বুধবার, ১৮ মার্চ, ২০২০

করোনা ভাইরাস ও চীন ~ সুশোভন পাত্র

ভাবুন আপনি আছেন চিনের Wuhan শহরে। করোনা ভাইরাস প্যান্ডেমিকের আঁতুড়ঘরে! 
না, আমি জানি আপনি টুনি বাল্ব থেকে মোবাইল, সস্তার টর্চ থেকে মেয়ের খেলনা –যে কোন জিনিসের শীঘ্রপতনেই 'চায়না মাল' বলে খিল্লি করেন, কালীপূজায় হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির কৃতী ছাত্র হিসেবে 'চাইনিজ বাজি' বর্জন করে বেজিং-র অর্থনীতি কে হেব্বি ধাক্কা দিয়ে দু-পেগ রাম সেবন করেন; তাহলে কোন দুঃখে আপনি চিনের Wuhan শহরে থাকতে যাবেন? সুপারপাওয়ার না ছাই! 
তবুও একটু কষ্ট করেই না হয় ভাবুন, আপনি আছেন চিনের Wuhan শহরে! আপনি আছেন করোনা ভাইরাস প্যান্ডেমিকের এক্কেরে আঁতুড়ঘরে! 
প্যান্ডেমিকের সতর্কতায় Wuhan-এ 'কমপ্লিট লকডাউন'। এমনিতে 'কমপ্লিট লকডাউন' শব্দটায় থ্রিলিং একটা ব্যাপার আছে! কিন্তু মুশকিল হল, 'কমপ্লিট লকডাউন' বিষয়টা এক্সিকিউট করার ক্ষেত্রে তার থেকে অনেক বেশি চাপ আছে। কারণ 'কমপ্লিট লকডাউনে' মানুষ ঘরে বসে থাকে, কর্পূরের মত উবে তো আর যায় না! তাঁরা স্নান করে, গান শোনে, প্রেম করে, খাবার খায়, এমনকি তাঁদের আমাশাও হয়। তাই 'কমপ্লিট লক ডাউনে'ও Wuhan-এ নাগরিক জীবন স্বাভাবিক রাখতে চিন সরকার ঘোষণা করেছে, মাসিক বিল বকেয়া থাকলেও নাগরিকদের ইলেকট্রিক, জল, ইন্টারনেট, টেলিফোন সহ কোন জরুরী পরিষেবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। কিন্তু তা হলেই বা! এসবে কি মানুষের পেট ভরে? এমনিতে যে সুইগি-জোমেটোর যুগে ঘরে বসেই যে চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য খাওয়াই যায় সেটা আমার ৩ বছরের মেয়েও জানে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল অনলাইন ফুড ডেলিভারির বিশালতা। 'কমপ্লিট লকডাউন'-র সময় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১কোটি ৫০লক্ষ মানুষ Wuhan-এ অনলাইন খাবার অর্ডার করেছেন এবং ডেলিভারি পেয়েছেন¹।   
সে না হয় হল! কিন্তু খেয়ে আবার আমাশা হলে কি হবে? কারও প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজন হলে কি করবে? দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না বুঝেই প্রাথমিক চিকিৎসার ৫০%-ই অনলাইন করেছে চিন। ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট থেকে প্রেসক্রিপশন, এমনকি ওষুধ ডেলিভারি –সবটাই অনলাইনে। প্যান্ডেমিকের আতঙ্কে বিশ্বের তাবড় শহরে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের হাহাকার। লন্ডনের শপিং মলে মামুলি টয়লেট পেপার নিয়ে হাতাহাতি হচ্ছে। ইতালির সুপার মার্কেটে গ্রোসারি জাস্ট ছবি হয়ে যাচ্ছে। খোদ কলকাতায় স্যানেটাইজার খুঁজতে আপনার প্যান্টালুন হলুদ হয়ে যাচ্ছে। আর চিন সমস্ত রাষ্ট্রীয় সংস্থার সমস্ত কাজ থামিয়ে, জরুরী ভিত্তিতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদনে নিয়োগ করেছে। আলপিন থেকে এলিফ্যান্ট চিনে পাওয়া যাচ্ছে সবই, সুলভে²! 
এসবই তো গেলো সতর্কতা। ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় কি ম্যাজিক দেখাচ্ছে চিন? ম্যাজিকই বটে! ২০০২-র সার্স ফ্লু-র সময় গোটা দেশে যে অসংখ্য 'ফিভার ক্লিনিক' বানিয়েছিল চিন, সেই ফিভার ক্লিনিকই এখন চিকিৎসার প্রাথমিক স্তর। ফিভার ক্লিনিকের পরীক্ষায় যদি COVID19-র কোন লক্ষণ দেখা যায় তাহলে হচ্ছে বাকায়দা সিটি স্ক্যান! কারণ চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে এক্স-রে নয়, COVID19 আক্রান্ত ব্যক্তির ফুসফুসের 'গ্রাউন্ড-গ্লাস-অপাসিটিস' কার্যকরী ভাবে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে সিটি স্ক্যানেই। দিনে ২০০টা সিটি স্ক্যান করছে চিনের প্রতিটি মেশিন। আপনার ধারেপাশে খোঁজ নিয়ে দেখুন, সংখ্যাটা ৫০ পেরুবে না। সিটি স্ক্যানেও যদি COVID19-র লক্ষণ থাকে তখন পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে আক্রান্ত কে ক্যাটাগোরাইজেশন করা হচ্ছে -মাইল্ড, সিভিয়ার, কিম্বা ক্রিটিক্যাল। মাইল্ড আক্রান্তদের জন্য অপেক্ষা করছে চিনের স্টেডিয়াম, জিমনাসিয়াম, স্কুল, কমিউনিটি হল দখল করে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা অসংখ্য আইসোলেশন সেন্টার। আর সিভিয়ার বা ক্রিটিক্যালদের জন্য হাসপাতাল। 
করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষান করেছে চিন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৪০,০০০ মেডিক্যাল কর্মী পৌঁছে গেছে Wuhan-এ³। কালকে যিনি ছিলেন হোটেলের রিসেপসনিস্ট আজ তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে জ্বর মাপছেন। পরশু যিনি নির্মাণ কর্মী হিসেবে কাজ করছিলেন আজ তিনি সিচুয়ানের প্রত্যন্ত গ্রামে স্বাস্থ্য শিবির করছেন। প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১৬লক্ষ টেস্ট করার মেডিক্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার বানিয়েছে চিন। ১০দিনে ৬৪৫,০০০ স্কয়ার ফুটের হাসপাতালে দাঁড় করিয়েছে চিন⁴। আক্রান্তদের মোবাইল ডেটা-স্যাম্পল থেকে 'কন্টাক্ট পয়েন্ট' ট্রেস করে রুগীর সংস্পর্শে আসা সকলকে আইসোললেট করার চেষ্টা করেছে চিন⁵। আর তাই, ডিসেম্বরও আক্রান্ত কাউকে চিহ্নিত করে চিকিৎসা শুরু করতে যেখানে ১৫ দিন সময় লাগছিল চিনের, এখন সেটা কমে গড়ে ২দিন। ডিসেম্বরও যেখানে প্রতিদিন ৪৬,০০০ সন্দেহভাজন কেস আসছিল চিনে এখন সেটা কমে ৫-১০। 
কি ভাবছেন 'চিনের দালাল'? 'চিনের প্রেসিডেন্ট আমার প্রেসিডেন্ট'? রেড আর্মির পুরনো পাপী? আরে চাপ নেবেন না! কারণ উপরের এই তথ্য গুলো মাও সে তুং বলেননি কিম্বা লি শাও চি লিখে যাননি। বলছে খোদ WHO-র যে টিম ফেব্রুয়ারি তে চিনে গিয়েছিল সেই টিমের লিডার; পোলিও, এবোলার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের লড়াই'র ক্রুসেডর ডঃ ব্রুস আইলওয়ার্ড। নিউইয়র্ক টাইমসের সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন "চিন সরকার COVID19 আক্রান্তদের টেস্ট এবং চিকিৎসার সমস্ত খরচা বহন করছে। আর এখানেই চিন দৃষ্টান্তমূলক। চিনের অভাবনীয় লড়াইর জন্যই গোটা বিশ্ব নিজেদের প্রস্তুত করতে কমপক্ষে ২সপ্তাহ সময় হাতে পেয়েছে।" 
আর অন্যদিকে প্যান্ডেমিকে ক্যাপিটালিজমের পিতামহ ভীষ্ম, আমেরিকার অবস্থা লেজে গোবরে⁶। ২০১৮তে ট্রাম্প সরকারী স্বাস্থ্য সুরক্ষা সংস্থায় ৮০% বরাদ্দ ছাঁটাই করে, শূন্য পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করে আমেরিকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কে ঠেলে দিয়েছিলেন আরও বেসরকারিকরণের পথে⁷। প্যান্ডেমিকের প্রাদুর্ভাবে তারই মাশুল গুনছেন সাধারণ নাগরিকরা। সাধারণ ডাক্তার ভিজিটের খরচা ১৪৯-১১৫১ ডলারে ঘোরাফেরা করছে⁸। বেসরকারি ক্ষেত্রে করোনা ভাইরাসের টেস্ট করাতে  ৩,২৭০ ডলার খরচা হচ্ছে⁹। কিছু প্রভিন্সে নামমাত্র সরকারি ভর্তুকির ঘোষণা করলেও গোটা আমেরিকায় করোনা ভাইরাসের টেস্ট এবং চিকিৎসা মূলত বেসরকারি এবং ব্যাপক খরচা সাপেক্ষ। গোদের উপর বিষফোঁড়া ৩কোটি আমেরিকানদের কোন মেডিক্যাল ইনস্যুরেন্সই নেই, আরও ৪কোটির ইনস্যুরেন্স থাকলেও ব্যাপক খরচা কভার করতে অপর্যাপ্ত¹⁰। তাই চিনে যেখানে প্রতি ১০লক্ষ মানুষের মধ্যে করোনা ভাইরাসের টেস্ট হচ্ছে গড়ে ২,৮২০জনের, আমেরিকায় সেটা মাত্র ২৩জনের¹¹। আমেরিকায় তীব্রতর হচ্ছে প্যানিক। মুডি অ্যানালেটিক্সের অনুমান প্যান্ডেমিকে ক্যাসকেডিং এফেক্টে কর্মহীন হতে পারেন ৮ কোটি মানুষ¹²।   
বিশেষজ্ঞদের মতে সামনের কয়েক সপ্তাহে অগ্নিপরীক্ষা ভারতের। জানি, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা রাতারাতি বদলাবে না। কিন্তু সরকারের পলিসি মেকিং-র প্রায়োরিটি তো বদলাতে পারে। হাতে গরম উদাহরণ তো রইলোই। একদিকে ক্যাপিটালিস্ট আমেরিকা। যারা স্বাস্থ্য পরিষেবা কে প্রফিটের জন্য বাজারের উপর ছেড়ে, সেনসেক্স আর নিফটি সূচকে বড়লোক শিল্পপতিদের পকেট ভরাতে, শ্রমিকদের পেড সিক লিভের আবেদন বাতিল করে¹³, ভাইরাসের 'কমিউনিটি স্প্রেড' আটকাতে 'কমপ্লিট লকডাউন' না করে সাধারণ মানুষ কে ঠেলে দিচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে। আরেকদিকে রইলো সমাজতান্ত্রিক চিন, যারা সেনসেক্স-নিফটি-প্রফিট কে গুলি মেরে, 'কমিউনিটি স্প্রেড' আটকাতে তৎক্ষণাৎ 'কমপ্লিট লকডাউন' করে, নাগরিক জীবন সচল রাখতে বকেয়া বিল মকুব করে, শ্রমিকদের পেড সিক লিভ মঞ্জুর করে, পুরো রাষ্ট্রশক্তি কে সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচানোর কাজে লাগিয়ে দিতে পারে, চিকিৎসার সম্পূর্ণ খরচা বহন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। হাতে গরম উদাহরণ তো রইলোই। একদিকে ক্যাপিটালিজম, যেখানে প্রফিট আগে, পরে মানুষ। একদিকে সমাজতন্ত্র, যেখানে মানুষ আগে, অন্য সবকিছু পরে। চয়েস ইস ইয়োর্স!













কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন