে তবে সেবার পুজোটা আরো ভালো কেটেছিল সারাদিন সব কাজ ফেলে বাবা আমাকে গল্প শুনিয়েছিল
ষষ্ঠী থেকে শুরু হত আমাদের পুজো পরিক্রমা সকালের জলখাবার সেরেই বেরিয়ে পরতাম উত্তর কলকাতার ঠাকুর দেখতে এক প্যান্ডেল থেকে আরেক প্যান্ডেল যেতাম পায়ে হেঁটে নতুন জুতোয় পায়ে ফোস্কা পরে একাকার তবু উন্মাদনায় খামতি ছিলনা ঠাকুর দেখার ফাঁকেই চলত নানা রকম রাস্তার খাবার খাওয়া ওই কদিন আর কোনো বাধা নিষেধ ছিলনা

ষষ্ঠী সপ্তমী বাইরের ঠাকুর দেখে অষ্টমীতে পুজোর রুটিনে একটু রদবদল হত অষ্টমীতে মামার বাড়ি সব মামা মাসি মামাতো , মাসতুতো ভাইবোন একত্র হতাম সেজ মামার বাড়িতে,সেখানেই দিদা থাকত সেখানে সারাদিন হইচই করে দুপুরে একসাথে খেয়েদেয়ে সবাই মিলে বেড়িয়ে ঠাকুর দেখে আবার রাতের খাবার সেরে যে যার বাড়ি ফিরতাম এসবের মাঝে আমি কিন্তু থাকতাম বাবার পাশে পাশেই মামা আর মেসো দের সাথে সাহিত্য,সিনেমা ,ক্রিকেট ফুটবল ,রাজনীতি নিয়ে আলোচনা গুলো আমি কিছুটা বুঝে কিছুটা না বুঝে হা করে গিলতাম বিষয় গুলোর চেয়ে আমার নজর থাকত বাবার বাচনভঙ্গির ওপর সব বিষয়ে খুঁটিনাটি খবর রাখত বাবা ,প্রতিটা বিষয়ে বাবার গভীর জ্ঞান সবাই কে মুগ্ধ করত ,তর্কের সময় যুক্তির পর যুক্তি সাজিয়ে যেভাবে বাবা দৃপ্ত কন্ঠে নিজের মত রাখত তাতে সবাই হাসি মুখে বাবার যুক্তির কাছে হার মানত আর আমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত সেরা বাবার মেয়ে হওয়ার গৌরবে
পুজোর চারটে দিন আলোর গতিতে কেটে যেত আর তারপর একরাশ বিষন্নতাবাবার ছুটি শেষের সময় লক্ষীপুজোর পর দিন যে বাবা ফিরে যাবে লক্ষীপুজোর দিন বিকেলে যখন বাবা আলমারির মাথা থেকে সুটকেসটা নামতো আমার বুকের ভেতর তখন চাবুক পড়ছে প্রতিবার এইসময় টা চাদরমুরি দিয়ে জোর করে শুয়ে থাকতাম সুটকেস খোলার আওয়াজ টা যাতে কানে না আসে তাই কান দুটো চেপে শুয়ে থাকতাম কিন্তু আওয়াজ পেয়েই যেতামআর গলার কাছে কি যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠত আর তো মাত্র কযেকটা ঘন্টা ,তারপর তো আবার সেই ভোর বেলা,গেট পেরিয়ে ,গলির মোর পেরিয়ে বাবার চলে যাওয়াটা আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে যাওয়া আর আবার প্রতিক্ষা আরো 'মাসের প্রতিক্ষা আবার চোদ্দটা গরমের দুপুরের গল্প শোনার,বিকেলে মিশনের মাঠে বসে বাবার লেখা কবিতা শোনার আর ফেরার পথে গোল্ডস্পট খাওয়ার

আজ প্রতিক্ষার পালা বাবার চাকরিরতা ,বিবাহিত ,তার সবচেয়ে প্রিয় ছোট মেয়ের সঙ্গে কযেক মুহূর্ত সময় কাটানোরমেয়েটা যে আজ ভিষণ ব্যস্ত চাকরি আর সংসার সামলে সপ্তাহান্তে কযেক ঘন্টার গল্পের জন্য ,কলেজস্ট্রীট ঘুরে কেনা তার নতুন বই এর কালেকশন দেখানোর জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয় সারা সপ্তাহতাও কোনো কোনো সপ্তাহে মেয়ের এত তাড়া যে কোনমতে মায়ের সাথে দরকারী কথা সেরেই পালাতে হয়আবার কোনো কোনো দিন ফোন এর ওপারে মেয়ের গলায় "এই রোববার আসতে পারবনা" শুনলে বাবার দীর্ঘ অবসর আরো একটু দীর্ঘ হয়ে ওঠে


পুজোর দিনগুলো আমার এখন ভাগ হয়ে গেছেকিছুটা স্বামীর জন্যে ,কিছুটা শশুরবাড়ির জন্যে রেখে সাকুল্যে একটা দিনের অর্ধেক কাটে বাবার সাথেআর সেই অর্ধেক দিনেই বাবার তোতাপাখির মত পুজো পরিক্রমার গল্প বলা,সবটাই টি.ভি তে,আবার সেই দুই বোনে মিলে ধাঁধার সমাধান করা,নতুন লেখকের গল্পের ,নতুন রিলিজ হওয়া কোনো ভালো সিনেমার সমালোচনা ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই ছোটবেলার ফেলে আসা দিন গুলোতে বাইরে বিসর্জনের কাঁসর ঘন্টার দাপাদাপি ম্লান হয়ে যায় আমাদের বসার ঘরের চার দেওয়ালে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন