বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৯

ইসলামিক মৌলবাদ ~ অনির্বাণ অনীক

১৯৫৮ সাল, কায়রোর রাজপথ । মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাসছেন গামাল আবদেল নাসের। মিশরের জননায়ক । হাসছে মঞ্চের সম্মুখের সারিবদ্ধ জনতা । দিচ্ছে হাততালি । জনতার মুখরিত সখ্যের নদীতে ভেসে চলেছেন সুপুরুষ নাসের । ধুয়ে দিচ্ছেন মুসলিম ব্রাদারহুডের খোয়াবনামা । কবছর আগেই কায়রো শহরে তীব্র বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে মুসলিম ব্রাদারহুড । বোমা বিস্ফোরিত করে তোলপাড় করেছে থিয়েটার , হোটেল , নাইট ক্লাব , মিউজিয়াম - আধুনিক সভ্যতার যত বিজয়রথ । না , তখনো মুজাহিদিনদের পেছনে আমেরিকা এসে হাজির হয়নি । বারবাক কারমাল , নাজিবুল্লাহদের পশ্চিমী মদতপ্রাপ্ত ইস্লামিস্টদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের দিন তখনো বহু দূর । জনতার সামনে নাসের দিয়ে চলেছেন মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতার সাথে তাঁর মোলাকাতের জবানবন্দী । বলছেন - ব্রাদারহুডের নেতা তাকে প্রস্তাব দিয়েছেন মিশরের প্রতিটি নারীর হিজাব পরিধান বাধ্যতামূলক করতে । তিনি উত্তর দিয়েছেন - আপনার মেয়েটিকে সেদিন দেখলাম মেডিসিন পড়তে যাচ্ছে । মাথায় হিজাব দিতে তো দেখলাম না । ব্রাদারহুডের নেতা দুঃখ করে বলেছেন তাকে পশ্চিমী ভাবধারা থেকে বাগে আনতে তিনি ব্যর্থ । তাই ভবিষ্যতের নারীদের আধুনিক সভ্যতার প্রভাবমুক্ত করতে তাঁর চাই বাধ্যতামূলক হিজাব । মিশরের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নাসেরের হাতেই বর্তায় সেই গুরুদায়িত্ব । নাসের শুনে হেসেছেন । বলেছেন - আপনি একটি মেয়েকেই হিজাব পরাতে অপারগ , আর আমাকে বলছেন দেশের লক্ষ লক্ষ মেয়েকে হিজাব পরাতে বাধ্য করতে ? হাততালিতে মুখরিত হয়ে উঠলো সভাস্থল । অস্তাচলে যেতে থাকা সূর্যের আলোর ধারায় নীল নদের বুকে তখন গোধূলির স্নিগ্ধ রং ।

আসুন টাইম মেশিনে চড়ে ঘুরে আসি বিংশ শতকের সূচনায় আঙ্কারার রাজপথে । বিজয়রথ ছুটিয়ে চলেছেন কামাল আতাতুরক । বন্ধ করছেন আরবি নাম রাখার চল । মাতৃভাষার নরম আলোর ছটায় আলোকিত করছেন মানুষের মন । আরবির পরিবর্তে বাধ্যতামূলক করছেন মাতৃভাষা শিক্ষা । মোল্লা, মৌলবি , ইসলামিক শিক্ষার পরিবর্তে বাধ্যতামূলক করছেন আধুনিক শিক্ষা । প্রবল প্রতিবাদের মুখেও উদ্ধত মেরুদণ্ডের ঋজুতা । এনলাইটেনমেন্টের আলোয় ধুইয়ে দিচ্ছেন ১৪০০ বছর আগের অন্ধকার ।

দেখে নি ৫'এর দশকের সূচনার ইরান । জনতার জয়ধ্বনিতে মুখরিত শত শত বছরের ইতিহাস বিজড়িত তেহরানের রাজপথ । ভারতের সাথে শত শত বছরের সুখে দুঃখে জড়িয়ে থাকা প্রাচীন পারস্য । রক্তপতাকায় ঢেকে গেছে শহরের প্রতিটি প্রান্তর । জনতার বিপুল সমর্থনে জয়লাভ করেছেন বামপন্থী মোসাদেগ । তখনো অজানা , আমেরিকার চক্রান্তে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম ক্যু-দেতা । কিছুদিন বাদেই অপসারিত হবেন সেদিনের ইরানীয় গণমানুষের অবিসংবাদিত নেতা মোসাদেগ । অধিষ্ঠিত হবেন মার্কিন মদতপুষ্ট কিন্তু সেকুলার শাসক পারস্যের শাহ । আর বছর পঁচিশেক বাদেই সেকুলার সংস্কারে ক্ষুব্ধ হবে ইসলামিক নেতৃত্ব । ধর্মীয় কঠোরতা রূপায়নের তাগিদে অর্থনৈতিক সমস্যার উপর ভর করে উঠে আসবে সবুজ পতাকার ঢল । ইরানের মাটিতে নিশ্চিনহ হবে রক্তপতাকারও শেষ অস্তিত্ব । আমেরিকা বুঝে যাবে চিলি , ভিয়েতনাম বা মেক্সিকোর পথ নয় । পারস্যের শাহের মত ক্যু-দেতা করে বসিয়ে দেয়া সেকুলার বিকল্প নয় , মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশ্বে বামপন্থা হঠানোর সেরা ঢাল ইস্লামিজম ।

গুটি গুটি পায়ে চলে এসেছি ৮'এর দশকের আফগানিস্তান । প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত গান্ধার । স্বপ্ন দেখছেন বারবাক কারমাল - স্বপ্ন দেখছেন নাজিবুল্লাহ - রুক্ষ শুষ্ক মাটিতে ১৪০০ বছর আগের বন্ধ্যাত্ব কাটিয়ে আধুনিকতার আবাদ । আফগান ইস্লামিস্টরা সন্ত্রস্ত । আমেরিকাও সন্ত্রস্ত - না আধুনিকতার আবাদের জন্য নয় । ওরা কমিউনিস্ট । ওরা সোভিয়েতের সহযোগী । কোল্ড ওয়ারের সময় । পাক-আফগান-রুশ-ভারত সীমান্তে সে এক ভয়ানক বিষয় । ততদিনে বুঝে গেছে আমেরিকা । মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশ্বে বামপন্থা হঠানোর সেরা ঢাল ইস্লামিজম । মুজাহিদিন , তালিবান । আমেরিকার প্রিয় পাত্র । নাজিবুল্লাহর দেহটা ল্যাম্পপোস্টে ঝোলার দিনে যারা নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতায় মুক্তিযুদ্ধের অগ্রদূত ।

চলে এল সেই দিন । মডারেট ন্যাশনালিস্ট বা বামপন্থী শক্তিগুলোর হাত থেকে লড়াইটা চলে গেল ক্রমশ ইস্লামিস্ট এক্সট্রিমিস্টদের হাতে । প্যালেস্টাইনের ইয়াসের আরাফতদের হাত থেকে কর্তৃত্ব চলে গেল হামাসের হাতে । আফগান ওয়ারের পর মুজাহিদিনদের অধক্ষেপ ঢুকে পড়ল ভারতের কাশ্মীরেও । মডারেট ন্যাশনালিস্টদের হাত থেকে হুরিয়ত হয়ে ঢুকে পড়ল লস্কর ই তইবারা । বদলে গেল আন্দোলনের চরিত্র ।

এবার আমেরিকা ব্রিটেনদের এই কূটকচালী না থাকলে কি ইসলামী মৌলবাদ থাকত না ? নিশ্চয় থাকত । ইসলামিক মৌলবাদের কার্যকারিতা , মানুষের উপর তার প্রভাব ইত্যাদি আঁচ করেই তো এই শক্তিগুলি এককালে নিজ নিজ অর্থনৈতিক স্বার্থ পূরণের স্বার্থে ইসলামিস্ট দানবের সাথে হাত মিলিয়েছিল । ওয়াহাবী , সালাফী, দেওবন্দী বিবিধ নামের কট্টর গোষ্ঠীগুলির মধ্যেই রয়েছে মৌলবাদের বীজ । ৭১'এর আগের পূর্ব পাকিস্তান , পরবর্তীকালে বাংলাদেশের মাটিতেও হয়েছে ভয়াবহ মৌলবাদের চাষ , সন্ত্রাসের আবাদ । রক্তাক্ত হয়েছে বাঙালী জাতিটাই । এর সূচনায় তো নেই পশ্চিমী মদতের কোন অবদান । ভিয়েতনামে আমেরিকা বৌদ্ধ মৌলবাদ দিয়ে কাজ হাসিল করার চেষ্টা করেনি । কিউবাতে ক্রীস্টান মৌলবাদ দিয়ে কমিউনিজম প্রতিহত করার চেষ্টা করেনি । অথচ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশ্বে সহযোগী তার ইস্লামিজম । কিন্তু , ইসলামিক দানবের অস্তিত্ব থাকলেও এদের দেশগুলির অভ্যন্তরেই গত শতকের মধ্যভাগ থেকে যে সেকুলার/সমাজতান্ত্রিক/ জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলি বৃদ্ধি পাচ্ছিল তারা অন্তত লড়াইটা করতে পারত । বর্তমানে সেই শক্তিগুলি বিধ্বস্ত ।

সম্প্রতি আমেরিকা পুণরায় ইরানের তেলের ভাণ্ডারের দখল নিতে উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছে । 
"ইরান কে ভাতে মারার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের চারপাশে এক দৃশ্যমান ও শক্তিশালী প্রভাব বলয় তৈরি করেছে।কার্যত সামরিক, আর্থিক ও সাংস্কৃতিক অবরোধ তৈরি করেছে । মূল লক্ষ্য ইরানকে আর্থিক ও কূটনৈতিক ভাবে নিঃসঙ্গ করা। ভারত, চীন, জাপান, তুরস্ক, মেক্সিকো, ইতালি, গ্রিস,দক্ষিণ কোরিয়াকে কার্যত হুমকি দিয়ে ইরানের থেকে অপরিশোধিত তেল কেনার জন্য চাপ দিতে শুরু করেছে।ভারতকে যেহেতু জ্বালানির জন্য ইরানের ওপর নির্ভর করতে হয় ,এককথায় ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করা সম্ভব নয়।দ্বন্দটা এখানেই।একদিকে চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ক্রমশ মজবুত হয়েছে।চায়না ,পাক ইকোনোমিক করিডোর ভারতের কাছে তার স্বার্বভৌমত্বের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ।পাশাপাশি সুদীর্ঘ দিন ধরে চাবাহর বন্দরকে দিল্লি নিজেদের ভুসামরিক স্বার্থের জন্য ব্যবহার করার প্রস্তুতি নিয়েছে।ইরানের থেকে জ্বালানী কেনা বন্ধ করার অর্থ মধ্যএশিয়ার ওপর কতৃত্ব ও পাক চীন দ্বিপাক্ষিক অক্ষের পাল্টা জোট হিসেবে ইরান-আফগানিস্তান-ভারতের মৈত্র দুর্বল হওয়া।"

" ইরানে যুদ্ধের দামামা বাজলে আপনি আক্রান্ত হবেন কি করে?উপসাগরীয় অঞ্চলে নতুন সংঘাতের অর্থ সেই যুদ্ধে সৌদি , সংযুক্ত আমিরশাহীর মতো দেশগুলোর যুদ্ধে আর্থিক ভাবে জড়িয়ে পড়া।সেদেশের তেলের উৎপাদনের মূল্য বাড়লে আপনার আমার রান্না ঘরে তার প্রভাব পড়বেই।পড়তে বাধ্য। শুধু তাই নয়, মনে রাখবেন আফগান ওয়ারের পর মুজাহিদিনদের অধক্ষেপ ঢুকে পড়েছিল ভারতের কাশ্মীরেও । বদলে দিয়েছিল আন্দোলনের চরিত্র । বাড়িয়েছিল আপনার দেশেরই প্রতিরক্ষা বাজেট । সাম্রাজ্যবাদ , নয়া ঔপনিবেশিক শক্তি শুধু রান্নাঘরে হানা দেয় না,কৌশলে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়ায়।তার কোপ পরে স্বাস্থ্য,প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা হয়ে জনমুখী প্রকল্পে।"

বামপন্থী মোসাদেগকে অন্যায় ভাবে অপসারিত করে আমেরিকা যে বদমাইশির সূচনা করেছিল সেই মুকুটে যুক্ত হতে চলেছে আরেকটি নতুন পালক ।

পুনশ্চ - আপনি কমিউনিজমের সমালোচনা করতেই পারেন । কমিউনিস্ট দেশে গণতন্ত্রের অভাব নিয়ে আলোচনাও করতে পারেন (মানে অন্য দেশেও গণতন্ত্রের বহু সমস্যা দেখা যায় , কিন্তু অন্য দেশে আছে বলে কমিউনিস্ট দেশে গণতন্ত্রের অভাব থাকবে সেটাও কোন কাজের কথা না ) । আলোচনা করতেই পারেন আরব ন্যাশনালিস্ট বা কমিউনিস্ট শক্তিগুলির বিশ্ব বাজার থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকাটা ইন দ্য লঙ রান আদৌ কোন ফলপ্রসূ বিষয় ছিল কিনা । আপনি সাম্প্রতিক কালের এক শ্রেণীর বিপ্লবী বাম লিবেরাল শক্তির ইসলাম-প্রেম নিকষিত-হেম'এর সমালোচনাও করতেই পারেন । কিন্তু সেই কারণে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির ইস্লামিস্ট দানবের সাথে হাত মিলিয়ে পথযাত্রাটি তো অস্বীকার করতে পারবেন না । ইস্লামিজমকে অস্বীকার করা যেমন অপরাধ , তেমনি এই সত্য স্বীকার না করাটাও সত্যের অপলাপ । মুক্তচিন্তার সাথেই বৈরিতা ।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন